শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০৭

0
413

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

রিনু’র গলা ফাটা চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসে। সবার স্তব্ধ নয়ন আটকে আছে দরজার দিকে। রুহুল আমিন বললেন,
-“ব‌উ মা কে নিয়ে ভিতরে চল?আর কতোক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকবে মেয়েটা?
-“জ্বি বাবা।

তারপর ফয়জান তার সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী কে নিয়ে ভিতরে ঢুকে।রামিসা অভিমানী কন্ঠে বললো,
-“ভাইয়া তুমি বিয়ে করেছো? আমাদের একটু জানালে কি হতো? আমাদের কত্ত প্লান ছিল তোমার বিয়ে নিয়ে আর তুমি..

ফাইজা ও বোনকে সাপোর্ট করে বললো,
-“ভাইয়া তুমি এমনটা করতে পারলে?

বোরকা পরিহিত মেয়েটা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো ছেলে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের অনেক স্বপ্ন থাকে কিন্তু তিনি এমনটা কেন করলেন? লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা।

ফাহমিদা খাতুন পা দুটো পিছিয়ে দপ করে বসে পড়লো সোফায়। তিনি যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
আয়েশা আগ বাড়িয়ে কিছু বলছেন না।যদি তার জা রাগ করে এই ভেবে।

শফিক সাহেব বললেন,
-“তোমাদের না জানিয়ে আমরা এতো বড় কাজটা করে ফেলেছি সে জন্য দুঃখিত। এখন এভাবে সবাই ঘুমড়া মুখ করে বসে থাকলে মেয়েটার খারাপ লাগবে।
ফাইজা,রামিসা তোদের ভাবী কে তোদের রুমে নিয়ে যা।
-“জ্বি বড় বাবা।

ফাইজা মেয়েটাকে নিয়ে যায়। পিছন পিছন রামিসা যায়।রিনু টলি ব্যাগটা নিয়ে তাদের পিছু পিছু যায়।

ফয়জান মায়ের পাশে বসে অতি নরম গলায় বললো,
-“সরি মা।এ ছাড়া উপায় ছিল না।মাফ করে দাও প্লিজ?
ফাহমিদা খাতুন এবার আর্তনাদে ফেটে বিলাপ শুরু করলেন। এই দিন দেখবার জন্য তোকে পেটে নিয়েছিলাম ফয়জান? তোর বাপেরে নিয়া বিয়ে করে নিয়া আইলি অথচ মায়েরে জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলি না? একবার তো ক‌ইতে পারতি মেয়েটা কে তুই পছন্দ করিস, বিয়ে করতে চাস। আমি কি তোকে বাঁধা দিতাম?

সাথে আয়েশা মৃদু রাগ করে বললেন,
-“বুঝলে ফামিদা ছেলের কাছে তার দুই বাবাই সব। আমাদের দুই মায়ের কোন মূল্য নেই।

ফয়জান উঠে আয়েশার কাছে গিয়ে বললো,
-“সরি বড় মা।প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও?

শফিক মাহমুদ বললেন,
-” বুঝলি ভাই মানুষজন আমাদের কে নিয়ে হিংসাত্মক কথা বলছে। আসলে আমাদের মতো কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারেনি তো তাই ঘা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।

রুহুল আমিন ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বললেন,
-“ভাইজান হক কথা বলেছেন।যাই হোক খাবার গুলো কিন্তু বেশ সুস্বাদু ছিল। এবার একটা সুন্দর ঘুম দিলেই হবে।

দুই ভাইয়ের কথা শুনে মুখ বাকায় আয়েশা এদিকে ফাহমিদার অবস্থা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো।
.
.
আইরিন সুলতানা ম্যামের মৃত্যুর পর থেকে আলো ইসলাম কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। ফয়জান জানতে পারে আইরিন সুলতানার মেয়ে আলো ইসলাম।আর তাই মায়ের মৃ’ত্যুতে মুষড়ে পড়ে আলো। দুনিয়ায় অন্ধকারে ছেয়ে যায় তার জীবন। তাকে সার্থহীন ভালোবাসাতো এক মাত্র আইরিন সুলতানা।আলো’র প্রতিটি পদক্ষেপে অনুপ্রেরণা ছিলেন আইরিন সুলতানা ম্যাম।

