শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা পর্ব-১১+১২

0
288

#শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা
#পর্বঃ১১+১২
#ফারজানা_আক্তার

অন্তরীক্ষে হাজার তারার মেলা। থালার মতো গোল হয়ে চাঁদ বসে আছে আকাশের বুকে। ছোট ছোট মেঘেরা ভেসে চলেছে গগন জুড়ে। এমন মুহুর্ত সত্যিই মনোমুগ্ধকর। একা একা এসব মুহুর্ত উপভোগ করা যায়না, কেউ একজন লাগে মুহুর্তগুলোকে রাঙ্গিয়ে তোলার জন্য কিন্তু হুসনার জীবনে তেমন কেউই নেই। পরিবার থাকলেও পরিবারে কারো সাথে কোনো ভাব নেই হুসনার। এই ঘরে হুসনার আপন এবং কাছের বলতে একজনই আছে আর সে হলো ডায়রি। হুম এই ডায়রিটা হুসনার ভীষণ কাছের। হৃদয়ের যত কথা যত চাওয়া পাওয়া যত নালিশ যত অভিযোগ সব এই ডায়রিটার সাথেই শেয়ার করে হুসনা। হুসনা অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে “কেউ একজনকে পাঠাও খোদা আমার ধুসর জীবনটাকে রাঙানোর জন্য, যে মানুষটা আমার জন্য দুনিয়াতে এবং আখেরাতে কল্যাণকর।”
কথাটি বলেই চোখ বন্ধ করে মৃদু বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে হুসনা তখনই ফোনের রিংটোনের শব্দ ভেসে আসে ওর কর্ণধারে। বেলকনি থেকে ছুটে রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখে রাইসার কল, আর এক মুহুর্তও দেরি না করে ফোন রিসিভ করে সালাম দেয় হুসনা। তারপর অনেকক্ষণ রাইসার সাথে কথা হয় হুসনার। রাইসার শ্বাশুড়ি হুসনাকে আগামীকাল দেখা করতে বলেছে মূলতঃ এটা বলার জন্যই রাইসা হুসনাকে কল দিয়েছে। কল কেটে দেওয়ার পর হুসনা খুশি হওয়ার সাথে সাথে খুবই নার্ভাস হয়ে যায়। রাহেলা খাতুন কি বলবে হুসনাকে এটা এখনো কেউ জানেনা তাই এটা নিয়ে মোটামুটি রিয়া রাইসা হুসনা সবারই চিন্তা হচ্ছে। হুসনা ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

*
রাত প্রায়ই ১২টা ছুঁই ছুঁই কিন্তু সিয়ামের এখনোও ঘুমানোর কোনো নাম গন্ধ নেয়, সে তার ফোন নিয়েই ব্যস্ত। রাইসা অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ শুয়ে ছিলো কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলোনা কারণ সিয়াম মিউজিক চালু করেছে আবার। রাইসা দ্রুত উঠে যেয়ে মিউজিক বন্ধ করে দিয়ে এসে সিয়ামের পাশে বিছানায় বসে ওর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলে “চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন কোনো কথা নয়।” এটা বলেই নিজের জায়গায় শুয়ে পরে রাইসা। হা হয়ে বসে আছে সিয়াম। সিয়াম ভীষণ অবাক হচ্ছে রাইসার সাহস দেখে। এতোটা সাহস মেয়েটা পেলো কোথায়? রাগে লাল হচ্ছে সিয়াম। কপালের রগ খাঁড়া হয়ে গিয়েছে সিয়ামের, চোখ দিয়ে যেনো অগ্নি ঝরছে। দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ কিছুটা গরম করে সিয়াম বলে “দেখো কালো পরি বারাবাড়ি করিওনা, মোবাইল দাও।”

“দিবোনা মোবাইল, ঘুমান।”
“রাগ বাড়াচ্ছো কিন্তু। ”
“চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে শুয়ে থাকুন তবে রাগও কমে যাবে আর ঘুমও চলে আসবে।”
“এই শুনো একদম বউ বউ সাজতে চাইবেনা বলে দিলাম।”
“আপনার বলাতে আর না বলাতে কি হবে? কিছুই হবেনা কারণ আমি সত্যি সত্যিই আপনার বউ।”
রাইসা কথাটা বলতে না বলতেই হিং’স্রর মতো ঝাপিয়ে পরে সিয়াম ওর উপর। রাইসা খুব করে ব্যস্ত নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কিন্তু পরিশেষে সে ব্যার্থ। স্বামীর সোহাগে বিলিয়ে দেয় রাইসা নিজেকে।

