শেষ সূচনা পর্ব-০৩

0
453

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ ০৩
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

—- মেম!আমিতো মেয়েদের দিকে না। স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপনি শুধু শুধু মেয়েদের বলে আমার দোষ ভারী করছেন।
আমার দুঃসাহস দেখে মেম সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি নিশ্চিত মেম এর স্থানে অন্য কেউ হলে তৎক্ষনাৎ রেগেমেগে আমার পশ্চাদ্ দেশে বেত্রাঘাত করে রগরগে লাল করে দিতেন এবং আমার অভিভাবক ডেকে নালিশ দিতেও ভুল করতেন না। কিন্তু শান্ত-শিষ্ট নির্ঝঞ্ঝাট প্রিয় এই মেম কিছু করলেন না। একমুহূর্তে স্থির থেকে বাইরের দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে মাথা দুলিয়ে মৃদু বললেন, “বের হও, কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক, যাও।
আমি বললাম,” মেম দোষ কী শুধু আমার? স্বর্ণাওতো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।”
ইচ্ছে করেই ক্যাচাল পাকিয়ে দিলাম। অথচ স্বর্ণা আপন মনেই ক্লাসে মনোযোগী ছিল।
মেম স্বর্ণার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন,” এটা কি সত্যি স্বর্ণা?”
ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে স্বর্ণার ঠোঁট দুটো বার কয়েক স্ফুরিত করে হাত উঁচিয়ে কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু গলার কাছে এসে আটকে গেল কথাটা। মেম এবার কড়া গলায় বললেন,
—- যাও, দুজনেই দরজার সামনে কান্ ধরে দাঁড়িয়ে থাক। ক্লাস শেষ হলে তারপর আসবে।
আমি খুশিমনে নাজেহাল ভঙ্গিতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্বর্ণা না পারতে কাঁদো কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। সে কি দৃশ্য! আজও আমার মনের গভীরে কোন তাঁরকাটা, কোন ধরা ছাড়াই আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে আছে। কোন ছলে বলে কৌশলে, কোন আঘাতে, কোন ঝড়-ঝাপটায়, কোন আবর্তে সেই দৃশ্য মন থেকে ছুটে পালাতে চায়না। বলা উচিত, স্বর্ণা ছিল ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। কিন্তু তার রাগটা সবসময়ই ঐ সুকুমার মুখের অন্তরালে নত মাথায় চুপটি করে লুকিয়ে থাকত। হুটহাট রেগে যাওয়াই তার স্বভাব। কিন্তু সেই রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী করার মত ধৈর্য বোধহয় তার কোনকালেই ছিলনা। এই রাগ এই হাসি, আবার এই রেগেমেগে রুদ্রমূর্তি করে নাকের পাটা ফোলানো আবার এই চঞ্চলতা! কারোর উপর দীর্ঘদিন ধরে তরান্বিত রাগ ইচ্ছেমতো ঝেড়ে,লাত্থি-গুতা,কিল-ঘুষি, উপহার করে পরের দিন আবার কাছে টেনে স্যরি বলার কিম্ভুত ক্ষমতাটাও তার প্রখর ছিল। যদিও তার চাল-চলন, বেশ-ভূষা,বচনভঙ্গি সবিই ছিল অন্যসব সাধারণ মেয়ের মতোই। দিনভর এভাবেই তার চলত। সেদিন মেম চলে যাবার পর স্বর্ণা কিছু বললনা। শুধু নিজের জায়গায় গিয়ে ব্যগের উপর মাথা গুঁজে বসে ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ওঁকে বিনা কারণে শাস্তিতে লেলিয়ে দেয়ার অপরাধে সে আমার সাথে দু এক ছত্র কথা-বার্তা কিংবা ঝগড়াঝাটি করবে। ঠিক তার উল্টো পিঠে অবস্থান করা বিষয়টা যখন সে করে বসল তখন আমার মনের মধ্যে একটা অযাচিত অনুকম্পার সৃষ্টি হল। যেটা আমাকে বাকী ক্লাসগুলোতে উপর্যুপরি চোবাতে চোবাতে ‘ডিপ্রেশনে’ রূপ দিল। যা আমার করা দোষারোপের নিরিখে সম্পূর্ণ বেমানান ও অনর্থক! কিন্তু আমি আকাট মূর্খ ছিলাম। আমি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে, স্বর্ণা তো স্বর্ণাই! সে কি কাউকে মুফতে ছাড় দিতে পারে? দুটা লাথি-গুতা না দিলেই যে তার নয়! ঠিক তাই হলো! ক্লাস শেষে আমাকে ইশারা দিয়ে ভালো মেয়ের মতো ডাকল সে। যেন কোন কিছুই সে জানেনা। তখন সবাই চলে গেছে যারযার বাড়িতে। ক্লাস রুমে শুধু আমি আর স্বর্ণা। ইশারা পেয়ে আমিও গেলাম। সে যে কেতা দুরস্তের মতো বাইরে এক ভিতরে আরেক মনোভাব নিয়ে বসে থাকবে সেটা আমার অবগত ছিলনা। আমি কাছে যেতেই সে নিজের ভিতর নিরন্তর ঘুরঘুর করা রাগ বশে হাটু দিয়ে আমার দু উরুর মাঝখান বরাবর আঘাত করলো। মুখ চেপে ধরে বসে গেলাম আমি। এরপর আমার অবল পিঠের উপর পড়তে লাগল ধুপধাপ কিল-ঘুষি, খেঁক শিয়ালের মতো লম্বা নখের আঁচড়।

