শেষের পঙক্তি পর্ব-৬+৭

0
472

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
তূর নীরার হাত ধরে বললো,
–ডাক্তার ইফতি কিন্তু তার অতীতের ভালোবাসার মানুষটার নামের মেয়ে আরো অনেক দেখেছে। প্রথম প্রথম নাম শুনে থমকে গেলেও নামের অধিকারিণী তার হৃদয় কাড়ে নি। ১০ বছর তো কম সময় নয়। সে অনেক কম বয়সি সুন্দর নীরা নামের মেয়ে দেখেছে কিন্তু কাউকে ওই নামটা ছাড়া আর ভালো লাগাতে পারে নি নিজের কাছে। কাউকে দেখে তার মনে হয় নি জীবনে কাউকে আনা উচিত। কিন্তু তোকে দেখে মনে হয়েছে তার। আর সে তোকে কেনো বিয়ে করতে চায় তা তার কাছে সঙ্গা এমন ছিল যে,
“তার কস্ট গুলো আমাকে খুব গভীর ভাবে ছুঁয়েছিল। যখন তার কান্নারত ও ক্লান্ত মুখ নিয়ে হসপিটালের করিডরে ঢলে পরছিল তখন তাকে আগলানো আমিটা যেনো ভিতর থেকে বলছিল, সারাজীবন আগলাতে হবে একে!”

নীরা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মাস চারেক আগে যখন নীরা ওর মাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল আর ডাক্তার ওর মায়ের অনেকগুলা টেস্ট করতে দেয়, সেই ডাক্তার টা ছিল ইফতি। নীরার মায়ের বলা সমস্যা অনুসারে চেকআপ করতে দিলে। নীরা সব চেকআপ করায় আর তখন ইফতি নীরার নাম জানতে পারেন। পরেরদিন নীরা ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তার ইফতির কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার ইফতির তখন বিকেলের কেবিনে রোগী দেখার প্রায় শেষ সময় ছিল। নীরার পর আরেকটা পেশেন্টের পর রাউন্ডের সময় ছিল তার। নীরার মায়ের রিপোর্টে এসেছিল, হাই LDL, হৃৎপিন্ডে কপাটিকাতে চর্বি জমেছে মানে ব্লকের কাছাকাছি আর ফ্যাটি লিভার।
ডাক্তার ইফতি তখন নীরাকে একন লিভার স্পেশালিষ্ট সাজেস্ট করার পর হৃৎপিন্ডের জন্য প্রয়োজনীয় মেডিসিন ও ডায়েট চার্ট দেয়। নীরাকে তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলার পর ডাক্তার ইফতি খেয়াল করেছিল যে নীরার শরীর কাঁপছে আর চোখ মুখের অবস্থাও ভালো না। কেবিন থেকে বের হয়ে নীরা করিডোরের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল যাতে অন্য রোগীর প্রবলেম না হয়। বাবা-মায়ের অসুস্থতা সন্তানের জন্য কতোটা কস্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। ইফতির রোগী দেখা শেষ হবার পর করিডোরের জানালার দিকে নজর যাওয়ার পর নীরাকে দেখেছিল কাঁদতে। ডাক্তার ইফতি সেখানে এগিয়ে যাওয়া ধরতেই নীরা সেন্সলেস হয়ে ঢলে পরতে নিয়েছিল। সারাদিন ভার্সিটিতে থেকে না খাওয়া ছিল আর টেনশনে প্রেশার ফল করেছিল।

তূরের ধা*ক্কাতে বাস্তবে ফেরে নীরা তারপর সেখান থেকে উঠে চলে যায়। তূর নীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে গোসল করতে চলে যায়। তারপর নামাজ ও খাওয়ার পর এলার্ম দিয়ে ঘুম দেয়।

________
রাত ১০ টা। সবাই গাবতলিতে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তূর ঘুমে ঢলে পরছে। সন্ধ্যার নামাজের পর সে আরো এক ঘন্টা ঘুমিয়ে ৮ টার সময় উঠে রেডি হয়ে রওনা হয়েছে। এখন বাসে বসা নিয়ে বিড়ম্বনা চলছে। ৭টা ডাবল সিট নিয়েছে। লিরা ও ফাইজা, রিজভী ও তাইজুল, রাফি ও অর্ক, তাওহীদ ও আসফি, নাদিয়া ও তার হাসবেন্ড শাফকাত, এবার রণক বলে সে জারিনের সাথে বসবে। আর তূর ঘুমে ঢলে পরছে বলে তূর জারিনের সাথে বসবে। জারিন রণককে বুঝিয়ে মিহালের সাথে বসায়। জারিন ও তূর একসাথে।