ভোরবেলায় রাইসা ঘুম থেকে জেগে দেখে অঘোর ঘুমে বিভোর সিয়াম। ঘুমন্ত অবস্থায় সিয়ামকে খুব নিষ্পাপ লাগছে। এতোটা সুদর্শন পুরুষ এর আগে যেনো আর একটাও দেখেনি রাইসা। নিজের অজান্তেই রাইসা মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছে সিয়ামকে।
রাইসা গোসল করে ওজু করে এসে সিয়ামকে ডেকে দেয় গোসল করে নামায পড়ার জন্য। কিন্তু সিয়াম কিছুতেই উঠছেনা। সিয়ামকে ডেকে তুলতে ব্যার্থ হয়ে এক গ্লাস পানি এনে ওর মুখে ঢেলে দেয়, সিয়াম সাথে সাথে উঠে বসে যায়। লাল লাল চোখ করে সিয়াম তাকিয়ে থাকে রাইসার দিকে। সিয়ামের এমন রাগ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে ঢুক গিলে রাইসা। সিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে রাইসার দুই বাহু চেপে ধরে বলে “আমার ছোঁয়া পেতে খুব ভালো লাগে তোর তাই না? আমার ছোঁয়া পেলে খুব শিহরণ জাগে, খুব ভালো অনুভূতি হয় তোর তাই না?”

কপাল কুঁচকে রাইসা বলে “ছিঃ কি বলছেন কি এসব আপনি?”

“ভুল কি বললাম? বারবার আমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্যই তো এসব উল্টাপাল্টা কাজ করো তুমি।”
“ভুল ভাবছেন আপনি, ছাড়ুন ব্যাথা লাগে।”
এটা বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রাইসা। মুখ গুমরা করে দাঁড়িয়ে থাকে সিয়াম। রাইসা ছোট ছোট চোখ করে বলে “অনেক হয়েছে যান এবার গোসল করে নামায সেরে নিন। তারপর ব্যায়াম করতে হবে।”
সিয়াম বিরক্ত হয়ে বলে “কেনো শুনতে হবে তোমার কথা আমাকে? পারবোনা কিছু করতে ঘুমাবো আমি। বিরক্ত করিওনা নিজের কাজে যাও তো।”
এটা বলেই সিয়াম বিছানায় বসতে যাবে তখনই রাইসা বলে “এবার কিন্তু পুরো বালতি এনে ঢেলে দিবো। যা বলছি তা-ই করুন।” সিয়ামের বুঝা হয়ে গেছে তার আর শান্তিতে ঘুমানো হবেনা। কেনো যে এতো দ্রুত বিয়ে করতে গেলো কে জানে। সিয়াম রাগ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই পেঁছন থেকে মুচকি হাঁসে রাইসা। ছেলেটা ত্যাঁরা হলেও কিউট। রাইসা নামায শেষ করে কোরআন তেলাওয়াত করতে বসে। সিয়াম নামায শেষ করে রাইসার কথা অনুযায়ী ব্যালকনিতে যেয়ে ব্যায়াম করতেছে। রাইসার তেলাওয়াতের সুর সিয়ামের কানে আসতেই সে থেমে যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে সিয়াম শুনে রাইসার তেলাওয়াত করা। মুগ্ধ হয় সিয়াম, এর আগে আর কখনো যেনো এতো সুন্দর তেলাওয়াত সে শুনেনি। সিয়াম ধীরে ধীরে এসে রাইসার পাশে এসে বসে। রাইসা খেয়াল করে সিয়মাকে আর মুচকি হাসে। রাইসা তেলাওয়াত শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে সিয়াম ঘুমিয়ে গেছে। রাইসা বুঝতে পারে যে সিয়াম ওর তেলাওয়াত শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গেছে। রাইসা রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনে সিয়ামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সিয়াম জেগে যায়। সিয়াম জাগতেই ছিঁটকে কিছুটা দূরে সরে যায় রাইসার থেকে আর বলে “শুনো কালো পরি আমার ক্লোজ হওয়ার একটুও চেষ্টা করবেনা। দূরে দূরে থাকবে আমার থেকে।”

