শেষটা সুন্দর পর্ব-১১+১২

0
573

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১১

নির্ঝর শুকনো ঢোক গিলে তরীর বন্ধ চোখের দিকে তাকালো। মুখটা নিচু করে তরীর মুখের কাছাকাছি আনতে আচমকা তরী ধপ করে চোখ খুলল। নির্ঝরের অনুভূতি গুলো যেন থমকে গেল। সাথে থমকে গেল সে। অাবছা অন্ধকারে তার অক্ষিযুগল বড় বড় হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে নিজেকে উঁচু করে রাখা হাতদুটো ভেঙে পরতে তরীর বুকের উপর লুটিয়ে পড়লো। তৎক্ষনাৎ তরী দু হাতে ঠেলে তাকে সরিয়ে দিল। একলাফে বিছানায় উঠে বসে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

‘কি করছেন কি?’

নির্ঝর খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কথাও সাজিয়ে নিল। উঠে গিয়ে রুমের লাইট অন করে তরীর দিকে এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘তরী তুমি ঠিক আছো?’

‘ঠিক থাকবো না কেন? কি করেছেন আমাকে?’

‘ধুর! বোকা মেয়ে। আমি কি করবো? তুমি নিজেই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আচ্ছা, এই রোগটা কি তোমার বহু পুরনো? ‘

তরীর চোখে মুখে চিন্তার ক্লেশ। সে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। মিনমিন করে বলল,

‘কোন রোগের কথা বলছেন আপনি?’

‘কি রোগ সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। ঘুমের মধ্যে তোমার প্রচন্ড চিৎকারের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়।ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি তুমি ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করছো। সেজন্য আমি কোলে করে রুমে নিয়ে আসলাম। কিন্তু রুমে এনে আরেক বিপদ দেখা দিল। তোমার পালস চলছিল না। শ্বাস নিচ্ছিলে না তুমি। ‘

তরীর দু চোখে আতংক এসে ভর করলো। সে নিভু নিভু স্বরে বলল,

‘শ্বাস প্রশ্বাস চলছিল না আমার?’

‘না! সেজন্য আমি ভয়ে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের চিন্তা করলাম। বিষয়টা যদিও আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। তবুও জান বাঁচানো ফরয ভেবে করতে নিয়েছিলাম। কিন্তু…. ইট’স অ্যা মিরাকল তরী! যেইমাত্র তোমার কাছাকাছি গেলাম সেইমাত্র তুমি সুস্থ হয়ে গেলে। থাঙ্কস গড!’

তরী ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে চেয়ে আছে। তার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে ঝুলে আছে। নির্ঝর একটা হাই তুলে বলল,

‘মাঝরাতে এত নাটক কেন করছো? এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে?’

‘আপনি মিথ্যে বলছেন,তাই না?’

‘হাউ ফানি! মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? তুমি কি ভেবেছ, তোমায় চুমু খেতে নিয়েছিলাম আমি? তাও আবার লুকিয়ে?’

‘এটাই সত্য! তাই তো?’

‘হাউ ফানি! তোমায় চুমু খাওয়ার জন্য তো আমার কোনো লুকোচুরির দরকার নেই। এই সহজ বিষয়টা বুঝো না কেন তুমি?’

বলে নির্ঝর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না। তরীর মাথা চেপে ধরে ঠোঁটে স্বশব্দে চুমু খেল। তিন সেকেন্ডের ব্যবধানে তরীর ভেতর বড়সড় পরিবর্তন ঘটলো। বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেল না। তার আগেই নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বিস্ময় মিশ্রিত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিন্তু নির্ঝর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে উঠে দাঁড়ালো।

তার দিকে ভুলেও তাকাল না। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে ধীরে সুস্থে বের হয়ে গেল। সেই গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তরীর চোখ দুটো ক্রমেই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।

দরজা বাইরে থেকে ভিড়িয়ে দিয়ে একদৌঁড়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো নির্ঝর। বুকের দুই ইঞ্চি নিচে পুরোদস্তুর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আনমনে ডান হাত ঠোঁটে চলে গেল। এক্ষুণি সে কি করল? এত সাহস কোথায় পেল সে? সে দু গালে হাত রেখে টেনে টেনে শ্বাস নিল।

___________

নির্ঝর অফিস থেকে ফিরলো সন্ধ্যাবেলা। ড্রয়িং রুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল। তার মাকে দেখতে পেল। ডেকচিতে পানি বসিয়েছে। সে মায়ের আঁচলে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে ডাক দিল,

‘মা!’

