শেষের পঙক্তি পর্ব-১২+১৩

0
413

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
অফিসের জন্য তৈরি হয়ে মিহাল নাস্তা করতে ডাইনিংয়ে যায়। মিহালের মা মিহালকে তখন জিজ্ঞাসা করেন,

–তুমি তানজিনার সাথে বাজে ব্যাবহার করো কেনো? তানজিনা বলেই সব মানিয়ে নিচ্ছে। অন্যকেউ হলে তোমাকে মুখ ঝামটা দিতো।

মিহাল পরোটা চিবুচ্ছে আর মায়ের কথাগুলো শুনছে। মিহাল বিড়বিড় করে বলে,
–দিক না মুখ ঝামটা। তাও আমায় রেহাই দিক।

মিহালের মা মিহালের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে সন্দেহের স্বরে বলে,
–কিছু বলছো তুমি?

মিহাল ঘার নাড়িয়ে না জানায়। মিহালের মা আবার বলেন,
–তাহমিনা(তানজিনার মা) আমায় বলল। তানজিনার নাকি তিন চারদিন ধরে মন খারাপ। তাহমিনা ওকে কাল রাতে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, তুমি নাকি অনবরত তানজিনার সাথে বাজে ব্যাবহার করো? তাহমিনার কাছে কতোটা নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিলো জানো?

মিহাল খাবার চি’বানো শেষে বলে,
–আমি তানজিনার সাথে কোনো খারাপ ব্যাবহার করি নি। আর তানজিনা যে আমাকে দোষারোপ করছে, তাহলে ওকে বলতে বলো, আমি কি খারাপ ব্যাবহার করেছি? আমার জানামতে আমি একটু ওর মতো লুতুপুতু না করাতে সে এগুলো বলছে। আর প্লিজ মা। তোমার পছন্দের সে, আমার না। তাই ওসব প্রেম প্রেম আলাপ আশা না করাই বেটার।

মিহালের মা সন্দিহান হয়ে বলেন,
–আমার পছন্দ হলেই কি তুমি তার সাথে বিয়ের পর সাধারণ সম্পর্কে যাবে না? বিয়ে যার পছন্দেই হোক, বিয়ে তো বিয়েই।

মিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–হুম। আগে সেটা হোক। আর তাছাড়া জীবনসঙ্গী খারাপ হলেও যদি পরিবারের কথায় তার সাথে সম্পর্ক টিকাতে হয় তবে সেটাতে কম্প্রোমাইজ ছাড়া কিছু থাকে না। তখন তোমার কাছে তো তানজিনা অভিযোগের মহাসাগর বানিয়ে বসবে! তখন সামলিয়ো।

মিহাল নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরে। তানজিনা এগুলো তানজিনার মাকে বলাতে মিহালের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে কারণ, দুই দিন পর যে পার্টিতে যাবে সেখানে তানজিনাকে অপদস্থ হবে তাতে তানজিনার মাকে তো তানজিনা বলবে তারপর তিনি মিহালকে আরও খারাপ ভাববে। তারপর যদি রেহাই মেলে!

________
অফিসের ব্রেক টাইমে রিজভী এসে মিহালের পাশে বসে বলে,
–তাইজুল এখনও আসে নি? তাইজুলের তো আজকে একটু বেশি কাজ পরেছে। কি জানি কম্পিলিট করতে পেরেছে কী-না?

মিহাল বলে,
–চলে আসবে। খাবার অর্ডার করি।

তারপর পিয়নকে ডেকে খাবার দিয়ে যেতে বলে। রিজভী হুট করে মিহালকে জিজ্ঞাসা করে,
–ভিসা অফিস থেকে ফোন এসেছে তোর? আমার সকালে এসেছে। সময় করে যেতে হবে। মনে হয় ভিসা কনফার্ম হয়ে যাবে। তিন মাস ধরে ট্রাই করছি।

মিহাল বলে,
–হ্যাঁ এসেছে। রাফিদের সাথে কথা হয়েছে? সবার তো এক ভার্সিটিতে আসবে না। দেখা যাক কার কোনটায় আসে। আর তূরের কি খবর? সে কি মাস্টার্সে ভার্সিটি চেঞ্জ করবে?

