শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০৬

0
622

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

ক্লাসের মাঝে আইরিন সুলতানা ম্যাম এসে বললেন,
-“স্যার আপনার অনুমতি পেলে আলো কে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যেতাম?

ফয়জান অনুমতি দিয়ে বললো,
-“জ্বি ম্যাম অবশ্যই কেন নয়?
আলো যাও ম্যাম যেতে বলছেন।

আলো তখন আইরিন সুলতানা ম্যামের সাথে ক্যান্টিনে যায়। গতকাল পিরিয়ড এর ব্যাথার কারণে কলেজে আসতে পারেনি আলো। এরকম প্রতি মাসের একটি দিন আলো কলেজে আসতে পারে না।
আজকেও কিছুটা ব্যাথা রয়েছে তাই আইরিন সুলতানা আলোকে কিছু খাইয়ে মেডিসিন দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন।

ক্লাসের রুলস অনুযায়ী যারা হোম ওয়ার্ক করেনি তারা দাঁড়িয়ে আছে।কেউ কেউ অজুহাত দেখিয়ে বললো,
-“অসুস্থ ছিল বলে গতকাল কলেজে উপস্থিত হতে পারেনি তাই হোম ওয়ার্ক করতে পারেনি।

তখন ফয়জান বললো,
-“তোমাদের মতো আলো ইসলাম ও গতকাল কলেজে আসেনি। তাহলে ও কি করে হোম ওয়ার্ক করে নিয়ে আসলো? আমি রুলসে বলে দিয়েছিলাম যে এসব অজুহাত গ্রহণ করা হবে না।তোমরা কলেজে উপস্থিত হতে না পারলে এক জন আরেক জনের সাথে যোগাযোগ করে পড়া কমপ্লিট করে আসবে।

ফয়জান এর কথায় সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফয়জান এসব তোয়াক্কা না করে বোর্ডে অঙ্ক করা শুরু করে। একটা অঙ্ক করা হলে আলো এসে বললো,
-“স্যার আসতে পারি?

ফয়জান বোর্ড থেকে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আসো।

আলো তার বেঞ্চে বসলে ফয়জান বললো,
-“আলো এই অঙ্ক টা নিয়ে তোমার কোন প্রশ্ন আছে?

আলো অঙ্কটা দেখে বললো,
-“জ্বি না স্যার।
-“ভেরি গুড।
.
.
তায়েসের বাইকে চড়ে বসে রামিসা।বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। তায়েস গাড়ি চালানোতে পূর্ণ মনোযোগ রেখে বলল,
-“মানুষজন যেভাবে বসেছে বাই এনি চান্স পরে টরে গেলে আমার কোন দোষ নেই!
-“দোষ নেই? কিছু হোক তখন বুঝবেন মজা আমার দুই বাবা আপনাকে পুলিশে দেবে!

রামিসার এমন অবুঝ কথায় আড়ালে হাসে তায়েস। পুলিশকে কিনা বলছে পুলিশে দেবে হাহাহা।

অতঃপর,
কলেজের থেকে দু মিনিটের রাস্তা আগে তায়েস বাইক থামিয়ে রামিসা কে বলল নামো। রামিসা ভালো মেয়ের মত বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো ওমনি তায়েস বাইক স্পিডে চালু করে হাওয়া হয়ে গেল! ব্যাপারটা বুঝতে রামিসার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। চেচিয়ে বলল রাজা’কার কোথাকার তোকে আমি একবার হাতে পাই তখন বুঝাবো মজা। কত্ত বড় বদের হাড্ডি হলে আমাকে এখানে নামিয়ে দেয় আমি যদি বড় বাবাকে বলে তোকে বকা না খাইয়েছি তাহলে আমার নাম রামিসা তুজ জোহরা চৌধুরী নয়। তারপর কলেজ যায় রামিসা।
.
.
রামিসার সাথে ঐ ঘটনার পর থেকে ছেলে দুইটাকে শফিক মাহমুদ এর বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।রামিসা বাসায় সবাই কে বিষয়টা জানালে তায়েস ছেলে দুইটা কে শাসিয়ে বলে এই বাসার আশেপাশে দ্বিতীয়বার যেন তাদের দেখা না যায়। ছেলে দুটো সেদিন ভয় পেয়ে বলে এই এলাকায় আর আসবেনা। বাসার সবাই তখন ভেবেছিল এই ঝামেলা এখানেই হয়তো সমাপ্ত। কিন্তু কে জানতো এদের এভাবে নির্মমভাবে হ’ত্যা করা হবে?

