শেষটা সুন্দর পর্ব-১৩+১৪

0
553

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৩

সোফায় বই, খাতা গুছিয়ে রেখে তরী লম্বা একটা হাই তুলল। প্রচুর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ড্রয়িং রুমের সদর দরজার উপরে রাখা দেয়ালঘড়ির দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলো সে। রাত বারোটার বেশি বাজে! এত রাত হয়ে গেছে? এক লাফে উঠে রুমের দিকে পা বাড়াল সে।

ডিনারের পর থেকে সে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে পড়াশোনা করেছে। মাঝে আধ ঘন্টার মতো টেলিভিশন দেখেছিল দুজন। তারপর শ্বাশুড়ি মা পড়া দিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোই সে এতক্ষণ ভর বিড়বিড় করে মুখস্থ করছিল। তার বিয়ের সময় সীমা দুই মাসের কাছাকাছি। অথচ মনে হয় না এতদিন হয়ে গেছে। মনে হয়, এইতো সেদিন রাত্রের কথা!

এই দেড় মাসে সে একবারও গ্রামে যায়নি। দুবার তার বাবা-মা, ভাই বেড়াতে এসেছিল। দু’বার ফুপা-ফুপি এসেছিল। তাছাড়া রোজ সবার সাথে ফোনে কথা হয়। সত্যি বলতে সে গ্রামকে ততটা মিস করে না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, দুপুরের দিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে পড়া দেওয়া, সন্ধ্যার সময় উঁকিঝুঁকি মেরে নির্ঝরের অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা করা, নিনাদের সাথে অবসরে লুডু খেলা, আবার রাতের বেলা পড়া শেষ করে ঘুমানো তার নিত্য রুটিন।

রাতের পড়াটুকু সে নিজের রুমে বসে শেষ করে। নির্ঝরের হুকুম এটা! সে যতক্ষন বাসায় থাকবে তার সামনে বসে পড়তে হবে। ব্যাপারটা তার জন্য ভীষণ লজ্জাকর। প্রতিবার নির্ঝরের চোখে চোখ পড়তে লজ্জায় চুপসে যায় সে!

কিছুটা ভয়ে ভয়ে তরী ভেড়ানো দরজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ডিনার শেষে নির্ঝর রুমে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল। অথচ সে কিছুটা ইচ্ছে কৃতভাবে দেরি করেছে। নির্ঝরের সামনে না পড়ে ড্রয়িং রুমে পড়তে বসেছিল।

দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তরী। নির্ঝরকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে। লাইট অন রেখেই বিছানার দিকে এগিয়ে এলো সে।

নির্ঝর ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কেমন নিস্তব্ধতার সুর তুলে যাচ্ছে। তরী নিচু হয়ে নির্ঝরের আঘাতের জায়গাটা পরখ করলো। ক্ষত সেরে গেছে। সেলাই দেওয়ার সময় এখান থেকে কিছু চুল কেটে ফেলা হয়েছিল। সেগুলো আবার বড় হয়ে যাচ্ছে। সে সরে দাঁড়াল। বিছানা ঘুরে নিজের জায়গা এসে শুয়ে পড়লো। প্রায় তার সমান কোলবালিশটা নির্ঝর আগে থেকে মাঝখানে দিয়ে রেখেছে।

নিজের জায়গা উবু হয়ে শুয়ে সে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো। কি অদ্ভুত মেয়েদের জীবন। সে যে এতগুলো দিন হলো সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাসায়, অপরিচিত মানুষদের সাথে রয়েছে তবুও বাবা-মা কত নিশ্চিন্তে রয়েছে। সর্বোপরি সে অপরিচিত একটা ছেলের সাথে এক রুমে, এক বিছানায়!

কোলবালিশের উপর দিয়ে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গেল তরী। ঘুমের মধ্যে কি সুন্দর লাগে ছেলেটাকে! এত সুদর্শন একটা ছেলে তার বর ভেবে মাঝে মধ্যে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। সে কিছুদিন হলো লক্ষ্য করেছে, একমাত্র এই মানুষটার কথা মনে হলে তার বুক ধুকপুক করে, ঠোঁটের কোণে লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠে। শরীরে অন্য রকম শিহরণ বয়ে যায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না এই মানুষটা তাকে পছন্দ করে কিনা! বা আদৌ ভালোবাসে কি না। সবসময় কেমন ধমকের মধ্যে রাখে। অথচ ফুপি বলেছে, একেক জনের ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ একেক রকম। তাই বলে ধমকে ধমকে কেউ কারো ভালোবাসা প্রকাশ করে?