ফয়জান প্রতিদিন এই আশায় ক্লাস রুমে যেত যে আজকে নিশ্চয়ই আলো এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই নিরাশার মেঘ জমেছে। ফয়জান আগের মত উৎসাহ পায় না ক্লাসে। আগের মত কঠোরতা অবলম্বন করতেও ইচ্ছে করে না।

আসলে প্রতিটি ক্লাসে দুই একজন হলেও মেধাবী শিক্ষার্থী থাকে।আর তাদের কারণেই শিক্ষকরা ক্লাস করতে আনন্দ পায়।এর মাঝে হুট করে মেধাবী শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি প্রতিটি শিক্ষকের নজর এড়ায় না।

এরকম তিন সপ্তাহ পার হলো।
একদিন ক্লাসের রুলস অনুযায়ী যারা হোম ওয়ার্ক করেনি তারা দাঁড়িয়ে আছে। ফয়জান তার নিয়মমাফিক ক্লাস শুরু করলো।
ব‌ই থেকে মাথা তুলে হঠাৎ বোরকা পরিহিত মেয়েটা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ফয়জান বিষ্ময় ভরা চাহনিতে তাকিয়ে র‌ইলো ঠিক কতক্ষন বলা মুশকিল।

ধ্যান ভাঙল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কেরানির ডাকে। কেরানি ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে বললেন,
-“স্যার একটা নোটিশ জানানোর ছিল শিক্ষার্থীদের।

ফয়জান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-“কি নোটিশ বলুন?

কেরানি ভিতরে এসে প্রিন্সিপালের দেওয়া নোটিশ পড়ে শোনালো।

তারপর কেরানি ফাইল এগিয়ে দিলে ফয়জান সাইন করে দিলে কেরারি চলে গেল।
কেরানি থেতে ফয়জান আলো’র দিকে পুনরায় তাকিয়ে দেখলো আলো নেত্রজোড়ায় পানি টলটল করছে!
ফয়জান এর ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। মনে মনে খুজার চেষ্টা চালালো,আলো কাঁদছে কেন?

তার আগে প্রশ্ন জাগলো,
আলো দাঁড়িয়ে আছে কেন?
সবার দিকে দৃষ্টি রেখে উত্তর পেয়ে গেল।আলো হোক ওয়ার্ক করেনি বলে দাড়িয়ে আছে।তার মানে এই জন্যই কাঁদছে।

যে সব সময় সবার আগে পড়া কমপ্লিট করে। আজকে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই দাঁড়িয়ে থাকাতে তো সে অভ্যস্ত নয়, সে কারণেই লজ্জায় কষ্টে কাঁদছে।

ফয়জান নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
-“আলো সিটে বসো!

কথাটা যেন বুঝতে পারলো না আলো, সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ফয়জান এর দিকে। ফয়জান পুনরায় চোখে ইশারা করে বললো,
-“বসতে বলেছি।

আলো দ্বিরুক্তি না করে বসলো।

অতঃপর ক্লাসে মনোযোগ দিল ফয়জান।
.
.
ক্লাস শেষ হ‌ওয়ার ঘন্টা পড়লে ফয়জান ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। বারান্দা দিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতে কি মনে করে যেন আবার ক্লাসরুমের সামনে আসে। আলো হাই বেঞ্চের উপর মাথা রেখে বসে আছে।
ফয়জান বললো,
-“আলো ইসলাম বিরতি সময় অফিস রুমে দেখা করবে আমার সাথে।

আলো মাথা তুলে তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই ফয়জান চলে যায়।
.
.
বিরতি সময় ইসমত আরা মনে করিয়ে দেয় আলোকে স্যার এর সাথে দেখা করতে।আলো দূর্বল পায়ে হেঁটে যায় অফিস রুমের দিকে পথিমধ্যে সমির স্যার এর সাথে দেখা হয়। সমির স্যার মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-“সুখে থাকতে ভুতে কিলায় মানুষকে”! এখনো সময় আছে ফিরে যাও! আমার প্রস্তাব মেনে নাও!

