শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা পর্ব-০৯+১০

0
279

#শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা
#পর্বঃ০৯+১০
#ফারজানা_আক্তার

আকাশে লাল আভা ফুটে উঠেছে, একটু একটু করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পাখিরা সব ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে, পৃথিবী যেনো সেজেছে হলুদে হলুদে। আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি মাগরিবের আজান দেওয়ার। সিয়াম আর রাইসা বাসায় পৌঁছে গিয়েছে, গাড়ি থামতেই রাইসা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। সিয়াম ওর এমন অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে বলে “এই কালো পরি সমস্যা কি তোমার হ্যাঁ?”
রাইসা একবার সিয়ামের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। সিয়ামের মুখে কালো পরি নামটা শোনে রাইসার সেই প্রথম দেখার কথা মনে হয়ে যায় আর এটা মনে হতেই ওর মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষণ। রাইসার প্রাকৃতিক হাওয়া ভালো লাগে, প্রাকৃতিক বাতাসে স্বস্তি মিলে রাইসার তাই সে দ্রুত এসি গাড়ি থেকে নেমে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো। সিয়ামের এমন রাগান্বিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে হয়নি রাইসার তাই সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করতেই রাইসা দেখে সবাই ওদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। রিয়া ছুটে এসে রাইসাকে জড়িয়ে ধরে বলে “আজ কলেজে খুব বেশিই মিস করেছি আমি আর হুসনা তোমায়।”
রাইসা মুচকি হেঁসে রিয়ার গালে হাত ছোয়ায়। তারপর শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে সালাম দিয়ে কোশল বিনিময় করে। রাহেলা খাতুন বলেন “কথা সব পরে হবে আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো কিছুক্ষণ। আমি তোমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি।” এটা বলে রাহেলা খাতুন রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। রাহেলা খাতুন চলে গেলে রাইসাও পা এগোই নিজের রুমের দিকে।

চারিদিকে মাগরিবের আজানের সুর। রাইসা ওজু করে এসে দেখে সিয়াম পা ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। রাইসা ধীরে ধীরে সিয়ামের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রাইসা সিয়ামের পাশে বসে সিয়ামের চুলে হাত বুলিয়ে বলে “উঠুন মাগরিবের নামাযের সময় হয়েছে”
রাইসা কথা টা বলতে বাকি সিয়ামের হুংকার দিতে দেরি হয়নি। সিয়াম চিল্লিয়ে বলে উঠে “এই শুনো এটা তোমার বাপের বাড়ি নয় এটা আমার বাড়ি, এখানে আমি যা বলবো তা-ই হবে। এখানে তোমার কোনো কথার মূল্য আমার কাছে নেয়। রাতে তৈরি থেকো, আজ রাতেই তোমাকে সম্পূর্ণ আমার করে নিবো।”
কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য সিয়াম। সিয়ামের এমন আচরণে বেশ ভয় পেয়ে যায় রাইসা। এইদিকে মাগরিবের নমাযের সময় কম বলে রাইসা আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত নামাযে দাঁড়িয়ে যায়। মোনাজাতে রাইসার একটা-ই প্রার্থনা সিয়াম যেনো সঠিক পথে ফিরে আসে, আল্লাহ যেনো হেদায়েত দান করেন সিয়ামকে।

*
রাতে সিয়াম রাইসাকে স্পর্শ করতেই রাইসা দূরে সরে যায় এতে সিয়ামের রাগ উঠে কিছুটা আর বিড়বিড়িয়ে দাঁত গিজগিজ করে বলে “তোমার দেনমোহর পরিশোধ করেছি বিয়ের দিনেই। সব টাকা তোমার একাউন্টেই আছে সুতরাং তুমি এখন আমার জন্য বৈধ তবে কেনো এভাবে দূরে সরে গেলে তুমি? পর্দার পেঁছনে কি অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা আছে নাকি হুম? ধরা পরে যাওয়ার ভয় হচ্ছে কি?”