“আচ্ছা থাকবো দূরে। আর আমি তো দূরেই থাকি আপনি নিজেই তো বারবার কাছে টেনে নেন আমায়।”
মৃদু হাঁসির সাথেই বলে রাইসা। আগুন উঠে যায় সিয়ামের মাথায় আর গিজগিজ করতে করতে বলে “তুমি ইচ্ছে করেই রাগাও আমায় আমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। তোমাদের মতো মেয়েকে খুব ভালো করেই চিনি আমি।”
“আচ্ছা চিনলে তো ভালোই। নিন আপনার কফি।” এটা বলেই রাইসা সিয়ামের হাতে কফি ধরিয়ে দিয়ে রুম ত্যাগ করে।

*
রিয়া আর রাইসা গাড়িতে বসে আছে সিয়ামের অপেক্ষায়। এইদিকে কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিয়া বিরক্ত হয়ে বলে “সবসময়ই ভাইয়া আগে এসে অপেক্ষা করে আমার জন্য আর আজ ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নাই।” রাইসা শান্তভাবে বলে আচ্ছা আমি দেখছি কোথায় আছে তোমার ভাইয়া। এটা বলে রাইসা গাড়ি থেকে নামতেই সিয়াম হুটহাট কোথায় থেকে এসে যেনো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। রিয়া চমকে গিয়ে ভাইকে বলে “আরে ভাইয়া কি করছো কি তুমি? গাড়ি থামাও, ভাবি যাবে তো আমাদের সাথে।”
সিয়াম শান্তভাবেই বোনের প্রশ্নের উত্তরে বলে “দেখ নিজের চিন্তা নিজে কর, অন্যের চিন্তা করতে হবেনা। রাইসা রিক্সা বা টেক্সি নিয়ে চলে আসবে সবসময় যেভাবে যায়।”
রিয়া খুব আপসেট হয়ে বলে “এটা তুমি ঠিক করোনি ভাইয়া। আমাদের বাসা থেকে রিক্সা করে কলেজ যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” সিয়াম আর কিছু না বলে চুপচাপ ড্রাইভ করে। মন খারাপ করে বসে থাকে রিয়া।
এভাবে গাড়ি স্টার্ট হয়ে যাওয়াতে রাইসা খুব অবাক হয় কিন্তু মুহুর্তেই ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে। মেসেজটা আর কেউ নয় ওর স্বামী সিয়াম রহমান সেন্ড করেছে। মেসেজে লেখা ছিলো “তোমার মতো দুই টাকার মেয়েকে শুধু সিয়াম রহমানের বিছানায় মানায় এতো দামি গাড়িতে নয়। তুমি রিক্সাই বা টেক্সি তে সবসময় যেমন আসা যাওয়া করো তেমনই চলে এসো কলেজ।”
রাইসার খুব কান্না আসে সিয়ামের এসব কথায়। কষ্ট হচ্ছে খুব। বুকে চিনচিন ব্যাথার সৃষ্টি হচ্ছে। আজকের আগে কখনোও এমন অপমানবোধ করেনি রাইসা। নিজেকে খুব ছোট লাগছে রাইসার। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অনবরত অশ্রু ঝরছে। রাহেলা খাতুন জানালা থেকে দেখে রাইসা খুব চটপট করছে সেটা। রাইসা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু ফেলছে তখনই কেউ এসে ওর কাঁদে হাত রাখতেই চট করে সে চোখের জল সব মুছে ফেলে। রাহেলা খাতুন বলে “লুকিয়ে লাভ নেয় মা, আমি দেখেছি সব। আমার ছেলেটা এমনই, আমি পারিনি ওকে মানুষ করতে। আমি তোমাকেই সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলাম সিয়ামকে চেঞ্জ করার জন্য। মন খারাপ করিওনা। আমি ড্রাইভার কে বলতেছি আরেকটা গাড়িতে চলে যাও তুমি।”
শ্বাশুড়ীর এমন কথা শুনে মুচকি হাঁসে রাইসা। “না থাক আম্মু। আমি সবসময়ই এর মতো চলে যেতে পারবো। অভ্যাস আছে আমার।”
এটা বলে রাইসা আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়।
কলেজে পা রাখতেই রাইসার চোখাচোখি হয় সিয়ামের। সিয়াম বন্ধুদের নিয়ে উচ্চস্বরে হাঁসিতে মেতে উঠে। এসব দেখে খুব খারাপ লাগলেও রাইসা পাত্তা না দিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১২
#ফারজানা_আক্তার

