শেষ সূচনা পর্ব-০৭

0
257

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ০৭
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ।

সামনের সপ্তাহ থেকেই কুমিল্লায় এক বছরের ট্রেনিং। মদ খাওয়াটা এবার ছাড়তেই হবে। যে করেই হোক! একজন মদ্যপ ব্যক্তিকে নিশ্চয় পুলিশের কোন পদে নিয়োগ করা সুখকর হতে পারে না। বরং বর্তমানে পুলিশের লোকের উপর জনগণের যে ছি ছি পড়েছে সেই ছি ছি’র মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। “সো, নিজেকে ধারানো চাই,পরিবর্তন করা চাই” মনে মনে হাজারো সংকল্প ধীরে ধীরে কুড়িয়ে বুকের নিভৃতে স্থাপন করলাম। শেষবার চোখ বুলিয়ে নিলাম কাজগটায়। এরপর তর্জনী দ্বারা ‘টুক’ করে একটা টোকা দিয়ে কাগজটা দুই হতে গুটিয়ে নিয়ে আবার সোফায় এসে বসলাম। সিগারেট ধরালাম আবার। নাহ,সিগারেট খেতে দোষ নেই। মদের নেশাটা সিগারেট দিয়েই চুকিয়ে দিতে চাই আপাতত। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস-সমেত মনের অজান্তে জনমদুখি একটা গান আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আমাকেই চমকে দিল।

কেন পিরিতি বারাইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি।
কেমনে রাখিব তোর মন…

অর্ধেক গানেই আচম্বিতে নিজের উপর নিজে চমকটা আমি খেলাম। মনের ভিতর থেকে কেউ একজন কুটিল স্বরে বলো উঠলো, “এতো বিবাগী হলি কবে তুই?” আমি সেই উত্তর না দিয়ে নিজেকে হঠকারীর মতো ধিক দিলাম। একাকী মনের সঙ্গে সেই খ্যাপামির সময় খালা এলো একেবারে রৌদ্রস্নানে সিক্ত হয়ে। লবনাক্ত নিদাঘ গড়িয়ে পড়ছে গাল-গলা বেয়ে। তার কিম্ভুত তামাটে বর্ণটা বাইরের কড়া রৌদ্রের একঘেয়ে তাণ্ডবে এবার কালোর কাছাকাছি গিয়ে ঘেঁষেছে। তিনি ঝরে পড়া ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন,
—- খাওয়া দাওয়া কিছু হইছে? না একাই বিড়ি টানতেছেন? বিড়ি দিয়াই বেরেকফাস্ট নাকি!
নতুন জিনিস আবিষ্কারে আমার মুখখানা পলকে হাসি হাসি হয়ে গেল। বললাম,
— সত্যিই তো খালা। দারুন বলেছো। সিগারেট দিয়েই ব্রেকফাস্ট। জীবনে প্রথম।
খালা এতক্ষণ ডান দিকের ঘাম মুছছিল। এবার বাম দিকে ধরে বলল,
—- ঠিকাছে কিচুক্ষন বহো। আমি নাস্তা বানাই আনতেছি।কাজ বাড়াইলা আমার। পাশের দোকানে খাইয়া নিলে কি হইতো? উফফ্!