রিজভী বলে,
–তা জানি না। রাফিকে জিজ্ঞাসা করতে বলবো। আর একই রাজ্যে থাকলেই হয়। তুই আর তূর একটাতে গেলে ভালো হবে। তাছাড়া আমরা দুই তিনটা ইউনিভার্সিটি চেঞ্জ করে মাস্টার্স করতে পারবো।

তাইজুল আসার পর ওর সাথেও এই বিষয় নিয়ে কথা হয়। তাইজুল পরে যাবে। পাসপোর্ট করে রেখে দিয়েছে। ভিসাটাও। পরে রিনিউ করে সে যাবে। তাইজুল জানালো যে তাওহীদও পরে যাবে। ওরা দুইজনে আগে বিসিএস ট্রাই করবে তারপর যাবে।

_______
তূরের খালা ও খালুকে তূরের বাবা বিয়ের ব্যাপারটা আগাতে মানা করে দিয়েছেন। তূর ওর খালার বাসা লস এঞ্জেলেসে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। এখন সে লোকেশন পরিবর্তন করতে চায়। খালার বাসায় থেকে পড়তে চায় না। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কেলের ক্যাম্পাসে ভর্তি হবে বা সান ফ্র্যান্সিসকোতে ট্রাই করবে। তূরের পরিচিত প্রফেসর সেই দিকটা লক্ষ্য রাখছেন। খালার বাসা থেকেই ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যেতে দেড় ঘন্টার বেশি লাগতো। এখন চেঞ্জ করলে ৩-৪ ঘন্টার মতো লাগবে।
তূরের খালামনি আজকে তূরকে ফোন করে বলেন,

–তুমি না-কি ভার্সিটি চেঞ্জ করছো?

তূর চায় নি এগুলোর জবাব এখনি দিতে কিন্তু দিতে হবে বিধায় সে বলে,
–আমার তো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল তুমি জানতে। অনার্সে পাই নি কিন্তু এখন সিজিপিএ ফোর আউট অফ ফোর না হলেও ৩.৫ এর উপরে আছে। তাই ট্রাই করে দেখছি। যদি হয়ে যায়।

তূরের খালামনি তূরের এই ইচ্ছেটা জানতো। তূরের সাথে যখন সময় হতো গল্প হতো তখন তূর ওই ক্যাম্পাসের কথা বলতো। কিন্তু ওই ক্যাম্পাস অনেক দূরে। তূরের খালামনি বলেন,

–কোথায় থাকবে তুমি? যাওয়া আসাতে ৬-৭ ঘন্টার বেশি লাগবে। তোমার শরীর সেটার ধকল নিতে পারবে না।

তূর বলে,
–তুমি টেনশন নিয়ো না। প্রফেসরের বাড়ি ওই দুইটা ইউনিভার্সিটির প্রায় মাঝামাঝি। উনি আমাকে তার বাড়িতে তার মেয়ের সাথে থাকতে বলেছেন। আমি মানা করার পরেও তিনি শোনেন নি। আমার রিসার্চ ফ্যাকাল্টি তো উনিই। বেশিদিন থাকতেও পারবো না। আমি ভাবছি ওখানে বেশিদিন থাকবোও না। কয়েকদিনের মধ্যেই হোস্টেল বা পার্টনারশিপে ফ্লাট পেয়ে গেলে উঠে যাবো। উনি যে জবটা আমার জন্য খুঁজে রেখেছেন সেটাও কাছাকাছি।

তূরের খালামনি স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলেন তারপর বললেন,
–রাফসানের ব্যাপারটা ভেবে দেখলে হতো না? তুমি কি ওর কারণেও ভার্সিটি পরিবর্তন করছো?

তূর প্রশ্নে হতাশ হয়। তূর শান্ত স্বরে বলে,
–আমি ইন্টারেস্টেড না উনার ব্যাপারে। আর হ্যাঁ। কিছুটা তার কারণেও। আমি চাই না সে মনের ভিতর কোনো মিথ্যা আশা রাখুক। তাকে আমি আগেও ইনডাইরেক্টলি ইগনোর করতাম। প্রয়োজনেও তাকে আমি নক করতাম না কিন্তু সে নিজে আগ বাড়িয়ে আসতো তখন ভদ্রতার খাতিরে সবসময় মানাও করতে পারতাম না। দোয়া করি সে ভালো কাউকে জীবনসঙ্গিনী পাক। আমি তাকে কখনও সেই নজরে দেখিও নি আর না কখনও তাকে বিন্দু পরিমানও আশা দিয়েছি।