যাত্রা বিরতিতেও তূর ঘুমাচ্ছে। জারিন তূরের পাশে বসেছিল। তূর জারিনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে এতক্ষণ। এখন জারিনের ঘুম পাচ্ছে বলে জারিন মিহালকে তূরের পাশে বসতে বলে সে রণকের পাশে বসে। মিহাল আর রণক এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে এখন ওরা ঘুমাবে না। মিহাল গিয়ে তূরের পাশে বসে। জারিনরা সবাই জানে তূরকে মিহাল ভালোবাসে কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে সে তূরকে জানাতে নারাজ। তূর কিছুক্ষণ জানালার সাথে মা’থা ঠেকায়, কতক্ষণ সিটের সাথে এরপর মিহালের কাঁধে। জার্নির ধকল সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুষাচ্ছে।

সকাল ৮ টায় ওরা সিলেট মেইন টাউনে পৌঁছায়। মিহাল তূরের ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগেই জারিনকে আবার তূরের পাশে বসিয়ে দেয়। ওরা সবাই সেখানে ২ ঘন্টার জন্য হোটেলের দুইটা ডাবল বেডের রুম ভাড়া করে ফ্রেশ হয় ও নাস্তা করে। তারপর হযরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার দর্শনে বেরিয়ে পরে। যেহেতু দুই দিনের ঘোরাঘুরিতে এসেছে তাই প্রথম দিনই ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। দুইটা মাজার দর্শন করতে করতে দুপুর হয়ে যাচ্ছে। মাজার এরিয়াতে দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা আবারও বাস স্ট্যান্ডে আসে। বাস স্ট্যান্ড থেকে লাক্কাতুরা চা-বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

লাক্কাতুরা চা বাগানে এসে তো মেয়েদের ছবি তোলার ধুম পরে গেছে। চা বাগানের পাশ দিয়ে ও ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা এতো সুন্দর আর পুরো চা বাগানটা এতোটা মনোমুগ্ধকর যে বারবার এই সবুজের সমারোহে হারাতে মন চায়। পাহাড়ের ঢালের মতো চা বাগান। তার মাঝে মাঝে কিছু বৃক্ষরাজি তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ওরা সবাই নিজের মনের আহ্লাদ মিটিয়ে পরিবেশ উপভোগ করছে। চা বাগানের পাতা সংগ্রহকারীদের সাথে সবাই দুই একটা পাতা তুলে হাতে নিয়ে ছবি তুলেছে অনেক। মিহাল কিছুটা দূর থেকে তূর দুই হাত দিয়ে “দুইটি পাতা একটি কুঁড়ি” যখন তুলছিল আর হাসছিল, তখন মিহাল ওর ছবি তুলে নেয়। আকস্মিক তোলা ছবিটা অসম্ভব সুন্দর উঠে। মিহাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে সগোউক্তি করে,

“তার স্নিগ্ধ হাসিতে মুগ্ধ হোক আমার হৃদয়। এই ওষ্ঠকোনে হাসির রেশ যেন অম্লিন থাকে।”

ঘন্টা দুয়েক চা বাগানে ঘোরাঘুরি করে চা বাগানের আশেপাশের চায়ের দোকান থেকে ওরা সবাই ফ্রেশ চা-পাতি দিয়ে বানানো চা পান করে শ্রিমংগলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করে। শ্রিমংগলে একটা কাঠের বাংলা টাইপ হোটেলে ওরা বুকড করে রেখেছে। হোটেলটা চা বাগানের মধ্য আর অনেক গুলো বাংলো টাইপ কিছুটা দূরে দূরে। সেখানে রাতে থাকবে এরপর সকালে শ্রিমংগল ঘোরাঘুরি করবে। বাংলোটাতে চারটা রুম। দুইটা মেয়েদের দখলে আর দুইটা ছেলেদের। বিবাহিতদেরও এখানে সিঙ্গেলের মতো থাকতে হবে।