বাসার সবাই যখন নিউজে খবরটা দেখল তখন সবাই থমথমে মুখ করে বসে থাকলেও রামিসা মনে মনে ভীষণ আনন্দ পায় তবে বাহিরে তা প্রকাশ করে না। তারপর নিজের রুমে গিয়ে রিতা কে কল করেন জিজ্ঞাসা করে এমন দারুণ খবর নিতে জানে কিনা?
এমন মুমূর্ষ খবর শুনে রিতা ধপাস করে বসে পড়ে ফ্লুরে। বারান্দার গ্রিল গলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মানুষের জীবনে কখন কি দুর্ঘটনা ঘটে যায় কেউ পূর্বে ঘুনাক্ষরেও টের পায় না।

অনেক ভীতু এবং কোমল প্রকৃতির মেয়ে রিতা তাই ছেলে গুলো ওদের উত্তপ্ত করার পরেও মায়া হয় এমন নির্মল ঘটনা শুনে।
.
.
আজকে দুদিন হলো কয়েসের সাথে ফাইজার আংটি বদল হয়েছে। আগামী মাসের শুরুতে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে।এর মধ্যেই ফাইজা দের এপার্টমেন্ট কমপ্লিট হয়ে যাবে। আজকে সবার থেকে বলে কায়েস ফাইজা কে নিয়ে ট্যুরে বেড়িয়েছে।
ঢাকার কাছে বেরাইদ বালু নদীর ঘাট,ইছাপুরা।যেটা ঢাকার অতি কাছে একদিনের ট্যুর করার জন্য বালুনদী একটি আদর্শ জায়গা। নদীর দুই পাশে রয়েছে সবুজের সমারোহ, দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।নদীর ঘাটের আশেপাশে ছোট ছোট অনেক রেস্টুরেন্ট আছে । যা খাবারের চাহিদা পূরণ করে।

প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক আসে একটু সবুজ শ্যামল পরিবেশ ও নদী এলাকার বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের জন্য। নদীর ওপারে মানুষ গুলো অনেক ভালো, লোকজন কে অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করে হাসিমুখে। নদীর এপারে বেরাইদ আর ওপারে রূপগঞ্জ- নারায়ণগঞ্জ। মরুভূমির স্বাদ নিতে অনেক বড় বালুর মাঠ আছে যেখানে । নদীর ওপারে রাস্তা এত পরিষ্কার যা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ।

নদীর কাছে এসে ফাইজা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। সেই ছোট বেলা নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যায় বাবা মায়ের সাথে।এর পর থেকে প্রকৃতির সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আজকে এতো বছর পর এমন নির্মল প্রকৃতিতে নিজেকে উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করছে।ইশ যদি সময়টা এখানেই থেমে যেত!

কায়েস দোকান থেকে কিছু বাজা পুরি নিয়ে নৌকা ভাড়া নিল।
ফাইজা নৌকায় বসে নদীর পানি স্পর্শ করছে। পাশে কায়েস বসে আছে। খাবারের প্যাকেট টা খুলে ফাইজার সামনে ধরে বললো না খাও।
ফাইজা বললো উহু খাব না আমি । আপনি ই খান।
কায়েস বারন শুনলো না বললো, তুমি আগে শুরু করো দ্যান আমি খাব। অঘর্তা না চাইতেও ফাইজাকে খেতে হলো না হয় কায়েস খাবে না।

কায়েস ভাবলো,আর কিছু দিন তারপর আমি নিজ হাতে তোমায় খাইয়ে দিব টুনিপাখি।
অপর প্রান্তে ফাইজা ভাবছে, শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আগমন!এটা কাটানোর নয়।শুভ্রতার আগমন আর কখনোই ঘটবে না। সেখানে মেঘ গুলো স্থায়ী হয়ে গেছে।

বশিলা নামের একটা চড়ে এসে মাঝি নৌকা থামালেন। কায়েস বললো,চলো এখানে নামবো।
ফাইজা বললো, এখানে কেন নামবো?
কায়েস বললো,নেমেই দেখ।
তারপর নৌকা থেকে অতি সন্তর্পণে নেমে সামনে এগিয়ে যায় ফাইজা।
এখানে চড়ের মধ্য ভাগ বালু তার দুই পাশে সবুজ ঘাসের সমারোহ।ফাইজা হাঁটতে হাঁটতে অনেক টা চলে গেল। ইচ্ছে করছে বাচ্চাদের মত দৌড়ে ছুটে বেড়াতে। আবার পরক্ষনেই সেই ইচ্ছা দমন করে নেয়। মনে হয় এইসব তার জন্য নয়।যাদের জীবন প্রকৃতির মতো নির্মল তাদের জন্য।

কায়েস এর ফোনে কল আসায় তার পা থেমে যায়।কলে কথা শেষ করে দেখলো ফাইজা অনেক টা সামনে চলে গেছে।সে দ্রত পা চালিয়ে ফাইজার কাছে যায়।ফাইজা ঘাসের উপর হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
-“একটা জিনিস চাইবো দিবেন?

