শেষ সূচনা পর্ব-০৪

0
355

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০৪
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

তখন পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। বাড়ির পাশের বাগানের ইউকেলিপ্টাস গাছের পেছন থেকে আকাশ ফুঁড়ে সোনার থালার মতো স্নিগ্ধ, কোমল রোদ উঁকি দিচ্ছে। আর দক্ষিণের জানালার ফাঁক গলে শিরশির দোল বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঘরময়। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম খালার চিৎকার চেঁচামেচিতে মেয়েটা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছে। বাচ্চাদের মতো দুই হাতের তালু দিয়ে দু-চোখ রগড়াচ্ছে। এই তো আমার স্বর্ণা! কিন্তু আজ হাঠাৎ কী বলে নিজেকে পরিচয় দিব? উপায়ন্তর না পেয়ে আমি দ্রুত সেই জায়গা থেকে সরে যেতে চাইলাম। দুই পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাক পড়ল,
—- এইযে শুনছেন? কটা বাজে এখন? একচুয়েলি আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে!
এই পরিস্থিতিতে আর নিজেকে লুকানোর অবকাশ নেই। জবাব না দিয়ে লম্বা পা ফেলে চলে গেলেও ব্যাপারটা সন্দেহজনক হয়ে যায়। তাই কিছুটা ভয় এবং সংশয় নিয়ে ঘাড় ফিরালাম। বললাম,
— এইতো ছটা বাজে মাত্র। আপনি আরো ঘুমান, সমস্যা নেই।
অাবহমান ঝড়-বাদলের রাতে গন্তব্যহীন পথিক যখন আচানক বজ্রপাতের আস্ফালনে চমকে ওঠে স্বর্ণাও ঠিক তেমনিভাবে চমকে উঠলো। বজ্রপাতটা যেন ঠিক তার গায়েই এসে পড়লো। সে নিজেকে প্রাণপণে রাশ টেনে ধরে কেমন অন্যরকম গলায় বলল,
—- তুমি?
আমি একটু ফচকে হেসে বললাম,
—- কেন চিনতে অসুবিধে হয়েছে বোধহয়? খোঁচা খোঁচা দাড়ি রেখেছি। মাথার চুল নিয়ম করে ছাঁটা, সাথে একটা চশমাও জুড়ে দিয়েছি।…
চোখটা নামিয়ে নিল স্বর্ণা। মৃদু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
—- হ্যাঁ কিন্তু আল্লাহর দেয়া জিনিসগুলোকে তো পরিবর্তন করতে পারোনি। শুধু আমার পছন্দের জিনিসগুলোই পরিবর্তন করতে পেরেছ। এতো ঘৃণা ধরেছে জানতাম না!
আমি হেসে বললাম,
— নাহ ঘৃণা হবে কেন? আমাকে তো খারাপ দেখাচ্ছে না।
—- তা দেখাচ্ছে না। বাই দা ওয়ে আছো কেমন?
বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলো স্বর্ণা। যেন কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সব আগের মতো আছে।
—- আছি ভালোই। চলছে… একলা একা। তুমি?
—- আমিও। কি করা হয় এখন?৷ সেই বাউণ্ডুলে স্বভাব নিশ্চয় নেই? –বলে ঠোঁট দুটো টেনে হাসলো স্বর্ণা।
হাসির জবাবে হাসি দিতে হয়। হোক সেটা ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায়। আমি মুচকি হেসে বললাম,
—- হয়তো নেই। নিজেকে চিনতে পারিনা আমি। একটা জব করেছিলাম, এখন আপতত কিছু করছিনা। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। বাপের যতোই টাকা থাকুক। নিজের কিছু করা তো চাই! তুমি কী করছ?
—- কিছুনা।
—- কিছুনা? ভ্রুকুটি করে তাকালাম আমি। সেই তাকানোতে আমি বুঝাতে চাইলাম,আমি অনেক কিছু জানি! কিন্তু সে কি বুঝল কে জানে। একটু ইতস্তত করে অপ্রস্তুত হেসে শুধু বলল, “না”
খালা চলে এলো কয়লা হাতে দাঁতে আঙুল চালাতে চালাতে। ঠোঁটের ফাঁক গলে থুতনি বেয়ে কয়লার রস গড়িয়ে পড়ছে তার৷ এসেই গায়ে পড়ে বলল,
— ওমনিই ভাব হইয়া গেল? আগে থেকে পরিচয় মনে অয়?
