শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা পর্ব-১৩+১৪

0
307

#শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা
#পর্বঃ১৩+১৪
#ফারজানা_আক্তার

হাঁপাতে হাঁপাতে রিয়ার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে রাইসা। রাইসাকে এভাবে হাঁফাতে দেখে রিয়ার চোখ যেনো আকাশে উড়ছে। রিয়া দৌড়ে রাইসার কাছে গিয়ে বলে “ভাবি কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো?” রাইসা কিছু না বলে হাতের ইশারায় টেবিলের উপর রাখা পানি দেখিয়ে দেয় রিয়াকে। রিয়া দৌড়ে পানি এনে রাইসাকে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় নিয়ে বসায় আর কি হয়েছে সব জানতে চাই। রাইসা শান্তভাবে সব খুলে বলে রিয়াকে। রাইসার কথা শুনে হাঁসতে হাঁসতে কুটিকুটি রিয়া।
রাতে খাবার খাওয়ার জন্য রিয়া আর রাইসা একসাথে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তখনই ওদের সাথে যোগ হলো আরেকজন আর সেই মানুষটা আর কেউ নয় সিয়াম। সিয়াম এসেই ওদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে নামতে লাগলো, অন্যসময়ে সিয়াম সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামলেও আজ সে রাইসাদের সাথে ধীরে ধীরে পা মিলিয়ে হাঁটছে। রাইসা সিয়ামের দিকে আঁড়চোখে তাকায়, সিয়ামের ওষ্ঠ জোড়ে বাঁকা হাঁসি।
খাওয়া শেষে সবাই সবার মতো নিজ নিজ রুমে চলে গেছে কিন্তু রাইসা এখনো রান্নাঘরে পায়চারি করছে। রুমে যাওয়ার সাহস সে পাচ্ছেনা কারণ রাত হলেই সিয়াম অন্যরুপ নিয়ে নেয় যা রাইসার সহ্য করতে বড্ড বেশি কষ্ট হয়। তবুও ওকে সিয়ামের সামনাসামনি হতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে সকল পরিস্থিতির।
খুব ধীর পায়ে রাইসা রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা পা রুমে রাখতেই রাইসার চোখ ছানাবড়া। যে ছেলে রাত ২টা বাজলেও ঘুমানোর নাম নেয়না সেই ছেলে নাকি আজ রাত ১১টাই ঘুমিয়ে গেছে, বিশ্বাস হচ্ছে না রাইসার। রাইসা সিয়ামের সামনে গিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে দেখলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই সিয়ামের। ঘুমে বিভোর হয়ে আছে সিয়াম কিন্তু তবুও রাইসা বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ সিয়ামের পাশে বসে থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে যায় রাইসা। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ দোয়া দরুদ পাঠ করতে করতেই রাইসার চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম ভর করে।

*
রাইসা কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হয় ঘর থেকে। গেইট থেকে বের হওয়ার আগেই রাইসা বাগানে গিয়ে একটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠে “কিছু ফুল গাছে নয় হাতেই মানায় ভীষণ।” গোলাপটাকে নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস নিতে থাকে রাইসা, গোলাপের ঘ্রাণে নবিজিকে স্মরণ করার মতো আনন্দ আর মুগ্ধতা অন্যকিছুতে পাওয়া মুশকিল। সিয়াম গাড়ি স্টার্ট দিতেই রাইসা ওইদিকে তাকায় কিন্তু রাইসাকে সিয়াম খেয়াল করেনি। রাইসা পেঁছনে ঘুরতেই দেখে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে তৈরি হয়ে। রাইসা অবাক কন্ঠে বলে “রিয়া তোমার ভাইয়া তো চলে গেছে তুমি তৈরি হয়েও যাওনি কেনো?” রিয়া রাইসাকে জড়িয়ে ধরে বলে “আমার কিউট ভাবিটাকে রেখে আমি কি একা যেতে পারি “রিয়ার এমন আহ্লাদ-ই কথায় হেঁসে ফেলে রাইসা। তারপর তারা একটা টেক্সি করে রওনা দেয় কলেজের উদ্দেশ্যে। রিয়া জীবনে এই প্রথম টেক্সিতে উঠেছে, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে রিয়ার।
মাহিন রিয়াকে টেক্সি থেকে নামতে দেখে অবাক হয় অনেকটা। বড়লোকের মেয়ে আর টেক্সিতে, কি ব্যাপার? মাহিন একবার ভাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে আবার ভাবে যদি অপমান করে তাই আর সে কিছু না বলে ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। রিয়া লক্ষ করে মাহিন ওর দিকে তাকিয়েছিলো কিন্তু বুঝতে পারছেনা ছেলেটা ওকে ইগ্নোর করছে কেনো। মাঝে মাঝে মাহিনের কথা বেশ মনে পরে রিয়ার। কিন্তু সব অনুভূতি রিয়া নিজের মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই কারণ মহান আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে ওর।