“ছি কি যা তা বলছেন আপনি? আপনি না জেনে এভাবে আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলতে পারেননা আর সেই অধিকার আপনার নেই। আপনি আমার স্বামী আমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আপনার আছে কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে এমন কথা বলার অধিকার নয়।”

“তাহলে কাছে আসো তৃপ্তি মিটিয়ে দাও আমার”

“আগে ওজু করে আসুন, দুই রাকাআত নামাজ পড়তে হবে”

“মানে কি? পড়বো না আমি নামায”

“নামায না পড়লে আমিও নিজেকে আপনার কাছে বিলিয়ে দিতে পারবোনা।”

“তোমার ধারণা আছে কি বলতেছো তুমি? আমি কিন্তু চাইলেই জোর করতে পারি আর তুমি চিৎকারও করতে পারবেনা লজ্জায় কারণ আমি তোমার স্বামী। ”
দাঁত কিড়মিড় করে বলে সিয়াম।

“আপনি স্বামী নামক ধর্ষক হতে চাইলে জোর করতেই পারেন”
একটু হেঁসেই কথাটি বলে রাইসা যা সিয়ামের মোটেও সহ্য হয়নি তাই সে দ্রুত ওজু করতে চলে যায়। মানুষটা এতোটাও খারাপ নয় যতটা রাইসা ভাবছে এটা ভেবেই সে ওষ্ঠ মেলে হাঁসে। এই নামায ফরজ নয় তবুও রাইসা এই নামাযের জন্য সিয়ামকে জোর করার কারণ হলো সে চাই সিয়ামের অভ্যাস হোক ধীরে ধীরে নামায পড়ার। রাইসা চাই সিয়ামকে নামাযের প্রতি আসক্ত করতে যেমনকি সে তার মোবাইল নিয়ে আসক্ত। সিয়াম অতিরিক্ত ফোন চালায় যা রাইসার মোটেও পছন্দ না। রাইসা খুব সাদামাটা একটা মেয়ে, জীবনের জটিলতা তেমন একটা পছন্দ করেনা তবুও জীবনটা কেমন জটিল হচ্ছে ধীরে ধীরে। এই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাবে তার সে কখনোই ভাবেনি তবুও মেনে নিতে হবে আল্লাহর হুকুম।

