সৎ মা পর্ব-০১

0
611

#সৎ_মা (০১)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

‘ ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখি আমার একমাত্র আদরের ছোট বোন টি মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে বোনের কাছে বসে মাকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু মা আমার কথায় কোনো সাড়া দিচ্ছে না। দৌড়ে গেলাম মায়ের রুমে। রুমে ঢুকতেই আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কারণ, মা একটা অপরিচিত লোকের সাথে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি মাকে এই অবস্থায় দেখে পেছনে ফিরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই মা আমায় ডাক দিল। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মা বলল,”তোর না এখন দোকানে থাকার কথা ছিল কিন্তু তুই এখানে কেন ?”
আমি বললাম,”বাবা আমাকে পাঠিয়েছিল তোমার কাছ থেকে পনেরো হাজার টাকা নিতে।
– টাকা দিয়ে কি করবে ?
– মাল কিনতে যাবে কিন্তু পনেরো হাজার টাকা কম আছে তাই বলেছে বাড়ি এসে নিয়ে যেতে।
– ঠিক আছে ড্রয়ের থেকে নিয়ে নে।
– ঠিক আছে।
– আর শোন..
– বলো।
– আমাকে যে এই অবস্থায় দেখেছিস তা কিন্তু তোর বাবাকে বলবি না।
– ঠিক আছে বলবো না।
– মনে থাকে যেন।

আমি মনে থাকবে বলে, ড্রয়ের থেকে পনেরো হাজারের জায়গায় ষোল হাজার টাকা নিয়েছি কারণ, বোন কে ত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। টাকা নিয়েই মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম‌। দৌড়ে বোনের কাছে এসে বোনকে কাঁধে তুলে নিলাম। বোন ব্যাথায় ছটফট করছে। আমি পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হাঁটছি আর বলছি,”কিছু হবে না বোন আমার। এই ত ডাক্তারের কাছে চলে এসেছি। এখন ই ভালো হয়ে যাবি তুই।”

আমার কথা মনে হচ্ছে বোনের কানে পৌঁছাচ্ছেই না। সে শুধু ছটফট করছে আর গোঙাচ্ছে। আমার পা জোড়া যেন আর চলতে চাচ্ছে না। তবুও হাসপাতাল বাড়ি থেকে দূরে না তাই কোনোরকম হেঁটে চলছি‌। পথে দু-তিন জনকে বলেছিলাম,” আমার বোন টা অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, আমি আর পারছি না। ওকে একটু হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাবেন ?” কিন্তু কেউ ই আমার কথায় পাত্তা দিল না। আমার বোন টাকে কেউ ই হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এলো না। আট বছর বয়সী বোন আমার, আমার বয়স পনেরো। আমি তাকে কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আজকে যদি মা বেঁচে থাকতো, তাহলে আমাকে আর এই দিন দেখতে হতো না। আর আমার বোনের ও এই অবস্থা হতো না। আমি খুব জোড় দিয়ে বলতে পারবো, আমার এই সৎ মা ই আমার বোনকে মেরে এই অবস্থা করেছে।

কোনোরকমে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। একজন ডাক্তারকে দেখে ওনার কাছে নিয়ে গেলাম। আমি যেহেতু ছোট বাচ্চা তাই ডাক্তার নিজেই আমার কাঁধ থেকে বোন কে কোলে করে নিয়ে গেলেন। আমকে বললেন, এখানেই বসতে। আমি বসে রইলাম। একটু পর একটা মহিলা নার্স এসে আমার পাশে বসলেন। আমি ওঠে গেলাম তখন তিনি বললেন,”কোথায় যাও ? বসো এখানে কথা আছে।”
আমি বসে বললাম,”জ্বি বলেন কি বলবেন ?”
– তোমার নাম কি ?
– সিফাত।
– বয়স কত তোমার ?
– চৌদ্দ পার হয়ে পনেরো চলে।
– যাকে নিয়ে এসেছো সে কি হয় তোমার ?
– বোন হয়।
– কিসে পড়ে ?
– লেখাপড়া করে না।
– কেন ?