ক্লাস শেষে সিয়াম রিয়ার কাছে এসে বলে রাইসাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে। এটা শুনে রিয়া খুব খুশি হলেও নিমিষেই ওর মুখের ঝলক থেমে যায় কারণ কিছুতেই গাড়িতে উঠতে রাজি হচ্ছে না রাইসা। সিয়াম মুখ গুমরা করে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বউকে টেক্সিতে দেখতে খুশি লাগলেও নিজের বোনকে টেক্সিতে সে মানতে পারছেনা। খুব রাগ হচ্ছে সিয়ামের রাইসার উপর। রিয়া অনেক জোরাজোরি করার পর রাইসা বলে “তোমার ভাইয়া যদি সবার সামনে কোলে করে আমায় গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসায় তবেই আমি যাবো তোমাদের সাথে।” রাইসার কথাটা শুনতেই রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায় সিয়ামের। রাগে যেনো মাথা জ্বলে যাচ্ছে সিয়ামের। সিয়াম আর কিছু না ভেবেই রাইসাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবছে রাইসা “আব আইহে উঠ পাহাড়কি নিচে।” আর মুচকি মুচকি হাঁসছে।
বাসায় পৌঁছতেই রিয়া গাড়ি থেকে নেমে নিজের রুমে চলে যায়। রাইসা গাড়ি থেকে নামতে যেয়ে থেমে যায় আর তারপর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু কণ্ঠে বলে “যেভাবে গাড়ি থেকে নামিয়ে সবার সামনে অপমান করেছিলেন আমাকে ঠিক তার ব্যতিক্রম ভাবে গাড়িতে তুলতে বাধ্য করেছি আপনাকে। কেমন লাগছে এখন বড়লোক বাবার বখাটে ছেলের?”
রাইসা কথাগুলো বলেই সিয়ামকে আর কিছু বলতে না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।
সিয়াম তখন আর ঘরে না গিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায় ঘুরতে। রাগে ফাঁস ফাঁস করছে আর ড্রাইভ করছে সিয়াম।
রাইসা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে পড়তে বসেছে, পড়ার টেবিলেই মাথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে যায় সে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে কিন্তু কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা রাইসার। আর মাত্র এক মাস পরই সিয়ামের অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা কিন্তু ওর কোনো চিন্তা নেই পড়ালেখা নিয়ে, বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। রাইসার ভাবতে ইচ্ছে করছেনা সিয়ামের কথা তবুও বারংবার সিয়ামের কথায়-ই ওর ভাবনাঘরে এসে ভীর জমায়। ঘুমন্ত রাইসার চুলগুলো উড়ছে বেশ। সিয়াম রুমে প্রবেশ করেই কুকুর নিয়ে খেলায় ব্যস্ত হয়ে পরে। হুম সিয়াম আসার সময় একটা পালিত কুকুর কিনে নিয়ে আসে। কুকুরের ঘেঁউ ঘেঁউ শব্দে রাইসার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাইসা হামি দিয়ে চোখ খুলে দেখে সিয়াম বিছানায় বসে আছে আর একটা ছোট্ট ধবধবে সাদা কুকুর ওর কোলে। রাইসা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে। সিয়াম বুঝতে পেরে বলে “এই কুকুরটা আমি কিনে এনেছি। আজ থেকে এই কুকুরটা আমার সাথেই থাকবে আর ওকে কখনোই কুকুর ডাকবেনা কারণ আমি ওর নাম রেখেছি টকি। টকি বলে ডাকবে ওকে বুঝেছো।” রাইসাকে কথাগুলো বলেই মনে মনে সিয়াম হাসে আর ভাবে “তুই কালো পরিকে শায়েস্তা করার জন্যই এই কুকুরকে এনেছি আমি। এই কুকুরের মালিক বলেছে লাল রং মোটেও পছন্দ করেনা এই কুকুরটা৷ আর তুই যখনই লাল রঙয়ের কাপড় পরিধান করবি তখনই ও তোর উপর আক্রমণ করবে। তারপর আমার আজকের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে।”