সন্ধ্যার পর ওরা বাংলোতে পৌঁছায়। বাংলোর সামনে বন ফা’য়ার করা আছে। বন ফা’য়ারের মধ্যে চিকেন গ্রিল করার ইচ্ছে ওদের তাই কেয়ারটেকারকে বলে সব বন্দোবস্ত করে আনে। বন ফা’য়ারের চারপাশে পাটি বিছিয়ে ওরা গান-আড্ডা দিচ্ছে আর খানিকটা দূরে আরেকটা বন ফা’য়ার করে তাতে কেয়ারটেকার কয়েকজন হেল্পিং হ্যান্ড আনিয়ে চিকেন গ্রিল করছে। এই বাংলোটা কাল দুপুর ১২ টার মধ্যেই ছেড়ে দিবে। বন ফা’য়ারের ঈষৎ হলুদাভাব আলোতে দুই জোড়া চোখ লুকুচুরি খেলছে আড়ালে। চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি সরানোর যেনো এক অনবদ্য প্রতিযোগীতা! নাদিয়া ও শাফকাত, রণক ও জারিন তো পাশাপাশি বসেছে। অর্ক গিটার এনেছে সাথে। অর্ক গিটারের টুংটাং মিউজিক তুলছে। ওরা একটা খেলা খেলবে। যেখানে দুইটা বক্সে চিরকুট থাকবে। একটাতে ওদের প্রত্যেকের নামের চিরকুট আরেকটাতে কিছু করে দেখাতে হবে সেসব নাম। প্রথমে এলো শাফকাতের নাম আর তার পড়লো গান। শাফকাত কোনোমতে দুই লাইন গান গেলো জেমস ব্র্যান্ডের। তারপর একে একে সবার নাচ, আবৃতি, অভিনয়, জোকস, যেকোনো একটা লুকানো সত্য বলা এসব আসলো। তূরের পড়েছে আবৃতি।

তূর কবি সুফিয়া কামালের “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতার কিছু লাইন আবৃতি করে।

“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারি না কোনমতে। ”

কবিতাটার এই কয়েকটা পঙক্তিই যেনো পুরো কবিতার ভাবার্থ নির্দেশ করে।

মিহালের বেলায় গান পড়াতে মিহাল গায়,
“আমি পারি নি তোমাকে, আপন করে রাখতে।
আমি পারি নি তোমাকে, আবার আমার করে রাখতে।
তুমি বুঝোনি, আমি বলি নি,
তুমি স্বপ্নতে কেন আসোনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে সব গেয়েছি।”

তূর গানটা মিহালের কন্ঠে শুনে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। যে গাইছে তার পুরো বিপরীত এই গানটা তূরের কাছে। মিহাল গানটার এক প্যারা গেয়ে আর গায় না। মিহালের মনে চলতে থাকে,
“তোমাকে সেদিন রিজেক্ট করারও কারণ ছিল তূর। ইনায়া তানজিনাকে সব বলেছে যানো! তানজিনাকে নিজের জীবন থেকে না সরিয়ে তোমাকে আমি আমার জীবনে আনতে পারবো না। আমার মা তখন তোমাকে সহ্য করতে পারবে না। তানজিনার জন্য তো আম্মু আমাকে কম মানসিক যন্ত্রনা দেয় না! তানজিনা নিজ থেকেই আমার জীবন থেকে সরে যাবে সেটার বন্দোবস্ত করতে হবে।”

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৭
নাম না জানা পাখির কলরবে মুখরিত চারিপাশ। শ্রীমঙ্গলে ঘোরাঘুরি শুরু করবে সবাই। সকালের নাস্তার পর শ্রীমঙ্গলে টুকটাক ঘোরাফেরা করে রাতারগুলের উদ্দেশ্যে বের হয় বাংলোটা ছেড়ে দিয়ে। সাড়ে তিন ঘন্টা পর রাতারগুল পৌঁছে। রাতারগুল পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর দেড়টার বেশি বেজে গেছে। ওরা প্যাকেট বিরিয়ানি ও পানি কিনে নিয়েছিল সেটা খেয়ে নিয়েছে। রাতারগুল যাওয়ার পর নাদিয়া বলে,

–এখানে থেকে যাবো না আমি। এখানেই থাকবো। আহা! বন-জঙ্গলে ঘুরে বেরাবো। নৌকাতে ঘুরবো।

শাফকাত অসহায়ের মতো বলে,
–না মানে, আমি তো আর স’রকারি জমি কিনতে পারবো না। তো তুমি কী ব’নমা’নুষের মতো যা’যাবর জীবন যাপন করতে চাও? তিন বেলা কী ফল-মূল খেতে হবে?

সবাই হেসে উঠে। নাদিয়ে শাফকাতকে ঠে’লা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে।

ওরা সবে মাত্র নৌকাতে উঠেছে। নৌকা গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে এগুচ্ছে। গাছের লতা গুলো পানি ছুঁয়ে আছে। সময়টা বসন্ত কাল তাই পানি লেভেলে আছে। বর্ষা কালের দিকে হলে গাছের অর্ধেকের মতো পানির নিচে থাকতো। তখন সা’পের উপদ্রব বেশি হতো।
স্বচ্ছ পানি হাত ও পা দিয়ে অনবরত নাড়ছে তূর। পা নৌকাতে উঠাতে বলছে সবাই কিন্তু তূর তো উঠাবে না। মিহাল অন্য নৌকা থেকে তূরের ছবি তুলে কিছু।

তূর স্নিগ্ধ হেসে বলে,
–স্বচ্ছ জলরাশির বিন্দু মাত্র কণাও মানুষের মনের বিষাদ কমাতে পারে। আচ্ছা এর গভীরতা কতটুকু?