আমি বললাম,
—- হ্যাঁ খালা, পরিচিত, তবে কাল রাতে চিনতে পারিনি।
খালা তেমনি এদিক-ওদিক করে দাঁতে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,
—- চিনবা কেমনে, মদ খাইয়া টাল হয়ে চিলা যে!… নাস্তা রেডি করতাছি। ১ ঘন্টা পর আইসো। গেলাম।
বলে শেষ কয়েকটা ডলা দিয়ে বেসিনের দিকে এগুলো সে। আমি কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে ঘার ফিরালাম। একটু চমক খেয়ে গেলাম। দেখলাম স্বর্ণা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু একটা বলতে যাব তখনি সে ঠোঁটদ্বয় ঈষৎ কাঁপিয়ে আর্তকণ্ঠে বলে,
—- এতো পরিবর্তন কিভাবে হলে?
নিজের অগোচরেই মনের অতলান্তে জমে থাকা চাপা বাষ্প নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। কৃত্রিম হেসে বললাম,
— তুমি কিভাবে হলে?
সে তার অনিমেষ চাউনি আগের মতো স্থির রেখে বলল,
—- আমার সম্পর্কে কী জান তুমি? কখনো নিজের প্রয়োজনে নিজেকে বদলাতে হয়।
—- আচ্ছা,…তাই বলে এভাবে না!
—- কীভাবে? স্বর্ণার চোখে মুখে নিজের প্রচ্ছন্ন কুকীর্তির খোলস খসে পড়ার ভয় ইতিমধ্যেই পেয়ে বসেছে তা আমি পষ্ট দেখতে পারছি। এই বুঝি কেউ জেনে গেল!
আমি উত্তর দিলাম না। ততক্ষণে আমরা হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে চলে এসেছি। বাইরে বেরিয়ে এলাম। স্বর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
—- গেলে আসতে পার। রাস্তাঘাট ফাঁকা এখন। একটু হেঁটে আসি।
বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটা ধরলাম। পেছনে ফিরলে দেখতে পারতাম, স্বর্ণা একটু ইতস্তত করে জুতা দু’টো হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে আমার দিকে। দৌড়ে এসে আমার সঙ্গ দিল সে। টক করে জুতাজোড়া রাস্তায় ফেলে পায়ে লাগাতে লাগাতে বলল,
—- এতো তাড়াতাড়ি হাঁটো কেন। আস্তে হাঁটো।
আমি একটু গতি শ্লথ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে সেই গলির মুখে চলে এলাম। তখনো কারো মুখে রা নেই। নির্বিকার হয়ে যে যার মতো হাঁটছে। এই গলিটা পশ্চিমমুখী হওয়ার পূবের আকাশে সদ্য বিকশিত সূর্যের কোমল আলোকচ্ছটা তেরছাভাবে আমাদের গায়ের উপর এসে পড়েছে। সেই আলোকচ্ছটা বাঁধা পেয়ে সুমুখে সৃষ্টি করেছে দুটি নর-নারীর কল্পিত ছায়ামূর্তি। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল দৃশ্যটা। গলির মুখের দোকানটা খুলেছে কেবল ৷ সেখানে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক কপাল-ঠোঁট একসাথে কুঁচকে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। হয়তো-বা চা খাওয়ার ‘ফুতফুত’ বিশ্রী শব্দটাও হচ্ছে, দূরে থাকায় বুঝায় উপায় নেই। বাদবাকি সব দোকান বন্ধ। রাস্তায় দু’একটা গন্তব্যছুট গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছে ক্ষণিক পরপর। পরিবেশজুড়ে এক কিম্ভুত নিশ্ছিদ্র নীরবতা। অদূরবর্তী কোনোকিছুর দিকে তাকিয়ে লক্ষ্যহীন হাঁটছে স্বর্ণা। তার পরনে সাদা পাড়ের পিঙ্গল রঙ্গের একটি টি-শার্ট আর সাধাসিধে পায়জামা। চুল আঁট করে পিছনে বেঁধে ঝুঁটি করা। ডানহাতে রূপার ব্যাসলেটের সাথে একটা কাপড়ের তাবিজ বাঁধা। আগের তুলনায় কপোল দ্বিগুণ ভরেছে। হরিণীর মতো টানা টানা চোখের গভীরতাটাও দ্বিগুণ হয় বরং চতুর্গুণ বেড়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, চোখের দিঘল জোড়াপক্ষ্ণ বিনা কাজলেই অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরপুর! যেন পদ্মআঁখি! এই রূপ দেখে তরুনদের মনের মধ্যে কাঁপন শুরু হয়। অথচ আমি! কাছে পেয়েও হারিয়েছি। একটু পর নীরবতা ভেঙে বললাম,
—- তো তারপর… তোমার…বাবা মায়ের কি অবস্থা? শরীর স্বাস্থ্য ঠিকঠাক?
