শেষটা সুন্দর পর্ব-২০+২১

0
577

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___২০

ফুপির বাসায় তরীর থাকার ঘর পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিবার আসলে গেস্ট রুমে থাকা হতো। কিন্তু এবার তাকে নির্ঝরের নামে বরাদ্দকৃত রুমটাতে থাকতে বলা হয়েছে। আগে তার পরিচয় ফুপির ভাইয়ের মেয়ে ছিল। এখন এ বাড়ির বউ! ছোট বউ!

দোতলা বাড়ির দক্ষিণ দিকের বেলকনিসহ রুমটা নির্ঝরের। তরী সেটা জানে। এ বাড়ির প্রতিটি ইট, বালি, সিমেন্টের কণা তার চেনা। ঘরের কোনায় কোণায়, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা তেলাপোকা থেকে শুরু করে সব চেনা। শুধু চেনা ছিল না নির্ঝর। এই মানুষটাকে ভালো মতো আবিষ্কার করার আগেই তার সাথে জীবন জুড়ে গেল।

বাবা-মাসহ সবার সাথে কথা বলে ঘন্টাখানেক পর ভেড়ানো দরজা ঠেলে তরী নির্ঝরের রুমে ঢুকলো। তারা আসবে বলে রুমটা আগে থেকে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লোরসহ ঝকঝকে, তকতকে প্রতিটি জিনিস। বিছানায় এক রঙা সবুজ চাদর বিছানো। মনে হচ্ছে পুরো প্রকৃতি বিছানায় ঠেলে রেখেছে। একটা হাই তুলে তরী বিছানার দিকে যেতে মাঝপথে থেমে পড়লো। নির্ঝর নিচ থেকে বার বার বলে দিয়েছে ঘুমিয়ে যেন না পড়ে। আগে শাওয়ার নিতে হবে।

থমথমে মুখে সে ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে লাগেজ টেনে খুলে ড্রেস বের করলো। তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। খুব দ্রুত শাওয়ার শেষ করে ঘুমাতে হবে।

নির্ঝর রুমে ঢুকার সাত মিনিটের মাথায় খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। না চাইতেও মাথা উঁচু করে সে তরীর দিকে তাকালো। তরী থ্রি পিস পড়েছে। ঢিলেঢালা জামা কাপড় চুলের পানিতে ভিজে একাকার। সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। ছোট্ট টেবিলটার দিকে ইশারা করে বলল,

‘খাবার উপরে নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও!’

তরী ছোট করে বলল,

‘খাব না আমি। মাথা ব্যথা!’

‘মাথা ব্যথার সাথে খাওয়ার কি সম্পর্ক? অল্প একটু খেয়ে মেডিসিন খাও।’

তরী কোনো উত্তর দিল না। ভেজা টাওয়ালটা বিছানার একপাশে রেখে আরেক পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। নির্ঝর জানালার পাশে চেয়ারে বসে ছিল। তরীকে না খেয়ে শুয়ে পড়তে দেখে উঠে এলো। খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে বিছানার উপর রাখলো। কিছুটা হুকুমের স্বরে বলল,

‘তরী উঠে পড়ো তো! আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

তরী চোখ না খুললেও বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হলো। আজ পর্যন্ত নির্ঝর তার অনেক যত্নাদি নিয়েছে। জোরপূর্বক ফলমূল মুখে তুলে দিয়েছে। কিন্তু কখনো প্লেটে করে ভাত-মাংস তুলে খাওয়ায়নি। এটা তাকে করতে হয়। প্রায়ই নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে নির্ঝর তার হাত দিয়ে খেয়ে নেয়। আজ সে বেশ অবাক হলো।
নির্ঝরের হাতে খাবার খাওয়ার লোভ জাগলো। তবে খুব তাড়াতাড়ি সে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। নির্ঝর গাড়িতে তাকে যেইহারে ধমক দিয়েছে, এরপর তার হাত থেকে খাওয়া মানে হার মেনে নেওয়া।

তরীকে নিরব দেখে নির্ঝর আরো দুবার ডাকলো। উত্তর না পেয়ে তরীর হাত ধরে টেনে তুলল। খাটে বালিশ রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তরী বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘এমন করছেন কেন? মানুষ মনে হয় না আমাকে?’