আসফি জবাব দেয়,
–কেন তোর কি ডুব দিতে মন চাচ্ছে?

তূর মুখ ভেঙচি দিয়ে নিজের কাজে মত্ত হলো। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে রাতারগুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করছে সবাই। ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশের এরিয়াতে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে ছবি তোলা শেষ হলে ওরা জাফলং এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। জাফলং যেতে আরো দেড় ঘন্টা লাগে। সন্ধ্যার আগে জাফলং থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিকেল সাড়ে চারটায় জাফলং পৌঁছে ওরা পিয়াইন নদীর কাছে যায়। জাফলং সীমান্ত ইন্ডিয়ার ডাওকি অঞ্চলের পাশে। ডাওকি অঞ্চলের পাহার থেকে ডাওকি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কাঁটাতার দিয়ে সীমান্ত আলাদা করা। জাফলং পাথরের জন্য বিখ্যাত পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি।

জাফলংয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই ওরা জাফলংয়ে মাত্র এক ঘন্টা ঘোরাফেরা করে ফেরার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠে। এখন ওরা মালনীছড়া চা বাগানের কাছে একটা হোটেলে রুম বুকড করেছে। সেখানে পৌঁছাতে রাত ১১ টা তো বাজবে। হোটেলের মালিককে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। রাতে হোটেলে থেকে সকালে মালনীছড়াতে ঘুরবে তারপর রেস্ট নিয়ে গ্রিনলাইন বাসে করে ফিরবে। গ্রিনলাইনের ডাবল ডেকারে করে যাবে। সিট শুয়ে থাকার জন্য উপযোগী।

এতো পথ ঘোরাফেরা ও জার্নি করে সবাই ভীষণ ক্লান্ত। হোটেল ম্যানেজারের কাছে থেকে রুমের চাবি নিয়ে যে যার যার রুমে গিয়ে ব্যাগে থাকা কিছু বিস্কিট ও কেক খেয়ে পানি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। রুম ৭টা বুক করা হয়েছে যাতে আরাম করে ঘুমাতে পারে।

সকাল বেলা তূরের রুমের বাহিরে একটা পার্সেল পায় জারিন। জারিন তূরের আগে ঘুম থেকে উঠেছে। জারিন পার্সেলটা দেখে এদিক সেদিক তাকায়। ওরা যে সাতটা রুম ভাড়া করেছে তা সবগুলো একই ফ্লোরে না। আর এই ফ্লোরের রুম গুলো কয়েকটা বাহির থেকে তালা দেওয়া মানে অন্য দর্শনার্থীরা চা-বাগান ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। জারিন পার্সেলটা হাতে নিয়ে দেখে তাতে তূরের নাম লেখা। তূরের নাম দেখে পার্সেলটা ভিতরে নিয়ে গিয়ে তূরকে ডাক দেয়। তূর অনেকটা গাড়ো ঘুমে আচ্ছন্ন। জারিন ডাকলে সে আরো নড়েচড়ে ঘুমাচ্ছে। জারিন এবার গ্লাসের পানি তূরের উপর ছিটাতে থাকে। তূর ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে পানির উৎস খুঁজতে থাকে তারপর জারিনের হাতে পানির গ্লাস দেখে উঠে জারিনকে এলোপাথাড়ি মা*রতে থাকে আর বলতে থাকে,

–আমার ঘুমটা এভাবে নষ্ট করলি কেন? ডাকার জন্য তো তোর গ’লা আছে, মুখ আছে তো পানির প্রয়োগ করলি কেন?