তূরের খালামনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
–বড় বিচিত্র জালে ফেঁসে গেছো তুমি। খুব জলদি নিজের জীবনের গতি খুঁজে নাও দোয়া রইল। অবশ্যই ছুটির দিনে মাসে একবার হলেও আমার কাছে আসতে হবে। তোমাকে তো আমার দুই মেয়ের থেকে কোনো অংশে কম দেখি নি। তোমার মায়ের অনুপস্থিতিতে আমি তোমার মায়ের মতো। ভিনদেশে ক্ষুদ্রাকায় আপনজনও অনেক আপন হয়। আর শোনো, তোমার ভাবিকে একটু সময় করে রাতে ফোন করো। সে তোমার সাথে না-কি কথা বলবে না আর। রাগ করেছে বোধহয়।

তূর হাসলো। তারপর বিদায় জানিয়ে ফোন রাখলো। তার এই দুই মাসে অনেক কিছু ফিক্সড করতে হবে। তানজিনার কলেজ লাইফের চাল-চলন গুলো মনে করে এখন তূরের মনে হচ্ছে, একবার হলেও তানজিনার পারসোনাল রিলেশনের বিষয়ে জানতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ইরাকে আর প্যাঁচানো যাবে না। সিলেটে সেদিন জারিনের কথাগুলো এখন তূরের কিছুটা আঁচ করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে। জারিনকেই আগে ধরতে হবে।

_______
–দেখো, তানজিনা। তোমার নিজের ফিউচার রিলেশনশিপ নিয়ে আবারও ভাবা উচিত। সেদিন ওই ছেলের কাজে তুমি সত্য-মিথ্যা যাই প্রমানিত হও না কেনো, দিনশেষে কোনো সম্মান ও ভালোবাসার ছিঁটে ফোঁটাও নেই। এজ এ এডভাইসর হিসেবে বললাম। তোমার সাথে আমার ওরকম কোনে সম্পর্কও ছিলো না যা সেদিন ওই ছেলে মিন করেছে। অন্তত আমি তোমার সাথে কখনও ওরকম ক্লোজনেস ক্রিয়েট করি নি। তুমি ব্রাইট স্টুডেন্ট এন্ড তোমার প্রবলেম হলে আমার সাথে ক্লিয়ার করো। এটুকুই তো।

তানজিনা নিজের অসহায়ত্ব প্রফেসর আরিফের সামনে জাহির করে বলে,

–সেটাই তো মিহাল খুব বাজে ভাবে উপস্থাপন করেছে। আমি কারও সাথে ফ্রেন্ডলি মিশলেই সেটাকে বাজে ইঙ্গিত মনে করে। আমি আম্মুকে বলেছি বাজে বিভেবের ব্যাপারে। বিয়েটা তো আমার ইচ্ছে তে হচ্ছে না। আমার মা তার বান্ধুবীর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল।

প্রফেসর আরিফ আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। হ্যাঁ তার মনে সফট কর্নার আছে তানজিনার জন্য পারসোনালি কিন্তু সেটা কখনও সে তার প্রফেশনালিজমে আঘাত করাতে নারাজ। ওদিকে তানজিনা প্রফেসর আরিফের অফিস রুম থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

–স্যার অন্তত আমাকে জাজ করেন নি। আমি তো রিলেশন করে বেড়াচ্ছি না। কেনো জানি মনে হয় স্যারের সফট কর্ণার আছে আমার প্রতি। খেয়াল রাখতে হবে সেটা। আর ওই দুইজন তো আমাকে দেখলে নাক ছিঁটকায়। আমি ওদের সাথে ফ্রেন্ডশিপই তো করেছিলাম তবে ফান হিসেবে একটু আকটু তো চলেই। যাক ওদের মুখো হওয়া যাবে না। তাহলে পুরো ডিপার্টমেন্ট কি! ক্যাম্পাসে রটিয়ে যাবে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
রাকিব তানজিনার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। ডিপার্টমেন্টের টিচার্স অফিস রুমের বাহিরে করিডরে। রাকিবকে দেখে তানজিনা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। রাকিব বুকে দুই হাত গুঁজে তানজিনার দিকে বাঁকা হেসে বলে,

–আরও বাকি আছে দুজন দুজনকে ভালো করে চেনার ও জানার? আরও ভালো করে চিনবে জানবে তারপর রিলেশনশিপ পাবলিক করবে! এমনটাই তো বলেছিলে? চারটা বছরে অনেক তো চিনলাম জানলাম। কয়েকদিনে সেটা তিনগুণে রূপান্তর হয়েছে। তোমার কি মত?