‘একদমই মনে হয় না। এবার লক্ষী মেয়ের মতো বড় করে হাঁ করো তো।’

‘খাবো না আপনার হাত থেকে?’

‘হাউ ফানি! সব দোষ আমার হাতের তো? এই হাত রাখবো না আমি। তোমার খাওয়া শেষ হলেই কেটে ফেলবো। নাও হাঁ করো!’

তরী হাল ছেড়ে দিল। নির্ঝর তাকে খাইয়ে ছাড়বে। এতটুকু সে চিনে মানুষটাকে। দ্বিরুক্তি না করে হাঁ করলো। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। চোখ ভেঙে ঘুম পাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে কয়েক লোকমা খেল।

একটুপর হাত উঁচু করে বাধ সাধলো। নির্ঝর আর জোর করলো না। একটা ট্যাবলেট খুলে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল। তরী এটার অপেক্ষায় ছিল। চুপচাপ ওষুধ গিলে সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। পেটের কাছে চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে দিল। মাথার যন্ত্রণা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকলো সে।

উচ্ছিষ্ট খাবারের প্লেটটা নির্ঝর সরিয়ে রাখলো। সে ইতোমধ্যে খেয়ে ফেলেছে। তরীর বাবা-মায়ের সাথে একত্রে খেতে হয়েছে তাকে। একটুপর নিজের শুকনো টাওয়ালটা নিয়ে তরীর পাশে বসে পড়লো। ভেজা চুল নিয়ে মেয়েটা শুয়ে পড়েছে। পরীক্ষার আগে অসুস্থ হলে ভয়ানক বিপদ হবে। সে অালতো হাতে ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে থাকলো। তরী লাল চোখে একবার নির্ঝরের দিকে তাকাতে নির্ঝর চোখের ইশারায় ঘুমিয়ে পড়তে বলল। তরী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করলো।

চুলগুলো ভালোমতো মুছে দিয়ে সে তরীর কপালে হাত রাখলো। গা হালকা গরম। এতটুকু শরীরে জ্বর টর এলে সহ্য করবে কিভাবে? অবশ্য মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছে সে। আপাতত কপালসহ মাথায় হালকা করে ম্যাসেজ করা শুরু করলো। মাথা ব্যথাকে গুডবাই জানানোর জন্য।

_____________

বেলকনিতে হেঁটে হেঁটে পড়া মুখস্থ করছে তরী। বিড়বিড় করে মুখ নেড়ে লাইনগুলো মনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে ঝিরিঝিরি বাতাসের ঝাপটা এসে পরশ ছুঁয়ে দিল। পায়চারি থামিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু পা এগিয়ে গ্রিলে হাত রাখে মৃদু হাসলো। এখন রাত। গ্রিলের ওপাশে যতদূর চোখ যায় অন্ধকার আর অন্ধকার। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে একটা করে বাড়ি। সব বাড়িতে আলো নিভে গেছে। সবাই গভীর ঘুমে। অথচ সে দেখেছে, ঢাকা শহরে রাত এগারোটায় সবেমাত্র দিন শুরু হয়। লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়।

‘তরী?’

তরী মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। রুমের ভেতর থেকে নির্ঝর ডাকছে। এতক্ষণ সে রুমে ছিল না। নিচে ড্রয়িং রুমে দেখে এসেছিল! বিকেলের খাবারটা নির্ঝর তাকে জোর করে খাইয়েছিল। কিন্তু রাতের খাবার সে নিচে সবার সাথে একত্রে খেয়েছে।

‘তরী? কোথায়? আছো?’

তরী আর দেরি করলো না। বেলকনি থেকে রুমে ঢুকলো। হাতের বইটা টেবিলের উপর রেখে বলল,

‘এই তো!’