তার মা নাহিদা বেগম ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

‘এতক্ষণে আসার সময় হলো?’

‘এতদিন ছুটিতে ছিলাম না! সেজন্য আজ একটু বেশি কাজ জমে ছিল।’

এর মধ্যে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। এ সময়টাতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। শুধু নির্ঝর তার অফিসে জয়েন করেছে। আর সিলেট থেকে তার ভাইসহ বাবা-মা ফিরে এসেছে। নির্ঝর এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে বলল,

‘নিনাদ কি করে মা?’

‘ড্রয়িং রুমেই তো দেখলাম একটু আগে। তরীর সাথে গল্প করছিল। হয়তো রুমে এখন। ভালো কথা! শোন! তরীর বাবা ফোন করেছিল। ওর পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বললো। বোর্ড এক্সামের বেশিদিন নেই। তোর বড় মা-ও বলল এ বিষয়ে। মেয়েটা তো গতবার ফেল করেছে। এবার তো পাস করতে হবে।নাকি?’

মায়ের কথা শুনে নির্ঝরের মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো। তরী যে গতবছর ইন্টারের বোর্ড পরীক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেইল করেছে তা সে অনেক আগে থেকে জানে। তবুও মায়ের মুখে শুনে হাসি পেল। সে বিদ্রুপ করে বলল,

‘মা, তোমার বৌমা এত বোকা কেন? সারাজীবন আমি টপ রেজাল্ট করে এসেছি। আর আমার বউ কি না কমার্স থেকে ইন্টারে তিন সাবজেক্টে ফেইল করেছে। মেনে নেয়া যায়?’

নাহিদা বেগম মুখ ঘুরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,

‘খবরদার বৌমাকে অপমান করবি না। একবার ফেইল করেছে তো কি হয়েছে? এবার ইমপ্রুভ দিবে। অনেক ভালো রেজাল্ট করবে নিশ্চয়ই! তুই শুধু গ্রাম থেকে বই আনার ব্যবস্থা কর।’

নির্ঝরের মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠলো। কত সহজে তার বাবা-মা তরীকে মেনে নিয়েছে। তার বাবা-মায়ের এমন সুন্দর মন মানসিকতার জন্যই সে অনেকটা একা একা এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সে এক পলক দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে তাকাল। তরীকে চোখে পড়ছে না। শার্টের উপরের বাটন খুলে দিয়ে সে বলল,

‘মা গো! তরীকে পড়াবে কে? আমার তো সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। কমার্সের স্টুডেন্ট কিভাবে পড়াবো?’

‘তুই পড়াবি কেন গাধা? আমি পড়াবো! আমি কমার্সের স্টুডেন্ট ছিলাম তোর মনে নেই? আমি পড়াবো ওকে! প্রয়োজনে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবো। নিনাদ যেভাবে পড়ছে, ও সেভাবেই পড়বে।যা ফ্রেশ হয়ে নে।’

‘হুঁ!’

নির্ঝর মাকে জড়িয়ে ধরে রান্নাঘর থেকে বের হলো। তার মা ঢাকার একটা প্রাইভেট হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছে দীর্ঘ দিন। সে অফিসে জয়েন করার পর থেকে মাকে আর চাকরি করতে দেয়নি।

নিজের রুমে ঢোকার আগে নির্ঝর তার ছোট ভাই নিনাদের রুমে উঁকি দিল। নিনাদ এ বছর নবম শ্রেনীতে উঠেছে। এর মস্তিষ্ক অবিকল তরীর মতো। টেনেটুনে জেএসসি পাস করেছে।

‘তুই আবার গল্পের বই হাতে নিয়েছিস?’

নির্ঝরের আচমকা আক্রমণে নিনাদ এক লাফে উঠে বসলো। হাতে ধরে রাখা ইংরেজি সাহিত্যের বইটা পেছনে লুকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,

‘হে হে! বই কোথায় দেখলে ভাইয়া? আমি তো নোটবুক পড়ছিলাম।’

‘নোটবুক? আজকাল হ্যানরি রাইডার হ্যাগার্ড নামের বিদেশি লেখকও দেখছি নোটবুক লিখে? তাও আবার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। হাউ ফানি! বইটা বের কর।’

‘থাক না ভাইয়া।’

‘এক চড় খাবি। বই দে!’

