শেষ পাতায় তুমি পর্ব-০৫

0
3271

#শেষ_পাতায়_তুমি
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫|

মাহি নিজের রুমে পাথর হয়ে বসে আছে। তবে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মাহির মা কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে ঢুকে ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“মেহের এমন কেন করল? তুই সব জানতি তাই না?”

মাহি চুপ করে আছে। কথা বলছে না। মাহির মা মাহির নীরবতা দেখে চেচিয়ে বলল,
“আমি জানি তুই সব জানতি। তুই মেহেরের ব্যাপারে এমন কিছু নেই যে জানিস না। মেহের এমন একটা কাজ কি করে করল? ও তো এমন মেয়ে না।”

মাহি মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্না মিশ্রিত
কন্ঠে বলল,
“আমি জানতাম না, মা। আমি যদি জানতাম তবে জীবন দিয়ে হলেও ওকে বাঁধা দিতাম। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না মেহের বিয়ে করেছে। তাও ফায়াজকে। ওর কি হবে সেটা ভেবেই আমার কলিজা কেঁপে উঠছে।”

মাহির মা ওর দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তারপর বলল,
“তুই ওই ছেলেকে চিনিস?”

মাহি মায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল।
তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“ও আমাদের ভার্সিটির। পলিটিক্স করে। ও খুব খারাপ ছেলে মা। মেহেরকে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করো। বাবার সঙ্গে কথা বলো প্লিজ। মেহের ওখানে ভালো থাকবে না।”

মাহির মা এ-সব শুনে ভয় পেয়ে গেল। মেহের শেষ পর্যন্ত এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করল? কেন করল? মেহের তো এমন মেয়ে না। মেহের তার খুব আদরের মেয়ে।
মেহেরের মা কি করবে বুঝতে পারছে না। মেহেরের জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। মেহেরের বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মেহেরের বাবা খুব ক্ষেপে আছে। রাগ কমলে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। মেহেরের জীবনটা এভাবে তিনি নষ্ট হতে দিতে পারেন না।

মাহি মায়ের যাওয়ার পর দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে কাঁদতে লাগল।
“আমার জন্য এ-সব হয়েছে। আমার জন্য মেহেরের জীবনটা নরক হয়ে গেল। আমি ওকে যে নরক থেকে বাঁচাতে নিজে আগুন নিয়ে খেললাম সেই আগুনে ও পড়ে গেল। ফায়াজ এভাবে বদলা নিল? আমার দূর্বল জায়গায় এভাবে আঘাত করল? আমার কলিজাটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল? এত বড় গেম খেলতে পারল? ”

মেহের চোখে মুখে পানি দিয়ে ভাবছে,
“এখন যদি মা বাবাকে বুঝাতে পারে তবেই মেহের বাড়িতে ফিরে আসতে পারবে। মেহের আমাকে কিছু বলতে নিষেধ করেছে কিন্তু আমি তো অন্য উপায়ে চেষ্টা করতে পারি। এখন বাবা বুঝলেই হয়।”

.

ফায়াজ ড্রাইভ করছে। মেহের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজ মেহেরকে একটু পর পর দেখছে আর বিরক্তি নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। যারা এভাবে তাড়িয়ে দিল তাদের জন্য এভাবে কাঁদার কি আছে বুঝতে পারছে না।

ফায়াজের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌছে গেলে মেহেরকে ধমক দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে আরেকবার কাঁদলে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব। কখন থেকে ফেচফেচ ফেচফেচ করছে। জাস্ট বিরক্ত লাগছে।”

মেহের ফায়াজের ধমক খেয়ে চুপ করে গেল। ফায়াজের দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে আছে। জোর করে কান্নাটা আটকে রাখছে। কিন্তু পারছে না। ঠোঁট কামড়ে রেখেছে।

.