ডান হাতটা বাড়িয়ে তরী নির্ঝরের গাল স্পর্শ করলো। এই মানুষটার একটুখানি স্পর্শে তার ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। রাতের বেলা পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে যতবার নির্ঝরের আঙুলে আঙুল রাখে, ভুলবশত হাতে ছোঁয়া লাগে বা খাতা দেওয়া নেওয়ার সময় হালকা ছুঁয়ে দেয় তখন তার ভেতরে উলোট পালোট হয়ে যায়। হৃদপিণ্ড যেন বুক চিঁড়ে বের হয়ে আসতে চায়। কতটা কষ্টে নিজেকে আড়ালে রাখে তা একমাত্র সেই জানে!

নির্ঝরের মুখের সর্বত্র হালকা করে ছুঁয়ে দিয়ে চিবুকের কাছে এসে তরীর হাতটা থেমে গেল। সামান্য ঝুঁকে নির্ঝরের আরো একটু কাছাকাছি গেল। প্রায় ফিসফিস করে বলল,

‘আপনি এত অমানুষ কেন নির্ঝর শাহরিয়ার? কবে মানুষ হবেন আপনি?’

আচমকা তরীর হাতের উপর নির্ঝর বাম হাত রাখলো। তরীর পিলে চমকে উঠলো। নির্ঝরের দিকে চেয়ে দেখলো চোখ বন্ধ। ঘুমজড়ানো কন্ঠে নির্ঝর বলল,

‘হাউ ফানি! এতগুলো বছর তো মানুষ ছিলাম আমি। আর মানুষ হতে চাই না। এবার বাবা হতে চাই!’

নির্ঝরের শেষের বাক্যটি কানে যেতে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল তরী। মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের করলো। সেটা হলো,

‘ছি!’

নির্ঝরের হাতের তলা থেকে ডান হাতটা একটানে সরিয়ে নিল। ঝটপট নিজের জায়গা শুয়ে কম্বল টেনে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে ফেলল। কি অসভ্য মানুষ!

কিছু মুহূর্ত কেটে গেল। কিন্তু ওপাশ একদম নিশ্চুপ। তরীর কপাল কুঁচকে গেল। নির্ঝর কি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাবা হবে? সে একটানে মুখের উপর থেকে কম্বল সরালো। মাথা উঁচু করে নির্ঝরের দিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নির্ঝর আগের মতো নির্বিকার ভাবে ঘুমাচ্ছে। তবে কি এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কথা বলল? হয়তো!

ধপাস করে আবার নিজের জায়গা শুয়ে পড়লো তরী। বিড়বিড় করে নির্ঝরকে বকাঝকা করতে করতে চোখ বন্ধ করলো।

____________

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তরীকে ডাকলো নির্ঝর। এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তরী। মাথার ভেজা চুল গুলো মুছে সে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। তরী বাচ্চাদের মতো পা ভাঁজ করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। তরীর ঘুমানোর প্রতিটি ভঙ্গি নির্ঝরের মুখস্থ, কতক্ষণ পর পর তরী কাত ঘুরে, ঘুমের মধ্যে কতবার নড়াচড়া করে সব মুখস্থ তার। বিগত দিনগুলোতে রাত জেগে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এসবই দেখে গেছে। তরী যেন তার এক হাত দূরে স্বযত্নে সাজিয়ে রাখা কোনো ফুলের বাগান। যে বাগান শুধু দেখার অধিকার আছে, ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। অধিকার নেই ভালোবেসে বুক পাঁজরে পিষে ফেলার!

‘তরী? এই তরী?’