“কি ভাবছেন আপনি এভাবে আনমনা হয়ে?”
রাইসার কন্ঠ কর্ণকুহর হতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে সিয়াম। সিয়াম কিছু না বলে টকিকে কোল থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই রাইসা চেয়ারের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে যায় কারণ কুকুকে ভীষণ ভয় পায় রাইসা। সিয়াম বলে কিছু করবেনা টকি তবুও রাইসা ভয়ে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের উপর। সিয়াম ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে টকি রুমের কোথাও নেই আর রাইসাও নেই। পুরো রুমে টকিকে আর রাইসাকে খুঁজে না পেয়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখে রাইসা একা একা দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে। সিয়াম রাইসার পাশে এসে জিজ্ঞেস করে টকি কোথায় তখন রাইসা বলে “টকি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।”

“মানে? কি করেছো তুমি আমার টকির সাথে?”
“কিছু করিনি শুধু কাজের ছেলেকে দিয়ে টকিকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি অনেক দূরে।”
“পাগল হয়েছো তুমি? তুমি জানো কত শখ করে কুকুর পালবো বলে কিনে এনেছি আমি।”
“আপনি কি জানেন ইসলামে কুকুর পালন করার বিধান কি?”
“জানতেও চাইনা, তুমি আমার টকিকে এনে দাও।”
“বাচ্চাদের মতো জেদ না করে কফি খেয়ে নিন। আপনার জন্য বানিয়ে এনেছি মাত্র।”
“আমার টকিকে লাগবে মানেই লাগবে। আমি টকিকে পালবো, খুব শখ আমার কুকুর পালার।”
“এতো শখ ভালো না। শুনুন ইসলাম কি বলে। শখ করে ঘরে কুকুর রাখা, মানুষের চেয়ে কুকুরের যত্ন বেশি নেওয়া, কুকুরের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা বা গবাদি পশু পাহারা অথবা শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া— কুকুর লালন-পালন করে, প্রতিদিন ওই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমাণ নেকি কমে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৭৫; তিরমিজি, হাদিস : ১৪৮৭)

অন্য হাদিসে আছে, ‘এক কিরাত হলো, উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং : ৪৬৫০)”

“সব কিছুতে তোমার এই বড় বড় লেখচার ভালো লাগেনা।”
“কিন্তু আমার বলতে ভালো লাগে।”
“তুমি মেয়েটা বড্ড বেশি বিরক্তিকর।”
কথাটা বলেই সিয়াম রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সিয়ামের উদ্দেশ্য সফল হলোনা তাই ও খুব আপসেট।

রাতে খাবার টেবিলে রাহেলা খাতুন বলেন সিয়ামের একমাত্র চাচার একমাত্র ছেলে দেশে ফিরছে আগামীকাল। ওর নাম তামিম। তামিম খুব ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়ে ফেলে আর তারপর থেকেই সে রাহেলা খাতুনের কাছে থাকতো। পরে তামিমের যখন স্কুললাইফ শেষ হয় তখন পড়ালেখা করার জন্য ওর বাবা মুশফিক রহমান ওকে লন্ডন নিয়ে যায় নিজের কাছে। তামিম লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে অফিস জয়েন্ট করেছে ইন্টার পরিক্ষা দেওয়ার পর পরই। তামিম আর ওর বাবা দুজনেই দেশে আসতেছে রাহেলা খাতুনের আমন্ত্রণে। রাহেলা খাতুন নিজের ছেলেমেয়ের থেকেও তামিমকে বেশি ভালোবাসে। রাহেলা খাতুন একটা নেক উদ্দেশ্যেই তামিমকে দেশে আসতে বলেছেন যেটা সবার অজানা। তামিমের আগমনের খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি সিয়াম। সিয়াম আর তামিম একই বয়সের তাই ওদের মধ্যে সম্পর্কটাও বেশ ভালো। ভাই থেকে বন্ধু বেশি দুজন। তবে তামিমের চরিত্র অনেক ভালো, সিয়ামের মতো বখাটে হয়নি তামিম।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১৪
#ফারজানা_আক্তার