এরপর পুরো এক সপ্তাহ আমি স্কুলের আশপাশে ঘেঁষলাম না। বিষম ব্যথায় কাতরাতে থাকলাম বিছানায়। মেয়েরা যে অবলা নয় , সবলাও হতে পারে সেবার আমি প্রথম টের পেলাম। হাড্ডিসার চিকন চিকন হাতের আড়ালে এতো শক্তি,জোর লুকিয়ে থাকতে পারে তা আমার ধারণারও অতীত ছিল।বড়বড় নখের আঁচড়গুলো আর টিনটিন করা হাতের আঘাতগুলো তখন পিট জুড়ে ব্যথার সুই ফুটাতে ফুটাতে একাত্ম রাজত্ব করছিল। সেই রাজত্ব চলল পুরোদমে এক সপ্তাহ পর্যন্ত। তখন দাদি বেঁচে ছিলেন। তিনি নিজের নাতির জন্য লজ্জায় মাথা নুইয়ে শ্লেষ কটাক্ষে বললেন,
— ছিঃছিঃ শেষ পর্যন্ত কিনা একটা মেয়ের মার খেয়ে বাসায় ফিরলি? লজ্জা শরম নাই তোর!
আমি বিষণ্ণ মুখে চেঁচিয়ে বললাম,
—- ধুরর বুড়ি! কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিও না তো! এমনিতেই মরি আমি।
দাদি আমার হাতটা পিঠের উপর রেখে বললেন,
—– হু,এখন তো লজ্জায় মরে যাচ্ছিস। দেখি কোথায় কোথায় মেরেছে আমি মলম লাগিয়ে দিয়। ভালো লাগবে।
আমি গা ঝারা দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
—- যাও লাগবেনা। ঘুমাতে দাও এখন।
তিনি জোর করে আমাকে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—- কার এতবড় সাহস!আমার নাতিকে এভাবে মারে! আমি কালই স্কুলে গিয়ে নালিশ করব। ঐ মেয়েকে বের করব ঐ স্কুল থেকে।
দুর্ভর শরীরেও তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম আমি। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
—- কি বললে? আমার মানসম্মান খোয়াবে না-কি তুমি? কিছু করতে হবে না তোমার।
— তোর আবার মানসম্মান কিসের? যা শুয়ে থাক।
আমি ধীরে শুতে শুতে বললাম,
—- এতোকিছু আমি জানিনা। তুমি স্কুলে যাবেনা ব্যস।