নির্ঝর একবার আপাদমস্তক পরখ করলো তরীর। এখন খানিকটা সুস্থ মনে হচ্ছে। বিকেল বেলা তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। সে বিছানার এক কোণে বসে বলল,

‘পড়াশোনা কতদূর?’

‘পরীক্ষার হল অবধি আগে পৌঁছাই। প্রশ্ন হাতে পাই। তারপর বোঝা যাবে পড়াশোনা কতদূর করেছি।’

‘হাউ ফানি!’

তরি বিড়বিড় করে বলল,

‘হাউ বজ্জাত!’

‘কিছু বললে?’

‘নাহ।’

‘গুড! এখন বলো চা, কফি কিছু খাবে?’

‘না! আমি ঘুমিয়ে পড়বো আজ।’

এত তাড়াতাড়ি বলতে নিয়েও নির্ঝর থেমে গেল। আজ জার্নি করে এসেছে। লম্বা দূরত্বের জার্নি। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া দরকার। সে উঠে বিছানার চাদর ঠিকঠাক করলো। বালিশ সোজা করে একপাশে জায়গা করে দিল। বিছানা ঝেরে বলল,

‘ঠিক আছে। এবার ঘুমিয়ে যাও!’

‘আমি তো এখানে ঘুমাব না।’

তরীর নির্বিকার উত্তরে নির্ঝরের হাত থেমে গেল। সোজা হয়ে ভ্রু যুগল কুঁচকে তরীর দিকে তাকালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে বলল,

‘এখানে ঘুমাবে না মানে? কোথায় ঘুমাবে তাহলে?’

‘মায়ের সাথে ঘুমাব আজ।’

নির্ঝরের বুকের ভেতর অজানা আতংকে কেঁপে উঠলো। চোখে মুখে এসে ভর করলো দুশ্চিন্তার ছাপ। প্রবল দুঃখ বোধে জর্জরিত হয়ে গেল। সর্বনাশ! তরীর সাথে না ঘুমালে তো তার ঘুম হবে না। এটা অবশ্য ঠিক যে সে তরীর সাথে লেপ্টে ঘুমায় না বা তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় না। কিন্তু গত মাসগুলোতে তরী আর তার মাঝে এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়েছে। ঘুমের ঘোরে একটু আধটু হাতে হাত রেখেছে। প্রায় প্রতিদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তরীর মুখ আবিষ্কার করে জাগ্রত হতো। তরীকে এক হাত দূরে রেখেও খুব নিকটে অনুভব করতো। নিজের খুব কাছে তার অস্তিত্ব অনুভব করতো। তরী তার পাশে আছে এটা ভেবেই প্রশান্তিতে বুক ভরে উঠতো। সেই তরীর সাথে এক বিছানায় না ঘুমালে ঘুম হবে কি করে? সে এগিয়ে এসে তরীর নিকটে দাঁড়াল। বিস্ফোরিত নয়নে বলল,

‘অসম্ভব!’

তরী ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কি অসম্ভব।’

‘মায়ের সাথে ঘুমাবে মানে? তাহলে আমি কি করবো?’

‘প্রতিদিন যা করেন তাই করবেন। নাক ডেকে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে থাকবেন। কানের কাছে কেউ চিল্লাফাল্লা করে কিছু বললেও তার কিছু আপনার মস্তিস্কে ঢুকবে না।’

‘তরী প্রতিদিন যা করি সেসব করার জন্যই তোমাকে পাশে প্রয়োজন আমার। প্রশান্তিতে ঘুম!’

নির্ঝরের কথা তরীর বোধগম্য হলো না। সে একটা হাই তুলে টেবিলের বইটা হাতে তুলে নিল। ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

‘আমি আসছি!’