‘তুমি একটা অশান্তি ভাইয়া!’

‘বই দে আগে! তোর আর তোর ভাবীর মস্তিষ্ক ধুয়ে গোবরমুক্ত করে তারপর মাথায় পুনরায় সেট-আপ করতে হবে। ‘

নিনাদ মুখ শক্ত করে বালিশের নিচ থেকে বইটা টেনে বের করলো। তার বড় ভাইয়াকে কখনো সাহিত্যের বই পড়তে দেখেনি। মাঝে মধ্যে এস্ট্রোনমির বই হাতে দেখে এই যাঃ! নিজে না পড়ুক তাতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। তার আফসোস একটা জায়গা সেটা হলো তার ভাই তাকেও গল্পের বই পড়তে দিতে চায় না। সাহিত্যের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয় না।

বইটা নির্ঝরের হাতে তুলে দিয়ে নিচুস্বরে বলল,

‘বিয়ে করেছ এবার তো একটু সাহিত্যের বই পড়ে রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করো?’

নির্ঝরের কানে সম্পূর্ণ অংশ পৌঁছাল না। সে বইটা ছিনিয়ে হাতে নিল। বইয়ের নামটার দিকে ফিরেও তাকাল না। এক হাতে শার্টের বাটন খুলতে খুলতে রুমে ঢুকলো।

রোজকার মতো আজও তরী আয়নার সামনে বসে আছে। নির্ঝর দরজার আড়াল থেকে কিছুক্ষণ তরীর দিকে চেয়ে রইলো। তার আর তরীর সম্পর্কটা আগের মতোই আছে। সে তরীকে সময় দিচ্ছে নিজেকে গুছিয়ে তোলার। জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দেওয়ার ইনটেনশন তার মধ্যে কোনো সময়ে ছিল না। একই বিছানায় শুয়েও মাঝের কোলবালিশটা যেন যোজন যোজন দূরে রেখেছে দুজনকে!

সেই চাইলেই কোলবালিশটা সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু সরাচ্ছে না। তরীর অপেক্ষায় আছে। যেদিন তরীর চোখের দৃষ্টি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হবে, তরীর মনে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে সেদিন তরী নিজে থেকে কোলবালিশ সরিয়ে তার কাছে আসবে। সেদিনের অপেক্ষা!

একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। হাতের বইটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলল,

‘সবসময় আয়নার সামনে বসে থেকে কি হবে? পড়াশোনার নাম গন্ধ নেই? তোমার উপর থেকে যে স্টুডেন্ট তকমাটা এখনো যায়নি তা কি বেমালুম ভুলে গেছো?’

তরী কিছুটা চমকে উঠলো। সত্যি তো! সে তো এখনো পড়াশোনা করছে। কিন্তু এটা ভেবেছিল যে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই আর পড়তে হবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের উন্মুক্ত বুকের কিছু অংশ নজরে পরতে চোখ সরিয়ে নিল। অ্য দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমাকে এখনো পড়তে হবে? মানে বিয়ের পরো?’

‘কেন? তুমি বিয়ের পর পতি সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছ যে বিয়ের পর পড়তে পারবে না? হাউ ফানি!’

‘দেখুন, কথায় কথায় হাউ ফানি, হাউ ফানি করবেন না! সবজায়গা মানায় না।’

‘ওটা আমার মুদ্রাদোষ। এখন কাজের কথায় আসো। গ্রাম থেকে বই খাতাপত্র আনার ব্যবস্থা করছি। দু একদিনের মধ্যে পড়াশোনা শুরু করবে। এবার ফেইল করলে কিন্তু ডিভোর্স দিয়ে দিব।’

নির্ঝর কপাল কুঁচকে তরীর দিকে তাকালো। তরীর মুখের উজ্জ্বলতা তার চোখ এড়াল না। তরীর সেই মুখোভঙ্গি লক্ষ্য করে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। হালকা করে তরীর সদ্য বিনুনি করা চুল টেনে ধরে কাছে নিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে টেনে টেনে বলল,

‘তারপর তৃতীয় বারের মতো আবার আমিই বিয়ে করবো।’

(চলবে)

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১২

হালকা করে তরীর সদ্য বিনুনি করা চুল টেনে ধরে তাকে কাছে নিয়ে এলো নির্ঝর। চোখে চোখ রেখে টেনে টেনে বলল,

‘তারপর তৃতীয় বারের মতো আবার আমিই বিয়ে করবো!’