তানজিনা নজর লুকাচ্ছে। রাকিব তা দেখে বলে,
–তোমার ফিউচার যে ব’র্বাদ হতে চলেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। আমরা তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড ছিলাম বলে আমাদের তো ঠকালে। এবার তোমার জীবন ন’রক হতে চলেছে। মিহাল করবে তোমার জীবন ন’রক। ওকে বিয়ে করার জন্য এতো ঠকানো তো এবার বিয়ের পর বুঝবে। বেটার লাক ফর ইউর সো কলড ফিউচার!

রাকিব চলে যায় প্যান্টের পকেটে দুই হাত পুরে শি’স বাজাতে বাজাতে। তানজিনা পেছোনেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে।

________

মিহাল তানজিনাকে নিয়ে পার্টিতে এসেছে। তানজিনাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। তানজিনা রাকিবের বলা কথা গুলোর পর আর সেদিনের মিহালের কাজ ও ব্যাবহারের পর মিহালকে এক বিন্দুও ভরসা করতে পারে না।
মিহাল তানজিনাকে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে লাপাত্তা। তানজিনা ভয় পাচ্ছে এমন না। তানজিনা ছবি তুলতে ও সাঁজ-গোজে ব্যাস্ত। তানজিনার সামনে এক কম বয়সি যুবক এসে দাঁড়ালো। যুবুকটি ফর্মাল গেটআপে আছে। যুবুকটি তানজিনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–হাই বিউটিফুল লেডি।

তানজিনা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে যুবুকটির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চাইল অতঃপর আবার ফোনের দিকে নজর দিলো। লোকটি চলে গেলো। এরপর অনেকক্ষণ পর মিহালের সাথে এলো। মিহাল চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,

–সাগর, ও হচ্ছে তানজিনা। যার সাথে আম্মু আমার বিয়ে ঠিক করেছে।

সাগরও বসতে বসতে বলে,
–সি ইজ সো মাচ বিউটিফুল।

তানজিনা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে তার সন্দেহের ভীর। অন্য সময় হলে সে দারুন খুশি হতো কিন্তু এখন তার মনে সন্দেহের আনাগোনা। মিহাল হাসতে হাসতে বলে,
–তুমিও ওর রূপে ফেঁসে গেলে! ওর রূপে যেই ফাঁসে ও তার ফায়দা তুলে! ও হচ্ছে একাধিক ভ্রমর আকর্ষণীয় ফুল!

তানজিনা হতবাক হয়ে গেলো। এমনটা সে আশা করে নি। সাগরকে ওগুলো বলার সময় ওখানে আরও দুজন উপস্থিত হয়। ওরা চারজনে হাসছে। তানজিনা অপমানে চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলে। একজন বলে উঠে,

–এটা কিন্তু বাহবা দেওয়ার যোগ্য। এতোজন ঘুরালেন কি করে? আর কতোজন ঘুরলো?

এই কথা বলে ওরা আবারও হাসতে লাগলো। মিহাল ওদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে,
–অসংখ্য! তবে তিনজনকে ঘুরিয়েছে নিজের পেছোনে। আরও আছে কি-না জানা নেই। আরও আছে কি তানজিনা?

তানজিনা অপমানে সেখান থেকে উঠে গেলো। মিহাল মিটিমিটি হাসছে। তানজিনা সোজা বাহিরে বের হয়ে যায় তারপর একা একাই চলে যায় তার বাসায়। নিজের বাসায় গিয়ে ড্রয়িংরুমে চিল্লাতে থাকে তার মাকে উদ্দেশ্য করে,

–মা! মা! তোমার বান্ধুবীর ছেলে আমাকে কি পেয়েছে? যেখানে সেখানে অপমান করে। তার কলিগদের সামনে অপমান করতে ছাড়ে না। মিহাল অনেক বার বেড়ে গেছে। আমি সহ্য করবো না এসব। প্রতিবার আমাকে অপমান করে।