*
“ইমতিয়াজ হোসেন জাহানারা বেগমকে প্রতি রাতেই মা’রে তারপর দুতলায় গিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী কে নিয়ে ফূর্তিতে মেতে উঠে। আর এসব হুসনা আর ওর বড় বোনের চোখের সামনেই ঘটে। ওরা দুই বোন মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো সবসময়ই। জাহানারা বেগমকে কোনো খরচা দিতেননা ইমতিয়াজ হোসেন এমনকি মেয়ে দুটোর পড়ালেখার খরচও দিতেননা তাই উনি বাধ্য হয়েই মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালাতেন। এটা নিয়েও জাহানারা বেগমের সতীন ঝামেলা করতো আর ইমতিয়াজ হোসেন কে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দিতো পরে ইমতিয়াজ হোসেন ক্ষেপে গিয়ে জাহানারা বেগমকে প্রচুর মার’ধর করতেন। এভাবে চলে প্রায়ই এক বছরের মতো তারপর এক রাতে দ্বিতীয় বউয়ের কথায় ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে দুই মেয়েকে সহ জাহানারা বেগমকে বের করে দেন ঘর থেকে। তারপর মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান জাহানারা বেগম। সেখানেও আরেক ঝামেলা, জাহানারা বেগমের নিজের মা নেই, জাহানারা বেগমের জন্মের তিন মাসের সময়ই উনার মা মা’রা যান তারপর উনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মায়ের সংসারে বড় হয়েছেন জাহানারা বেগম। জাহানারা বেগম এর আপন ভাই বোন নেই কিন্তু সৎ ভাই বোন আছেন। বাপের বাড়িতে এসেও বিন্দুমাত্র শান্তি পাচ্ছেননা জাহানারা বেগম। একদিকে সৎ মা জ্বা’লাতন করছেন তো অন্যদিকে সৎ ভাইবোন। মায়ের কষ্টে যেনো বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো হুসনার সে মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাবার বাসায় চলে আসে একদিন চু’রি করে। হুসনা এসেই সোজা দুতলায় গিয়ে ইমতিয়াজ হোসেন এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে “আপনি বাবা নামের কলঙ্ক শুধু বাবা নয় আপনি তো মানুষ নামেই কলঙ্ক। লজ্জা করছেনা আপনার বেঁচে থাকতে? আপনি কি জানেন মা কত কষ্ট করছে আমাদের দুই বোনকে নিয়ে? আপনার জন্যই আজ আমার মা আধ’মরা হয়ে বেঁচে আছেন। আপনাদেরকেও শান্তিতে সংসার করতে আমি দিবোনা। আমি থা’নায় ডাইরি করে এসেছি এবং একটা চিঠি লিখে আমাদের নিচতলায় এমন জায়গায় রেখে এসেছি যেখানে হাত দিলেই পুলিশ সহজে চিঠিটা পেয়ে যাবে কিন্তু আপনারা পাবেননা।”
এবার ইমতিয়াজ হোসেন এর দ্বিতীয় স্ত্রী নাজমা আক্তার ভয় পেয়ে ঢুক গিলে বলে “এই মেয়ে কি বলছো এসব তুমি, কিসের ডাইরি করে এসেছো তুমি কি করেছি আমরা? আর কিসের চিঠির কথা বলছো তুমি?”
এবার হুসনা বাঁকা হাসে আর বলে “কিছুই তো করেননি আমার মা তো এমনিতেই কষ্ট পাওয়ার ঢং করছে। কিন্তু এবার করবেন আপনারা কিছু তারপর পুলিশ এসে আপনাদের দুজনকে বেঁধে নিয়ে যাবে”। এটা বলেই উচ্চস্বরে হাঁসে হুসনা।
নাজমা আক্তার ইমতিয়াজ হোসেন কে বলেন ” তোমার মেয়ে উম্মাদ হয়ে গেছে, ও কি বলছে নিজেই জানেনা। ভালো করে জিজ্ঞেস করো কি করতে চাই ও?”
হুসনা নাজমা আক্তার এর কথা শুনে বলে “কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে হবেনা যা বলার আর করার আমি এখনই করতেছি” এটা বলেই হুসনা ওর জামার ভেতরে লুকিয়ে রাখা ছু’রিটা বের করে ওর গলায় ধরে আর ইমতিয়াজ হোসেন কে উদ্দেশ্য করে বলে “আমি এখন এই মুহুর্তে নিজেকে শেষ করবো যদি আপনি আমার মায়ের আর আমাদের দুই বোনের দায়িত্ব না নেন। চিন্তা করিয়েননা আমি শেষ হয়ে গেলেও আপনাদের রক্ষা নেয় কারণ চিঠিতে আমি লিখে এসেছি আমাকে আপনারা দুজনে মিলেই খু’ন করার পরিকল্পনা করেছেন এবং বহুবার আপনারা আমাকে খু’ন করতে চেয়েছেন কিন্তু সফল হননি আর ডাইরি তো করেই এসেছি। আমার মনে হয় আপনাদের জীবন ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু করতে হবেনা আমাকে আর। আমি চলে যাবো ওপারে আমার নিজের মতোই কিন্তু আপনারা কষ্ট করে যাবেন যতদিন বাঁচবেন আমাকে খু’ন করার দ্বায়ে।”
কথাগুলো বলতে বলতে হুসনার গলার নিচে একটুখানি কেটে র’ক্ত বেরিয়ে আসে তাতে খুব বেশি ভয় পেয়ে যান নাজমা আক্তার। ভয়ে নাজমা আক্তারের গলা শুকিয়ে আসে। উনি হুসনাকে বলেন “দেখো মেয়ে তুমি এসব কিছুই করবানা। আ আমি কথা দিচ্ছি আমি আর তোমার বাবা এখনই গিয়ে তোমার আম্মু আর বোনকে নিয়ে আসবো এই বাসায়। দয়া করো একটু মা। আ আমি এ এখনি যাচ্ছি তোমার মা বোনকে আনতে চলো তুমিও চলো আমাদের সাথে।” কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন নাজমা আক্তার।