আমি কিছু বললাম না। কারণ আমি চাই না, পারিবারিক কথা বাহিরের কেউ জানে। তিনি আবার বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে না বললে নাই। এখন বলো তোমার আব্বু কোথায় ?”
আমি বললাম,”দোকানে।”
– তোমার মা কোথায় ?
– মারা গেছে।
– তোমার বাবা কি জানে তোমার বোনের এই অবস্থা হয়েছে ?
– না।
– জানাওনি কেন ?
– এমনি।
– ঠিক আছে এখন গিয়ে তোমার বাবাকে আসতে বলো।
– না না।
– কেন ?
– বাবা শুনলে খারাপ কিছু একটা হয়ে যাবে।
– তুমি জানো কি তোমার বোনের চিকিৎসা করতে টাকা লাগবে ?
– হ্যাঁ জানি।
– তোমার বাবাকে না বললে এই টাকা দিবে কে ?
– আমি ইং দিবো টাকা।‌
– তুমি টাকা কোথায় পাবে ?
– ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু আমার বোনকে সুস্থ করে তুলেন।

বলেই বসা থেকে উঠে একটু দূরে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে একটা কাগজ দিয়ে বললেন নিচে দোকানে গিয়ে ডঃ হাসানের কথা বলে ঔষধ গুলো নিয়ে আসতে। আমি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসে ডাক্তারকে দিয়ে দিলাম। ওনি আবার বললেন গিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে আসতে। আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা খুঁজে নিয়ে এলাম। ডাক্তার আমার বোনকে কাঁধে করে নিয়ে এসে রিক্সায় বসে আমাকে উঠতে বললেন। আমি উঠলে একজন নার্স আমার হাতে কিছু ঔষধ দিয়ে দেন। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম,”কোথায় যাবেন আমাদের নিয়ে ?”
ডাক্তার বললেন,”তোমার বাবার কাছে।”
– কেন ?
– দরকার আছে। তুমি শুধু বলো তোমার বাবা কোথায় আছেন ?
– দোকানে।
– দোকানের ঠিকানা বলো।
– ** এই যায়গায়।

তিনি রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” এই চাচা ওর দেওয়া ঠিকানায় চলো।”
রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে সাহেব।”

রিক্সা কিছুক্ষণ পর আমাদের দোকানের সামনে এসে থামে। আমি আমাদের দোকান দেখিয়ে বললাম,”এই যে আমাদের দোকান।”
ডাক্তার সাহেব রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”এই দাদা থামেন এখানে।”

রিক্সাওয়ালা আচ্ছা বলে তার রিক্সা থামালেন। ডাক্তার সাহেব আমাকে নামতে বললেন। আমি নামলে আমার বোনকে আমার কাঁধে দিয়ে তিনি রিক্সা থেকে নেমে রিক্সা ভাড়া দিয়ে আবার বোনকে আমার কাঁধ থেকে ওনার কাঁধে নিয়ে দোকানে চলে আসেন। বাবা আমাদের দেখে দোকান থেকে বের হয়ে বললেন,”আমার মেয়ের এই অবস্থা কেন ?”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাক্তার নিজেই বললেন,”এই টুকু ছোট একটা বাচ্চাকে কেউ এভাবে মারে নাকি ?”
বাবা অবাক হয়ে বললেন,”কি বলছেন দাদা ? আমি ত ওর গায়ে ফুলের টোকা ও দিই না। আর ওর মা ও ত কিছু বলে না মারবে দূরে থাক।”
– ওদের না মা নেই।
– গর্ভধারিনী মা নেই কিন্তু সৎ মা আছে যে ওদের নিজের সন্তানের মত ই দেখেন।
– নিজের সন্তানের মত দেখলে দেখেন ত মেরে কি অবস্থা করেছে ?

ডাক্তার সাহেব ওনার কাঁধ থেকে বোনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বোন আমার ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না। আমি তাকে ধরে দাঁড় করালাম। বাবা বোনকে ভালো ভাবে দেখে বললেন,”কিরে সিফাত শিফার এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে ?”
আমি বললাম,”বাবা আমি জানি না।”
বাবা আমার দিকে হাত উঁচিয়ে বললেন,”জানিস না মানে ? সত্যি করে বল ওর এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে ?”
আমি ভয় পেয়ে কেঁদে দিব অবস্থা প্রায়। বাবা চোখ বড় বড় চোখে তাকালেন আমার দিকে। এবার আমার আরও ভয় করতে লাগলো‌। তবুও ছলছল নয়নে বললাম,”আমি জানি না।”
বাবা বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বোনকে জিজ্ঞেস করলেন,”মারে তোর এই অবস্থা কে করেছে ? এভাবে কে মেরেছে তোকে ?”
বোন কিছু বলছে না শুধু কান্না করছে। বাবা বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”ভয় পাস না মা। আমি তোর সাথে আছি। তুই বল তোকে এভাবে কে মেরেছে ? তোর ভাই মেরেছে ?”
বোন কান্নার কন্ঠে বলল,” না।”
বাবা আবার ও জিজ্ঞেস করলেন,” তাহলে কে মেরেছে ?”
বোন “মা” বলেই ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। বাবা আমাকে বললো,”সিফাত দোকান বন্ধ করে বাড়ি আয় এখনি।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে বাবা।”

বাবা বোনকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমি তারাতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে দৌড় দিলাম।

চলবে।