রোদের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড রোদের মাঝে হালকা মৃদু বাতাসে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে রাইসা। ক্লাস শেষ করে রিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে টেক্সিতে উঠে যায় রাইসা। রিয়া অনেক বুঝিয়েছে রাইসাকে ওদের সাথে গাড়িতে যাওয়ার জন্য কিন্তু রাইসা নাছোরবান্দা, সে কিছুতেই রাজি হলোনা। আজকের ঘটনাটা রাইসার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে খুব। টেক্সি চলছে আপন মনে, আনমনা হয়ে বসে আছে রাইসা। শ্বাশুড়ির কথাগুলো ভাবাচ্ছে খুব রাইসাকে। কিভাবে সে সিয়ামকে সঠিক পথে আনবে বুঝতে পারছেনা। বড়লোকের বখাটে ছেলে একটা। আসলেই শিক্ষার অভাব আছে উনার নয়তো একটা মানুষ এতোটা ছোট মনের কীভাবে হতে পারে। রাইসার ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে এতোটা জগণ্য একটা মানুষ ওরই স্বামী। রাইসার টেক্সি এসে বাসার সামনে দাঁড়াতেই রাইসা গাড়ি থেকে নেমে দেখে নিজের গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিয়াম। সিয়ামকে না দেখার ভান ধরে রাইসা ঘরের দিকে চলে যেতে নিলে সিয়াম পেঁছন থেকে ডাক দেয় কালো পরি বলে। রাইসা তবুও না দাঁড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রাইসা রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে যেয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পরেন রাইসা। নিজের ভাগ্যের উপর রাগ করবে নাকি হাঁসবে বুঝতে পারছেনা রাইসা। রাইসা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে রিয়া আর হুসনা বসে আছে ওর বিছানায়। রাইসা ওদেরকে দেখে একটুও অবাক হয়নি কিন্তু রাইসার একটুও মনে ছিলোনা যে হুসনা আজ আসবে। হুসনাকে দেখে রাইসা হাঁসিমুখে বলে তোমরা বসো আমি কাপড়চোপড় গুলো শুকাতে দিয়ে আসি। রিয়া বলতে চেয়েও বলতে পারেনি যে বেলকনিতে সিয়াম আছে। হুসনা রিয়াকে বলে “আচ্ছা রাইসা আমাদের সাথে গাড়িতে আসেনি কেনো? ওদের মধ্যে কি ঝামেলা চলছে?” তখন রিয়া সব বলে হুসনাকে। হুসনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে “জানিস রিয়া এই পৃথিবীতে স্বামীর সুখ হলো সবচেয়ে বড় সুখ। যে নারী স্বামীর সুখ বঞ্চিত হয় তার মতো দূরভাগ্য আর কেউ নেই।” হুসনার কথা শুনে রিয়া কিছুটা ইমোশনাল হয়ে বলে “জানিনা এতোকিছু তবে এইটুকু জানি ভাবি ভাইয়াকে একদিন ঠিক চেঞ্জ করে দিবে, সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার ভাবির উপর। ”
রাইসা বেলকনিতে যেয়ে সিয়ামকে দেখেও না দেখার মতোন হয়ে কাপড়চোপড় শুকাতে দিচ্ছে। সিয়াম উচ্চস্বরে বলে উঠে হঠাৎ করে “কিসের এতো ভাব তোর হ্যাঁ? এতো ভাব নিচ্ছিস কেনো তুই আজ?” রাইসা সব শুনেও কিছু না বলে চলে আসতে চাইলে সিয়াম রাইসার হাত ধরে টান দিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে “রাতে খবর করে ফেলবো দেখে নিস, তোর সব ভাব শেষ হবে আমার বিছানায় এসে মনে রাখিস। ” এটা বলেই রাইসাকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সিয়াম। রুমে রিয়া আর হুসনা আছে এটা ভেবে খুব লজ্জিত হয় রাইসা কিন্তু কিছু করার নেই এটা ওর ভাগ্য, মেনে নিতে হবে সব। ভাগ্য করে একটা স্বামী পেয়েছে বলতে হবে। রিয়া আর হুসনা রুম থেকে সব শুনেও কিছু না শোনার ভান ধরে বেলকনিতে রাইসার কাছে এসে হাঁসিমুখে বলে “রাইসা আমি যাচ্ছি, ভালো থাকিস নিজের খেয়াল রাখিস।” রাইসা চোখের জল আঁড়াল করে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে “চলে যাবি মানে? আম্মু কি বলেছে কিছু তো বললিনা।” তখন রিয়া বলে “আম্মু বলেছে ও এখন যেভাবে টিউশনি করছে সেভাবে টিউশনি করে চলতে। কারণ এতো ভালো ঘরের মেয়ে বাহিরে এসে কাজ করবে এটা খুব খারাপ দেখায় আর ধৈর্য ধরলে ফলাফল নিশ্চয়ই খুব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। আরো অনেক কিছুই বলেছে।” রাইসা সব শুনে হুসনাকে বলে “মন খারাপ করিসনা বোন, আম্মু যা বলছে তোর ভালোর জন্যই বলেছেন হয়তো।” হুসনা হালকা হেঁসে বলে “হুম আমি বুঝেছি উনি যা বুঝাতে চেয়েছেন।” এভাবে আরো অনেকক্ষণ কথা বলে ওরা তিনজন। ওরা কথা বলতে বলতে সিয়াম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চিল্লিয়ে বলে “এই কালো পরি কই তুমি?” সিয়ামের ডাকে কিছুটা কেঁপে উঠে রাইসা। পরে নিজেকে সামলিয়ে বলে “আসতেছি।” এটা বলেই রাইসা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রিয়া আর হুসনা মুখ টিপে হাঁসে। রাইসা রুমে গেলে রাইসার পেঁছন পেঁছন রিয়া আর হুসনা যেয়ে রুমে থেকে বেড়িয়ে যায়। ওরা চলে গেলে রাইসা সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলে “কিছু কি বলবেন?”