“উঁহু শুধু আনতে গেলে হবেনা আপনাদের এই কাগজে সিগনেচার করতে হবে আগে।”
ডান হাতে গলায় ছু’রি ধরে রেখে বাম হাত দিয়ে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় হুসনা ইমতিয়াজ হোসেনের দিকে। ভ্রু কুঁচকে ইমতিয়াজ হোসেন বলেন “কিসের কাগজ এটা?” নাজমা আক্তারের চোখে ভয় দেখলেও ইমতিয়াজ হোসেনের চোখে বিন্দুমাত্র ভয় বা লজ্জা দেখলো না হুসনা।
“এই কাগজে লেখা আছে আপনি আজকে আমার মাকে ঘরে আনার পর থেকে আর কখনো আমার মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করতে পারবেননা গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক। আর আজকে গিয়ে আপনারা দু’জনেই ক্ষমা চাইবেন আমার আম্মুর থেকে। আর যদি কখনো আমার মা কষ্ট পায় এমন কাজ করেন তবে সব শাস্তি নিজ থেকেই মাথা পেতে নিবেন নয়তো পুলিশ আপনাদের খুব বাজে অবস্থা করে দিবে। আরো অনেক কিছু লেখা আছে এতে”।
নাজমা আক্তার দেরি না করে দ্রুত সিগনেচার করে দেন আর ইমতিয়াজ হোসেনকে দিয়েও করিয়ে নেন তারপর তারা তিনজন জাহানারা বেগমকে আনার জন্য পথ দেন। ”
পুরোনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায় হুসনা। হুসনা এতকিছু করেছে তার মা বোনের জন্য কিন্তু আজও সবার কাছে সবটা অজানা।

*
মাহিন শুয়ে শুয়ে পড়ছিলো তখনই ওর ফোনে একটা কল আসে ওর বন্ধু শান্তর। শান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের তাই মাহিন শান্তর সাথে বেশি মিশে যদিও সব বন্ধুই জানে মাহিনের পরিস্থিতির কথা তবুও তারা মাহিনের সাথে খুব ভালো আচরণ করে। মাহিন লজ্জায় কম মিশতে চাই তাদের সাথে কারণ সবাই সবাইকে ট্রিট দেয় খাওয়ায় কিন্তু মাহিন তা পারেনা তাই ও দূরে থাকতে চাই সবার থেকে। মজার কথা হলো মাহিন যতই দূরে থাকতে চাই সবার থেকে ততই সবাই মাহিনকে আরো বেশি কাছে টেনে নেয়। শান্ত মাহিনকে কল করে বলে একটু পাশের খেলার মাঠে আসার জন্য, মাহিন ভয় পেয়ে যায় এটা ভেবে যে শান্তর কোনো বিপদ হলো না তো? কেনো এতো রাতে ওকে মাঠে ডাকছে? এসব ভাবতে ভাবতে চেয়ারের উপরে রাখা টি-শার্ট টা টান দিয়ে পরিধান করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। মাঠে হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগলেও মাহিন তিন মিনিটে পৌঁছে যায়, মাহিন মাঠে গিয়ে কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা। চাঁদের আলোয় মাঠ ঝিকিমিকি করছে। মাহিন পাগলের মতো শান্তকে খোঁজে চলেছে কিন্তু কোথাও শান্তর হদিস পাচ্ছেনা সে। মাহিন খুব চিন্তায় পরে গেলো, শান্তকে অনেকবার কল দেয় মাহিন কিন্তু সে কল রিসিভ করছেনা মাহিনের চিন্তা আরো বেড়ে গেলো। রাত ১২টা বাজার আর মাত্র এক মিনিট বাকি আছে। এতো রাতে কোথায় খুঁজবে শান্তকে সেই চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে মাঠে বসে পরে মাহিন। মাঠে বসার জন্য একটা এক্সট্রা টুল রাখা আছে সেখানে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে আছে মাহিন তখনই কিছু সুর ভেসে আসে মাহিনের কর্ণধারে। মাহিন চোখ খুলে দেখে ওর চারপাশে ঘিরে আছে_______