সে হাঁটা শুরু করলো। কয়েক পা এগোতেই নির্ঝর তার হাত টেনে ধরলো। অনুরোধের স্বরে বলল,

‘এখানে ঘুমাও না প্লিজ। আসলে আমার এই রুম নিয়ে একটা ভুতুড়ে কাহিনি আছে। প্রায়ই আমার মৃত দাদুকে হাঁটতে দেখি। সেজন্য কিঞ্চিৎ চিন্তিত।’

নির্ঝরের খাপছাড়া মিথ্যে ধরতে তরীর দুই সেকেন্ড সময় লাগলো না। দ্বিতীয় বারের মতো হাই তুলে বলল,

‘ আমি অলৌকিক কর্মকান্ডে ভীষণ ভয় পাই। আমার বাবার থেকে ভূতকে বেশি ভয় পাই। আমি এখানে ঘুমাচ্ছি না।’

নির্ঝরের রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। এই মেয়ে অনুরোধ রাখার মতো মানুষ না। তরী হাতটা ছাড়াতে চাইলে সে আরো কঠোর হাতে চেপে ধরলো। তরী সঙ্গে সঙ্গে মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। নির্ঝর তার তোয়াক্কা না করে শক্ত গলায় বলল,

‘রুমের বাইরে এক পা রাখতে পারবে না। এখানেই ঘুমাবে তুমি।’

তরী কিছু বলার চেষ্টা করলো। তার আগেই দরজার বাইরে মিলিত পদধ্বনির আওয়াজ এলো। নির্ঝর তরীর হাত ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

‘নির্ঝর ভাইয়া!’

অল্প বয়সী একটা ছেলে ঝনঝনে কন্ঠে ডাক দিল। নির্ঝর স্মিত হেসে হাত নেড়ে কাছে ডাকলো। তরীর একমাত্র ভাই তাফসি! বয়সের তুলনায় পড়াশোনায় বেশ এগিয়ে গেছে। সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে। অবশ্যই পড়াশোনায় তরীর থেকে ভালো। তাফসি এগিয়ে এসে বলল,

‘তরী আপুকে মা ডাকছে। মা আজ আপুর সাথে ঘুমাবে।’

নির্ঝরের মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। তরী মুচকি হেসে বলল,

‘আমি বরং যাই। তাফসি তুই তোর নির্ঝর ভাইয়ার সাথে ঘুমা আজ।’

তরী ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল। নির্ঝর পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। তাফসি তার পাশে বসে পড়তে সে আহত স্বরে বলল,

‘ব্রো, সিগারেটের ব্যবস্থা করতে পারবে?’

‘কি? ভাইয়া আপনি সিগারেট খান?’

নির্ঝরের হুশ ফিরলো। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে তাফসির মাথায় একটা গাট্টা মারলো। সুর টেনে বলল,

‘হাউ ফানি! আমি সিগারেট জীবনে স্পর্শ করিনি। আসলে তোমায় ছোটখাটো একটা ম্যাজিক দেখাতে চাইলাম। তুমি জানো না যে আমি ম্যাজিক পারি। হরেক রকমের ম্যাজিক। এই ধরো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি!’

তাফসি ফিক করে হেসে দিল। নির্ঝর সুর পাল্টে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

‘মজার বিষয় না এটা ব্রো। অদৃশ্য হতে পারি না এটা ঠিক। তবে ম্যাজিক পারি আমি। এই ধরো, হাতের তালুতে অনেক বড় বড় জিনিস লুকিয়ে ফেলতে পারি। তারপর একটা সাদা রুমাল দিয়ে সিগারেট ঢেকে দিবে তুমি। একটুপর রুমাল সরিয়ে দেখবে সেটা গোলাপ হয়ে গেছে। টকটকে লাল গোলাপ।’

তাফসি আগ্রহ দেখাল ম্যাজিক দেখার। সে একদৌঁড়ে রুম থেকে বের হলো। মিনিট পাঁচেক নির্ঝর হাঁসফাঁস করলো। আজ যে তরীর বিরহে প্রচন্ড দুঃখের গান শুনবে আর সারারাত সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়বে। তার ভাবনার মাঝে তাফসি একদম নতুন এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট হাতে হাজির হলো।

________________

ভোরবেলা নামাজ শেষ করে তরী পড়তে বসলো। পড়ার মাঝখানে নোট প্রয়োজন পরতে সে মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়লো। এ বাড়ির কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। সে সাবধানে সিঁড়ি মাড়িয়ে নির্ঝরের রুমের দিকে এগোল।