ফায়াজ গাড়ি থামিয়ে নেমে মেহেরকে নামতে বলল। মেহের চুপ করে বসে ছিল। কিছু একটা ভাবছিল। ফায়াজের ডাকে ঘোর ভাঙল। তারপর দেখল গাড়ি থামানো হয়েছে। ফায়াজ গাড়ির বাইরে। মেহের গাড়ি থেকে নামতেই ফায়াজ বাড়ির ভেতরের দিকে যাচ্ছে মেহেরকে ছাড়াই। মেহেরের অসুস্থ লাগছে। মাথাটা ঘুরছে। কাজি অফিসে নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে মাথাটা ঘুরছে। মেহেরের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মেহের কিছু ধরে ব্যালেন্স রাখার জন্য বন্ধ চোখেই হাত বাড়াল। কিন্তু হাতরে কিছুই পাচ্ছে না। ফায়াজ পেছনে ঘুরে মেহেরের এই অবস্থা দেখে দৌড়ে আসতে আসতেই মেহের মাটিতে পড়ে গেল।
ফায়াজ দ্রুত বসে মেহেরের মাথা তুলে মেহেরের নাম ধরে ডাকছে কিন্তু মেহেরের সাড়াশব্দ নেই। ফায়াজ মেহেরের গায়ে হাত দিতে চেয়েও গায়ে হাত দিতে পারছে না। কেমন যেন বাঁধছে। ফায়াজ কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই মেহেরকে তুলে নিল। মেহেরকে ভেতরে নিয়ে গেল।

মেহেরকে বিছানায় শুয়ে দিতেই ফায়াজের ফোন বেজে উঠল। ভিডিও কল এসেছে। ফায়াজ ফোন রিসিভ করে কোনো ভনিতা না করেই বলল,
“আমি আজ বিয়ে করেছি। তোকেই প্রথমে জানালাম। হুট করে বিয়ে করায় আগে জানাতে পারি নি।”

অপর পাশ থেকে একটা মেয়ে ফায়াজের এই কথা শুনে লাফিয়ে উঠল। ফায়াজ লাফানো দেখে হা করে চেয়ে আছে।
ফায়াজ ফোনটা বিছানার কাছে গিয়ে মেহেরকে দেখিয়ে বলল,
“লাফালাফি বন্ধ কর। ওর নাম মেহের। গাড়ি থেকে নামার পর হটাৎ সেন্সলেস হয়ে গেছে।”

বিদেশীদের মতো ধবধবে সাদা মেয়েটা মেহেরকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“ওয়াও! কত সুন্দর। নামটাও বেশ।”

ফায়াজও মেহেরের দিকে তাকাল। এর আগে মেহেরকে ভালো করে দেখা হয় নি। দেখার প্রয়োজন মনে হয় নি। আজ ফায়াজ মেহেরকে দূর থেকে দেখছে। ফায়াজ ফোন কেটে মেহেরের পাশে গিয়ে বসল। চোখের বড়বড় পাপড়িগুলো পানিতে ভেজা। ফর্সা মুখে চোখের পানির দাগ বসে গেছে। হাত দিয়ে ঘষে ঘষে বারবার চোখের পানি মুছায় গাল লাল হয়ে আছে। সরু নাক, ঠোঁটের নিচে কুচকুচে কালো তিল। মেহেরকে দেখে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। মেহেরের জ্ঞান ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। ফায়াজ উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

.

কিছুক্ষণ পরে ফায়াজ দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে নিয়ে রুমে ঢুকল। মেহের তখনও শুয়ে আছে। ফায়াজ প্যাকেটগুলো টেবিলের উপরে রেখে মেহেরের কাছে গেল ওকে ডাকতে। ফায়াজ মেহেরের নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পরেও মেহের রেসপন্স করছে না। তাই ফায়াজ পানি নিয়ে মেহেরের চোখে-মুখে পানির ছিটা মারল।

মেহের কিছুক্ষণ পর আলতোভাবে চোখ মেলে আদো আদো চোখ খোলে বলল,
“আপু তুমি প্রচন্ড জ্বালাচ্ছ। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে আমাকে রেহাই দেও।”

ফায়াজ চোখ বড়বড় করে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি তোমার আপু নয় আমি ফায়াজ।”

মেহেরের কানে ফায়াজ নামটা পৌছাতেই মেহের এক প্রকার লাফিয়ে উঠল। আশেপাশে একবার দেখে ফায়াজের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে ওড়না লেহেঙ্গা ঠিক আছে কি না চেক করে নিল।

ফায়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ফ্রেশ হয়ে নেও। খাবার এনেছি। ভূতের মতো তো চেহেরা করে রেখেছ।”

মেহের উঠে দু’হাতে লেহেঙ্গা তুলে ওয়াশরুমে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। মুখটা ভালো করে ধুয়ে নিল। এখন সমস্যা হচ্ছে লেহেঙ্গা। এই লেহেঙ্গা পড়ে কতক্ষণ থাকা যায়? অন্য জামাকাপড়ও তো নেই। ওর গায়ের জামাকাপড়ও লেহেঙ্গা পড়ার সময় ফেলে এসেছে। এখন কি পড়বে।

