শেষ সূচনা পর্ব-০৬

0
284

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০৬
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

দুপুরের দিকে পরিবেশটা গুমোট রূপ ধরল। মাথার উপর তেজস্বী সূর্য তল্লাটজুড়ে খাড়া আলো ছড়াচ্ছে। গাছের পাতাগুলোকে যেন ঠেলে নাড়ানো যায়না। দেখলে মনে হয় পৃথিবীটা গুম হয়ে গভীর ধ্যানে বসেছে। কোন সাড়াশব্দ করলে যেন জাত চলে গিয়ে গিয়ে চরাচর কলুষিত হয়ে পড়বে। স্বর্ণা এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। হাঁটছে, চলছে, কথা বলছে। একটু আগের বিষণ্ণতাটার কালো মেঘটা খুব দ্রুত কেটে গেছে সময়ের সঙ্গেই। আমি দুপুরের খাবারগুলো গরম করে নিলাম। একটা প্লেটে করে ভাত-তরকারি নিয়ে মেয়েটাকে খাইয়ে দিয়ে এলাম। এবার সে চোখের জল ফেলেনি। স্বাভাবিকভাবেই খেয়ে নিলো। যেন এভাবে হাঁত বেঁধে খাওয়ানো তার নিত্যকার জীবনের ঘটনা। মনে মনে ঠিক করলাম মেয়েটার স্বামীর খোঁজ নিয়ে চিকিৎসার সমস্ত খরচ আমি বহন করবে। সিন্দুকে-ব্যাংকে তো টাকার অভাব নেই। একটু ভালো কাজে নাহয় যাক সেই টাকা। হাজার হোক, একটা মেয়ে নিজের স্বামীর জন্য অপকর্মে জড়িত হবে,সন্ত্রাসী’র খাতায় নাম লেখাবে সেটা নিজ চোখে দেখার মতো মনন এখনো আমার হয়নি। দান-খয়রাতের অভ্যাস নেই ঠিক। তবে এ বিষয়টা কেন জানিনা আমাকে নিরবচ্ছিন্ন পীড়া দিয়ে যাচ্ছে।
হলঘর থেকে ঘরে এসে স্বর্ণার ঘরের দিকে গেলাম। রুমে নক করলাম। সাড়া পাওয়া গেলনা। আরো বারকয়েক কড়া নাড়লাম। তাও চলমান নৈঃশ্বব্দ বিরাজমান। অগত্যা দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলাম। কিন্তু ভেতরে কাউকে দেখলাম না। চপল চোখে ঘরের একোণ-ওকোণ চোখ ঘুরালাম। কিন্তু একটা প্রাণীর দেখা মিলল না। বেলকনিতে উঁকি দিলাম। নাহ এখানেও নেই। বাথরুমের পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আসছিল। আমি হেঁটে গিয়ে কান পেতে বললাম,
—- স্বর্ণা, গোসল করছো?