অন্তরীক্ষে লাল হলুদের মিশ্রণ। কিছুটা ফর্সা হচ্ছে পৃথিবী। এখনো পুরোপুরি সকাল হয়নি। পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারিপাশ। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রাইসা আর রাহেলা খাতুন। ফজরের নামাজের পর রাহেলা খাতুন কিছু কথা বলবে বলে ডেকেছেন রাইসাকে। রাইসা চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে মিষ্টি সকাল উপভোগ করছে। হঠাৎ রাহেলা খাতুনের মিষ্ট কন্ঠে ঘোর কাটে রাইসার। রাহেলা খাতুন চায়ে চুমুক দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসেন তারপর রাইসাকে বলেন “বসো মা। একটু কথা বলি দুজন প্রাণ খুলে।”
মৃদু হেঁসে রাইসাও অন্য একটা চেয়ার টেনে শ্বাশুড়ির মুখোমুখি হয়ে বসে।
রাহেলা খাতুন আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলেন “তুমি জানো ওইদিন হুসনাকে আমি কেনো চাকরি দিতে নিষেধাজ্ঞা করেছি?”

“না আম্মু। কেনো আপনি হুসনাকে এভাবে মুখের উপর নাহ করে দিয়েছিলেন।”
“কারণ হুসনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটার মাঝে এক অন্যরকম মুগ্ধতা আছে।”
রাইসা শ্বাশুড়ির মতিগতি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে। রাহেলা খাতুন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলেন “গতকাল রাতে তামিম নামের কারো কথা বলেছিলাম ডাইনিংয়ে। মনে আছে তোমার?”

“জ্বি।”
“তামিম হলো আমার চতুর্থ সন্তান। সিয়াম রিয়া শাহিল যেমন আমার সন্তান ঠিক তেমনই তামিম। তবে তামিম আর সিয়ামের চরিত্রে রয়েছে অনেক তফাৎ। তামিম খুব ভালো চরিত্রের ছেলে একদম ফুলের মতো স্নিগ্ধ। তামিম খুব অল্প বয়স থেকেই সবটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, বাবার কষ্ট সব শেয়ার করে নিয়েছেন। ছেলেটা আমার থেকে দূরে থাকে, খুব চিন্তা হয় ওর জন্য আমার। ওই ভিনদেশে ওর যত্ন নেওয়ার মতো কেউই নেই। তাই আমি চাই কেউ একজনকে ওর সাথে লন্ডন পাঠাতে যাতে আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হতে পারি।”
“জ্বি আম্মু বুঝেছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু এখানে হুসনার কি কাজ? ও তো পরিবার ছেড়ে অন্যদেশে গিয়ে এমন জব করতে পারবেনা কারণ ও কিছুটা হলেও দ্বীনদার। ”
“তোমার প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। বোকামেয়ে এইটুকু বুঝতে পারলেনা? আমি চাই তামিমের সাথে হুসনার বিয়ে দিতে কারণ হুসনা অন্যরকম একটা মেয়ে। হুসনার পরিবারের সাথে ওর ভাব খুবই কম তা ওর কথাবার্তাতেই বুজতে পেরেছি। যেহেতু ওর পরিবারের সাথে ওর তেমন ভাব নেই সেহেতু ও ভিনদেশে সবাইকে ছেড়ে খুব ভালোই মুহুর্ত উপভোগ করতে পারবে যা অন্যমেয়েরা পারবেনা। আর মেয়েটা ভীষণ বুঝদার একটা মেয়ে। এবার তুমি কি বলো আমার সিদ্ধান্তে কি কোথাও ভুল আছে? তুমি এই বাড়ির বড় বউ তাই তোমার মতামতেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি আমি।”
“হুসনা আর তামিম ভাইয়া যদি রাজি থাকে তবে আমার কোনো অমত নেই বরং আমি ভীষণ খুশি আমি আর আমার বেস্টফ্রেন্ড একই পরিবারের পুত্রবধূ হবো সেটা ভেবে।”

রাইসার কথা শুনে বেশ শান্তি লাগছে রাহেলা খাতুনের। রাহেলা খাতুন রাইসাকে হুসনার সাথে কথা বলতে বলেছেন। হুসনা রাজি থাকলেই তামিমকে নিয়ে উনি হুসনাদের বাসায় যাবেন।
রাইসা চা শেষ করে এক ছুটে রিয়ার রুমে যায়। রিয়া তখন বসে বসে একটা রুমালে হাতের কাজ করছিলো, রাইসার পায়ের শব্দ শুনতেই রিয়া রুমালটা লুকিয়ে ফেলে তবুও রাইসা বুঝে ফেলে কিছুটা। রুমালে স্পেসিয়াল কারো নাম লিখেছে রিয়া তাই সে দ্রুত রুমাল বালিশের নিচে রেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসে। রাইসা হাঁসি মুখ নিয়ে রিয়ার পাশে বসে তারপর ধীরেসুস্থে ওর আর রাহেলা খাতুনের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছে সব রিয়াকে বলে। রিয়া যেনো আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পরছে এমনভাবে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে। রাইসা রিয়াকে চিমটি কেটে বলে “হুম বইন তুমি কানে যা শুনছো এতোক্ষণ সব বাস্তব। আচ্ছা শুনো নাস্তা করার জন্য ডাইনিংয়ে আসো আমি তোমার ভাইয়াকে ডেকে আসি।”