#চলবে _ইনশাআল্লাহ

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১০
#ফারজানা_আক্তার

জ্যোৎস্নায় ভরপুর পৃথিবী। চারিদিকে আলোয় আলোয় মাঠ ঝিকিমিকি করছে। মৃদু বাতাস মাহিনের চোখে মুখে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বন্ধুদের কন্ঠ কর্ণকুহর হতেই পট করে চোখ মেলে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় মাহিন। সবাই একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠেছে “শুভ জন্মদিন মাহিন।” কিন্তু এতে মাহিনের চোখে মুখে মোটেও আনন্দ খুঁজে পেলোনা ওর বন্ধুরা। তারপর সবাই ওকে বললো “দেখ মাহিন তুই আমাদের বন্ধু ভাবিস আর না ভাবিস আমরা কিন্তু মন থেকেই তোকে ভালোবাসি। আরে টাকা পয়শা কোনো ব্যাপারই না যদি আমাদের মন টা সরল থাকে। আজ থেকে তুই কখনো আমাদের সামনে নিজেকে ছোট করে রাখবিনা বলে দিলাম আর হ্যাঁ আজ থেকে এমন গম্ভীর হয়ে থাকিসনা প্লিজ। আরে দোস্ত আমরা আমরাই তো, চিল।” এসব বলে সবাই একসাথে হৈ হুল্লোড় করতে থাকলো। মাহিনের জন্য অনেক উপহার আর একটা চকলেট কেক এনেছে কিন্তু মাহিন এসব গ্রহণ করতে নারাজ কিন্তু ওর বন্ধুরা নাছর বান্দা তাই এসব নিতেই হবে। তবুও মাহিন কেক কাটাই অমত প্রকাশ করছে মাহিনের মুখে একটাই কথা ইসলামে জন্মদিন এভাবে পালন করার নিয়ম নেই।
“কেনো রে জন্মদিন পালন করা কি হারাম?”
হুট করে বন্ধুদের মাঝ থেকে একজন বলে উঠলো। তখন মাহিন বলে
“জন্মদিন পালন করা হারাম বলাটা সহজ হবে না। কেননা কেবল সে সব কর্ম বা জিনিসকে হারাম বলা যায় সে জিনিসের বিপরীত স্পষ্ট রেফারেন্স থাকে।
কুরআন বা হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া থাকে যে এটা হারাম। অথবা কুরআন ও হাদিসে হারাম ঘোষিত জিনিসের সাথে সাদৃশ্য রাখে।

কিন্তু জন্মদিন পালনের বিষয়টি কুরআন হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ নয়। অন্যদিকে যে সব কারণের ভিত্তিতে হারাম বলা হয় সে সব কারণ জন্মদিন পালনের মধ্যে বিদ্যমান নয়।

যেমন যদি বলা হয় যে, জন্মদিন কাফিররা পালন করে। আর কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখতে রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – নিষেধ করেছেন। তাই এটা পালন করা হারাম।

তাহলে এই দাবিটি ঠিক হবে না। কেননা হাদিসে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখতে যে নিষেধটি আছে সেটা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
যেমন কাফিররা শার্ট প্যান্ট পরিধান করে তাই বলে কি মুসলিমদের জন্য শার্ট প্যান্ট পরিধান হারাম?
একইভাবে জাতিসংঘ অনুমোদিত অনেক দিবস কাফির মুসলিম সকলে মিলে পালন করে যেমন ভাষা দিবস, শিশু দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, বৃক্ষরোপণ দিবস ইত্যাদি।
এই দিবসগুলো কাফিররা পালন করছে বলেই মুসলিমরা পালন করতে পারবে না বিষয়টি এমন নয়।
বরং হাদিসে কাফিরদের সাথে সে সব ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রাখতে নিষধ করা হয়েছে যে কর্মগুলো কাফিরদের ‘শিয়ার’ বা ধর্মীয় প্রতীক বহন করে।
বা যে কর্মক্রীয়া একান্তভাবে কাফিরদের সাথে বিশেষিত। যেমন সর্বপ্রকার পূজা, বড়দিন, নওরোজ, মেহেরজান ইত্যাদি।
কিন্তু যে কর্মগুলো কাফির সম্প্রদায়ের সাথে বিশেষিত নয় সে কাজগুলো সার্বিকভাবে মুসলিমদের জন্য নিষেধ নয়।
তার মধ্যথেকে কিছু কাজ কোনো কারণ বিশেষে নিষেধ হতে পারে আবার কোনো কাজ বৈধও হতে পারে।
এই পুরো আলোচনা থেকে যে উপসংহার বের হবে সেটা হলো জন্মদিন পালন করা শরয়ি অকাট্য রেফারেন্স দ্বারা হারাম নয়।
অন্যদিকে তা কাফির সম্প্রদায়ের শিয়ারও নয়। তাই জন্মদিন পালনকে হারাম বলা যাবে না।”