ক্ষীণ স্বরে ডাকলো নির্ঝর। তার ডাকে কপাল কুঁচকে গেল তরীর। কিন্তু কোনো নড়চড় করলো না। তরীর গায়ের কম্বলটা হালকা করে টান দিয়ে নির্ঝর আবার ডাকলো। তরী বিরক্তি নিয়ে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

‘ঘুমাতে দিন তো! রাতে ঘুম হয়নি।’

‘তরী উঠে পড়তে বসো।’

‘পারবো না!’

‘তরী, উঠে পরো। চড় খাবে কিন্তু!’

তরী পিটপিট করে চোখ খুলল। আবার বন্ধ করে ভালো মতো নিজেকে কম্বলে পেঁচিয়ে ফেলল। টেনে টেনে বলল,

‘আপনি এমন করেন কেন? একটু তো ঘুমাচ্ছিই! আপনার মাথার উপর উঠে তো আর নাচছি না!’

‘মাথার উপর উঠে নাচতে চাইলে নাচতে পারো। কিন্তু ঘুমাতে পারবে না।’

‘চুপচাপ সরে যান তো। প্লিজ!’

নির্ঝর একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তরীর বোর্ড পরীক্ষা দোরগোড়ায়। বেশিদিন নেই আর! গতবারের মতো এবার ফেইল করলে তো অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে। তাছাড়া এবার তার মা অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়াচ্ছে। সেও ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরার পর আবার তরীকে সময় দিচ্ছে, জোরজবরদস্তি করে পড়াচ্ছে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।

মাথার ভেজা চুলে আরেকবার ঝাড়া দিয়ে তরীর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়লো নির্ঝর। শীতল হাত দিয়ে তরীর চিবুক স্পর্শ করতে একলাফে উঠে বসলো তরী! চমকে বলল,

‘কি হয়েছে?’

‘কিছু হওয়ার আশা রাখো?’

তরী কপাল কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের স্নিগ্ধ চেহারার দিকে চোখ পড়তে কুঁচকানো কপাল প্রসারিত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। চোখে এসে ভর করলো একরাশ মুগ্ধতা। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

‘ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসো। সকালবেলার পড়া স্মরণে থাকে।’

নির্ঝরের কন্ঠে সংবিৎ ফিরে পায় তরী। ঘোর কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরে ওড়না খুঁজতে। দিন বিশেক হলো সে শাড়ি পরা বাদ রেখেছে। শ্বাশুড়ির কথায় থ্রি পিস পরে। নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়েছে। বালিশের তলা থেকে ওড়না টেনে বের করে গায়ে জড়ালো তরী। হতাশ সুরে বলল,

‘রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম আমি।’

তরীর ঘুমজড়ানো প্রতিটি কথা নির্ঝরের বুকে গিয়ে বিঁধছে। কেমন মাতাল করা কন্ঠ। কাছে ডাকার অস্পষ্ট আহবান। কেমন সম্মোহিত সে কন্ঠ। নির্ঝর দ্রুত তরীর সামন থেকে সরে গেল। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আলমারির থেকে বেছে বেছে ড্রেস বের করে শক্ত গলায় বলল,

‘পড়াশোনার ব্যাপারে নো গাফিলতি। টপ রেজাল্ট করতে হবে তোমায়। মাথায় ঢুকিয়ে নাও! নিজের মাস্টার্সের পড়াশোনা বাদ দিয়ে তোমার পেছনে এমনি এমনি সময় নষ্ট করছি না কিন্তু! ফেইল করলে হাড়গোড় ভেঙে ফেলবো।’

‘সময় নষ্ট করতে বলেছে কে আপনাকে? খোঁচা মেরে কথা না বলে থাকতে পারেন না আপনি? বেহায়া মানুষ!’

তরী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সেদিকে তাকিয়ে নির্ঝর ছোট্ট করে শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করলো। কিছুদিন যাবত সে খেয়াল করছে তরীর চোখ দুটো অন্য কিছু বলতে চায় তাকে। হাবভাব কেমন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। সে কিছুতেই তরীর মন অন্য দিকে যেতে দিতে পারে না। কিছুদিন পর পরীক্ষা। এখন নতুন কোনো অনুভূতির সাথে পরিচয় ঘটানোর উপযুক্ত সময় নয়। তরীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তাকে। না হলে যখন তখন অঘটন ঘটে যাবে।