সিয়াম ব্যায়াম করতেছিলো তখন রাইসা গিয়ে বলে “আজকের জন্য এইটুকুই থাকুক। ফ্রেশ হয়ে আসুন নাস্তা করবেন।”
“এই কালো পরি তুমি কি আমাকে তোমার আঙ্গুলের ইশারায় নাচাতে চাইছো নাকি হ্যাঁ? একবার বলো নামায পড়তে একবার বলো ব্যায়াম করতে আবার বলে অনেক হয়েছে আজকের জন্য ব্যায়াম, মানে আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই?”
“অবশ্যই আছে আপনার ইচ্ছার মূল্য যদি সেই ইচ্ছেটা নেক হয়।”
“তোমার সাথে কথায় পারা যায় না।”
“পারতে হবেনা ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“আচ্ছা শুনো আজ আমি কলেজ যাবোনা তামিমকে রিসিভ করতে যাবো এয়ারপোর্ট তাই তুমি আর রিয়া ড্রাইভার কে নিয়ে যেও সাথে ”
“চিন্তা কি শুধু বোনের নাকি বউয়েরও আছে?”
দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠে রাইসা। রাইসার এমন কথা শুনে সিয়াম চোখ লাল করে তাকায় রাইসার দিকে আর দাঁত চেপে বলে “তুই কখনো শুধরানোর নয়। সবসময়ই আমাকে রাগানোর ধান্দাই থাকিস কারণ তুই ভালো করেই জানিস আমি না রাগলে তোকে ইচ্ছে করে কখনোও ছুঁয়েও দেখিনা। বুদ্ধি ভালো আছে তোর কিন্তু আজ থেকে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম, তোর এই ফাঁদে আমি আর পা রাখবোনা।”
কথাগুলো বলেই ফ্রেশ হতে চলে যায় সিয়াম। মন খারাপ করে অশ্রুসিক্ত চোখে সিয়ামের কথাগুলো ভাবতে থাকে রাইসা। কতটা কষ্ট পেলে মানুষের আঁখিতে নিজ অনিচ্ছায় অশ্রু জমে। এতোটা কষ্ট নিয়েও মেয়েটা সবার সাথে হাঁসি মুখে ডাইনিংয়ে বসে গল্প করছে আর সবার আঁড়ালে চোখের কোণের অশ্রু মুছে। সিয়াম খেয়াল করে রাইসা কিছুক্ষণ পর পর ওড়না দিয়ে চোখের কোণে ছুঁয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ করে সিয়ামের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে। মেয়েটার জন্য কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করছে হুট করে সিয়ামের মনে। এমনটা হওয়ার কারণ সিয়াম বুঝতে পারছেনা। কেনো হঠাৎ এই মেয়ের প্রতি এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে যাকে নাকি সে সহ্যই করতে পারেনা। সিয়াম আর বেশি কিছু না ভেবে দ্রুত নাস্তা সেরে রওনা দেয় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

*
ক্লাস শেষ করে রিয়া রাইসা আর হুসনা ক্যাম্পাসে বসে আছে। রাইসা শ্বাশুড়ির কথা অনুযায়ী হুসনাকে সব খোলামেলা বলে দেয়। হুসনা চিন্তা করার জন্য সময় নেয় একদিন। আগামীকাল কলেজ এসেই সে রাইসাকে ওর সিদ্ধান্ত জানাবে বলে কথা দেয়। তারপর ওরা নিজেদের গন্তব্যে রওনা হয়।
হুসনা সারা রাত জুড়ে চিন্তা করে বিষয়টা নিয়ে। বিয়েটার জন্য যদি হুসনা রাজি হয় তাহলে ওকে কখনোই আর ইমতিয়াজ হোসেন এর মুখোমুখি হতে হবেনা আর ওর পড়ালেখার খরচের জন্য এতো পরিশ্রম আর চিন্তাও করতে হবেনা এটা ভেবে হুসনা বিয়েতে রাজি হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় আবার মা বোনের চিন্তায় মতামত চেঞ্জ করে ফেলে। হুসনার ভাবনা হলো ও ভিনদেশে চলে গেলে ওর মাকে আবারও ঘর থেকে বের করে দিবে ইমতিয়াজ হোসেন। চিন্তায় ঘুম আসছেনা হুসনার। এমন সুযোগ বারবার আসবেনা এটাও ভাবছে হুসনা। হুসনা কিছুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। চিন্তায় সারা রাত আর ঘুম হয়নি হুসনার। জীবনটা ভীষন জটিলতায় ভোগছে। না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সইতে। অন্যদিকে তামিম নামটা বেশ মনে ধরেছে হুসনার।