মাহিনের কথা শুনে এক বন্ধু বলে উঠে “তাহলে তো কেকটা কাটা যায় কারণ আমরা তো শুধু সাময়িক আনন্দ করতেছি গান বাজনা নাচ গান তো আর করতেছিনা।” এক প্রকার বাধ্য হয়ে মাহিন কেক কাটলো।
প্রায়ই রাত ২টা বেজে যায় মাহিন সবার সাথে আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে। মাহিন ঘরে গিয়ে দেখে ওর মা ঘুমাচ্ছেন। মাহিনও তাই কোনো শব্দ না করে চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়।

*
ভোর রাতে রাইসা কোনো রকমে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে কিন্তু সফল হচ্ছেনা। রাইসা কখনোই ভাবেনি সিয়াম এতোটা নিষ্টুর হবে। কিভাবে পারলো সিয়াম ভালোবাসার নামে শুধু চাহিদা মেটাতে? ভাবতে পারছেনা রাইসা। রাইসা বেশ বুঝতে পারছে সিয়াম সেই প্রথম দেখার ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই বিয়ে করেছে। সিয়াম গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে কিন্তু রাইসার চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। পুরো শরীর দাগ দাগ হয়ে আছে। শরীরের যন্ত্রণায় কাতর হচ্ছে রাইসা। রাইসার ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে বাবা মায়ের কাছে চলে যেতে। সিয়ামকে সহ্য করতে পারছেনা রাইসা আর।

সকালে সিয়াম আর রাইসা নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে না গেলে ওদের জন্য খাবার ঘরেই পাঠিয়ে দেন রাহেলা খাতুন। সিয়াম পেট পুরে খেলেও রাইসা ছুঁয়েও দেখেনি খাবার।
সিয়াম খাবার শেষ করে কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে কিন্তু রাইসা নিজের মতো করেই খাটের এক কোণে বসে রয়েছে মন খারাপ করে। সিয়াম রাইসার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাঁসে আর গরম কন্ঠে বলে “আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার শাস্তি পেয়ে গিয়েছো হয়তো এক রাতেই আর আমার উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে এখন তোমাকে আমার আর লাগবেনা। তোমার শরীর দেখার লোভ ছিলো শুধু কিন্তু এখন তো সেই শরীরের প্রতিটি অংশ ছুয়েও দিয়েছি, এটাই সিয়াম বুঝেছো? ভুলেও আর কখনো আমার সামনে আমার স্ত্রী সাজার মতো বোকামি করবেনা বলে দিলাম নয়তো গত রাতের চেয়েও জগন্য ভাবে যন্ত্রণা দিতেও দু’বার ভাববো না আমি। মনে থাকে যেনো।”
এটা বলেই কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় সিয়াম। সিয়াম বেরিয়ে গেলেই রিয়া প্রবেশ করে রুমে। রিয়াকে দেখে কিছুটা লজ্জিত হয় রাইসা কারণ রাইসার বুঝতে বাকি রইলো না যে রিয়া সব শুনে ফেলেছে কিন্তু সিয়াম দেখে নাই রিয়াকে। রিয়া এসে রাইসার পাশে বসে বলে “আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাবি, আমি জানতাম না ভাইয়ার মনে এতোটা ঘৃণা জমে আছে তোমার প্রতি। আমি মনে করেছিলাম ভাইয়া হয়তো তোমাকে ভালোবেসে চেঞ্জ হয়েছে কিছুটা।”

“না বোন নিজেকে দোষ দিওনা। এটা আমার ভাগ্য আর ধৈর্যের পরিক্ষা। যাও কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে। ”

“তুমি যাবেনা?”