তরী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো নির্ঝর ফর্মাল ড্রেস আপে অফিসের জন্য রেডি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এখন চুলে ব্রাশ করছে। ভেজা পাপড়ি মেলে আড়চোখে সে নির্ঝরের প্রতিটি কাজ সূক্ষ্ণ ভাবে পরখ করলো। রাগ পড়ে গিয়ে ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

তার চাহনিরত অবস্থায় হঠাৎ করে নির্ঝর পেছন ঘুরে তাকালো। তরীর চোখ দুটো স্ফিত হলো। সে চোখ সরানোর অবকাশ পেল না। নির্ঝর হালকা পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। শার্টের হাতের বাটনটা লাগিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রসন্ন হেসে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘কিছু বলবে তরী?’

তরীর গলা শুকিয়ে এলো। এক মন বললো, সামনের এই সুদর্শণ পুরুষটিকে তাের অনেককিছু বলার আছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরেক মন প্রতিবাদ করে উঠলো, কিচ্ছু বলার নেই। মুখ খুলবি তো ধরা পড়ে যাবি। চিরদিনের জন্য!

দ্বিতীয় মনের গতিবিধি অনুসরণ করে তরী মুখ খুলল না।শুধু মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে বুঝালো তার কিছু বলার নেই। তার চোখ আটকে গেল নির্ঝরের ভরাট ঠোঁটে। ঠোঁটের কোণে সবসময় স্মিত হাসি ঝুলে থাকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্ঝরের হাসি বিস্তৃত হলো। চট করে নিজের ডান হাতটা তরীর মাথা স্পর্শ করলো।

বার কয়েক মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘মন দিয়ে পড়ালেখা করবে সারাদিন। সময় মতো খাবার খেয়ে নিয়ো। আমি সন্ধ্যায় ফিরবো। আসি!’

তরীর উত্তরের অপেক্ষা না করে নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াল। সেন্টার টেবিল থেকে ফাইলটা হাতে তুলে আরেক পলক আয়নায় নিজেকে দেখে শব্দ হীন পদধ্বনি তুলে দরজার দিকে এগিয়ে চলল।

তরীর বুকের ভেতর কোথায় যেন জ্বলেপুড়ে গেল। চোখের মণিতে পানির অস্তিত্ব টের পেল। ইচ্ছে করলো এক দৌঁড়ে গিয়ে নির্ঝরকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরতে। সে কি দৌঁড়াবে? মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে বলবে, আপনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন না আমি বড্ড অভাববোধ করি আপনার? আপনি আশপাশে থাকলে, কাছাকাছি আসলে নাম না জানা হাজারো অনুভূতিতে ভেসে যাই আমি? এমন কেন হয় আমার?

(চলবে)

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।🧡

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৪

ভেড়ানো দরজার পাল্লায় হাত দেওয়ার আগেই নির্ঝরের কানে ধুপধাপ পা ফেলার শব্দ এলো। অদৃশ্য দৃষ্টি দিয়ে সে যেন পেছনের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ দেখতে পেল। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার। দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত সামনে সটান করে অস্ফুটস্বরে বলল,

‘স্টপ দেয়ার!’

নির্ঝরের এক হাত সামনে এসে তরী দাঁড়িয়ে পড়লো। অদ্ভুত কোমল দৃষ্টিতে নির্ঝরের বাড়িয়ে রাখা হাতের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। নির্ঝর হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,

‘লাফালাফি করছো কেন?’

তরীর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। সে যে নির্ঝরকে একটু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তা কি নির্ঝর বুঝে গেছে? বুঝতে পারলে বাঁধা দিচ্ছে কেন? এর একটাই উত্তর। নির্ঝর তাকে ভালোবাসে না। এই অমোঘ সত্যিটা আবিষ্কার করতে পেরে মুহূর্তে তার ভেতরটা বিষাদে ভরে গেল।

দৃষ্টি নত করে বলল,

‘আপনি যান।’

‘আমি এমনিতে যাবো। কিন্তু তুমি ঠান্ডা মাথায় শুনে নাও, আমি যাওয়ার পর নাস্তা করে মনোযোগ দিয়ে দিয়ে পড়তে বসবে।’

তরী শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো। গলার স্বরে কাঠিন্য ঢেলে বলল,

‘ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।’

‘ভাবতে হবে না মানে? আমি যাওয়ার পর আবার লাফালাফি করবে তা তো হতে দেয়া যায় না। তরী, কান খুলে শুনে রাখো। তোমায় ভালো একটা রেজাল্ট করতে হবে। না হলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। ‘

‘আপনি কি আমার রেজাল্ট ধুয়ে পানি খাবেন?’