তানজিনার মা নিজের রুমে ছিলেন। দরজা খুলেছে তানজিনার ভাবি। তানজিনার মা ড্রয়িংরুমে এসে মেয়েকে বলেন,

–কি হয়েছে তোমার? রাত ১০ টা বাজতে চললো আর তুমি চিল্লাচ্ছো কেনো? যা বলার তা আস্তেও বলা যায়।

তানজিনা ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
–তুমি মহিমা আন্টিকে (মিহালের মা) জানাও তার ছেলের ব্যাবহার। সবার সামনে আমাকে অপমান ও লাঞ্ছিত করা যেনো তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। এসব আর নেওয়া যাচ্ছে না।

তারপর তানজিনার মা তানজিনার কাছ থেকে জানতে পারলো মিহাল যে তানজিনাকে ফ্রেন্ডদের সাথে বাজে ভাবে পরিচয় করিয়েছে। তানজিনার মা এতো রাতেই মিহালের মাকে ফোন করেন। মিহাল তখন সবে নিজের বাসায় এসেছে। মিহালের মা মিহালের রুমে গিয়ে মিহালকে চ*ড় মে*রে মিহাল ও মিহালের বাবাকে সাথে নিয়ে তানজিনাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মিহালকে তানজিনার কাছে মাফ চাওয়াবে এটাই তার ইচ্ছে। মিহাল বিনাবাক্য ব্যয়ে যেতে রাজি হয়ে যায়। এমনকি মিহালের মা মিহালকে থা*প্প*ড় মে*রে’ছিল তখনও মিহাল ছিল নির্বিকার! যেনো সে কিঞ্চিত পরিমান হলেও অবগত ছিল ঘটে যাওয়া বিষয়টার বিষয়ে।

রাত প্রায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই। মিহালরা তানজিনাদের বাড়িতে গিয়ে পোঁছায়। তানজিনাদের বসার ঘরে ইতোমধ্যে তানজিনা সহ ওর বাবা-মা ও ভাই-ভাবি বর্তমান। মিহালরা পোঁছালে তানজিনার মা প্রথমে মিহালের মায়ের দিকে প্রশ্ন ছোঁড়েন,

–এসব কি মহিমা? তোমার ছেলে অনবরত আমার মেয়েকে অপমান কেনো করে? এসবের কারণ কি মহিমা?

মিহালের মা ব্যাস্ত হয়ে বলেন,
–আমি মিহালকে তানজিনার কাছে মাফ চাওয়াতে নিয়ে এসেছি তাহমিনা। মিহাল এমনটা আর করবে না। আমার ছেলের দ্বারা খুব বড় অন্যায় হয়ে গেছে।

তৎক্ষণাৎ মিহাল তার মাকে বাধা প্রদান করে বলে উঠে,
–উহু মা। একদম না। আমার দ্বারা অন্যায় হয়েছে মানলাম তবে সেটা খুব বড় না। সামান্য পরিমানে। তানজিনার জায়গায় যদি অন্যকেউ হতো তবে সেটা অতিকায় বৃহৎ অন্যায় বলে গণ্য হতো। কিন্তু বিষয় যখন তানজিনা তখন মাফ তানজিনার কাছে চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তানজিনা কি কি করে এসেছে এসব বললে লজ্জায় আপনারা মুখ দেখাতে পারবেন না। আমি ওর এই কর্মের জন্য ওকে সারাজীবন এভাবেই লাঞ্ছিত করে যাবো যদি ওর সাথে আমার সারাজীবন থাকতে হয়। মোট কথা, ওর কোনো সম্মান আমার কাছে নেই।

মিহালের মা মিহালকে আরও একটা থা*প্প*ড় মা*র-লেন। মিহাল তাও নির্বিকার। তানজিনার বাবা-মা ও ভাবি হতভম্ব ও তানজিনার ভাই তামজিদ ফুঁসে উঠে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে রা’গান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেন,

–তুমি কিসের উপর ভিত্তি করে আমার বোনকে দোষি ভাবো? কি করেছে আমার বোন?

