শেষ সূচনা পর্ব-০৫

0
295

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০৫
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

হলঘরের দরজা খুলতেই ঝাপটা মেরে একদল আলোকরশ্মি পুরো ঘর আলোকিত করে দিলো। অকস্মাৎ ঘরময় আলোর উপস্থিতিতে অভুক্ত মেয়েটি একটু নড়ে উঠলো। দুর্বলতায় মাথা নুইয়ে অনেকটা কোলের উপর এসে পড়েছে মাথাটা। চেহারা গতকালের তুলনায় দ্বিগুণ ম্লান ও শুষ্ক। হল ঘরের দিকে আসার পথে স্বর্ণাকে মেয়েটার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছি। প্রতুত্তরে সে আমাকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছে শুধু। কারণ হিসেবে দেখিয়েছে,” যে যাই বলে তাই বিশ্বাস করতে নেই, এমন মেয়েরা প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যা বলতেই পারে।”
প্রথমে স্বর্ণা এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়েও যখন মেয়েটার সাড়াশব্দ পাওয়া গেলনা। তখন স্বর্ণা খানিকটা বিরক্ত হয়ে মেয়েটার মুখের সামনে মধ্যমা ও বুড়োআঙুলের ঘর্ষনে ‘টুকটুক’ শব্দ করলো। মেয়েটা চমকিত হয়ে তড়িৎবেগে মাথা তুলল। চেয়ারের সঙ্গে হাত বাঁধা থাকার ফলে কাঁধে টান পড়ায় একটু কুঞ্চিত হয়ে উঠলো সে। স্বর্ণার দিকে চোস্ত দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটা
স্বর্ণা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাঠকাঠ গলায় বললো,
—- আমাকে মারতে এসেছিস না? নে মার। মিনহাজ ওর বাঁধন খুলে দাও ওর। দেখি ওর কতো জোর!
আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললাম,
—- আহা কুলডাওন স্বর্ণা! তোমাকে তো আগাগোড়া সব বলেছি। তারপরও এতো উত্তেজিত হওয়া কি তোমাদের স্বভাব?
স্বর্ণা চোখা দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ফস্ করে বলল,
—- বলেছ ঠিকি,কিন্তু তার কথা যে সত্যি সেটা কিভাবে বিশ্বাস করব? সে তো মিথ্যাও বলতে পারে।
বললাম,
—- এতো সন্দেহের কি দরকার? ওর স্বামী কোন হসপিটালে এডমিট আছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখলেই হয়।
স্বর্ণা স্পষ্ট শাসানোর ভঙ্গিতে তর্জনী তুলে বলল,
—- ঠিকাছে তাই করো। তারপর দেখি নিব ওকে। মিথ্যা যদি বলে না! ওর একদিন-কি আমার একদিন।
বলে হনহনিয়ে হলঘরের বাইরে চলে গেল সে।
আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলাম। মেয়েটা বদলে গেছে। ভীষণ বদলে গেছে। আগে ক্ষণে ক্ষণে এমন রুদ্রমূর্তির দেখা মিলত না। আর এখন! এই অগ্নিমূর্তিই যেন তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কিন্তু এই কিম্ভুত কুচ্ছিত মূর্তির নেপথ্যে কোন কলঙ্কিত ইতিহাস লুকোছাপা করে বেড়াচ্ছে তা এখনো বের করতে পারলাম না। আফসোস! আফসোস!
উপুড় হয়ে থাকা চেয়ারটা তুলে নিয়ে বসে পড়লাম। পাউরুটিতে জেলি লাগাতে প্রশ্ন করলাম,
—– হাওএভার, কোন হসপিটালে আছে তোমার স্বামী?
মেয়েটা একটা কাঁশি দিয়ে ক্ষীণস্বরে বলল,
—- সেন্ট্রাল হসপিটালের তৃতীয় তলায়।
—- রুম নাম্বার?