‘রেজাল্ট ধুয়ে যদি পানি বের হয়, তাহলে আমি সেই পানিও খাবো। কিন্তু তোমাকে রেজাল্ট ভালো করতে হবে মানে করতে হবে!’

নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াল। দরজার ছিটকিনির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ গলার স্বর উঁচু করে বলল,

‘তোমার ন্যুনতম সেন্সটুকু নেই তরী? আমি ঢাকার পাবলিক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সাথে ফরেন অ্যাম্বাসিতে জব করছি। আর তুমি এখন পর্যন্ত কলেজ পাস করে উঠতে পারোনি। বুঝো না তুমি আমাদের মধ্যকার গ্যাপটা?’

এতক্ষণে তরীর চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘আপনার পা ধরে ঝুলে পড়েছিলাম যে আমায় বিয়ে করুন?’

‘নাহ! ওটা করোনি তুমি। ওই একটা জায়গা আমার উইক পয়েন্ট। ভেবেছিলাম তোমায় পড়াশোনা শিখিয়ে আমাদের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলবো। কিন্তু তুমি তো তুমিই!’

নির্ঝর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। দরজা সরিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল।

নির্ঝর বের হয়ে যেতেই তরী রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। ফ্লোরে বসে কিছুক্ষণ অঝোর ধারায় কান্না করলো। ভেবেছিল, কোথায় এখন একটু ঘর সংসার করবে! কিন্তু নির্ঝর তো তাকে খোঁটা দিয়ে গেল। সে যে পড়াশোনায়, সবদিক দিয়ে তার থেকে অনেক পিছিয়ে তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। অপমানে তরীর কান্না দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘শয়তান, জাহান্নামী ছেলে! ইন্টারে তোর থেকে ভালো রেজাল্ট না করলে আমি জীবনে ভাত খাব না!’

_____________

অফিস শেষে নির্ঝর বাসায় ফিরলো না। ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। মন ভালো নেই তার! সকালবেলা একটু বেশিই রুডলি ব্যবহার করা হয়েছে তরীর সাথে। তরীর কাছে পার্সোনাল ফোনও দেয়নি যার সাহায্যে খোঁজ নিবে। সকাল থেকে তার মাথার মধ্যে সারাক্ষণ একটা জিনিস ঘুরছে, তরী ঠিক আছে তো? একটা সেকেন্ডের জন্য মেয়েটার ভাবনা থেকে মুক্তি মেলে না!

সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগে। চারিদিকে রঙ বেরঙের আলো জ্বলে উঠেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। সাথে ভ্যাপসা গরম। নির্ঝর শার্টের ইন খুলে ফেলল। হাতা ফোল্ড করে বুকের কাছে দুটো বাটন খুলে দিল। মাথার চুলগুলো একবার নেড়েচেড়ে আবার হাঁটায় মনোযোগ দিল।

হেঁটে অফিস থেকে একটু দূরের কফিশপে ঢুকলো সে। ক্লান্ত শরীর ও মন! দুটোই একটু সামলে নেওয়া দরকার। সামনের কয়েক টেবিল অতিক্রম করতে কর্ণারের দিকে একটা টেবিলে চোখ গেল তার। মোটামুটি স্বাস্থ্যের একটা মেয়ে বসে আছে। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বের হতে হবে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোতে মেয়েলি একটা সুর তার নাম ধরে ডেকে উঠলো। চোখ বন্ধ করে মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। জোরপূর্বক গম্ভীর মুখে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল।

মেয়েটি অত্যন্ত খুশি হয়ে হাত নেড়ে বলল,

‘হাই নির্ঝর! হোয়াট অা প্লেসেন্ট সারপ্রাইজ!’