প্লাস্টিকের দরজা ছেদ করে একটু পর শব্দ এলো,
—- নাহ, ডান্স করছি।… এসময় মানুষ কী করে? যাও নিজের কাজে।
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। মেয়েটা এক্কেবারে স্বাভাবিক! সেই আগের মতোই আচরণ করছে। যেন আমাদের মাঝে কোন দূরত্বের দেয়াল সৃষ্টি হয়নি। সত্যিই নারীজাতি বহুরূপী। আমি কৌতুকের ছলে বললাম,
—- আচ্ছা তুমি বেরোও, আমি রুমে অপেক্ষা করছি। তারপর একসাথে খাবো।
স্বর্ণা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
—- একদম না। তুমি খাবার টেবিলে যাও আমি রেডি হয়ে আসছি ওখানে।
—- আচ্ছা ঠিকাছে,তাড়াতাড়ি এসো।
আমি খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। গতরাতের নির্ঘুম রাতটার প্রাদুর্ভাবে এখন চোখে রাজ্যর ঘুম নেমে আসছে। কিন্তু মন কিছুতেই ঘুমানোর ব্যাপারটায় সায় দিচ্ছে না। অনবরত আন্দোলন করে যাচ্ছে। বলছে, একটা দিনই তো! তারপর তো চলে যাচ্ছে! আমার ঘুমকাতুরে চোখ রেগেমেগে বিদ্রোহ করে বলছে, যাক! ঠিকি খুঁজে নেব। এমন দোটানা টানাপোড়নের সময় স্বর্ণা এসে হাজির হলো। তার পরনে সাদা পাড়ের গোলাপি রঙের লং থ্রিপিস। হাতা দুই পলটে নিপাট করা। ফিনফিনে ওড়না দ্বারা গলা অবধি পেঁচানো। ঘন-কালো স্ফীত ঝাঁকড়া চুল সিঁথি করে ডান পাশে এলানো এবং কিছু অংশ কীলক দ্বারা আটকানো। সদ্যস্নাত পুরন্ত মুখমণ্ডলে একটা আদুরে আদুরে ভাব টলমল করছে। অপূর্ব দেখাচ্ছিল তাকে। ঠোঁটের কোণে এল চিলতে হাসি আর ফর্সা পায়ের পাতা বাড়িয়ে পতপত করে হেঁটে আসল সে। চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
—– চোখদুটো এমন লাল দেখাচ্ছে কেন? ঘুমচ্ছিলে নাকি!
আমি অপ্রস্তুত হেসে জবাব দিলাম।
—- হ্যাঁ গতকাল রাতে ঘুম হয়নি। তাই একটু ঘুম পাচ্ছে।… প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললাম,” কিন্তু এখন ঘুমানোর সময় নেই। মেয়েটার স্বামীর খোঁজ নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
—– কেন? শত্রুর জন্য এতো দরদ উছলে ওঠার কারণ কী?
আমি চোখের ইঙ্গিতে ভাতে প্লেট দেখিয়ে দিয়ে বললাম,
—- খাওয়া শুরু করো। আর… শত্রু আমার না। এই জগতে আমার আপনও নেই শত্রুও নেই। ভবিষ্যতে হবে কিনা সেটাও জানিনা। একটা উপায়হীন মেয়েকে সাহায্য করতে দোষ কী?

স্বর্ণা বুভুক্ষুর মতো একমনে গপ্ গপ্ করে খাওয়া শুরু করলো। আমার কথার উত্তর দিলোনা। একটু পর বেহায়ার মতো আমি আবার বললাম,
—– এই পোশাকে তো তোমাকে ভালোই লাগে। মাঝে মধ্যে ওসব গেঞ্জি-শার্ট পরো কেন?
খাবার থেকে মুখ তুলল না সে। খেতে খেতেই উদাসীন কণ্ঠে জবাব দিলো৷
—- সাধারণত এভাবেই সাধারণ পোশাকে থাকি। কিন্তু যখন কোন এ্যাটাক কিংবা… ধস্তাধস্তির আশঙ্কা থাকে তখন ওসব পরতে হয়।
আমি খাওয়া থামিয়ে বাঁ হাতে টেবিলে কনুই ঠেকে থুতনিতে হাত রেখে বললাম,
—- আচ্ছা… আচ্ছা তোমার ঐ খারাবির জগৎ থেকে ভালো পথে ফেরার ইচ্ছে হয় না?
স্বর্ণা চট্ করে বলল,
—- না হয়না। একটুও হয়না। এখন খেতে দাও আমাকে। আর প্রশ্ন করোনা।
আমি নিভে গিয়ে বললাম,
— ঠিক আছে খাও৷

খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম করলাম। দুপুরের তেজদীপ্ত রৌদ্রের সূচালো ধারটা যখন ম্লান এলো তখন মেয়েটার কাছে গেলাম। স্বর্ণার চোখ বোধহয় একটু লেগে এসেছিল। আমি গিয়ে ডেকে নিয়ে এলাম। হলঘরে এসে হাতের বাঁধন খুলে দিলাম মেয়েটার। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। এ কাজে আনাড়ি,অপরিপক্ক শরীরের খাঁজে খাঁজে যেন ব্যথার বিষ ছড়িয়ে গেল। দুই স্কন্ধদেশ যেন ব্যথায় অচেতন হয়ে আছে। সে নিচু হয়ে বলল,
—- এখন কী করব?
