শেষ পাতায় তুমি পর্ব-০২

0
3661

#শেষ_পাতায়_তুমি
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২|

সকাল ৮টা ৩০মিনিট।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সবাই তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ত মানুষের ভীড়ে নগরীও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মেহের তখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মাহি মেহেরের রুমের দরজা খুলে অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আছে। যে মেয়ে রোজ সকাল সকাল উঠে রেওয়াজে ব্যস্ত থাকে সে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে এখনো ঘুমে বিভোর।

মাহি দ্রুত মেহেরের কাছে গিয়ে মেহেরকে ধাক্কা মেরে উঠাচ্ছে।
“মেহু পাখি,ভার্সিটিতে যাবি না? আজকে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিস কেন? উঠ কলিজা আমার।”

মেহের নড়ে-চড়ে বলল, “আপু ২মিনিট। আরেকটু ঘুমাই।”

মাহি মেহেরকে জোর করে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিল।
“এখুনি ফ্রেশ হতে যা। আমি তোর ড্রেস, ব্যাগ পত্র রেডি করছি।”

মাহি আলমারি থেকে মেহেরের জামা কাপড় বের করতে চলে গেল। মেহের হাটুর উপরে মাথা রাখল ঘুম ঘুম চোখে। হটাৎ করে মেহেরের মনে হচ্ছে বিছানা কাঁপছে।
মেহের চমকে উঠল। তারপর চোখ ডলে বুঝতে পারল মাথা রাখতেই চোখ লেগে এসেছিল আর ওর ফোনটা বাজছে।
মেহের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল স্কিনে ভাসছে “তূর্য ভাইয়া”।

মেহের ফোন রিসিভ করে বলল,
” আরে জিজু আপনি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন সকাল সকাল। এখনো শরীর কাঁপছে। কি সাংঘাতিক লোক আপনি?”

অপর পাশ থেকে তূর্য কিছু বুঝতে পারছেনা। তাই বলল,” শালিকা কি করলাম আমি?”

“আপনার ফোনের কারণে আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে ভ হয়ে গেছে।” (হাই তুলতে তুলতে)

“তুমি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাও? মাহি তো উল্টো বলল তোমাকে ফোন করতে। তাই করলাম। শালিকা এমন হচ্ছে কেন যা করছি তাতেই ঘাপলা লেগে যাচ্ছে।”

মেহের চিন্তিত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে ভাইয়া? সিরিয়াস কিছু?”

তূর্য সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“খুবই সিরিয়াস বিষয়। তোমার আপু আমার সাথে রাগ করেছে। তার প্রধান কারণ তুমি আমার উপর রাগ করেছ। তুমি ইটস ওকে না বললে সে আমার সাথে কথা বলবে না। বোন আমার তোমার জন্য এক ট্রাক আইসক্রিম পাঠিয়ে দেব। তবুও তোমার বোনকে শুনিয়ে ইটস ওকে বলো। মাহি তোমার রুমেই আছে সেটা আমি জানি।”

মেহের হাই তুলতে তুলতে বলল,
“দুই পাগলের পাল্লায় পড়েছি। কি প্রেম এদের। আমার বোন তো একটা তারছিড়া। আপনিও ওর সাথে সাথে তারছিড়া হয়ে যাচ্ছেন? আপনাকে তো সুস্থ মানুষ ভেবেছিলাম।”

“সে উপায় নেই মেহের। পাগলের সাথে থাকলে পাগল না হয়ে উপায় নেই। এই এটা যেন মাহি না জানে। আমি ওকে পাগল বলেছি শুনলে কেইস আরো খারাপ হয়ে যাবে। এখন তোমার আপুকে শুনিয়ে ইটস ওকে বলো। তুমি যত আইসক্রিম চাইবে দেব। আমার হব হব সংসারটা ভেঙে দিও না।”

মেহের হেসে মাহিকে শুনিয়ে জোরে বলল,”ইটস ওকে জিজু।”

মাহি মুচকি হেসে জামাকাপড় রেখে চলে গেল।
তূর্য বলল,”তোমার আপু হেসেছে?”