নির্ঝর তেমন আগ্রহ পেল না। মেয়েটি তার অফিসে কাজ করে। টিকেট ম্যানেজিং অফিসার! একটু গায়ে পড়া স্বভাবের! একটু নয়, অনেক বেশি। এই যে আকস্মিক দেখা হওয়ার মতো বিব্রত অবস্থাটা মেয়েটির জন্য প্লেসেন্ট সারপ্রাইজ হলেও তার জন্য সেটা মোটেও প্লেসেন্ট না! চেয়ার টেনে বসে পড়লো নির্ঝর। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘হ্যালো মিস……. ‘

‘তাসপিয়া! তাসপিয়া নাম আমার। ভুলে গেছেন?’

‘মনে রাখিনি কোনোদিন। ভোলার প্রশ্নই আসে না!’

নির্ঝরের গা ছাড়া কথায় তাসপিয়ার মুখ কালো হয়ে গেল। নির্ঝরের এমন আচরণের সাথে পূর্ব পরিচিত বলে তেমন গায়ে মাখলো না। কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,

‘কিছু অর্ডার করুন!’

‘তার প্রয়োজন হবে না। আমাকে উঠতে হবে এখন মিস। আমার বউ অনবরত ফোন করছে।’

‘বউ? আপনি বিয়ে করেছেন?’

‘এত অবাক হচ্ছেন কেন? আমি কি বিয়ে করতে পারি না? আমাকে কি ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হয়? আমার উপর কি বিয়ে নাজায়েজ? নাকি ভেবেছিলেন আমি কখনো বউ পাবো না?’

নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। তাসপিয়া অগোছালো দৃষ্টি মেলে কোনোরকমে বলল,

‘আপনি বিয়ে করেছেন অফিসের কাউকে জানাননি কেন?’

‘অফিসে জয়েন করার সময় তো কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ হইনি যে আমি বিয়ে করলে সবাইকে জানাতে হবে! ভালো থাকেন মিস। আমি যাই এখন। বুঝতেই পারছেন, বউকে যমের মতো ভয় পাই। ছেলে হলে আমার ব্যাপারটা বুঝতেন। আসি!’

নির্ঝর হাত নেড়ে তাসপিয়ার থেকে বিদায় নিল। বড় বড় পা ফেলে কফিশপের বাইরে এলো। কিছুদূর এগিয়ে রিকশায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ফোনের লক প্যাটার্ন খুলতে তরীর ঘুমন্ত মুখের ছবি ভেসে উঠলো। ছবিটা জীবন ভাইয়ার বিয়ের আগের রাতে লুকিয়ে তুলেছিল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো জুম করা ছবিটির দিকে। এই একটা মুখ! এই একটা মুখ দেখে কখনো ক্লান্তি আসে না। বার বার, হাজারবার, প্রতিটা সেকেন্ড দেখতে ইচ্ছে করে।

নির্ঝর বাসায় ফিরলো রাত নয়টার পর। ডোর বেল বাজাতে দরজা খুললেন তার মা। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,

‘আজ এতো দেরি করলি কেন?’

‘ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছিল মা। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল। ভাত দাও তো মা এখন।’

শুধু হাতটা ধুয়ে ডাইনিং এ বসে পড়লো নির্ঝর। এক ফাঁকে জেনে নিল সবার ডিনার শেষ। তার মানে তরীও খেয়েছে। আড়চোখে সে বার কয়েক নিজের রুমের দিকে তাকালো।

খাবার বেড়ে দিতে দিতে নাহিদা বেগম বললেন,

‘তরীকে বকাঝকা করেছিস পড়ার জন্য?’

‘হাউ ফানি! বকাঝকা করবো কেন?’

‘আরে আজ সারাটা দিন বই নিয়ে বসে আছে।কিছুতেই বই রেখে দিবে না। জোর করে সময় মতো খাইয়েছি। মানে পড়ার জন্য একেবারে জান দিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। সত্যি করে বলতো নির্ঝর। বকাঝকা করিসনি তো?’