নির্ঝরের রুমের দরজা ভেড়ানো ছিল। হালকা একটু ধাক্কা দিতে সেটা খুলে গেল। রুমের ভেতর ঢুকতে তরী বড়সড় ধাক্কা খেল। সমস্ত ফ্লোর জুড়ে কাপড়চোপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিছানার চাদর, বালিশ সব ফ্লোরে বিছানো। ঘরজুড়ে সিগারেটের গন্ধ। এখানে ওখানে সিগারেটের টুকরো, আর ছাই পড়ে আছে। আর সেসবের মাঝে নির্ঝর হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে আছে। মাথাটা খাটের সাথে হেলানো। তরী এগিয়ে গিয়ে মুখে হাত রেখে বলল,

‘এসব কি? রুমের এ অবস্থা কেন?’

নির্ঝর জাগ্রত ছিল। তরীর কন্ঠ পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মাথার চুল এলোমেলো তার। চোখ দুটো টকটকে লাল। চোখের নিচে কালি। পুরোদস্তুর বিধ্বস্ত চেহারা। যে কেউ দেখে মনে করবে রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। সে ভারী মাথাটা খাট থেকে সোজা করে বলল,

‘তরী তুমি এসেছ? দেখো রুমের কি অবস্থা করেছে দাদু! কাল রাতে এসেছিল। তোমার লাগেজ থেকে সব কাপড় চোপড় বের করে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। বুদ্ধি করে আমার লাগেজে হাত দেয়নি।’

‘আপনার দাদু মহিলা মানুষ হয়ে রাতে সিগারেটও খেয়েছে?’

‘হুঁ! সিগারেট দাদুর ভীষণ পছন্দের।’

(চলবে…)

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___২১ (বোনাস পার্ট)

‘আপনার দাদু মহিলা মানুষ হয়ে সিগারেটও খেয়েছে?’

‘হুঁ! সিগারেট দাদুর ভীষণ পছন্দের।’

নির্ঝরের ভাবলেশহীন উত্তরে তরী ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। ফ্লোরে পড়ে থাকা নিজের জামা কাপড় বাঁচিয়ে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে এলো। চোখ পাকিয়ে বলল,

‘মৃত মানুষ সিগারেট খেতে এসেছে?’

‘হুঁ। কেন, তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি? এই বিশ্বাস করো আমায়?’

তরী হাসতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘আহা! এমন কিছু না। শুধু খটকা লাগছে। মৃত মানুষ কি সিগারেট খেতে পারে?’

‘হাউ ফানি! কেন পারবে না? মরে গেলেই কি মানুষের শখ, আহ্লাদ মিটে যায়? সিগারেট খাওয়া একটা শখের বিষয়। আমার পরিচিত এক বান্ধবী শুধুমাত্র শখের বশে সিগারেটে একটান দিতে চেয়েছিল। সুযোগ পায়নি বলে এক পর্যায়ে মানসিক রোগী হয়ে গেছিল।’

‘এতো জীবিত মানুষের কথা বলছেন। অবশ্যই মৃত মানুষ সিগারেট খেতে পারে না।’

নির্ঝর চোখ উল্টে বলল,

‘এমন কনফিডেন্স নিয়ে বলছো যেন দু চার বার মরে দেখেছো। মৃত মানুষের খাবার দাবার সম্পর্কে সব জেনে বসে আছো তুমি?’

‘বাদ দিন। এটা বলুন যে আপনার দাদুকে কি শুধু আপনি একা দেখতে পান?’