“হ্যাঁ, ভাইয়া হেসেছে। আপনারা এমন বিহেভ করেন যেন আমি ছোট বাচ্চা।”

“হ্যাঁ তুমি বাচ্চা। তোমার আপুর বাচ্চা। সাথে আমারও। বিয়ের আগেই ১৯বছরের একটা মেয়ের বাবা হয়ে গেছি। তোমার আপু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। মাহির খুশি আমার কাছে সবার আগে। আর তাছাড়া আমিও তোমাকে ছোট থেকে নিজের বোন মনে করে ভালোবেসে এসেছি।”

মেহের আবেগী হয়ে পড়ল।
“আমি জানি ভাইয়া আপনারা দু’জনই আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। তবে এতটা প্রায়োরিটি দিবেন না যাতে আপনাদের সম্পর্কে ঘাটতি থেকে যায়।”

তূর্য কিছু বলবে তখনই মেহের তাড়া দেখিয়ে বলল,”ভাইয়া আমার ভার্সিটিতে যেতে হবে। আ’ম অলরেডি লেইট।”
মেহের খট করে ফোন কেটে দৌড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

.

মেহের দোকান থেকে চকলেটের প্যাকেট কিনে সেই প্যাকেটা দিয়ে বলের মতো খেলছে আর গান গাইছে।
“এখন তো সময় ভালোবাসার। এ দুটি হৃদয় কাছে আসার। আমিও একা তুমিও একা,,,”
মেহের সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে ঢোক গিলে গান বন্ধ করে দিল।

ফায়াজ ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে ওর দিকে।
“এই মেয়ে তুমি কি শুধু সারাক্ষণ গান গাও?”

মেহের আবারও ঢোক গিলছে। সেদিন অনু,ওলিদ আর আলিফের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে। আর মাহি আপুর হুশিয়ারি কথাগুলো মনে পড়তেই মেহের কোনো দিকে না তাকিয়ে ভো দৌড়।
ফায়াজ বিস্ময় নিয়ে মেহেরের যাওয়া দেখছে। মেহের হুট করে দৌড় মারল কেন? কি এমন বলেছে ও?

ফায়াজ বিরবির করে বলছে, “পাগল নাকি এই মেয়ে? নির্ঘাত মাথায় গন্ডগোল আছে।”

ফায়াজের বন্ধু বলল,”আরে না মেয়েটা ভিতু টাইপের তাই ভয় পেয়ে দৌড় মেরেছে।”

ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,”আমি কি ওকে ইভটিজিং করছি নাকি? আমাকে দেখে কি ইভটিজার মনে হয়? অদ্ভুৎ।”

ফায়াজ বিরক্তি মুখ নিয়ে সিগারেট বের করে ধরাতে নিবে তখনই ফায়াজের বন্ধু ইশান বলল,
“মাহির কি খবর? আসেনি আজ?”

ফায়াজ সিগারেটে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল,
“ওর নাকি জ্বর তাই আসে নি।”

ইশান বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
“গার্লফ্রেন্ডের জ্বর আর তুই বসে আছিস?”

ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,”তো কি করব? আমি কি ডাক্তার?”

ইশান বলল,” ভাই দেখতে যাবি, দেখতে।গার্লফ্রেন্ডের জ্বর তাকে দেখতে যাওয়া তোর দায়িত্ব।”

“ওর বাসায় কি আমাকে এলাউ করবে? বলদের মতো কথা বলিস কেন?”
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল।

“তাতে কি তুই দেয়াল টপকে যাবি। পাইপ বেয়ে বারান্দা অথবা ছাদ দিয়ে রুমে ঢুকবি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকবি। যে-ভাবেই হোক ঢুকবি।”

ফায়াজ ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফায়াজ এমন চিপ কাজ করে না।”

“ফায়াজ করে না কিন্তু একজন প্রেমিক করে। প্রেমিকেরা এর চেয়েও বেশি চিপ কাজ করে। প্রেমে পড়িলে প্রেমিকেরা সব করে। যেমন আমি করি,তুষার করে, সবাই করে।”

ফায়াজ সিগারেট ফেলে বলল,” তোদের মতো আমার এত প্রেম পায় না।”

তুষার ফায়াজের কথা শুনে বলল,” ভাই তুই এমন কেন? তোদের প্রেম এক মাসও হয়নি। নতুন নতুন প্রেমে মানুষ কত পাগলামি করে। তোকে তো কিছুই করতে দেখলাম না। কারণ কি?”

ফায়াজের সোজাসাপটা উত্তর,”জানি না। আমার পাগলামি করতে ইচ্ছে করে না। মাহিও তো কোনো পাগলামি করে না।”

ইশান হতাশ হয়ে বলল,”আমার কি মনে হয় জানিস?”

ফায়াজ চেহেরায় প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলিয়ে বলল,
“তোর আবার কি মনে হয়?”

ইশান তুষারের দিকে তাকিয়ে আছে। বলার সাহস পাচ্ছে না। ফায়াজ যদি রেগে যায়।
তুষার ইশানকে চুপ দেখে বলল,”আমার মনে হয় তুই ওর ভয়েস ভালোবাসিস, ওকে নয়।”

ফায়াজ চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ওই তো একি কথা। তার ভয়েস ভালোবাসি মানে তাকে ভালোবাসি।”

ইশান এইবার বলল,”তাহলে তো মেহেরকেও ভালোবাসিস।”

ফায়াজ চমকে বলল,”মেহের!! মেহের কে?”