বলতে বলতে চলে গেল খালা। একটু পর খালা নাশতা নিয়ে এলে আমি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হসপিটালের উদ্দেশ্যে। হসপিটালের মূল ফটকে আসতেই মেহেনাজের(মেয়েটি) সঙ্গে দেখা। স্বামীর জন্য ঔষধ আনতে এসেছে সে। আমাকে দেখেই কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ে একগাল হেসে ঈষৎ হাত তুলে সালাম দিল। তার পরনে গতদিনের চক্ষুলজ্জাযুক্ত আঁটোসাটো পোশাকের বদলে শালীন পোশাক তকতক করছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে প্রশান্তি নামল আমার। আমি হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললাম,
—- সালামের সাথে হাত কপালে ঠেকাতে হবে কেন? এটা কোন হাদীসে আছে?
মেহেনাজ একটু তটস্থ হয়ে বলল,
—- যেটা প্রথা আরকি…
—- হুমম তোমাদের ঢাকাইয়া প্রথা এটা। আমাদের চট্টগ্রামে এভাবে কেউ সালাম দেয় না।
আমরা সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠছিলাম। মেহেনাজ আমার এ কথার জবাবে মৃদু হাসল। আমি জরুরি ভঙ্গিতে বললাম,
— আচ্ছা, তোমার স্বামী কেমন আছে এখন? অপারেশন সাকসেসফুল? কোন সমস্যা হয়নি তো?
—- হ্যাঁ সব ঠিকঠাক।
—- জ্ঞান কখন ফিরবে? – একটু থেমে জানতে চাইলাম আমি।
মেহেনাজ মনে করার ঢংয়ে একটা আঙুল কিঞ্চিৎ মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
—- উমমমঃ এইতো বারোটার দিকে জ্ঞান ফিরবে বলেছে। এখন বাজে এগারোটা।
—- আচ্ছা, এক ঘন্টা আছে আরো? জেনেও প্রশ্ন করাটা বাঙালির বহুলপ্রচলিত স্বভাব বলা চলে। আমিও তাই করলাম। সে মাথা নেড়ে বলল,”হু”।
কথা বলতে বলতে আমরা তিনতলায় এসে পড়লাম। গতদিনে কেবিনের যে গতিক দেখেছিলাম আজ তা সম্পূর্ণ তিরোহিত। সমস্ত ঠিকঠাক চলছে। প্রত্যেকটা যন্ত্র তাদের নিজ নিজ অবস্থান হতে নিজস্ব ভঙ্গিমায় উপস্থিতির সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। টাকা পড়েছে যে! আগাগোড়া একবার চোখ বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম দুজনে।বিনা কাজে বসে থাকার চেয়ে বাইরের ওয়েটিং রুমে বসে টিভি দেখা উত্তম। সময় কাটবে। রোগীর জ্ঞান ফিরতে আরো ঘন্টা-দেড়েক লাগবে। মেহেনাজকে বেশ প্রসন্ন দেখাচ্ছে। বারবার গিয়ে কেবিনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অপেক্ষায় আছে কখন স্বামীর জ্ঞান ফিরবে। অপেক্ষার সময় বড্ড ধীরে চলে। সময় যেন মানুষের মনের ভাষাটা এই সুযোগে উপলব্ধি করে নিতে চায়। বুঝে নিতে চায়,মানুষ কিভাবে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসায় খেদ কতটুকু,কতটুকু বিশ্বাস, তারা কত সময় ধরে অপেক্ষা করতে পারে প্রিয় মানুষটির জন্য।