—- ২৩৫।
—- ওকে।
জেলি লাগানো শেষে পাউরুটি তুলে ধরলাম মেয়েটার মুখে। মেয়েটা একটু সংকোচ করে ধীরে ধীরে পাউরুটি মুখে পুরে দ্রুত চিবুতে লাগল। দেখেই সহজে বোধগম্য হয় অনেক্ক্ষণ কিছু পেটে পড়েনি৷ নিজের কুকর্মের ফলে খিদের জ্বালা না বলতে পেরেছে আর না সইতে পেরেছে৷ অপারগ ছিল মেয়েটা। ঐ জায়গায় আমি থাকলে তাই করতাম। পাউরুটি চিবুতে চিবুতে মেয়েটার চোখের দু’কোণ ভরে আসছিল সেটা আমি স্পষ্ট টের পেলাম।প্রখর দৃষ্টিতে অবলোকন করলাম কিছুক্ষণ,এই কিসের কান্না! ভাবনায় ডুবে গিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে আবিষ্কার করলাম,একজন অজ্ঞাতকুলশীল ছেলের কাছে অবিমিশ্রত সেবা-যত্ন পাবার কারণেই এই জল-ছলছল চোখ। যেখানে এই দেশে কোন মানুষের অপরাধ না জেনেও গনপিটুনি দিয়ে রাস্তার সঙ্গে পিষে দেয়া হয়! বাঁচার জন্য হাজার আকুতি যেখানে কানে পৌঁছায় না সেখানে এমন আদর-যত্ন তো ভাবনারও অতীত! পৃথিবীর জিজীবিষু মানুষগুলোই তাড়াতাড়ি মরে। খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। স্বর্ণা তখন বাইরে দাঁড়িয়ে অজানা ব্যক্তির সাথে ফোনালাপ করছে। আমাকে দেখে “পরে ফোন করছি” বলে রেখে দিল। কাছাকাছি গিয়ে বললাম,
—– ফোনে চার্জ হলো?
স্বর্ণা দুইহাত নেড়ে বলল,
—- অল্প – একটু যা হলো আরকি।
—- আচ্ছা, চলো ভিতরে যাওয়া যাক।
বলে পা বাড়ালাম আমি। সে আমাকে অনুসরণ করতে করতে বলল,
—- আমি কিন্তু কালই সিলেট চলে যাচ্ছি, আজকে মেনেজ করলাম কোনমতে।
একথার জবাবে কিছু বললাম না ঠিক, কিন্তু মনের ভাবনাটা কোন ছলেই নিরস্ত হচ্ছেনা মাথা থেকে। তারমধ্যে আবার সিলেট! ঘরের চৌকাঠ পেরোতেই বললাম,
—- সিলেট কেন? আমার জানামতে ওখানে তোমার কেউ নেই।
—- তোমার জানার পরিধি খুব অল্প, তাই জানোনা। কাজেই যাচ্ছি, তাছাড়া ঘুরাঘুরিতে আমার স্বাদ নেই।
—– আগে তো ছিল। এখন হঠাৎ উধাও হবার কারণটা কী? সোফায় বসতে বসতে বললাম আমি।
স্বর্ণা কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখনি রান্নাঘর থেকে খালা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এলো।বললো,
—– ভাইজান যাইতাছি। রান্না কইরা দিয়া গেলাম আপনাগো দুজনের জন্য। সন্ধ্যায়কালে আসব আবার।
আমি হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে বললাম,
—- ৯ টা বাজে মাত্র। এখনি রান্না করে ফেলেছ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে না?
—- একটু গরম কইরা নিয়েন। বাসায় একটু কাজকর্ম আছে।
—- ঠিকাছে যাও। সন্ধ্যায় চলে এসো।
খালা চলে গেল। স্বর্ণা বিমনা হয়ে কি যেন ভাবছিল। আমার ডাকে চমকিত হয়ে সংবিৎ ফিরে পেল।
—– কী হলো,উত্তর দিলেনা যে? হঠাৎ সব চেঞ্জ করে ফেললে!