আমি বললাম,
—- তোমার স্বামীর হসপিটালে যাব। আর হ্যাঁ কোন চিন্তা করোনা। চিকিৎসার খরচের বিষয়টা আমি দেখছি।
মেয়েটা বোধহয় আমার কথার বিন্দুবিসর্গও বিশ্বাস করতে পারলনা। মূঢ়ের ন্যায় বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণে একটু ফ্যাকাসে হেসে যথাক্রমে স্বর্ণা এবং আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
— আপনি মজা করছেন তাইনা?
আমি মৃদু হেসে বললাম,
—- এসব সস্তা মজা আমি করিনা।… খাবার খেয়েছ। পেট টাইট আছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। এখনি হসপিটাল যাব।
মেয়েটা তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারলনা। চিত্রার্পিতার ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। তার বিস্ময়-বিহ্বল চোখে নোনা জলীয় কণা টলটল করছে,চোখের পল্লব নাড়া দিতেই কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। । আমি দেখেও কিছু বললাম না। তাড়া দিলাম। স্বর্ণাও মুখ ঘুরিয়ে অস্ফুটে ‘ হুহ!আহ্লাদ’ বলে গঞ্জনা করল। স্বর্ণার উদগ্র আচরণে রাগে গা রিরি করে উঠলো। তাও চুপ করে রইলাম। মন বলল, মাত্র একদিন! সহ্য করে যা।… হলঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়েটা চোখেমুখে পানির ঝাপটা মেরে ফ্রেশ হয়ে নিল। ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমরা। বাসার একটা গাড়ি আছে গ্যারেজে। বাবা মাঝে মধ্যে দেশে এলে সেটা নিয়ে নানান কাজ সমাধা করেন। চাবিটা অবশ্য ছিল আমার কাছে। কিন্তু অনেকদিন ধরে অযত্নে অবহেলায় গাড়িটা চালানোর মতো অবস্থায় নেই। উপায় না পেয়ে গলির মোড়ে এসে একটা সিএনজি ভাড়া করে সোজা হসপিটালে চলে গেলাম। মেয়েটার পিছু পিছু তেতলার ২৩৫ নাম্বার রুমে এসে পৌঁছালাম। রুমের যা শ্রী দেখলাম তাতেই গা শিউরে ওঠা অবস্থা। কোন নার্স নেই, না কোন মেশিন চলছে, আর না কোন মানুষের চলাচল আছে এই রুমে। একটা নিঃশেষিত স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে হ্যাংকারে। রোগী অজ্ঞান। বয়স বড়জোর তিরিশ বছর। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কোমরে হাত দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলাম। স্বর্ণাকেও একটু বিপন্ন, বিষন্ন দেখাল। মেয়েটা স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়া দিল। স্বর্ণা পূর্বের ঘটনার নিমিত্ত একটু ইতস্ততঃ করে এগিয়ে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। হায়রে টাকা! মেশিনে টাকা যতদিন পড়বে ততদিন ডাক্তার, নার্সের হাত দুর্বার গতিতে চলবে। বাবা- মায়ের কাছে ছেলে যখন দিতে অক্ষম হয় বাবা মায়ের সমস্ত আদরও তখন টাকার সঙ্গে সঙ্গে উবে যায়। বাবা যখন ছেলেকে দিতে অক্ষম হয় ছেলেও বাবাকে বলে,” তোমার বাবা হওয়ার যোগ্যতাই নেই!” স্বামী যখন আয় রোজগারে অক্ষম হয় প্রাণপ্রিয় স্ত্রী তখন মুহূর্তে চোখ উল্টে বলে,” বউ বাচ্চা খাওয়াতে না পারলে বিয়ে করেছ কেন?” ভালোবাসাটা তখন জানালা দিয়ে চুপিসারে পালায়। জগতটাই টাকার গোলকধাঁধায় বেষ্টিত। কিছু মানুষ মনে করে তাদের জন্মই হয় টাকা রোজগারের জন্য।অথচ তাদেরই আশেপাশে কত মানুষ যে উপোসে মরছে তার কোন আদি-অন্ত নেই। সবকিছু যেন তাদের অতীন্দ্রিয়!