মেহের হাত-মুখ মুছে বাইরে বের হয়ে দেখে ফায়াজ বিরিয়ানি খাচ্ছে। মেহের ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে। ফায়াজ প্লেটে না খেয়ে প্যাকেটেই খাচ্ছে।

ফায়াজ মেহেরকে দেখে বলল,
“ওখানে তোমার জন্য রাখা আছে খেয়ে নেও।”

মেহেরের খুব ক্ষিধে পেয়েছে। সারাদিন যে ধকল গেছে তাতে কিছুই খাওয়া হয় নি। মেহের প্যাকেট হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। উসখুস করছে।

ফায়াজ বিষয়টি দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“সমস্যা কি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

মেহের আমতা আমতা করে বলছে,
“না মানে।”

ফায়াজ আরো বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এত মানে মানে করছ কেন? কথা বলতে পারো না?”

মেহের সাহস পেয়ে বলল,
“আপনাকে দেখে তো বড়লোক মনে হয়। আপনার বাড়িতে প্লেট চামচ নেই?”

ফায়াজ ওর কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
“আছে তো।”

মেহের চোখ সরু করে বলল,
“তাহলে আপনি প্রচন্ড মাত্রায় কিপটা। প্লেটে না খেয়ে প্যাকেটে খাচ্ছেন।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা ফার্ম হাউস। আমাদের বাড়ি নয়। এখানে সব আছে। কিন্তু কোথায় কি আছে আমি জানি না। চুপচাপ খেয়ে নেও।”

মেহের ইতস্তত করে বলল,
“প্লেট ছাড়া কিভাবে খাব?”

ফায়াজের এত কথা অসহ্য লাগছে তাই বলল,
“তাহলে খেতে হবে না। খাওয়ার হলে এইভাবে খাও নয়তো রেখে দেও।”

মেহেরের খুব ক্ষিধে পেয়েছে তাই ফায়াজের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। তাই ঘুরে বসে চুপচাপ খেতে শুরু করল।
ফায়াজের কেন জানি মেহেরের কান্ড দেখে হাসি পাচ্ছে।

অনেক রাত হয়ে গেছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে মাহির টেনশন বেড়ে চলেছে। তাই মেহেরের নাম্বারে ফোন করেই যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। মাহির টেনশন তাই বেড়েই চলেছে। ঘরজুড়ে পাইচারি করছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। মেহের এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে জানা নেই। না জানা পর্যন্ত শান্তি হবে না।

মেহেরের মনেও ভয় বেড়েই চলেছে। চারদিক সুনসান নীরবতা। ফার্ম হাউসটাকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। মেহেরের এমন নীরব জায়গা খুব ভয় লাগে। ফায়াজও নেই। একা ফেলে কোথায় চলে গেছে জানা নেই। মেহের সাহস সঞ্চার করে রুম থেকে বের হল। রুম থেকে বের হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। ফায়াজের ছায়াও দেখতে পাচ্ছে না। হটাৎ ড্রয়িংরুমে চোখ গেল। ফায়াজ হুইস্কির বোতল হাতে নিয়ে বসে আছে। চোখ গুলো কেমন ভয়ংকর লাল লাগছে।

মেহের চুপচাপ পা টিপে টিপে ঘরে এসে দরজা লক করে দিল। মেহেরের ঘুম আসছে না। বাড়ির কথা, সবার কথা খুব মনে পড়ছে। কিছুক্ষণ আগে ঠিক থাকলেও এখন অস্থিরতা ওকে ঘিরে ধরেছে।

.

পরের দিন ফায়াজ মেহেরকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এল। বিশাল বড় বাড়িতে কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। মেহের কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বলল,
“এ বাড়িতে আর কে কে থাকে?”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কাকে কাকে প্রয়োজন? ”

মেহের কাচুমাচু হয়ে বলল,
“না মানে, আপনার পরিবার? আপনার বাবা-মা…

ফায়াজ ব্যাথাতুর হাসি হেসে বলল,
” আমার আবার পরিবার? আমার সাথে বাবা থাকে তবে সেটা নামেমাত্র। এখন তিনি কোথায় আছেন জানি না।”

চলবে….!