—- তোমার তো ইতিহাস অপছন্দ। এটাও তোমার কানে ইতিহাসের মতো শোনাবে। থাকনা…. আমি বলতে চাইনা। পুরোনো আবর্জনা ঘাটলে গন্ধ বের হয়।
সেইসময় কি হলো হঠাৎ জানিনা। আমার ভেতরটা অজানা রোষে আন্দোলন করে উঠলো। অকারণে রাগ চাপলো নিজের উপর এবং স্বর্ণার প্রত্যেকটা অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডের উপর। তড়াক করে দাঁড়িয়ে সোফা ছেড়ে বন্য মোষের মতো তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেলাম স্বর্ণার দিকে। দেখে স্বর্ণা চোখদুটো একটু ধারালো করল শুধু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকস্মিকভাবে দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিলাম তাকে। নিজের দুইহাত দেয়ালে ঢেকিয়ে বেষ্টনীতে আটকে ফেললাম তাকে। পুরো বিষয়টা সে হতবাক হয়ে দেখে গেল। কিছু করারই ছুটি পেলনা। নির্বাক মাথা উঁচিয়ে চেয়ে রইলো সে। তখনো অদমনীয় ক্রোধে উন্মত্ত আমি। দাঁত খিঁচিয়ে বললাম,
—- এখন এমন হাবলার মতো চেয়ে আছো কেন? বলো কি হয়েছিল? কেন তুমি এ পথে নামলে? তোমার ভাষা,আচার-আচরণ, অত্যাধিক উগ্রতা! কারণ কী এসবের পিছনে? তোমার পরিবার কোথায়। আর তুমি এখানে কেমনে এলে? বলো, জানতে চাই আমি!
শেষের দিকে কণ্ঠে জোর বেড়ে গেল আমার। স্বর্ণা তারপরও চুপ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। হঠাৎ ফিক্ করে হেসে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপতে চাপতে বলল,
—– জোর করে বলাতে চাও?
সেই হাসিতে যেন আমার সর্বাঙ্গে আগুন ধরে গিয়ে সেই আগুনের ফিনিক আশপাশের সবকিছু ভস্ম করে দিতে লাগল। আগের সুরে বললাম,
—- হ্যাঁ বলাতে চাই।…
মিনিট কয়েক ফুঁসফুঁস করার পর আমার রাগের ছাইসুদ্ধ হয়ে ধুয়েমুছে গেল। অনেকটা ধাতস্থ হয়ে হবার পর, ডানহাতে স্বর্ণার পিঠ পেঁচিয়ে টেনে বুকের কাছে নিয়ে এলাম। বুকের কাছ থেকে মাথাটা উঁচু করে সরল চোখে তাকালো সে। অজানা কারণে আজ অনেক বছর পর মনে হলো, জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া এই অধিকারটা আমি আবার ফিরে পেয়েছি। যদিও কোনকিছু আগের মতো নেই। সময় বদলেছে, স্বভাব বদলেছে, নিজেদের অবস্থান বদলেছে, কর্মক্ষেত্র বদলেছে, মনের দূরত্বটাও কিঞ্চিৎ বেড়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, মনের দূরত্ব বাড়লেই ভালোবাসাটা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়না! কাঠখড় পুড়িয়ে একটু যত্ন নিলেই সেটা পূনরায় ফিরে আসে। আজকে স্বর্ণার এই সরল চাউনি সে দিকই নির্দেশ করে৷ শুধু একটু নম্রতার দরকার হয়। একটু বিনয়ী হতে হয়। সেটা মাথায় রেখেই আমি গলাটা খাদে নামিয়ে বললাম,
—- বলো প্লিজ, হালকা লাগবে…।
স্বর্ণা হাঁ সূচক দুচোখ বন্ধ করে মৃদু মাথা নাড়লো। নিজের দু’হাত পিছনে নিয়ে আমার হাত থেকে নিজেকে অবমুক্ত করতে করতে বলল,
—– আসো বলছি। সোফায় বসো।
আমার ছাড়তে ইচ্ছে হলোনা। ইচ্ছে হলো, জন্মজন্মান্তর এভাবে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকি। এই বাহুবাঁধনে যেন চিড় না ধরে। ছাড়তে হলো।