আমি আর দেরি না করে দ্রুত কর্তব্যরত ডাক্তারকে ডেকে সাময়িক শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলাম। এবং যে ডাক্তারের অধীনে রোগীর চিকিৎসা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলে অপারেশনের সমস্ত খরচাপাতি মিটিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি অপারেশন করার জন্য বললাম।ফেরার সময় মেয়েটাকে বললাম,
—- মেহেনাজ, আমার কোন বোন নেই। ধরতে পারো একজন ভাই হিসেবে কাজটা করেছি আমি। এটাকে করুনা বা দয়া হিসেবে নিও না।
এরপর একটা নরমাল ফোন তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— আমার ফোন নাম্বার দিচ্ছি আর এই ছোট ফোনটা রাখো। প্রয়োজনে ফোন দিও। আর হ্যাঁ, চোখ কান খোলা রাখবে। তোমাকে যারা পাঠিয়ে খুন করাতে তারা কিন্তু আসতে পারে এখানে। সো… বি কেয়ারফুল।
মেয়েটা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলল,
—- আপনি মানুষ না, ফেরেসতা আপনি,ফেরেসতা…। বলে নিচু হয়ে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাইল।
আমি দ্রুত এক পা পিছিয়ে গেলাম। তার দু’হাতের পেশি ধরে তুলে শাসনের সুরে বললাম,
—- আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে মাতা নত করো না।আজ আসি। কাল একবার আসবো। এরমধ্যে কোন সমস্যা হলে ফোন করবে। চলো স্বর্ণা…

গাড়িতে বসে ভাবছিলাম, আমার শয়তান বাবাকে এতো টাকার হিসাব কিভাবে দেব! দুই মাস পরেই তো এসে টাকা খরচের হিসাব চাইবে। আগে অবশ্য চাইতোনা। কার মুখে যেন মদ খাওয়ার কথা শুনেছে। তারপর থেকেই একটু বেশ তৎপর হয়েছে। এই হাঙ্গামা থেকে রেহাই পেতেই চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছি। যোগ্যতা আমার কম নয় বটে। যথেষ্ট ভালো পড়ালেখা করেছি। খুব শিঘ্রীই কিছু হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
— আচ্ছা তুমি জানো? কেন আমি শেষে মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিতে গেলাম?
আচম্বিতে স্বর্ণার কণ্ঠে ভাবনায় ছেদ পড়ল,বললাম,
— কেন?