—- ঠিকাছে যাবনা। বলে দাদী বেরিয়ে গেল।

আমি মনে মনে আওড়ালাম,

তুমি আলেয়ার আলো
উপরে দেখতে ভালো
ভেতরে নিরেট কালো।
তুমিই আলেয়ার আলো।

তুমি ভাষাহীন বর্ণচ্ছটা
কখনো-বা হও মেনি বিড়ালটা
উঠে গেলে তোমার রঙের অবলেপ

নাহ হচ্ছেনা। রবিঠাকুরের মতো আমারো ছন্দপতন পছন্দ নয়। তাছাড়া এই মেকি শয়তানটাকে নিয়েই বা কেন ছন্দ বানাচ্ছি। উত্তর জানা নেই আমার। আজও এতোবছর পর সেই উত্তর খুঁজে পাইনা। সেই রাতটা কাটল আমার ভীষন যন্ত্রণায়। বিন্দু পরিমাণ ঘুম এলোনা চোখে। ঘুম যেন বিদায় জানিয়ে আমার কাছ থেকে চলে গেছে চিরতরে। ছোট্ট এই জীবনের সূচনা পর্ব হতে প্রত্যেকটা ঘটনা পুনঃপুন নিজের চোখের ভারি পর্দায় ভেসে উঠছিল আমার। সেই সাথে নিজের বুকের পাজর ঠেলে এক অনিরুদ্ধ কান্নার দলের হুড়োহুড়িতে ভারী হয়ে আসছিল চোখের পল্লব। বৃষ্টির জলে স্নানসিক্ত গাছের সরু পাতা বেয়ে যেমন করে জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে তেমনি আমার নাতিদীর্ঘ পক্ষ্মের গা বেয়ে টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছিল আমার সকল দুর্দশার কথা স্মরণ করে। দাদী ছিল আমার পাশে। সেই ছিল আমার পৃথিবী। পৃথিবীতে একমাত্র যে আমার মন বুঝত সে হলো আমার দাদী। সেই তালিকায় মাও নেই বাবাও নেই। থাকার কথাও বাহুল্য। আমার সেই রাখঢাকব্যর্থ কান্না দেখে দাদী বললেন,
—- ভিন্ন একটা ঘটনার জন্য এসব ভেবে কষ্ট পেয়ে কি হবে মিনহাজ? যারা ভালোবাসেনা তাদের কাছে স্নেহ ভালোবাসা আশা করাও পাপ।
আমি দাদীর হাতটা চেপে ধরে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেছিলাম,
— দাদী! তুমিও কি বাবার সাথে এমন করতে? তুমি বাবাকে ভালোবাসতে না?
দাদী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেছিল,
—- না রে। তোর বাবা-ই ছিল আমার একমাত্র ধন। দুই ছেলের মাঝে ওকেই বেশি পছন্দ করতাম। বড় ছেলে বলে কথা৷… ছোটটাকেও খুব আদর করতাম। ভালোবাসা পরিমাপ করা যায়না নাতি! তোর বাবার কথা মনে হলে, মনে হয় তাকেই বেশি ভালোবাসি, আর ছোটকাকার কথার মনে হলে, মনে হয় তাকেই বেশি ভালোবাসি। ছোটধন তো আল্লাহর কাছে চলে গেল… বড়ধনটা থেকেও নেই।

জবাবে কিছু বললাম না আমি। শুধু মাথাটা বালিশ থেকে নামিয়ে সন্তর্পণে দাদীর কোলে তুলে দিলাম। দাদী আমার দীঘল এলোমেলো চুলে আঙুল সঞ্চালন করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। বয়োজ্যেষ্ঠ তুলতুলে হাতের স্নেহমাখা পেলব স্পর্শে আমার চোখের হারিয়ে যাওয়া ঘুম রাজ্যব্যাপি আনন্দ-উল্লাসে ফিরে এলো। চোখ যখন হালকা লেগে এলো, ঠিক তখনি একফোঁটা বর্ণহীন উষ্ণ জল আমার গালের উপর এসে পড়লো। ঘুম ছুটে পালাল। চকিতে মাথা তুলে দাদীর মুখপানে তাকালাম। তাঁর অপলক দৃষ্টি দক্ষিণে জানালার চাঁদোয়া ভেদ করে চলে গেছে দূরে বহুদূরে। চাঁদের মৃদু আলোতে দাদীর আদ্র চোখের জলীয় কণাগুলো চিকচিক করে দ্যুতির স্ফুরণ ঘটাল। আমি মন বলল, তোমার দুঃখ আরো বেশি দাদী!