স্বর্ণা সোফায় বসে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ আড় হয়ে বসে রইল৷ বোধহয়, যে বিস্মৃত বিষাদস্মৃতিগুলো নিজের হৃদয়ের তলানিতে পড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ধুলো জমে ধূসর রূপ ধারণ করেছে তা ঝেড়ে মুছে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে। উদ্ধার হলে একটা দীর্ঘশ্বাস বায়ুমণ্ডলে মিলিয়ে দিয়ে একে একে সমস্ত বিবৃত করা শুরু করলো স্বর্ণা।

—— বাবা-মা তোমার বাসায় গিয়ে যেদিন দাদীর কাছে নালিশ করলো, সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছিলাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি দাদী কষ্ট পেয়ে তোমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন। পরেরদিন বাবা-মায়ের হয়ে স্যরি বলতে গেলাম তোমাদের বাসায়। কিন্তু গিয়ে দেখি বাসায় কেউ নেই। তালা ঝোলানো। পেছনের কুঁড়েঘর থেকে কেয়ারটেকার এসে বলল,” তোমরা চলে গেছ ঢাকায়। কোন ফুফুর বাসায় থাকছো আপাতত, পরে বাসা নিয়ে থাকবে। এতটুকুই জানলাম। ফোন নাম্বার চাইলাম। কিন্তু সে দিতে পারলনা। তুমিও তখন ফোন ইউজ করতেনা। এরপর বাড়ি চলে এলাম। বন্দী করে ফেললাম নিজেকে চারদেয়ালের মধ্যে। কিছুই ভালো লাগতো না। তোমার দুইটা ছবি ছিল আমার কাছে, সেগুলো দেখে দিনরাত পার করে দিতাম। এখনো ব্যাগের এককোনায় আছে বোধহয়। এসব দেখে বাবা-মা ভাবলো আমি নষ্ট হয়ে গেছি। বলাবলি করতে লাগলো,” যে মেয়ে অচেনা একটা ছেলের ছবি নিয়ে সারাদিন বসে থাকতে পারে সে তো ভালো মেয়ে হতে পারেনা। নষ্ট হয়ে গেল মেয়েটা” আমার নষ্ট হবার ধারণার জন্য বাবা মাকে দুষতো আর মা বাবাকে। কথা কাটাকাটি হতো তাদের মাঝে এই নিয়ে। তুমিতো জানো, আমার পরিবার কেমন রক্ষণশীল। তিলকে তারা তাল করে দেখতো। আমি জানতাম বিষয়টা দৃষ্টিকটু। একটা মেয়ে সারাদিন অষ্টপ্রহর অন্য ছেলের ছবি সঙ্গ করে বসে থাকবে এটা কেউই মেনে নিবে না। রক্ষণশীল পরিবারে তো একেবারেই না। যাইহোক, এভাবে কাটলো অনেকদিন। সেমিস্টার ফাইনাল চলে এসেছিল বিধায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সারাদিন মনমরা হয়ে থাকতাম। রেজাল্ট তেমন ভালো হলোনা। বাবা বকার জন্য নতুন টপিক পেলেন। এবার শুধু বকাই নয়, একেবারে পড়াশোনা বন্ধ করে আমার বিয়ে দেবে বলে স্থির করলেন। আমি অনেক বাঁধা-বিপত্তি দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলাম যে, “আমি বিয়ে করবনা এখন।” কেউ শুনলনা। নিজের মা-ই বলল,” কেন বিয়ে না করে অন্য ছেলের সাথে লুতুপুতু করে বেড়াবি, এটা তো হবেনা! আমাদের একটা মানসম্মান আছে”

মায়ের উক্তিটি পাক্কা মায়ের মতো করেই টেনে টেনে বলল স্বর্ণা। একটু থেমে দম নিয়ে আবার শুরু করল।