স্বর্ণা দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ করে বলল,
— হঠাৎই আমার কথা মনে হলো৷ আমিও তো উপায় না পেয়ে এ পথে এসেছিলাম। মেয়েটাও উপায় না পেয়ে এসেছে। প্রমাণসহ দেখলাম। মনে হলো… আমাকে তো তখন কেউ সান্ত্বনা দেয়নি। আমিই নাহয় দিলাম একজনকে।
প্রতুত্তরে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলাম আমি।

ঘরকোণোর মতো মানুষের মতো বাড়িতে গিয়ে বসে থাকার ইচ্ছে আমার হলনা। যদিও আমার ভীষণ ঘুমে চোখের পাতা দুটে দমে আসছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন দিন;পাশে এই মানুষটাকে আর পাব কিনা সেই সন্দিহানে ঘুমকে বিসর্জন দিতে হল। স্বর্ণাকে ঘুরাঘুরির অফার করতেই সে একটু ভেবে রাজী হয়ে গেল। সন্ধ্যার শহরটা একটু অন্যরকম। দিনের আলো ম্লান হবার সঙ্গে সঙ্গে শহরটা হয়ে ওঠে আরো দুর্বোধ্য, পথ-ঘাট চেনা দায় হয় ; কিন্তু চারদিকে আলোর বিচ্ছুরণে শহুরে সৌন্দর্যটা চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায়। তবুও মনুষ্য সৃষ্ট এই কৃত্রিম সৌন্দর্য কিছু মানুষের মন কাড়তে পারেনা। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে রিকসায় উঠলাম আমরা। স্বর্ণা টু শব্দ করলো না। সন্ধ্যা থেকে প্রায় রাত ন’টা পর্যন্ত ঘুরলাম আমরা। কিছু প্রয়োজনীয় কিছু শপিং করলাম,পার্কে ঘুরলাম, টিএসসির মোড়ে গিয়ে বর্ণিল মানুষের আনাগোনায় নিজেদের মিশিয়ে দিলাম, আড্ডা, কথাবার্তা,ছবি তোলা সর্বোপরি ভালোই ছিল পুরোটা সময়। কিন্তু পুরো সময়জুড়ে স্বর্ণার মুখটা সবসময়ের মতোই কঠিন ছিল। যেন অপারগ হয়ে কোন জটিল দায়ে পড়ে ঘুরতে এসেছে সে। তবুও আমি কিছু বলিনি৷ ঘুরতে এসেছে এটাই অনেক। না এলে তো জোর করার উপায় নেই। সেই অধিকারটাও বোধহয় খুইয়েছি আট বছর আগে।
বাসায় ফিরে খেয়ে নিলাম দুজনে। খাবার টেবিলে উপভোগ্য তেমন কোনো আলাপ হলনা। দাদী মারা যাবার পর থেকেই একা একা খাই। আজকে কাউকে পেয়ে মনটা ফুরফুরে লাগছে।কাল থেকে আবার একা হয়ে যাব।ভাবতেই মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকটা দুরুদুরু করে। কেন জানিনা না চাইতেও এই মেয়েটার ভোজবাজি আমাকে আবার ঘিরে ধরছে। একটা দড়ি কেটে দিতেই অক্টোপাসের ঝাপটার মতো আরেকটা দড়ি এসে গায়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। এ কেমন ইন্দ্রজাল!
কোনমতে বিছানাটা টেনেটুনে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম পরীরা নেমে এলো ঘুম পাড়াতে।
.
.
সকালে ঘুম ভাঙল রুমের দরজায় উত্তরোত্তর কড়াঘাতে।ঘোলাটে ধূসর দরজার গ্লাসে নারী ডৌল দেখা যাচ্ছে। আমি চোখেমুখে একরাশ বিরক্তিভরে দরজা খুলতে গেলাম। তখন রৌদ্রের তেজ বেড়েছে। জানালার পর্দার ফাঁকে ঝকঝকে সকালটা একবার অবলোকন করলাম। দরজা খুলতেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল আমার। স্বর্ণা ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে যাবার জন্য তৈরি। আমি চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললাম,
—- কি ব্যাপার এখনি চলে যাবে?