‘ঠিক বলেছ। একা দেখতে পাই! আরে দাদু শুধু আমার জন্য আসে। দাদু আমায় ভীষণ ভালোবাসে। রাতে বলছিল যে আমায় নাকি ভীষণ মিস করে। আমিও তাকে ভীষণ মিস করি। দুজনেই প্রচুর দুঃখে ছিলাম। সুখ দুঃখের আলাপ করলাম। এক পর্যায়ে দুঃখ কমানোর জন্য ধোঁয়া ছাড়লাম শুধু।’

নির্ঝরের এই নির্বিকার ভাবে বলে যাওয়া মিথ্যের ঝুড়ি তরীর বেশ ভালো লাগছে। সে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘তা আপনার দাদু কি আমায় তার সতীন মনে করে? আপনার লাগেজ স্পর্শ করলো না। কিন্তু আমার সবগুলো জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কি অবস্থা করেছে! তাকে এক্ষুণি ডাকুন তো। বলুন যে আমার লাগেজ পুনরায় গুছিয়ে দিয়ে যেতে। না হলে খুব খারাপ হবে।’

নির্ঝর মাথা নেড়ে বলল,

‘রাত ছাড়া তো দাদুকে পা-ওয়া যায় না। আজ রাতে এলে গুছিয়ে দিয়ে যেতে বলবো। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’

‘হাউ বজ্জাত! আমাকে বোকা মনে হয় আপনার কাছে?’

আচমকা নির্ঝর একলাফে বসা থেকে উঠে পড়লো। তরীর মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে লাল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর তরীকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তরী গলা উঁচিয়ে বলল,

‘আমার কাপড়চোপড় এভাবে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সবগুলো আগের মতো গুছিয়ে রাখুন। নইলে কিন্তু……’

দরজার কাছে গিয়ে নির্ঝর দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন ঘুরে তরীর দিকে এক নজর তাকিয়ে ছিটকিনিতে হাত রাখলো। ভেতর থেকে দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতে তরীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বুকের ভেতর শীতল একটা ঝড় বয়ে গেল। কাল রাতে কথা না শোনার জন্য এখন শাস্তি দিবে না তো? নাহ!

সে আমতা-আমতা করে বলল,

‘সকাল হয়ে গেছে দেখছেন না? এখন দরজার ছিটকিনি লাগানোর সময়?’

‘হাউ ফানি! দরজার ছিটকিনির সাথে সকালের কি সম্পর্ক তরীরানি?’

‘দরজা খুলুন। আমি বই নিতে এসেছি।’

‘দরজা খোলা যাবে না। বুঝতে পারোনি? ইংরেজিতে বলবো?’

তরী বেশ ঘাবড়ে গেল। কথা ঘোরানোর জন্য সহজ গলায় বলল,

‘আমার ভাই কোথায়? ও রাতে আপনার সাথে ঘুমায় নি? ‘

‘হুঁ! প্রথমে ঘুমাতে চেয়েছিল। ম্যাজিক দেখানোর কথা বলে সিগারেট আনিয়েছি ওকে দিয়ে। কিন্তু ম্যাজিক কাজ করেনি। মানে পুরো আধ ঘন্টায় চার চার বার সিগারেট রুমাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। মনে মনে অনেক দোয়া দরুদপাঠ করেছি। কিন্তু সিগারেট গোলাপে পরিণত হয়নি। রাগ করে তাফসি চলে গেছে আর কি! আমার মতো ঠকবাজের সাথে ঘুমাবে না সে।’

বলতে বলতে নির্ঝর তরীর দিকে এগোল। তরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না কোন ম্যাজিকের কথা বলছে। নির্ঝর সামনে দাঁড়াতে সে টেবিলের কাছে সরে গেল। ততক্ষণে নির্ঝর ফ্লোর থেকে বেডশিট উঠিয়ে বিছানায় কোনোমতো বিছিয়ে রাখলো। বালিশ দুটো উঠিয়ে তরীর দিকে তাকালো।

তরী দুটো নোটবুক আর খাতা, কলম বুকে জড়িয়ে বলল,

‘আমি নিচে যাব। পড়তে হবে।’

নির্ঝর কোনো কথা শুনলো না। নিজে বাঁচলে পড়ার নাম! সে যদি না ঘুমিয়ে ব্রেন স্ট্রোক করে তাহলে তরীর এত পড়ে কি লাভ? সে এগিয়ে এসে তরীর হাত চেপে ধরলো। হুকুমের স্বরে বলল,

‘নো পড়াপড়ি! আগে আমার ট্রিটমেন্ট দাও।’

‘আপনার আবার কিসের ট্রিটমেন্ট?’