‘তৃতীয় বারের মতো কবুল বলার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে বসে আছি!’

তরীর ব্যঙ্গাত্মক কথার ভঙ্গি কানে যেতে নির্ঝর এক হাতে তার কোমড় চেপে ধরে আরো একটু কাছে নিয়ে এলো। চোখ সরু করে বলল,

‘হাউ ফানি! কবুল বলবে না মানে? তুমিসহ তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে কবুল বলানোর ক্ষমতা এই নির্ঝর শাহরিয়ার রাখে। তরীরানি, তুমি এখনো আমাকে চিনলে না। সো স্যাড!’

‘ছাড়ুন! আপনার গা দিয়ে গন্ধ।’

‘গন্ধ?’

নির্ঝর নিজের শার্ট একবার শুঁকে তরীর গলার কাছে মুখ নিয়ে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। তরী জমে পাথর হয়ে গেল। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নির্ঝরের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইল। নির্ঝর উল্টো হাতটা এক হাতে বুকে চেপে ধরে বলল,

‘তোমার গায়ের গন্ধ থেকে বেশি নয়। তুমি যে টানা সাতদিন শাওয়ার নাও না!’

‘ছি! কি মিথ্যুক আপনি। একবার শুধু দুইদিন গোসল করেছিলাম না। আর আপনি সাতদিন বানিয়ে দিলেন?’

‘জোর না করলে তো আরামসে সাতদিন হয়ে যেতো।’

‘এই ছাড়ুন তো আপনি!’

তরীর অস্থিরতায় ডুবে থাকা মুখের দিকে পলকহীন চোখে নির্ঝর চেয়ে রইলো। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ধরে রেখে বাম হাতটা উঁচু করে তরীর মুখে হালকা করে ছুঁয়ে দিল। তার স্পর্শ পেতে তরী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে বুকের কাছের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। নির্ঝর মুচকি হেসে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে তাকে ছেড়ে দিল। ঠোঁট সরু করে শব্দ সৃষ্টি করতে করতে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড খুঁজো ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

নির্ঝর ওয়াশরুমে ঢুকতে তরী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। নিজের বোকামিতে গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল। কি বজ্জাত ছেলে। তার মাথার সব নতুন অনুভূতি ছাপিয়ে একটা শব্দই ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো ছেলেটা আস্তো একটা বদের হাড্ডি।

তার ভাবনার সুতোয় টান পড়লো নির্ঝরের কন্ঠে।ঝরঝরে গলায় ওয়াশরুম থেকে বলা শুরু করেছে,

‘তরী, কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো তো। সুগার কম, মিষ্টি বেশি!’

‘সাথে এক চামচ গাঁজা মিশিয়ে দিস তরী।’

বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে শোনাল তরী। শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বের হলো।

ভেজা চুলে বার কয়েক নাড়া দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো নির্ঝর। আড়চোখে রুমে নজর বুলিয়ে দেখলো তরী নেই। হাতের টাওয়ালটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে সেন্টার টেবিল থেকে চাপের কাপ হাতে তুলে নিল। বেলকনির দিকে তাকিয়ে তাতে একটা চুমুক দিল।

আবছা অন্ধকারে বেলকনির কাচ মাড়িয়ে তরীর জাম রঙের শাড়ি নজরে এলো তার। হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচল দোল খাচ্ছে। চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিয়ে সে বেলকনির দিকে পা বাড়াল।

তরীর পেছনে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নির্ঝর। তরী আজও টের পেল না। হয়তো গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। এই মেয়ে যে কোনো কিছু ভাবতে বসলে দিন দুনিয়া ভুলে যায় তা অজানা নয়। সে পাশ কাটিয়ে তরীর কানের কাছে ফু দিল। তরী দ্রুত ঘাড় ঘুড়িয়ে নির্ঝরকে দেখে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। তার নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে। নির্ঝরের কাছে তার দূর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। তাকে কিছুতেই কাবু হওয়া যাবে না। দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ করে সে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালো।

ওপাশে এতক্ষণে গাঢ় ছায়া নেমে গেছে। সূর্য তার সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবন গুটিয়ে নিয়ে আকাশের বুকে তলিয়ে গেছে। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে রাতের ঢাকা। সেই অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে পরপর কয়েক চুমুক দিয়ে নির্ঝর চায়ের কাপ খালি করলো। তরীর দিকে শূন্য পেয়ালা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘কাপটা ধরো।’