নির্ঝরের ভেতরটা পুলকে ভরে গেল। তরী পড়াশোনা করছে ভেবে কিছুটা স্বস্তি মিলল। আয়েশ করে ভাতের লোকমা মুখে পুড়ে খেল। স্মিত হেসে বলল,

‘আমি কিছুই বলিনি মা। হয়তো সুমতি ফিরেছে।’

‘চুপচাপ খা এখন। তোর বাবাকে গরম পানি দিয়ে আসি। আর তরীকে পড়াশোনার জন্য ধমকা-ধামকি করবি না। মনে থাকে যেন!’

‘ঠিক আছে।মনে থাকবে মা!’

খাওয়া শেষে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে রুমে ঢুকলো নির্ঝর। নিঃশব্দে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। রুমের পরিবেশ শোকতপ্ত আকাশের মতো বিষণ্ণ। নির্মল চোখ মেলে সে বিছানার দিকে তাকালো। সারা বিছানাময় বই, খাতা, নোটস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে তরী পড়ছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা মুখস্থ করছে। দিনশেষে তরীর মুখ দেখে মনে শান্তি ফিরে পেল। সে নিঃশব্দে তরীর দিকে এগিয়ে গেল। তরীর সামনে দিয়ে বার কয়েক পায়চারি করলো। তরী চোখ তুলে তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত!

বাধ্য হয়ে নির্ঝর আলমারি থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মিনিট পাঁচেকের ভেতর সে শুধু হাতে মুখে পানি দিয়ে বের হলো। টিশার্টের বুকের উপরের বোতামটা লাগিয়ে সে আবার তরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘বসার জন্য একটু জায়গা চাই আমার।’

তরী কোনো প্রতিত্তর করলো না। কয়েকটা বই খাতা সরিয়ে নির্ঝরের বসার মতো জায়গা বের করলো। নির্ঝর তার মুখ বরাবর বসে পড়তে তরী কয়েকটা খাতা তার দিকে এগিয়ে দিল। নির্ঝরের দিকে তাকালো না। আগের থেকে বেশি মাথা নিচু করে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিল।

নির্ঝর খাতাগুলো হাতে তুলে দেখলো এগুলো হোমওয়ার্ক। ইংরেজি গ্রামারের উপর অনেকগুলো প্রশ্ন সে করতে দিয়েছিল সেগুলো। খাতা থেকে চোখ সরিয়ে সে গভীর মনোযোগে তরীর দিকে তাকালো। কোমল স্বরে ডাক দিল,

‘তরী?’

তরী পূর্বের ন্যায় কোনো উত্তর দিল না। আলাদা খাতায় কিছু লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তরীর এই নিস্পৃহ ভাব নির্ঝর নিতে পারলো না। আরো দুবার ডাকলো। কিন্তু তরী যেন মিউট হয়ে গেছে। তরীর নিরব আঘাতে বুকের ভেতর পুড়ে উঠলো তার। সাথে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে। মনে মনে বলল,

‘এত তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিলে তরীরানি? আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারলে না? অথচ আমায় দেখো! সাত-সাতটা বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। শুধু তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি। তোমার মুখে ভালোবাসি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি। তোমার অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক জেনেও মুখ ঘুরিয়ে নেইনি। আর তুমি আমার একটুখানি ধমকে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছো না! আমায় এক পলকের জন্য দেখছো না? এত সহজে বিমুখ হয়ে রইলে? আমারও তো কষ্ট হয়!’

বুকের অতলে বিষণ্ণতার প্রচ্ছন্ন একটা রেশ থাকলেও সে নিটোল বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,

‘লেখালেখি বাদ দাও তরী! আর পড়তে হবে না আজ। ঘুমিয়ে পড়ো।’

তরীর মধ্যে ঘুমানোর কোনো ব্যস্ততা দেখা গেল না। আগের মতো নির্বিকার ভাবে খাতায় লিখতে লাগলো। নির্ঝরের ভেতরটা বিষাদে ছেয়ে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে তরী আজ অন্তত পড়া ছেড়ে উঠবে না। অথচ তরীর মুখটা কেমন শুকনো শুকনো। ঘুমিয়ে পড়া উচিত এখন। সে কালবিলম্ব না করে সামনের দিকে এগিয়ে এলো একটু। খপ করে শক্ত হাতে তরীর চলমান হাতটা ধরে বলল,

‘বারণ করেছি না? আর পড়তে হবে না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো!’

(চলবে)