‘ঘুমের ট্রিটমেন্ট। ঘুম প্রয়োজন আমার। দেখছো না, আমার অবস্থা? যখন তখন হার্টে অ্যাটাক ঘটবে। বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে হার্ট অ্যাটাক আটকে রেখেছি। হাত সরালেই পটল তুলতে চলে যাব।’

নির্ঝরের সব কথা তরীর মাথার উপর দিয়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে সে শুধু চেয়ে রইলো। তাতে অবশ্য নির্ঝরের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে হাত ধরে তরীকে বিছানায় বসিয়ে দিল। তরীর পাশে বালিশ টেনে শুয়ে পড়লো সে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। আশ্বাসের হাসি হেসে বলল,

‘আমার পাশে বসে পড়ো। শব্দ করে পড়বে কিন্তু।’

‘আমার পড়ার শব্দে ঘুম আসবে আপনার?’

‘ডিঙিরাণী! এতগুলো মাস তোমার পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। গতকাল রাতে সে ব্যবস্থা ছিল না বলে সারারাত ঘুম হয়নি আমার। তাকিয়ে দেখো, তোমার পেছনে মোবাইল রেকর্ড চালু করে রেখেছি। আজ যা যা পড়বে সব রেকর্ড হবে। ভবিষ্যতে তুমি পাশে না থাকলে রেকর্ড শুনে ঘুমিয়ে পড়বো।’

নির্ঝর চোখ বন্ধ করলো। তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে তরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নির্ঝরের অজান্তেই সে নিজের হাসিটুকু মিলিয়ে নিল। বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে তাতে নজর দিল। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় শুধু চোখ বুলাল। হঠাৎ নির্ঝর বন্ধ চোখে তার ডান হাতটা ধরলো। তরী কিছু বলার আগে সে জড়ানো কন্ঠে বলল,

‘হাতটা কপালের উপর থাক শুধু। শব্দ করে পড়ো! কানে তো আসে না।’

তরী হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। বরঞ্চ নির্ঝরের এই স্পর্শ টুকু তার ভীষণ ভালো লাগছে। নির্ঝরের কপালে রাখা হাতটার দিকে এক পলক চেয়ে সে জোরে জোরে পড়া শুরু করলো।

_______________

আজ রবিবার। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে। সেই ভোরবেলা থেকে বৃষ্টি। থেমে যাওয়ার নাম গন্ধ নেই। বৃষ্টির গতি একটু কমছে তো আবার পরক্ষণে বেড়ে চলেছে। ভেজা বেলকনি দিয়ে বাহিরটা পরখ করে তরীর মন খারাপ হয়ে গেল। আজ তার প্রথম পরীক্ষা। বোর্ড পরীক্ষা। অথচ আজকের দিনেই মেঘমল্লার সাহেবকে এত অভিমান করতে হবে? এত জল ঝরাতে হবে? মন খারাপ নিয়ে সে রুমে ঢুকলো।

রুমে ঢুকতে নির্ঝরকে নজরে এলো তার। তার দিকে পেছন ঘুরে আছে। টেবিলে রাখা ফাইল চেক করছে। এডমিট কার্ডসহ সবকিছু নেওয়া হয়েছে কি না! তরী নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। নির্ঝরের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্ঝরের আপাদমস্তক দেখে চলল। নির্ঝরের পরণে নীল শার্ট আর কালো প্যান্ট! শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করা। পাতলা লোমযুক্ত ফর্সা হাত অনেকটা অনাবৃত। সেই মোহনীয় বাম হাতে কালো একটা ঘড়ি! তরী হাঁ করে চেয়ে রইলো যেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যমানব তার চোখের সামনে।

কিছু সময় পর নির্ঝর ফাইল হাতে ঘুরে দাঁড়াল। তরীকে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল,

‘তুমি!’