আলো পাশ কাটিয়ে চলে যায় অফিস রুমে। সমির স্যার রাগে ফুঁসছে ফুঁসতে দেয়ালে সজোরে ঘু’সি মা’রে।
.
সমির স্যার ও একজন ইয়ং ম্যান। দেখতে শুনতে সুদর্শন যুবক। তার পুরো নাম সমির চন্দ্র সূত্রধর।আলো’কে ভিশন পছন্দ করেন প্রথম থেকেই!আলো’কে প্রপোজ করলে আলো তা প্রত্যাক্ষাণ করে।
.
.
ফয়জান এর মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে আলো।প্রায় পনেরো মিনিট যাবত আলোকে বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝাচ্ছে ফয়জান।আলো মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে কোন টু-শব্দ করছে না দেখে ক্লাসে যেতে বলে ফয়জান।

আলো চলে যাওয়ার পর ফয়জান হাতে থুতনি ভর দিয়ে ভাবছে এভাবে চলতে থাকলে মেয়েটার খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। পড়াশোনায় যে কোন মন নেই বুঝা যাচ্ছে। ঠিক করলো আলো’র বাবার সাথে কথা বলবে সে।

অতঃপর একদিন সময় করে আলো’দের বাসায় গেল। সেখানে গিয়ে একটা সত্য শুনে কিছুটা ধাক্কা খেল ফয়জান।
জানতে পারলো আলো ইসলাম আইরিন সুলতানার নিজের মেয়ে নয়!আর তাই আইরিন সুলতানার মৃ’ত্যুর পর থেকে তার ছেলে ছেলের বউ এবং মেয়েরা আলো উপর একপ্রকার অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে। আইরিন সুলতানার স্বামী চুপিসারে কেঁদে এই কথা জানান ফয়জান কে।
আলো’র কষ্ট গুলো কিঞ্চিৎ হলেও উপলব্ধি করে ফয়জান আর তাই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয় আলো’কে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিবে সে।এর জন্য একমাত্র উপায় বিয়ে! সেদিন ই মরহুমা আইরিন সুলতানা ম্যামের স্বামীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখে ফয়জান।

কলেজের টিচার হিসেবে পরিচিত ফয়জান।তাই মিনিট খানিক ভেবে বিয়েতে মত দেন রহমান সাহেব।

এরপর বাসায় ফিরে শফিক মাহমুদ আর রুহুল আমিন কে সাথে নিয়ে বিয়ে করতে যায় ফয়জান।
আলো প্রথমে দ্বিধা বোধ করে, রহমান সাহেব কে অনুরোধ করে বলে,এই বিয়ে করতে চায় না সে। টিচার কে বিয়ে করবে ভাবতেই শরীর শিহরিত হয়।
তারপর ইসতিখারা নামায পড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সালাতুল ইসতিখারা-
ইস্তিখারার অর্থ কারো কাছে সঠিক বিষয় বেছে দেওয়ার প্রার্থনা করা। যে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা একাধিক বিষয়ের মধ্য থেকে একটি বেছে নেয়ার অবকাশ আছে সেখানে আল্লাহর সাথে পরামর্শ না করে কোনো কিছু বেছে নেয়া বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুমিনের উচিত নয়। ছোট, বড়, গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আল্লাহর সাথে পরামর্শ করা, অর্থাৎ তাঁর মহান দরবারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাওফীক চাওয়া মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব।

অতঃপর তাদের বিয়েটা সুষ্ঠু মতো সম্পূর্ণ হয় আলহামদুলিল্লাহ।
.
.
তায়েস কক্সবাজার এর উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। কারণ রাকিব হাওলাদার এর পিচ্চি ছেলে আলিফ এর থেকে এমন কিছু তথ্য পেয়েছে যার থেকে তায়েস এর ধারণা কক্সবাজারেই রহস্য লুকিয়ে আছে!…

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।