এদিকে তানজিনার ভয়ে দুরুদুরু অবস্থা। মিহালের বাবাও চুপ করে বসে আছেন। মিহাল ওর বাবাকে তানজিনার প্রকৃতি সম্পর্কে খানিকটা অবগত করিয়ে রেখেছিল। মিহাল উঠে গিয়ে তামজিদের সম্মুখে দাঁড়ায় তারপর চোখের পাতা অনড় রেখে বলে,

–ছেলেদের সাথে মিথ্যে ভালোবাসার নাটক ও আশা দেখিয়ে নিজের ফায়দা হাসিল করা ও কারও ইমোশোনকে হাসির পাত্র বানিয়ে অপমান করা। আমার এখনও মনে আছে, ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসের প্রায় শেষের দিকে আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড সাজিদ, যে কী-না দারুন মেধাবী ছিল কিন্তু দেখতে কালো ছিল। সাজিদ তানজিনাকে চিঠি লিখে খুব স্বল্প ও ভদ্র ভাষায় তার মনের কথা জানানোর পর তানজিনা পুরো ক্লাসের সামনে সাজিদকে অপমান করেছিল। সাজিদের নামে প্রিন্সিপ্যালের কাছে বিচার দিয়েছিল। প্রিন্সিপ্যাল তানজিনার বলার ধরণে বুঝেছিল যে সাজিদ তানজিনাকে অ’শ্লিল ইঙ্গিত ও বিরক্ত করেছিল! তারপর প্রিন্সিপ্যাল সাজিদের বাবা-মাকে কলেজে ডাকিয়ে এসব বলেছিল এবং সাজিদকে এক সপ্তাহের জন্য কলেজ থেকে সাসপেন্ড করেছিল। সাজিদের বাবা-মা এরপর সাজিদকে কলেজ ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই একটা কারণে সাজিদ কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারে নি আর সাজিদের বোর্ড থেকে সব চেঞ্জ করায় সাজিদ একদম নতুন পরিবেশে নিজেকে মানাতে পারে নি। ইন্টার পরীক্ষা তার আশানুরূপ হয় নি। বুয়েটের স্বপ্ন তার অধরাই থেকে গেছিলো। আরও অনেক মানুষের ইমোশোনকে অপমান করছে কিন্তু তার মধ্যে সাজিদের ঘটনাটা অধিক গুরতর ছিল। আর আপনি চাইলে আমি তানজিনার ভার্সিটির সিনিয়র নাহিদ ভাই ও তানজিনার ব্যাচমেট রাকিবকে এই মুহূর্তে ফোন করতে পারি। ওদের কেমন মিথ্যে ভালোবাসার আশ্বাস দিয়ে ঠকিয়ে এসেছে তা জানবেন।

উপস্থিত সকলে বিস্ময়ে হতবাক। তানজিনা মূর্তির ন্যায় হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগের কাহিনী যে এখন সামনে আসবে তা তার ঘুণাক্ষরেও ধারণা হয় নি। নাহিদ ও রাকিবের কথা কিছুটা গোজামেল দিয়ে কাঁটানো যেতো। তামজিদ সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

–তুমি সাজিদের ব্যাপারটায় সত্য বলছো তার প্রমান কি? প্রিন্সিপ্যাল আমাদের তো জানিয়েছিলেন। সাজিদ নির্দোষ তার প্রমান কি?

মিহাল হেসে জবাব দেয়,
–ইনায়া বাদে যারা ক্লাসে সেসময় উপস্থিত ছিল তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে জবাব পেয়ে যাবেন। আর সাজিদ আমাদের হাতে-পায়ে ধরে রিকুয়েস্ট করাতে প্রিন্সিপ্যালের কাছে সেদিন বলতে পারি নি সত্যটা কিন্তু পরেরদিন বলার পর প্রিন্সিপ্যাল সাজিদকে ফোন দিয়ে ডাকিয়ে এনে তাকে সাসপেন্ড থেকে ফ্রি করতে চেয়েছিল আর তানজিনাকে সাসপেন্ড করতে চেয়েছিল কিন্তু সাজিদ প্রিন্সিপ্যালের কাছ থেকে ওয়াদা নেওয়াতে প্রিন্সিপ্যাল চুপ করে থাকেন তবে প্রিন্সিপ্যাল যে তানজিনাকে সাবধান করেছিল পারসোনালি তা তানজিনা নিজেও জানে।

উপস্থিত সকলের মধ্যে আরেকদফা বিস্ময় যেনো ছেয়ে গেলো।

চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ও কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।