তরীর হুশ ফিরলো। আলগা করে রাখা ঠোঁটজোড়া একত্রে করলো। জিহবা দিয়ে একবার ভিজিয়ে নির্ঝরের সামনে থেকে সরে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাবের পিন ঠিক করা শুরু করলো। নির্ঝর তাড়া দিয়ে বলল,

‘দেরি হয়ে যাচ্ছে তরী। চলো রওনা দেয়া যাক।’

‘হয়ে গেছে আমার। আচ্ছা বলুন তো। বেছে বেছে কেন নীল রঙের শার্টটাই আপনার পরতে হবে আজ?’

‘কেন এটা ভালো লাগছে না?৷ চেঞ্জ করবো?’

তরী আয়না দিয়ে নির্ঝরের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলল। এত সুশ্রী একটা মুখ, সুদর্শন একটা মানুষ তার একমাত্র বর ভেবে মন পুলকে ভরে গেল। একটুপর পেছন ঘুরে নির্ঝরের দ্বিধাদ্বন্দে ডুবে থাকা মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘আজকের মতো থাক। চলুন তাড়াতাড়ি।’

দুজন একত্রে নিচে নামলো। নির্ঝর আগে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। তরী সবার থেকে দোয়া নিয়ে কিছুক্ষণ পর তার বাবার হাত ধরে গাড়ির কাছে এলো। নির্ঝর গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসতে বললো। শেষ বারের মতো ফাইল চেক করে বিসমিল্লাহ বলে গাড়ি স্টার্ট দিল।

তরীর কলেজ সে চিনে। সেই কলেজ থেকে পাঁচ মিনিট দূরের আরেকটা কলেজে তরীর সিট পড়েছে। গতকাল নির্ঝর গিয়ে রোল নম্বরসহ সিট দেখে এসেছে। আজ সরাসরি তরী গিয়ে বসে পড়বে।

বাকি রাস্তা টুকু তেমন কথা বলল না তরী। নির্ঝর তাকে গম্ভীর গলায় অনেক উপদেশ দিল। সে শুধু মাথা নেড়ে হু হাঁ করলো। তরীর ভয় কমানোর জন্য নির্ঝর তাকে অনেক কথা বললো। একটু সহজ করার জন্য, হাসানোর জন্য অনেক মজার মজার কথা বললো। কিছুতেই কিছু হলো না। তরী মুখ ভার করেই রাখলো।

ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে আধ ঘন্টা পর তারা হলে পৌঁছে গেল। গেটের সামনে প্রচুর গাড়ি। মানুষ তেমন নেই। প্রচুর বৃষ্টি বলে ভীড় কম। ছাত্র ছাত্রীরা ভেতরে ঢুকছে। অভিভাবক প্রবেশ নিষেধ। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে ছাতা মাথায় দিয়ে তরীর পাশে এলো। দরজা খুলে তাকে ছাতার ভেতর নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। গেটের কাছাকাছি এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। তরীর চিন্তার ভাঁজ পরা মুখের দিকে চেয়ে স্মিত হাসলো। গভীর মায়া নিয়ে সে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ধরা গলায় বলল,

‘একদম ভয় পাবে না ডিঙিরানি! কোনো প্রেশার নিয়ো না। আমার ফেল্টুস বউ পছন্দ। কারণ বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনীদের বলার মতো গল্প হয়ে যাবে। এবার একটু হাসো তো?’

এই প্রথম সামনের মানুষটার মুখের উপর থেকে সব পর্দা সরে গেল যেন। তার মন অবধি পৌঁছাত পারলো তরী। এক নিমেষে মন পড়ে ফেলতে পারলো। সিক্ত নয়নে মুচকি হেসে ফেলল সে। ডান হাত উঁচু করে মাথায় রাখা নির্ঝরের হাতটা স্পর্শ করলো।

তরীর হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে নির্ঝর গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। মাথা ঝেরে পানির ফোঁটা ফেলে দিল। তারপর অস্পষ্ট কাচ দিয়ে দেখলো তার জীবন তরী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেন জানি নির্ঝরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বিড়বিড় করে তার জানা সমস্ত দোয়া দরুদ পাঠ করা শুরু করলো।

(চলবে….)