এক সপ্তাহ পরে স্কুলে এলাম। একটু আগে আগেই চলে এসেছি। সেদিনের ঘটনা বোধহয় কেউ জানেনা। নিজনিজ জায়গায় ব্যাগ রেখে সবাই পিটি করতে গেল। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আমি গেলাম না। ক্লাসরুমে থ মেরে বসে রইলাম। পুরো ক্লাস রুম যখন ফাঁকা তখন টকটক জুতার আওয়াজ করে এসে এক দৌড়ে ব্যাগটা রেখে পি.টি তে যাচ্ছিল স্বর্ণা। হঠাৎ দরজার কাছে গিয়ে থমকে গেল সে। একপা দু’পা করে পিছে হেঁটে আমার দিকে গভীরভাবে তাকাল সে। কয়েক সেকেন্ড এভাবে তাকানোর পর সহসা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমার কাছে চলে এলো সে। ব্যগ্রকণ্ঠে বলল,
—- কি হয়েছে তোমার? এতোদিন স্কুলে এলেনা কেন? জানো কত খুঁজেছি তোমায়?
এই ব্যগ্রতার সুর আমার অচেনা। একবার মনে হলো, এই সুর কৃত্রিম, পরে মনে হলো,এই সুর কখনোই কৃত্রিম হতে পারে না! আমি নিস্তরঙ্গ গলায় বললাম,
—- কেন? আমাকে তোমার কী দরকার?
—- দরকার ঠিক না! ঐদিন…
—- থাক! আর কিছু বলতে হবেনা! -কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম আমি।
কয়েক সেকেন্ড কাটলো স্থবির হয়ে। আমি আমার মতো করেই বসে রইলাম। সে নানান উচাটনে ইতস্তত করছে। কিছু বলতেও পারছেনা আবার চুপ করে থাকতেও যেন মনের কাছে বাঁধা পাচ্ছে। একটু পর হুট করেই আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল,
—- খুব ব্যথা পেয়েছ না? আসলে স্যরি। তুমিতো জানোই আমায়। কেন ওরকম কাজ করতে গেলে? তাইতো আমার রাগ হয়েছিল।
বেশ বাচ্চাসুলভ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে থামল স্বর্ণা। আমি বললাম,
—- এমন জায়গায় মেরেছ,মরে গেলে দায় কে নিতো?
স্বর্ণা নিচু কটাক্ষে আমার মুখের উপর তাকাল। তার মুখের উপর কে যেন কালি লেপ্টে দিল। সেই লজ্জায়,গ্লানিতে একাকার হয়ে তার সমস্ত দর্প,অহমিকা মুহূর্তে মিইয়ে গিয়ে নিদারুণ সন্তাপে জ্বলেপুড়ে ভস্মসাৎ হয়ে গেল। খপ করে আমার হাতটা ধরে বলল,
—- এতোদিন কি অসুস্থ ছিলে? চেহারা এমন দেখাচ্ছে যে?
বললাম,
—- নাহ, আনন্দ ফুর্তি করছিলাম এতোদিন! অনেক মজার সময় ছিল! আজ আবার স্কুলে এসে সব শেষ হয়ে গেল!
—- সব ঠিক থাকলে স্কুলে আসোনি কেন?
—- সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন নেই তো! আশ্চর্য! এতোদিন তো এসব কখনো জিজ্ঞেস করোনি। আজ কেন দরদ উছলে পড়ছে? যাও নিজের সিটে গিয়ে বসো। এক্ষুনি সবাই এসে পড়বে।
—আমিতো স্যরি বলেছি তারপরও এমন করছো কেন?
—- আচ্ছা, তুমিতো গুণ্ডি টাইপের মেয়ে। যদিও উপরে দেখতে একদম সাধারণ মেয়ের মতো। তো যাকে যাকে মারো সবার কী এভাবেই হাত ধরে রাখ? বলে একবার হাতের উপর চোখ রেখে আবার তার দিকে তাকালাম। সে ফস করে আমার হাতটা ছেড়ে দিল। পলকেই তার মুখমণ্ডল থেকে সমস্ত রক্তবিন্দু সরে গিয়ে মুখখানা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। কিটকিটে সেই চেহারাটা দেখার মতো ছিল। বীক্ষণীয় ছিল। সেই মুহূর্তে একজন শখের ফটোগ্রাফারের ভীষণ দরকার ছিল। আজও সেই শূন্যতা বুঝতে পারি। তবুও নিজের হৃদয় সিন্দুকে থরে-বিথরে সাজানো দৃশ্যগুলোর মাঝে এটিও অন্যতম স্থান দখল করে আছে। যা কখনো ভুলবার নয়। যেগুলোকে সংগ্রহে রাখার জন্য কোন দবদবা নেই, নেই কোন গাঁঠ বাঁধার উৎকণ্ঠা।
স্বর্ণা ব্যথিত মনে দেঁতো হাসি দিয়ে বলেছিল,
—- স্যরি। মাই ফল্ট!
বলে হয়ে থাকে, আজকের দিনটা যেমনই যাক,কালকের দিনটা তোমার খারাপ যাবে তার কী নিশ্চিয়তা? তেমনি সেদিনকার রাতটা আমার জন্য বেদনাদায়ক হলেও এরপরের দিন সেই বেদনা আর নেড়ে দেখার সুযোগ হয়নি। অন্য একটা সুখময় চাদর এসে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিল সকল দুর্দশার গনগনে অগ্নিশিখা থেকে। স্বর্ণাকে ক্ষমা করার শর্তে কিশোর আমি বলেছিলাম, “আমার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে হবে”
সে নিঃশঙ্কে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিল। আজও সেদিনের কথা মনে করে হাসি ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক দেয়। কত বোকাই না ছিলাম! জানিনা কেন সেদিন বলিনি আমরা ‘বন্ধু’ হতে পারি! হয়তো দু’জনের মনে একটা গূঢ় বাসনার আভাস দিচ্ছিল যা অন্যান্য সম্পর্কের তুলনায় গৌণ এবং তুচ্ছ।