—- কেউ নেই। থেকেও নেই। সব ছেড়ে চলে এসেছি।-কি নির্লিপ্ত জবাব স্বর্ণার! একথার ভেতরের রহস্যটা জানার চরম ইচ্ছে হলো আমার। একে একে হাজার রহস্য স্তূপাকার জমছে এই মেয়েটির অনূকূলে। কিন্তু কোনটার গাঁট-ই পুরোপুরি খুলছেনা। মরা গিরা দিয়েছে যেন! খুব জানতে ইচ্ছে হলো তার এই আলুলায়িত জীবনের গুপ্ত উদ্দেশ্যটা! বললাম,
—- কেউ পেয়েও হারায়। আবার কেউ কপালে না নিয়েই জন্মায়।… কি হয়েছিল?
স্বর্ণা একপলক তাকিয়ে বলল,
—- সব কথা কি আজই শুনে নেবে? অন্যদিনের জন্য বাকী রাখো কিছু!
—- তারমানে আমাদের আরো দেখা হচ্ছে!
—- তোমার স্বভাব তো আমি ভুলিনি! একবার যখন ঘাড়ে চেপেছ, তখন আর সহজে ছাড়ছোনা। নাকি সেই অভ্যাসটাও বদলেছো।
কথাটা যে নিতান্ত কথার কথা তা কিন্তু না। যথেষ্ট বাঙময় এবং সত্য। এটাও আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। একবার পেয়ে বসলে ছাড়া মুশকিল হয়ে যায়। বললাম,
—- নাহ বদলাইনি এখনো।… রাতে একটা মেয়ে এসেছিল তোমাকে মারার জন্য। অনেক যুদ্ধ-বিদ্রোহের পর আটক করে হল ঘরে বেঁধে রেখেছি। আরেকটু উনিশ-বিশ হলেই মরতাম আমি।
এই কথা শুনে বাণবিদ্ধ প্রাণীর ন্যায় থমকে দাঁড়ালে স্বর্ণা। অবিশ্বাস্য চোখে কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এরপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার মন্থর গতিতে হাটা শুরু করল। এই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে জগতের কিছুই সে জানেনা। একদম সাদাসিধা নির্মল একজন মানুষ! যার সাত চড়েও মুখে রা কাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং চড় খেয়ে মরে যাবার আশঙ্কা আছে। মনে মনে যেন সে সৃষ্টিকর্তার কাছে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে। জবাব না পেয়ে আমি আবার বললাম,
—- চুপ করে রইলে যে? আর লুকিয়ে লাভ নেই। বলো কেন এসব করছো তুমি? কিসের অভাব ছিল তোমার! যার কারণে সন্ত্রাসীদের সঙ্গ দিতে হচ্ছে তোমার!