কায়েস এর ঠোঁটের কোণে খুশির ঝিলিক উপচে পড়ে যেন।দ্রুত বলে একবার শুধু চেয়ে দেখ টুনিপাখি?

“টুনিপাখি” নামটা বহু বছর পর শুনে ফাইজার ভিতর টা দুমরে মুচড়ে উঠলো। নেত্রজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ঝাঁপসা হয়ে এলো মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগতে শুরু করলো।
কায়েস এর আড়ালে চোখে পানি মুছে বড় বড় কয়েকটি শ্বাস নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হলো।

কায়েস অধির আগ্রহে অপেক্ষায় আছে কখন ফাইজা তার কাছে কিছু চাইবে।ফাইজা কে তারা দিয়ে বললো, কি হলো বলো?

ফাইজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আগে প্রমিসড করতে হবে আমি যেটা চাইবো সেটা আপনি দিবেন আমাকে!

কায়েস এর মস্তিষ্ক কিছুটা নড়েচড়ে উঠল।বললো, আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দিব ইনশা আল্লাহ। এবার বলো কি চাই তোমার?
ফাইজা কায়েসের দিকে তাকিয়ে বললো, এখন নয়। সময় হলে চেয়ে নিব। তখন কিন্তু না শুনবো না।
.
.
(বর্তমান)

নিজেদের এপার্টমেন্ট কমপ্লিট হয়ে গেলে কিভাবে ফার্নিচার দিয়ে সাজাবে তা নিয়ে আলোচনায় বসেছে ফাহমিদা খাতুন। সেখানে আয়েশা সহ পরামর্শ দিচ্ছেন।

ফয়জান তখন দরজার কলিং বেল বিরতিহীন ভাবে বাজিয়ে চলেছে।রিনু দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল।আর বললো,
-“আফনেরা ভাই বোন মিল্লা শুরু করছেন কিডা?সুচ টা কি ডাবায় দিবেন নাকি?

ফয়জান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“সুচ কি?

রামিসা এসে বললো আরে ভাইয়া রিনু আপা কলিং বেলের সুইচ কে সুচ বলছে।
ফয়জান অহ আচ্ছা বলে ভিতরে চলে গেল। শফিক মাহমুদ আর রুহুল আমিন বসে টিভিতে সংবাদ দেখছেন। ফয়জান গিয়ে বললো,
-“বাবা আর বড় বাবা তোমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও! আমার সাথে যেতে হবে।

দু’জনেই চমকালো! রুহুল আমিন বললেন,
-“এই সময় আমরা কোথায় যাবো?
-“গেলেই দেখতে পাবে।

তারপর ফয়জান পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে এলো। বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে, কালো প্যান্টের,ক্রিম রঙের সাথে কালো মিশেল সার্ট। সুন্দর করে ইন করা।ফর্সা গায়ের রঙের সাথে রঙ গুলো বেশ চমৎকার লাগছে।

দুই ভাই তৈরি হয়ে এসে ফয়জান কে লক্ষ্য করে।একে অপরের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। ফয়জান এসব তোয়াক্কা না করে তাদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
.
.
অতঃপর রাত দশটার দিকে রিনু দরজা খুলে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। শফিক মাহমুদ বললেন,
-“কি ভিতরে ঢুকতে দিবি না নাকি?

রিনু বললো,
-“হে তো দিমুই কিন্তু এ বোরকা পরা বেডি কেডা?

শফিক মাহমুদ সহসাই উত্তর দেয়,
-“আমাদের ফয়জান এর ব‌উ!

এ কথা শুনে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে রিনু! চেঁচিয়ে পুরো বাসা মাথায় করে বললো,
-“খালাম্মা দেইক্কা যান ভাই আমাগো বাদেই ব‌উ ল‌ইয়া আইয়া পরছে!….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।