—- রাগে, ক্ষোভে , অভিমানে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, আমি স্বামীর জায়গাটা তুমি অন্য কাউকে দিতে পারতাম না। পুরো জায়গাটা দখল করেছিলে তুমি। অন্যকে বসাতাম কিভাবে? তাছাড়া বিয়ে ঠিক করল একজন অর্ধবয়স্ক খাটাসের সাথে। এরকম নরকের জীবন তো আমি চাইনা। একদিন রাতে চুপিচুপি বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। কিন্তু স্টেশনে গ্রামের দুইজন লোক আমাকে দেখে জোর করে নিয়ে এলো বাসায়। না পারছিলাম কাউকে ডাকতে আর না পারছিলাম দুজনের হাত থেকে ছুটে পালাতে। গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। লোক দুটো আমাকে জোর করে বাসায় নিয়ে এলো। রাতে বাসায় আসার পর বাবা-মা মিলে অনেক মারধর করল আমায়। এমনকি বাবা রেগে জুতা দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে। ঘরের ভিতরেই বাবার কাছ থেকে নষ্টা মেয়ে বলে উপাধি গেলাম আমি। দারুণ উপাধি। সবাই পাইনা এটা। পালিয়ে যাবার কথাটি এলাকায় অল্প-বিস্তর গুনগুন করলেও বাবার সম্মানার্থে সবাই একপর্যায়ে চুপ করে গেল। কিন্তু এই পোড়াকপালির বিয়ে ভাঙল না। বোধহয় ঐ অর্ধবয়স্ক বুড়ো মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিলনা। নাহয় এতকিছুর পর ঐ মেয়েকে কে বিয়ে করে? একবার মরতে ইচ্ছে হলো। সাহস হলোনা। ভাগ্যকে মেনে নিলাম।
স্বর্ণা থামল। সুমুখের টেবিলে থাকা গ্লাসে জগ কাত করে পানি ঢালল। ডানহাতে ধরে এক চুমুকে পুরো গ্লাসের পানি সাবাড় করে দিলো। টক্ করে গ্লাসটা রেখে বাঁ হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট মুছে আবার বলতে শুরু করল,
—- এরপরের ইতিহাস আরো জঘন্য! ভাবিনি কাউকে এভাবে বলতে হবে। তখন বিয়ের আরো একমাস বাকী। ঘরে থাকতে ভালো লাগত না আমার। যে সময়টা থাকতাম সে সময়ই বকাঝকা,খোঁটা, তিরস্কার অনবরত চলত। হয় নদীর পাড়ে বসে থাকতাম নাহয় দূরের বান্ধবীদের বাসায় গিয়ে সময় কাটাতাম। দূরত্বটা সামন্য ছিলো। এরিমধ্যে অন্য একটা গ্রামের কিছু ছেলেপেলে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। তোমার মনে আছে কিনা জানিনা আমাদের সাথে পড়তো তারা,রাজীবের দলটাই এসব করতো টাকা দিবে বলে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি রাজী হয়না। এভাবে একবার দুইবার,তিনবার… এমনিতেই ছিলাম চরম ডিপ্রেশনে। সব হারাতে বসেছিলাম তার উপর এই উটকো ঝামেলা। এভাবে একদিন শেষ বিকেলে বান্ধবীর বাসা থেকে ফিরছিলাম। তখন সন্ধ্যা হয় হয় এমন অবস্থা। হঠাৎই ছেলেগুলো আবার সামনে এসে দাঁড়াল। আবার সেই ঘৃণ্য প্রস্তাব! মেজাজ বিগড়ে গেল আমার, অনেকদিন পর সেই উগ্রমূর্তি ফিরে এলো আমার। সামনে থাকা ছেলেটিকে সজোরে চড় দিয়ে বসলাম। এরপর লাগাতার কয়েকটা কিল ঘুষি দিলাম। হয়তো সেই রাগই আমাকে শেষ করলো। নয়তো অন্যকিছু হতে পারত। ছেলেটাকে মারার সাথে সাথে বাকীরা আমাকে ধরে ফেলল। চার-পাঁচজন ছেলের কাছে আমার ঠুনকো রাগ কিছুই না। সবাই একত্রিত হয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ক্লাবের পুরোনো ভাঙা ঘরটাতে নিয়ে যায়। চিৎকার করেছি অনেক।কিন্তু পুরোনো সেই ঘরের আশেপাশে কোন বাড়িঘর ছিলনা। শুধু এই ছেলেগুলোর আড্ডাখানা ছিল৷ অনেক অনুরোধ করেছি তাদের যে, একসাথে পড়েছি আমরা,ভাইয়ের মতো, পায়ে পড়ি এই সর্বনাশ করিস না। কিন্তু আমার আর্তচিৎকার কেউ শুনেনি৷ পালাক্রমে আমার সর্বনাশ করে গেছে। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।