সাড়ে বারোটার দিকে জ্ঞান ফিরল লোকটার। চোখ খুলেই স্ত্রীর পর আমাকে দেখে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালেন। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ রোগীকে বেশি বিরক্ত করা যাবেনা। মেহেনাজ সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল আমার পরিচয়। পরিচয় পেয়ে তিনি সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। অথচ দু’জনের কেউই বুঝল না এই কৃতজ্ঞতার চাউনি আমি চাই নি। আমি শুধু একাকিত্বটা কাটিয়ে দু’টো কথা বলা যায় এমন মানুষ খুঁজছিলাম। সবাই যদি মানুষের মন পড়তে পারতো তাহলে পৃথিবীতে কোনকিছুই জটিল থাকতোনা। আবার অনেককিছুই খটোমটো হয়ে যেত। নার্স এসে আমাদের একপ্রকার অনুরোধ করে বের করে দিলেন। আমি আর ঘুরঘুর না করে মেহেনাজকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

এরপর দিন যায় রাত আসে। রাত পেরিয়ে দিনের আলোয় শোভিত হয় পৃথিবী। আমিও একলা একা অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি,কখন কুমিল্লা যাওয়ার ডাক পড়বে। অবশেষে সপ্তাহ ঘুরে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসে হাজির হলো। সেদিন খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। ধীরে-সুস্থে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস-পত্র একে একে গুছিয়ে গাঁটরি বেঁধে নিলাম। এরপর ন’টার দিকে নাশতা সেরে খালা থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এসময় গলির মুখে সিএনজি ড্রাইভাররা মুখিয়ে থাকে প্রেসেঞ্জারের জন্য। সেখান থেকেই একটা সিএনজি ভাড়া করে মেট্রোপলিটন চলে এলাম। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম রাস্তার একপাশ দখল করে আছে একটা সুবিশাল পুলিশ বাস। সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম আমারই মতো আরো কয়েকজন ভবিষ্যৎ পুলিশ সিভিল ড্রেসে জানালার পাশে সিট নিজ আয়ত্তে নিয়ে বসে আছে। বোঁচকাটা উপরে রেখে আমিও একটা সিটে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আরো কয়েকজন এলে গাড়ি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। কয়েকজন পেটওয়ালা সিনিয়র অফিসার আমাদের তত্বাবধানে রাখল। আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক কানে হেডফোন গুঁজে দিব্যি হেলেদুলে গান শুনছিল। কখনো বা দুলাদুলির ঠেলায় আমার গায়ের উপর এসে পড়ছে। তা দেখে সামনের সিটের একজন পেটমোটা অফিসার কটাক্ষ করে বলল,
—- এইযে সোহাগ চাঁদ। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখো৷ নাহয় পরে ট্রেনিংয়ের ঠেলায় তোমার চান্দি উড়ে যাবে। হুহ!
ভদ্রলোক গানের তোড়ে কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্নসূচক ঢংয়ে তাকাল স্যারের দিকে। অফিসার মুখ ঘুরিয়ে নিজের জায়গায় একটু নড়েচড়ে বসলেন।বিষয়টা কিঞ্চিন্মাত্র হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে সুরের তালে মাতাল হওয়া ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—- কী বললেন অফিসারে?
আমি বললাম,
—- বলল এমন বেসামাল হলে ট্রেনিংয়ে আপনার চান্দি উড়ে যাবে।
—- কী বলেন? কেন? বলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে নিজের মাথায় একবার হাত বুলালেন।
আমি উত্তর না দিয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসলাম। উত্তর না পেয়ে ভদ্রলোক ভদ্রোচিতের মতো আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,
— হাই,আমি অনিক দত্ত।
— আমি মিনহাজ আহমেদ। বলে করমর্দন করলাম দুজনে।
— আপনার বাড়ি কোথায়? প্রশ্ন করল অনিক।
—- বাড়ি চট্টগ্রামেই, কিন্তু থাকি ঢাকায়।
—- কেন, চট্টগ্রাম ভালো লাগেনা বুঝি? হা-হা- হা…..
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে কানে কানে বলার মতো করে বললাম,
—- আস্তে হাসুন। নাহয় সিনিয়ররা থাপ্পড় দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবে। পুলিশের বুটের লাথি তো খান নি। খেলে বুঝবেন।
—- না মসাই,আমার লাথিটাতি খাবার ইচ্ছে নাই হয়েছে কি, আমি একবার চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। সেখানকার মানুষজন এক্কেরে খবিশ। একগুঁয়ে। কী বলে না বলে কিচ্ছু বুঝিনা। অবশ্য সবাই না। আপনার মতোও ভালো মানুষ কিছু আছে… তো হোলো কি সেখানে, গিয়েছিলাম আমার খালার বাড়ি। আমার এক খালাত বোন…..