—- সঙ্গ বললে ভুল হবে। আমিও শীর্ষদের মাঝে একজন।- বলে ধূর্ত হাসলো স্বর্ণা।
সেই হাসিতে আমার আপাদমস্তক রাগের বহ্নিতে রিরি করে উঠলো৷ নিজেকে যথোচিত সংযত করার চেষ্টা করে স্বর্ণার বাঁ হাতটা চেপে ধরে বললাম,
— এসব ছেড়ে দাও প্লিজ! যেকোন দিন…
স্বর্ণা আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে টেনে টেনে বলল,
—- যে-কোনদিন…আমার মৃত্যু অ-ব-শ্য-ম্ভাবী তাইতো? মরতে তো একদিন হবেই,এভাবে মরলে ক্ষতি কি?
—– এসবে তোমাকে মানাচ্ছেনা স্বর্ণা! এই কাপড়! এই জীবন…
আমার কথার উল্টো জবাবে স্বর্ণা চেপে ধরা হাতের উপর কপট দৃষ্টি রেখে বলল,
—- আজ হঠাৎ এতো প্রেম জেগে উঠলো কেন? এতোদিন তো বেঁচে আছি কি মরে গেছি সেই খোঁজই নাওনি!

কথাটা তীক্ষ্ণ খরশান সূঁচের মতো এসে আমার বুকে বিঁধল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো সবার অলক্ষ্যে সেই সূঁচের খোঁচায় আমার হৃদপিণ্ড থেকে উছলে উছলে রক্তের লহর বয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটা এতোটা উচ্ছ্বনে গেল কীভাবে? আগে তো আমাকে একটা কড়া কথা বলতেও অন্তত দশবার ভাবতো৷ অথচ আমার হৃদপিণ্ডের রক্ত নিংড়ানো আকুলতা কি সে টের পাচ্ছেনা? আমি না চাইতেও ব্যথাতুর দৃষ্টিতে বললাম,
—- দোষ তো আমার ছিলনা স্বর্ণা! তোমার পরিবারই তো আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এজন্যই তো আমার দাদী চট্টগ্রাম থেকে এই ঢাকা শহরে চলে আসে,শুধু নিজের নাতির কথা ভেবে। ঐ চট্টগ্রামেও ফিরতে চাইনি সে। কি দুর্ভাগ্য তাঁর, নিজের জন্মস্থানেও তাকে দাফন করা হয়নি। সব তো তোমার পরিবারের জন্যই! এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে সব! তাহলে…
কথা শেষ করতে পারলাম না আমি। স্বর্ণা উদাস কণ্ঠে একশিসি গাম্ভীর্যতা ঢেলে বলল,
—– আমার মনটা পাষাণ হয়ে গেছে মিনহাজ। তাছাড়া এসবে আমার কোন হাত ছিলনা। আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই। একটু থেমে বলল, “দাদীর কবরের কাছে নিয়ে যাবে একবার? আমাকে পছন্দ করতেন অনেক”
— চলো..

ফেরার পথে গলির মুখে এককাপ চা খাওয়ার কথা তুলতেই স্বর্ণা নাকোচ করে দেয়। আমিও আর জোর করিনা। বাসায় চলে এলাম।
খাবার টেবিলে নাহিদ একা বসে পাউরুটি চিবুচ্ছে। আমাদের দেখেই ওঠে দাঁড়ালো। তার মুখে তখনি অর্ধেক টুকরো পাউরুটি সাঁটানো। সে ওভাবেই কি যেন বলল,ঠিক বুঝা গেলনা। এরপর এক গ্লাস পানি জোরপূর্বক গলায় ঢেলে পাউরুটি নিঃশেষ করে বলল,
—- স্বর্ণা আপু না? এখানে কিভাবে এলে? কতদিন দেখিনি।
স্বর্ণা একটুকরো হেসে বলল,
—- দেখবে কিভাবে? তুমিতো সৌদিতে ছিলে। আমি… আছি আশেপাশে কোথাও!
—-আচ্ছা। তা… ভালো আছো?