“নাহ।”
এটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইসা। লজ্জায় রিয়াকে বলতেও পারছেনা যে সে হাঁটতে পারছেনা ঠিকমতো। সিয়াম যে রাইসাকে আদর করেনি, নির্যা’তন করেছে এটা স্পষ্ট রিয়ার কাছে। রিয়ার ফোনে সিয়ামের কল আসলে রিয়া বুঝে যায় ভাই তাকে কেনো কল করেছে তাই সে দ্রুত ভাবে রাইসাকে বলে “তুমি এভাবে চুপ হয়ে থেকোনা ভাবি। তুমি যতই ওর এমন অত্যা’চার সহ্য করবে ততই ও তোমাকে আরো বেশি করে কষ্ট দেওয়ার ফন্দি আঁটবে তাই তুমি নিজেকে শক্ত করো তৈরি করো নিজেকে একজন স্ত্রী যোদ্ধা হয়ে। ভাই কল দিয়েছে আমায় এসে কথা হবে আল্লাহ হাফেজ।”
রিয়া চলে গেলে রাইসা অনেক চিন্তা করে এই বিষয় নিয়ে। জীবনটা এমনভাবে হুট করে এতোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি কখনো রাইসা।
রাইসা মনে মনে ঠিক করে সে সিয়ামের সামনে কিছুতেই নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবেনা। সিয়ামকে কিভাবে সঠিক পথে আনতে হবে ভালো করেই জানা আছে রাইসার। রাইসা মোটেও ভীতু হয়ে বসে থাকার মতো মেয়ে নয়, যথেষ্ট সাহসী রাইসা।

*
“ভাবি একটা কথা বলার ছিলো।”
রিয়া খুব নরম সুরে কথাটি বলে রাইসাকে। রাইসা আর রিয়া মাগরিবের পর একসাথে পড়তে বসেছে রিয়ার রুমে তখনই হঠাৎ কথাটি বলে রিয়া। রাইসাও স্বাভাবিক ভাবে বলে “হুম বলো৷ এতে আবার অনুমতির প্রয়োজন নেই তো।”

“আসলে হুসনা বলেছিলো ওর জন্য একটা পার্ট-টাইম জবের ব্যবস্থা করতে কিন্তু বাসায় তো তেমন ৪ঘন্টার কোনো কাজ আমি দেখছিনা। তবুও তুমি একটু আম্মুর সাথে কথা বলে দেখবে কি?”

“মন খারাপ করিওনা। আম্মুকে বলে দেখি কোনো কাজ হয় কিনা।”
রাইসার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় রিয়া।
পড়া শেষ করেই রাইসা আর রিয়া রাহেলা খাতুন এর কাছে যায় কিন্তু কেউ উনাকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা। রাইসা এই পরিবারের নতুন সদস্য তাই হুট করে এমন বিষয়ে কথা বলতে একটু নার্ভাস লাগছে ওর। প্রায়ই অনেকক্ষণ পর রাইসা হুসনার বিষয়ে কথা বলেন শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে। রিয়াও বলে ওর সাথে যা কথা হয়েছে হুসনার তা আর সে যে হুসনাকে ভরসা দিয়েছে তাও বলেছে। ওদের কথা শুনে রাহেলা খাতুন চিন্তায় পরে যায় কি কাজ দেওয়া যায় তাও বড়লোক ঘরের মেয়েকে। গরিব হলে যে কোনো একটা কাজ দিলেও সমস্যা হতোনা কিন্তু হুসনাকে কিভাবে কি কাজ দিবে মাথায় আসছেনা রাহেলা খাতুনের।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