তুষার বলল,”যার গান শুনে ওইদিন ফিদা হয়ে গেলি।”

ফায়াজ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে খুবই জটিল।”

ফায়াজ তারপর আনমনে ভাবতে লাগল,
“মেহেরের গানের ভয়েস আর মাহির পাঠানো গানের রের্কডিং এর ভয়েজ সেম মনে হয়। কোথাও একটা মিল আছে। কিছু একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু কি? ফায়াজ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।”

.

মেহের কলিং বেল বাজায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে দিল। তূর্য হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্যকে দেখে মেহেরের মুখেও হাসি ফুটল।
তূর্জ মেহেরকে বলল,”তোমার জন্য কি এনেছি দেখো শালিকা।”

দুইটা লোকের হাতে র‍্যাপিং করা দুইটা বড় বাক্স। মেহের বাক্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই গুলো কি তূর্জ ভাইয়া?”

তূর্য স্নিগ্ধ হেসে বলল,”তোমার জন্য আইসক্রিম এনেছি।”

মেহের চোখ বড়বড় করে বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর মিনমিন করে বলল,”আপনার মতো দুলাভাই যেন ঘরে ঘরে হয়।”

মাহিরা তূর্জর আসার খবর শুনে রুম থেকে এক প্রকার দৌড়েই বের হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে উস্টাও খেয়েছে একটা৷ নিচে এসে দেখে তূর্জ ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। আর মেহের সোফায় পা তুলে আইসক্রিম খাচ্ছে।

মাহিকে দেখে ওর মা বলল,
“এইতো মাহি চলে এসেছে। তোমরা গল্প করো।”
ওর মা মেহেরকে ইশারা করায় মেহের উঠে চলে গেল।

মাহি তূর্জের কাছে ঘেঁষে বলল,” আংকেল আন্টি নাকি বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে?”

“হ্যাঁ দিচ্ছে। তবে তাদের চেয়ে আমার তাড়া বেশি।”

মাহি চোখ ছোট ছোট করে বলল,”তোমার আবার কিসের তাড়া?”

তূর্জ বাকা হেসে বলল,”মাহিরে তোকে ছাড়া থাকা বড্ড কষ্টকর।”

মাহিরে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে লাজুক হাসি দিল।

তূর্জ মাহির বাবার বন্ধুর ছেলে। তাই পারিবারিক সম্পর্ক ভালো থাকায় ছোট থেকেই ওরা একে অপরকে চিনে। স্কুল
লেভেল থেকে একে অপরকে পছন্দ করে। কলেজে এসে ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিনতি পায়। তার কয়েক বছর পর তূর্জ নিজের পরিবারকে জানায় মাহিকে পছন্দ করার কথা। তারপর দু পরিবারের সম্মতিতে ওদের এনগেজমেন্ট হয়।
তূর্জ এ বাড়িতে প্রায়শই আসা যাওয়া করে। সবার সাথে গল্প করে, মাহি আর মেহেরকে নিয়ে বেড়াতে যায়। মাহি আর তূর্জ একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে।

.

চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিয়নের আলো আর গাড়ির হেড লাইটের আলো জ্বলতে শুরু করেছে। মাহি বারান্দার লাইট অফ করে কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর সময়টা কিছুদিন যাবত খারাপ যাচ্ছে। একটা চিন্তা মাথায় এসে ভর করেছে৷ রোজ সেই টেনশন মাথায় যন্ত্রণা শুরু করে। মনে হয় মাথার ভেতরে একটা পোকা উত্তাল-পাতাল করছে। আজকাল ঠিক করে ঘুম হয় না। ওর শুধু একটা জিনিসই চাই সেটা হচ্ছে তূর্জকে বিয়ে করা। কোনো ভাবে তূর্জের সাথে ওর বিয়েটা হয়ে গেলেই হয়। তাহলে ফায়াজ নামক ব্যক্তির কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।

ফায়াজ ফাকা বাড়িতে বসে বসে ড্রিংক করছে। বাড়িতে এলেই নিজেকে এই পৃথিবীর সব চেয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তি মনে হয়। নিজেকে এতিম এতিম লাগে। পরিবার, পরিজন কেউ নেই।
ফায়াজ গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। এই মাঝরাতে ওর হাসির শব্দ দেয়ালে বারি খেয়ে ফিরে এসে ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

চলবে….!