এরপর পুরো খাবার সময়জুড়ে সৌজন্যসূচক নানান কথোপকথন চললো। নাহিদ আমার বাল্যবন্ধু। চট্টগ্রাম থাকাকালীন সবসময়ই পাশে ছিল আমার। এরপর দূরে চলে এলেও যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়নি। ঢাকায় এসেছে পাসপোর্ট ভিসার কিছু জরুরি কাজে।সেই সুবাদে আমার বাসাতেই ওঠা। কয়েকদিন হলো এসেছে, একটু পরেই বেরিয়ে যাবে। খাবার টেবিলে আমি তেমন কথা বললাম না। একটা অবান্তর ভাবনায় অবিরাম ডুবে ছিলাম পুরোটা সময়। অর্থহীন বলেই আপনাদের সামনে তুলে ধরছিনা,অর্থপূর্ণ হলে ঠিকি মন উজাড় করে বলতাম। যাইহোক, নাহিদকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র তুলে দিয়ে বিদায় করলাম। সঙ্গে যেন আমার মনটাও সাথে নিয়ে গেল।সে বাড়িতে থাকায় কিছুদিন একটু গমগম করেছিল৷ আজ আবার নৈশব্দকে সাদরে বরণ করে নিবে। এটাই এই ভ্রহ্মাণ্ডের রীতি। মানুষের হাসি-আনন্দ,উল্লাস-উচ্ছ্বাস, আদর-যত্ন,ভাব-ভালোবাসা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয়না। সবকিছুই আসে ক্ষণিকের জন্য। আচমকা এসব যাচিত, অযাচিত বস্তু এসে আপনার জীবনে এসে আহ্লাদীপনায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে একসময় সেই আকণ্ঠ জ্বলেই গেড়ে রেখে পালাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবেনা। তখন নিজেকে নিজের পথ অন্বেষণ করা ছাড়া অন্যকোন পথের দ্বার খোলা থাকেনা।

ঘরে ঢুকে দেখলাম স্বর্ণাও বিদায় নেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমি ধীর পদে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
—– এখনি চলে যাবে?
সে একবার চোখ তুলে ব্যাগে কি যেন খুঁজতে খুঁজতে বলল,
—- যেতে তে হবেই। আজ নাহয় কাল। লিডার ফোন করেছিল,টীম মেম্বার একজনকে পুলিশে ধরেছে। থানায় গিয়ে উদ্ধার করতে হবে। একটু থেমে অস্ফুট বিড়বিড় করে বলল,শালারা কী করে খোদায় জানে…(বাকীটা বুঝা গেলনা)
আমি একটু কঠিন গলায় বললাম,
—- তাহলে বিপদের অভিনয় করে আমার ঘরে আসার কী দরকার ছিল?
স্বর্ণা এবার ব্যাগ হাতড়ানো থামিয়ে মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকাল। বলল,
—- অভিনয় হবে কেন? সত্যিই আমি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। আর আমার হাতে না ছিল অস্ত্র আর না ছিল পাশে কেউ। সাহায্য তো দরকারই ছিল।
আমি মাথা দুলাতে দুলাতে ঠোঁট গোল করে বললাম,
—- ওও…আচ্ছা,
—- হুমমম, তুমি একটু বেরোও। আমি চেঞ্জ করবো।
—- না। গাঁট মেরে বসে রইলাম আমি। নিজেকে সেই মূহুর্তে আগের সেই রগুটে বাচ্ছাটি মনে হলো।
— কী না? বিরক্তি ঝরে পড়লো স্বর্ণার কণ্ঠে। সঙ্গে মায়াবী গভীর চোখ দু’টো আরেকটু গভীর হলো এবং তেলতেলে মসৃণ কপোলে গুনে গুনে তিনটা ভাঁজ পড়লো। সেই আগের মতোই মোহ জাগানিয়া!
আমি তার এই বাঁকামূর্তির সামনে এক চিলতে হেসে বললাম,
—- এখন বেরোচ্ছো না তুমি… তোমাকে কে মারতে এসেছিল তার সাথে দেখা করবেনা? চলো হল ঘরে। বলে জোর করে তার হাত ধরে হলঘরের দিকে এগুলাম। সাথে পাউরুটি আর জেলির বয়ামটা নিলাম। সেই মেয়েটা এখনো অভুক্ত আছে। ইশশ্ অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে! তার কী পাবার দরকার ছিল, কী করার দরকার ছিল, আর সে পাচ্ছে কী আর করছে কী! একমাত্র স্বামীকে বাঁচানোর জন্য!

চলবে….