*
সকালে নাস্তার টেবিলে তামিমকে রাহেলা খাতুন এই বিষয়ে বললে তামিম স্পষ্ট বলে দেয় “বড় আম্মু আমি ছোট থেকেই তোমাকে আপন মায়ের চোখে দেখে আসছি। আমার কাছে মায়ের মমতা মানেই তুমি। আমি জানি আমার জন্য তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমার ভালোর জন্যই নিবে। আমার আলাদা কোনো পছন্দ নেই, আমার জন্য তুমি যাকে পছন্দ করবে তাকে নিয়েই আমি সন্তুষ্ট।”
রাহেলা খাতুন খুশিতে উতলা হয়ে বলেন “আলহামদুলিল্লাহ”
সব যেনো সিয়ামের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রুমে এসে সিয়াম রাইসার কাছ থেকে জানতে চাইলে রাইসা সব খোলে বলে সিয়ামকে। সিয়াম সব শুনে বলে “তাই বলে এমন পরিবারের সাথে সম্পর্ক করতে যাবে আম্মু? আরে যে মেয়ে নিজের মা বাবার অবাধ্য সে তার স্বামীকে কতটুকু সম্মাণ করবে?”
“আপনি ওর সম্পর্কে সবকিছু না জেনে এভাবে কথা বলতে পারেননা।”
“আচ্ছা তাহলে তুমি কতটুকু জানো ওর সম্পর্কে?”
এবার রাইসা আমতাআমতা করে বলে “আসলে তেমন কিছু জানা নেই তবে এতোটুকু জানি হুসনা খুব ভালো মেয়ে। ও নিজের সম্পর্কে কখনো খোলামেলা কিছু বলেনি শুধু বলেছে ওর বাবাকে ও সহ্য করতে পারেনা, ওর মা অনেক ভালো তবুও বাবার জন্য মায়ের সাথেও তেমন একটা ভাব ওর নেই।”
“তুমি আম্মুকে বলো এই সম্পর্ক না করতে।”
“আমি কেনো বলবো? আপনার সমস্যা তাই আপনি বলুন, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
এটা বলেই রাইসা কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। সিয়াম আর কিছু না বলে চুপচাপ মাথার নিচে হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। এই মেয়ের সাথে কথা বলে কখনোই পারবেনা এসব ভাবছে সিয়াম। রাইসা তৈরি হয়ে বলে “চলুন হয়ে গেছে আমার।”
“তামিমের সাথে ঘুরবো আজ পুরো শহর, তুমি যাও রিয়ার সাথে। ”
“ঘুরাঘুরি কলেজ থেকে ফিরেও করতে পারবেন। তামিম ভাইয়া দেশেই আছে কিছুদিন। চলুন উঠুন মাথার উপর পরিক্ষা ভনভন করছে সেটা দেখছেনা কেউ।”
কথাগুলো বলেই রাইসা সিয়ামকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে আসে গাড়ির সামনে। কেনো জানিনা আজকাল এই কালোপরির প্রতি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে সিয়ামের। গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো রিয়া। রাইসাকে সিয়ামের হাত ধরে টেনে আনতে দেখে কুটকুট করে হেঁসে ফেলে রিয়া। সিয়াম লাল লাল চোখ করে রাইসার দিকে তাকিয়ে এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়। মুখ টিপে হাঁসে রাইসা।

রিয়া কলেজের গেইটে গাড়ি থেকে নিচে পা রাখতেই দেখে সেখানে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে কোনোকিছুর আলোচনা করছে মাহিন। রিয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই সেই স্থান মুহুর্তেই ত্যাগ করে মাহিন। রিয়া বুঝতে পারেনা হঠাৎ করে কেনো ছেলেটা ওকে ইগ্নোর করছে।
রাইসার ডাকে ঘোর কাটে রিয়ার। হাঁসি মুখেই রিয়ার হাত ধরে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে রাইসা।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