জারিন তূরকে সাথে করে দুয়েক ঘা দিয়ে বলে,
–তোর নামে পার্সেল এসেছে। তাই তো ডাকলাম। আর তুই তো উঠিছিলি না।

তূর পার্সেলের কথা শুনে ভ্রঁ কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
–পার্সেল কে পাঠাবে? আর সিলেটে আমার পরিচিত কেউ নেই।

জারিন পার্সেলটা এগিয়ে দিলো। পার্সেলের ভিতর দুইটা ব্যাগের সাথে একটা চিরকুট। চিরকুটটাও ইউনিক শেইপে। বাটারফ্লাই শেইপে চিরকুট এর সাথে জোড়া লাভ শেইপ দিয়ে ডাবল পার্ট করা। মানে বাটারফ্লাই ও লাভের মাঝ বরাবর গ্লু দিয়ে লাগানো। বাটারফ্লাই অংশটা নীল রঙের। সেখানে লেখা,

“এই যে আমার অনেক শখের খুঁজে পাওয়া প্রজাপতি! ভালোবাসি! আমার হৃদয় অন্তরিক্ষের শুভ্রতায় তুমি এক একচ্ছত্র প্রজাপতি। যার রঙ নীল! কারণ ভালোবাসা ও বেদনা দুইটাই নীল রঙে। তুমি কিন্তু মেঘের মতোও! কখনো শুভ্র মেঘের মতো প্রাণোচ্ছল আবার কখনো কৃষ্ণ মেঘের মতো বিষাদে পরিপূর্ণ। তোমার সুখ ও কষ্টের উভয়ের কারণ একান্ত আমি। হয়তো এখন আমি তোমার মনে ঘৃণাতে! হোক ঘৃণা। তোমার মনেই তো বিরাজমান।”

তূর চিরকুটের লেখাগুলো পড়ে স্তব্ধ। এতো প্রগাঢ় অনুভূতির আশ্রয়ে চিরকুটটা কি তবে তার আকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির থেকে? কিন্তু কেনো? আর এতোই যদি তূর সেই আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের জীবনে আকাঙ্ক্ষিতা হয়, তবে কেনো এতো অবহেলা?
তূর এবার লাভ শেইপের চিরকুটটা পড়তে থাকে,

“হৃদয়হরণীর হৃদয়ের র’ক্তক্ষরণের কারণ যদি আমি হই তবে এর ঔষুধও হবো সয়ং আমি! হৃদয়হরণীকে নিয়ে আমি খুবই ঈর্ষান্বিত। তার মুখের হাসি অন্যকোনো পুরুষ হোক সেটা যে আমার সহ্যশক্তির এক অতীব রূঢ় যন্ত্রণা!”

তূর এবার চিরকুটটা পাশে রেখে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। তার এখন যন্ত্রণাদায়ক মা’থাব্যথা হচ্ছে। হুট করে মাথাব্যথা তার চার বছর আগে শুরু হওয়া বিষাদময় অসুখের লক্ষণ। এই অসুখ থেকে মুক্তি পেতে সে আবহাওয়া বদল করে ভিনদেশে চলে গিয়েছিল। যেই বিষাদময় অসুখ তাকে আ*ত্মহ’ননের চিন্তা করিয়েছিল। ডিপ্রেশনের এমন অবস্থায় গিয়েছিল যে শারিরিক কোনো আঘাত ছাড়াও তূর নিজেকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। যেকোনো ঔষুধের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতো।

জারিন তূরের এভাবে বসে থাকতে দেখে প্রথমে না বুঝে চেয়ে থাকে পরে কিছু মনে হতেই আঁতকে উঠে। তূরের সেসময়ের অবস্থা সম্পর্কে তার জানা। তূর তো ফার্মেসিতে পড়াশোনা করেছে। তূরের বাবা চেয়েছিল তূরকে ডিপার্টমেন্ট বদল করাবে কিন্তু সাইক্রিয়াটিস্টের কথায় আর বদল করে নি। ঔষুধের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থেকে সে এটার সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হবে এবং তারপর আস্তে আস্তে এই ভীতি কেটে যাবে। আর ঔষুধ খেতে ইচ্ছে হলে অক্ষতিকারক ঔষুধ খাবে নিজে জেনে বুঝেই। তারপর আবহাওয়া বদলের কথা বলেন। তূর তারপর চলে গিয়েছিল আমেরিকা।

জারিন তূরকে পানি খাওয়ায়। তূর পানি খেয়ে জারিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

–ও ও আমাকে কি সত্যি ভালোবাসে? তাহলে সেদিন কেনো আমাকে..? আর এগুলো কি ও দিয়েছে? বল না জারিন?

জারিন এবার শিউর পার্সেল মিহাল দিয়েছে। কিন্তু তূরকে কি বলবে? তূরকে সব বললে যদি হীতের বিপরিত হয়? জারিন কথা কাটানোর জন্য বলে,

–আমার মনে হয় কি, তুই মিহালকে পর্যবেক্ষণ করতে থাক। বুঝতে চেষ্টা কর নিজ থেকে। এভাবে কাঁদলে হবে না। তোকে শক্ত হতে হবে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ও কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।