স্বর্ণা নিজের হাতঘড়ির দেখে বলল,
—- নটা বাজে, তাড়াতাড়ি কই? ১০ টায় সিলেটের বাস ধরতে হবে। জানোই তো কাল টিকিট কেটে নিয়ে এসেছিলাম।
হঠাৎ আমার মনটা বিষাদে ভরে গেল। বললাম,
—- ঠিকাছে। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। আমি রেডি হয়ে এসে তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছি।
স্বর্ণা বাঁধা দেওয়ার গলায় বলল,
—- না না, লাগবেনা, আমি যেতে পারব। তুমি আপাতত গেট পর্যন্ত আসো।
আমি কয়েক সেকেন্ড স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এরপর বাঁ হাত সামনে দেখিয়ে বললাম, চলো…
বোঁচকাটা হাতে নিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম আমি তাকে। হঠাৎ মনে পড়লো স্বর্ণার নাম্বার তো নেয়া হয়নি। বললাম,
—- স্বর্ণা তোমার নাম্বারটা দাও।
সর্ণা ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে বলল,
— একটা দিন, দুই রাত আশ্রয় দেবার জন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি তোমাকে আমার নাম্বার দিতে পারবনা। আমার কোন ঠিকঠিকানা নেই। একদিন এই নাম্বার তো আরেকদিন ঐ নাম্বার। স্যরি।
আমি দুইহাতে চুলগুলোতে একবার ধীরে আঙুল সঞ্চালন করে ব্যগ্র হয়ে বললাম,
—- আমি তোমাকে বিরক্ত করবনা স্বর্ণা। সপ্তাহে একবার ফোন করবো শুধু! প্লিজ।
স্বর্ণা হিম জড়ানো গলায় বলল,
—– অবুঝের মতো ব্যবহার করোনা মিনহাজ। আমার সমস্যাটা বলেছি তোমাকে। আমাকে ফোনে পাবেনা তুমি!
আমি নিজের মুখ লুকাতে ঠোঁট চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। সেদিকেই তাকিয়ে বললাম,
—– গিভ মি আ হাগ্ প্লিজ। শেষ বার…
স্বর্ণা আর নিজেকে সংযত করতে পারলনা। আমাকে জাপটে ধরলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আচমকা ঝাপটায় আমি একটু স্থানচ্যুত হলাম। একটা মিষ্টি রেমশী ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধ আমাকে মুহূর্তে মোহাচ্ছন্ন করে দিল। এরপর স্বর্ণা হুট করে ছেড়ে দিয়ে শীতল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—- ভালো থেকো।
বলে আর দাঁড়ালো না। বোঁচকা নিয়ে হাঁটা ধরলো গলির মোড়ের দিকে। যতক্ষণ তার রম অবয়ব দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ অপলক চেয়ে রইলাম আমি।যখন তার ছায়ামূর্তিটা পর্যন্ত নিলীন হয়ে গেল তখন ধীরে ধীরে সেই জায়গা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম। গেটের ভিতর ঢুকে গেলাম। ঘরে এসে সিগারেট ধরিয়ে একের পর এক ঠোঁট পুড়তে লাগলাম। কষ্টটা যদি একটু লাঘব হতো! দীর্ঘদিন ধরে হৃদয়ের তলদেশে ধামাচাপা পড়া মানুষটির স্মৃতিগুলো আজ এই আড়াই দিনের খোঁচায় ফুলে ফেঁপে আছড়ে পড়ে সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আট বছরের পুরনো বিরহটা যেন আবার ঘাড়ে চেপে বসলো। তখনি ঠিক এই কাণ্ডই করেছিলাম।
ঘণ্টা-খানেক পর কলিংবেল পড়লো সঙ্গে একটা খাম এসে পৌছালো দরজার নিচ দিয়ে। সোফা থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে খামটা খুললাম। উপরে বড়বড় অক্ষরে লেখা, “বাংলাদেশ পুলিশ”। গতমাসে নিজের ফিটনেস পরীক্ষাসহ “পুলিশ ইন্সপেক্টর নিয়োগ ২০১৯” এপ্ল্যাই করেছিলাম। এ তারই ফলাফল। এই মুহূর্তে এমন একটা খুশির খবরের দরকার ছিলো। ভীষণ দরকার ছিল। সামনের সপ্তাহ থেকেই কুমিল্লায় ছ মাসের ট্রেনিং। মদ খাওয়াটা এবার ছাড়তেই হবে। যে করেই হোক!

চলবে…