“হুম বলবো বলেই তো ডেকেছি”
“বলুন”
“কফি খাবো”
“আচ্ছা আমি কাউকে বলছি কফি দিয়ে যেতে আপনাকে”
“নাহ আমি তোমার হাতের কফি খেতে চেয়েছি”
সিয়ামের শেষের এই কথাটি শুনে বেশ অবাক হয় রাইসা। এই মানুষটাকে বুঝতে পারছেনা রাইসা। কখনো কখনো মনে হয় সিয়াম আসলেই খুব ভালো স্বামী আবার হঠাৎ করে সে এমন কিছু করে বসে যে মুহুর্তেই সব ভাবনা উল্টাদিকে ঘুরে। রাইসা আর সময় নষ্ট না করে এক দৌড়ে গিয়ে সিয়ামের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসে।

*
সন্ধ্যায় প্রায়ই ৬/৭জন মেয়ে নিয়ে এসে নিজের রুমে আড্ডা দিতে ব্যস্ত সিয়াম। রাইসা এতক্ষণ রিয়ার রুমে থাকায় সে জানতোনা। রিয়ার রুম থেকে এসে রাইসা দেখে ওর রুম জুড়ে চলছে আড্ডা ফাড্ডা। এতোগুলো মেয়ের মাঝে একটাই ছেলে আর সে হচ্ছে সিয়াম, রাইসার রাগ উঠে খুব। রাইসা এসে সবার সামনে সিয়ামের হাত ধরে এক পাশে নিয়ে যায় তাকে তারপর বলে “কি হচ্ছে এসব? কি হয় এই মেয়েগুলো আপনার?”