তরী অন্য মনস্ক হয়ে চায়ের কাপ ধরতে সেটা ঠাস করে হাত থেকে পড়ে গেল। বিকট একটা শব্দ হয়ে সেটা মুহূর্তে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তরী চমকে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালো। ভয়ার্ত চোখ জোড়া পালানোর পথ খুঁজছে যেন। নির্ঝর থমথমে মুখে এগিয়ে আসতে তরী প্রচন্ড ভয় পেয়ে বলল,

‘দুঃখীত। মাফ করবেন। আমি খেয়ালে ছিলাম না।’

নির্ঝরের উত্তরের অপেক্ষা না করে তরী দ্রুত নিচু হয়ে বসে পড়লো। কাপের ভাঙ্গা টুকরোয় হাত রাখার আগেই নির্ঝরের তার হাত ধরে ফেলল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘শুধু শুধু মাফ করতে যাব কেন? আমি বার বার এত মহান হতে পারবো না। ভুল করেছ এর শাস্তি পাবে।’

‘কি? সামান্য একটা কাপ ভাঙার জন্য আমায় শাস্তি দিবেন?’

‘হাউ ফানি! কেন দিবো না? আজ কাপ ভাঙবে, কাল প্লেট ভাঙবে, পরশু ড্রেসিং টেবিল ভাঙবে, তরশু আমার মন ভেঙে অন্য আশিকের সাথে চলে যাবে! তা তো হতে দেয়া যায় না।’

‘আপনি এমন ভাবে বলছেন যেন ইচ্ছেকৃত ভাবে কাপ ভেঙেছি!’

‘ইচ্ছা অনিচ্ছা দিয়ে আমার আসে বা যায় না। তুমি কাপ ভেঙেছো। শাস্তি স্বরূপ আমার রাতের খাবারটা রুমে নিয়ে আসবে এবং আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিবে।’

তরী চোখ উল্টে নির্ঝরের দিকে তাকালো। তার ক্রুদ্ধ নয়ন জানিয়ে দিচ্ছে যে শাস্তিটা তার পছন্দ হয়নি। নির্ঝর তার হাত ছেড়ে দিতে সে হনহনিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে গেল। সে চলে যেতে নির্ঝর মুচকি হেসে কাপের ভাঙা টুকরো গুলো একত্রে করলো। সাবধানে উঠিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলল।

___________

‘নিন, হা করুন! এতোবড় ধামড়া ছেলেকে নাকি তুলে খাওয়াতে হবে! বলি হাতের আঙুল কি খসে পড়েছে? ভাতের দানা ধরতে পারছেন না?’

নির্ঝর আধ শোয়া থেকে সটান বসে পড়লো। তরীর বিরক্তিতে ভরপুর মুখের দিকে চেয়ে কাঠ গলায় বলল,

‘এই তুমি এভাবে বলছো কেন? তোমার সাহস দেখছি তো আলোর সমবেগে বেড়ে চলেছে।’

‘নিন এবার বড় করে হা করুন।’

নির্ঝর তরীর গাল টিপে ধরে বলল,

‘এভাবে হেসে হেসে কথা বলবে আমার সাথে ডিঙিরানি! মনে থাকবে?’

তরী মাথা পেছন দিকে নিতে নির্ঝর হাত সরিয়ে নিল। এক পলক প্লেটের দিকে চেয়ে যুতসই বসে পড়লো। দুহাতের তালু একত্রে করে ঘঁষতে ঘঁষতে বলল,

‘তুমি খেয়েছ?’

‘খেতে দিলেন কই? এমন তালগাছকে তুলে খাওয়ানোর হুকুম পড়েছে আমার উপর! ভাত কি গলা দিয়ে নামবে?’

‘আশ্চর্য, এমন ভাবে বলছো কেন তুমি? এতটা রিয়েক্ট করছো যেন তোমার হাতে না খেলে আমি মরে যাব! জীবনে হাত ধুয়েছ ভালো করে? তোমার অপরিষ্কার হাতে খেয়ে নিশ্চিত আমার ডায়রিয়া হবে। নেহায়েত আমি পাতলা পায়খানা বানিয়ে কয়েকদিন অফিসের ছুটি কাটাতে চাচ্ছি বলে তোমার হাতে খাওয়া।’

‘ছি! খাবার সামনে নিয়ে কি ধরনের কথাবার্তা?’