ভালোই চলছিল আমাদের দিনগুলো। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পদার্পণ করলাম দুজনে। অল্প-বিস্তরে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল আমাদের সম্পর্কের গাঢ়তা। কেউ কাউকে ভালোবাসি কথাটি না বললেও দুজনেই বুঝে নিতাম মনের সুপ্ত কথাটি। চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারতাম ঐ ঋজুর চাউনির তলদেশে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার সুবিশাল সমুদ্র। আমাদের সম্পর্কে কোন আলাদা জোরজবরদস্তি ছিলনা। ভালোবাসা আদায়ের জন্য কোন হম্বিতম্বি ছিলনা। বন্ধনটা আটকে ছিল সেই শর্তটাকে মাথায় রেখে। কিন্তু হঠাৎ…….

—- ভাইজান আপনার মতলবটা কিন্তু ভালো ঠেকতাছে না। আমি আফনার বাসার কাজের লোক হলেও মনে রাইখেন আফনার দায়িত্ব কিন্তু আমার হাতে। তোমার দাদী হেইডা দিয়া গেছে। কাল থেইকা দেখতাছি এই মাইয়া নিয়া আফনার উতসাহো বেশি। এখন দেহি সকাল সকাল নায়কের মতো খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখতাছেন। ব্যাফার কী এ্যাঁ?

সুদীর্ঘ ভাবনার বেড়াজালের ব্যবচ্ছেদ হলো খালার আকস্মিক আবির্ভাবে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ এনে বললাম,
— খালা দাঁত ব্রাশ করে আসেন প্লিজ! দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। তারপর সব উত্তর দিব।
খালা ঝুলে থাকা শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে দিয়ে রেগে বললেন,
—– বেরাশ করবো কেমনে? কইছিলাম একটা ব্রাশ আইনা দেন। তা তো দিলেন না। আফনে সব ভুইলা যান। এখন দাঁত মাজন ছাড়া উফাই কৈ?
—- ঠিকাছে ঠিকাছে তাই করেন। যান।

তখন পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। বাড়ির পাশের বাগানের য়ুকেলিপ্টাস গাছের পেছন থেকে আকাশ ফুঁড়ে সোনার থালার মতো স্নিগ্ধ, কোমল রোদ উঁকি দিচ্ছে। আর দক্ষিণের জানালার ফাঁক গলে শিরশির দোল বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঘরময়। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম খালার চিৎকার চেঁচামেচিতে মেয়েটা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছে। বাচ্চাদের মতো দুই হাতের তালু দিয়ে দু-চোখ রগড়াচ্ছে। এই তো আমার স্বর্ণা!

চলবে….