“ওরা আমার ফ্রেন্ড, তোমার কি আমি আমার ফ্রেন্ডেদের নিয়ে আড্ডা দিলে আর এটা প্রথম নয় ওরা সবসময়ই আসে এখানে আড্ডা দিতে। ”
“এখন আর তখন পার্থক্য আছে। তখন এই রুম আপনার একার ছিলো কিন্তু এখন আমিও আছি সাথে। আমি আপনার স্ত্রী আর কোনো স্ত্রীই এসব দৃশ্য নিজের চোখে সহ্য করতে পারবেনা।”
“সহ্য করতে হবেনা তুমি রিয়ার রুমে যেয়ে পড়তে বসো যাও।”
মেয়েগুলো অবাক ওদের কথাবার্তা শুনে। সিয়াম যে বিয়ে করেছে সেটা মেয়েগুলো জানতোনা। মেয়েগুলোর মধ্যে একটা মেয়ে নাম ইফা। এই ইফা নামের মেয়েটা ভীষণ ভালোবাসে সিয়ামকে এবং এক বছর ধরে তাদের সম্পর্ক। ইফা সিয়ামের গার্লফ্রেন্ড। রাইসা রিয়ার রুমে না যেয়ে ওই মেয়েগুলোর সামনে যেয়ে বলে “আমার রুম থেকে বের হয়ে যান সবাই। উনি আগে সিঙ্গেল ছিলো তাই আপনাদের আড্ডায় কারো সমস্যা হয়নি কিন্তু উনি এখন আর সিঙ্গেল নেই, আমার সমস্যা হয় আপনাদের এই আড্ডায়।”

মেয়েগুলো হা হয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে রাইসার কথা শুনে। ইফা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে “মানে কি এসবের? কে তুমি?”
হাঁসিমুখেই রাইসা বলে “আমি সিয়াম রহমানের স্ত্রী ”
এই কথা ইফার কর্ণকুহর হতেই সে ধপাস করে বসে পরে। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে সিয়াম এতক্ষণ সব দেখলেও এবার সে দৌড়ে এসে রাইসার দুই বাহু চেপে ধরে বলে “রাগ বাড়াইয়ো না আমার, ফলাফল ভালো হবেনা বলে দিলাম।” রাইসা সিয়ামের কথায় একটুও ভয় না পেয়ে বলে “কি আর করবেন? মাথা মোটা একটা মানুষ। রাগ উঠলেই তো হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পরেন আমার উপর কিন্তু সত্যি কি জানেন আপনার ওই আচরণে আমি একটুও কষ্ট পায়না কারণ আপনি আমার স্বামী আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমাকে কাছে টানার আদর করার।” কথাগুলো শুনে যেনো সিয়ামের গা জ্বলে যাচ্ছে। সিয়াম জানে রাইসা ইচ্ছে করেই গুছিয়ে মিথ্যা বলছে তবুও সে চুপ আছে কারণ এখন যদি সে কিছু বলতে যায় হিতের বিপরীত হতে পারে। রাইসা এবার মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে “আপুরা এবার আপনারা আসতে পারেন, আপনার ভাইয়ের সাথে কিছু পার্সোনাল কথা আছে আমার।” রাইসা কথাটা বলতেই ইফা বসা থেকে উঠে সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলে “সিয়াম তুমি এভাবে না ঠকালেও পারতে আমায়, বিয়ে করেছো অথচ আমাকে একবার বলা প্রয়োজন মনে করোনি তুমি। কিভাবে পারলে আমার জায়গাটা অন্যকাউকে দিতে?”
মেয়েটার কথা শুনে রাইসার আর বুঝতে বাকি রইলো না সিয়াম মেয়েটার সাথে সম্পর্কে ছিলো। ইফার কথার প্রতুত্তরে সিয়াম কিছু না বলে রাইসাকে উদ্দেশ্য করে বলে “তুমি আজ যা করেছো মোটেও ভালো করোনি, পস্তাবে তুমি।”

“কেনো পস্তাবো আমি। আমি তো ইচ্ছে করে আসিনি আপনি জোর করেই বিয়ে করেছেন আমায়। আমার পরিবারকে রাজি করিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছেন আমায়।”
সিয়াম কিছু বলতে যাবে তখনই ইফা বলে “সিয়াম তুমি কেমন ছেলে তা আমি ভালো করেই জানি। শুধু শুধু ওই মেয়েটাকে কেনো বকছো তুমি? শুধরে নাও নিজেকে আর আজকের পর আমার সাথে ভুলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেনা।” কথাগুলো বলেই সিয়ামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় ইফা। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ইফা যা সে সহ্য করতে পারছেনা কারণ ইফা সিয়ামকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে।
ওরা সবাই চলে গেলে লাল লাল চোখ করে সিয়াম রাইসার দিকে এগিয়ে যায়। রাইসা ভয়ে ঢুক গিলে আর এক পা দু পা করে পিঁছাতে থাকে।।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