‘তুমিই তো শুরু করলে!’

‘কি? আমি কখন শুরু করলাম?’

‘শুরু করোনি? এবার তাহলে শুরু করো। ভাতের লোকমা মুখে দাও!’

নির্ঝর হাঁ করতে তরী ছোট করে ভাতের লোকমা মুখে পুড়ে দিল। নির্ঝর বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে স্ক্রল করা শুরু করলো। সে বেশ আয়েস নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এদিকে তরীর খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। কাউকে খাইয়ে দিয়ে অভ্যাস নেই। নির্ঝরের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সময় প্রতিবার মুখের চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল নির্ঝর হয়তো ধমক দিবে সেজন্য। কিন্তু নাহ! প্রতিবার মুখে খাবার নেওয়ার পর নিজেই টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে ফেলছে।

কয়েক লোকমা খাওয়ার পর নির্ঝর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল,

‘ডিঙি, এখান থেকেই খেয়ে নিতে পারো। তোমার মতো পাষাণ নই আমি! তাছাড়া এত ভাত একা খেতে পারবো না আমি।’

‘চুপচাপ খেতে থাকুন। নইলে তুলে আছাড় দিবো!’

শেষের বাক্যটি ক্ষীণ স্বরে বলল তরী। নির্ঝরের কানে কানে পুরোপুরি পৌঁছাল না। সে মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,

‘আছাড় টাইপ কিছু বলছিলে মনে হয়?’

‘তেমন কিছু না। নিজেকে! নিজেকে আছাড় দেওয়ার কথা বলছিলাম।’

‘তুমি না পারলে আমায় হুকুম করতে পারো। আছাড় দিয়ে দিবো।’

তরী আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ নির্ঝরের মুখে খাবার তুলে দিল। আরো কয়েক লোকমা খেয়ে নির্ঝর হাত দিয়ে ইশারা করে না করলো। সে আর জোর করলো না। প্লেটটা নামিয়ে রেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। নরম সুরে বলল,

‘বলছিলাম কি? অনেকদিন তো হলো। একবার সিলেট থেকে ঘুরে আসলে হয় না? বাবা-মাকে অনেক দিন হলো দেখি না। আমার ছোট ভাইটাকেও দেখি না!’

নির্ঝর পানি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তরীর মুখোভঙ্গি লক্ষ্য করলো। বড় মায়ের সাথে কথা বলে রেখেছে সে। তরীকে এখনি গ্রামে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পুরনো ভূত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া আশিকও নতুন করে বিপদ ডেকে আনতে পারে। পানির গ্লাস নামিয়ে রেখে বলল,

‘আগামীকাল বড় মাসহ তোমার বাবা-মা, ভাই সবাই ঢাকা আসছে। তোমাকে দেখার জন্য। এদের ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে চাও? যাকে দেখতে চাইবে তাকেই তোমার চোখের সামনে হাজির করবো। শুধু তোমার দুই মাস সাতাশ দিনের ভালোবাসার আশিক ছাড়া।’

‘কথায় কথায় আমার আশিক আমার আশিক করবেন না। দিনের মধ্যে যতবার আশিকের নাম নেন, মনে হয় আশিকের সাথে দুই মাস সাতাশ দিন আমি নয়, আপনি প্রেম করেছেন।’

‘আমার রুচি এত থার্ডক্লাস না!’

তরী কথার পিঠে কথা খুঁজে পেল না। আপতত তার মন ভালো হয়ে গেছে এটা ভেবে যে সবাই আগামীকাল ঢাকা আসছে। সে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওষুধপত্রের ব্যাগটা নির্ঝরের পাশে রাখলো। গ্লাসে নতুন করে পানি ঢেলে দিয়ে প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা গিয়ে আবার থেমে গেল। নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হেসে বলল,

‘আপনার বাবা-মা এত ভালো মানুষ কেন?’

‘দেখতে হবে না বাবা-মা টা কার? এখন চটজলদি ডিনার শেষ করে রুমে আসো তো। আমার মাথা ব্যথা করছে। চুল টেনে দিবে। আগামীকাল একবার ডক্টরের কাছে গিয়ে মাথার সেলাই খুঁলতে হবে।’

তরী দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,

‘আপনাকে নিশ্চিত ছোটবেলায় কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল।’

(চলবে)