… জ্ঞান ফিরে সকালে। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ায় ঘুম ভাঙে আমার।প্রথমটা বুঝে আসতে সময় লাগলো। পরক্ষণেই নিজের অবস্থা দেখে মুহূর্তে আমার পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়। হৃদপিণ্ড ধকধক আওয়াজ করা বন্ধ করে দেয়। কাঁদতে গেলে মুখ বিকৃত হওয়া ছাড়া একবিন্দু চোখের জল বোরোয় না। চিৎকার করতে চাইলে ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপা ছাড়া আর কোন শব্দ বেরোয় না। পাশে পড়ে থাকা ময়লা কাপড়চোপড় পরে ঠিক করে বেরিয়ে গেলাম সেই ঘর থেকে। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। বাবা-মা থেকে শুরু করে এলাকার সবাই আমার আগের কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে বলল যে, আমি ইচ্ছে করে আমার স্কুলে পড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়েছি এবং সুযোগ বুঝে তারা ফায়দা লুটেছে। অথচ কোনকালেই তারা আমার বন্ধু ছিলনা। তারা আমাকে অসতী বানিয়ে পালিয়ে গেল৷ কিন্তু নিজের আপন পরিবার সহ প্রত্যেকে আমাকে ভুল বুঝল। নানান অপবাদ ছড়িয়ে পড়লো পুরো গ্রামজুড়ে। বিয়ে ভেঙে গেল ঠিক। কিন্তু এভাবে ভাঙাতে চাইনি আমি। পুলিশ তাদের এখনো খুঁজে চলেছে। জানি পাবেনা কখনো। ওরা টাকার কাঙাল। ঐদিন রাতেই আমি সব ছেড়ে চলে আসি ঢাকায়।সবার সামনে। কেউ টু শব্দ করেনি। কোন কিছুতে আমার কষ্ট লাগেনি। কিন্তু নিজের মা কিভাবে আমাকে ‘বেইশ্যা,ব্যভিচারিণী’ বলে অপবাদ দিতে পারল? কীভাবে আমাকে নিজের মেয়ে বলে অবিশ্বাস করল? আমার তো দোষ ছিলনা! আমি শুধু একটু শান্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু তারপ…
আর বলতে পারলনা স্বর্ণা। গালাটা ভারী হয়ে এলো তার। আন্দোলনরত ক্ষিপ্ত জনগণের সামনে পুলিশ বাঁধা দিলে জনস্রুত যেভাবে ঠেলে আসতে চায়, ঠিক তেমনি দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমাণ কান্নার অবাধ্য দলেরা এবার বুকের পাঁজর ঠেলে বিদীর্ণ করে স্বর্ণার আকণ্ঠ রোধ করে দিল। পুরো শরীরটা একবার ঝিনঝিন কেঁপে ফুলে উঠলো তার। সেই প্রভঞ্জনে তার চোখ বেয়ে দরদর করে শব্দহীন বড়বড় অশ্রুফোঁটা কোলের উপর পড়তে লাগল।
আমি সইতে পারলাম না এই ব্যথা। বুকের ভেতরটা দুলে দুলে আসছে। এই বুঝি চোখ বেয়ে ফোয়ারা নামবে। কিন্তু নিজের রাশ টেনে ধরলাম। সামলালাম। অনেক্ক্ষণ দু’জনের কোন কথা হলোনা। পাতিপাতি করে খুঁজেও কোন কথা বেরোলো না। ঘরময় দুশ্ছেদ্য নীরবতা।
স্বর্ণা ভারী গলায় বলল,
—– বলতে তো চাইনি। তারপরও কেন জোর করে বলালে? আট বছর পর কাঁদানোর জন্য? আমাকে দমাতে পারবেনা তুমি। তোমার পথ আর আমার পথ কাল থেকেই আলাদা। ওদের প্রত্যেকটাকে কবরে না পাঠিয়ে মরছিনা আমি। খারাপ যখন একবার হয়েছি। খুঁজেখুঁজে খারাপ কাজই করে যাব।

স্বর্ণার কণ্ঠ অল্প স্বাভাবিক হলো বটে। কিন্তু কঠিন কথাগুলোও কেমন যেন করুন শোনালো। এ বড় কঠিন প্রশ্ন। আমি জবাব দিতেও গিয়েও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই উত্তর আমার কাছে নেই আপাতত। নেই কোন সান্তনা বাণী।

চলবে….