আমি মুখে একটা বিরক্তি প্রকাশের ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে একটু কাত হয়ে ফোনটা বের করলাম। আপাততঃ এই বেহুদা আলাপ শোনার ইচ্ছে আমার নেই। বাবা অথবা মাকে ফোন করে একবার জানানো দরকার। যদিও জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি৷ তবুও এই বাঁচাল লোকটার হাত থেকে রেহাই পেতে একবার ফোন করতেই হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মা’র নাম্বারটা পেলাম। দুইবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হল।
—- আসসালামু আলাইকুম
—- ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছ?
—- এইতো আছি। যে কারণে ফোন দিয়েছিলাম কুমিল্লা যাচ্ছি এক বছরের ট্রেনিংয়ে। ঢাকায় এলে পাবেন না। খালার কাছে চাবি আছে। লাগলে নিয়ে নিবেন।
—- ওহহ আচ্ছা, কিসের ট্রেনিং?
—- পুলিশের চাকরি পেয়েছি। এস আই। নিয়োগের আগে এক বছর ট্রেনিংয়ে দিচ্ছে।
—- আর চাকরি পেলেনা? এই…
আমি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম,
—- আমি আপনার কমপ্লিমেন্ট চাই নি! শুধু জানাতে চেয়েছি যে, ঘরের চাবি আমার কাছে নেই। রাখছি।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস স্পীকার ফুঁড়ে আমার কানে প্রবেশ করলো। তিনি নীরস গলায় বললেন,
—- ঠিকাছে, ছাড়ছি।
ফোন রাখার পর দেখলাম অনিক নামের লোকটা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কি ধড়িবাজের পাল্লায় পড়লাম! জার্নিটাই বেহদ্দ অসহনীয় হবে মনে হচ্ছে।ছোট করে প্রশ্ন করলাম,
— কী?
— ফোনে কে ছিল জানতে পারি?
— মা।
— ওও… ঠোঁট গোল করে বলল অনিক।
আমি একটু ক্রূর হেসে জানালার বাইরে যতদূর পারা যায় শূনদৃষ্টি মেলে ধরলাম। ততক্ষণে আমাদের দুরন্ত বাস ঢাকার ছোটবড় গলিঘুঁজি পেরিয়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে উঠেছে। বিস্মৃত স্মৃতিগুলো নিজের শীর্ণ হৃদয়তটিনীর ঘোলাটে জলে শক্ত-পোক্ত গাঁট বাঁধানো কলাগাছের ভেলার মতো ভেসে উঠল আবার। ঠিক আট বছর আগে এই সড়কেই ঢাকা এসেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। আমাকে ঢাকার বাড়িতে নিয়ে এসেছিল দাদী। আমার সেই ঘটনার নালিশের কারণেই দাদী তার স্বামীর ভিটা ছেড়েছে। অথচ আজ সেই আমাকে একা রেখে স্বার্থপরের মতো আলবিদা জানালো।
দূরপাল্লার ধানক্ষেতের আধপাকা ধানের শিষগুলো বাতাসের তুড়িতে এপাশ-ওপাশ দোদুল্যমান। তারও দূরে খালের পাড়ের জারুল গাছে কয়েকটা নানা জাতের পাখি এ-ডাল ও ডাল করে বেড়াচ্ছে। ছোট-বড় নানাবিধ গাছগুলো তপ্ত রোদের রোশনি মাথায় নিয়ে যেন গাড়ির উল্টোদিকে প্রাণপণে দৌড় প্রতিযোগিতা খেলছে। প্রকৃতি প্রেমিদের জন্য এই দৃশ্য যথেষ্ট দৃষ্টিশোভন। অজ্ঞেয় কারণে হঠাৎই আমার বেরসিক মনটা আজ প্রকৃতির নির্মল, নিষ্কলুষ সৌন্দর্যে ডুবে যেতে ইচ্ছে হলো। মানুষের মন কখন কি চায় বলা ভার। হুটহাট চমকে দিয়ে আস্বাদিত, অনাস্বাদিত সকল বস্তুর স্বাদ নেবার জন্য কোমর বেঁধে নামে। তখন আর উপায় থাকেনা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে কোনো কারণে রাস্তায় বিস্তর যানজটের সৃষ্টি হলো। যদিও সচরাচর এদিকে যানজটের দেখা মেলেনা। দীর্ঘ এক ঘন্টা পর যানজট ছাড়ালে বাতাসে বাতাসে খবর এলো ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় একই পরিবারের ২ জন স্পট ডেথ। এজন্যই এতক্ষণের এই যানজট। বাসজুড়ে উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুক্ষণ গুঞ্জন চলে থেমে গেল। পেটমোটা সিনিয়র অফিসার নিজের নিচের ঠোঁটটাকে আধা ইঞ্চি প্রসস্থ করে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
—- উফফ ঢাকা-চিটাগাং সড়কটা হয়েছে একটা মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিন একটা না একটা ঘটেই!
ড্রাইভার পুলিশটা সহমত জানালো “ঠিক” বলে।

এরপর অপরিচিত মানুষদের মধ্যে আবার নীরবতা। গাড়ি ছুটে চলল শাঁই শাঁই করে। আমার চোখে দৃশ্যমান হয় নানা বর্ণের মানুষ। কেউ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়,কেউ টং দোকানে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে চায়ের কাপে ঠোঁট ভেজায়, কেউ বন্ধু-বান্ধব সহ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়ায়,হাসি ঠাট্টায় সময় পার করে। সব দৃশ্যই আমার চোখে অস্থায়ী। এই আছে এই নেই!

কুমিল্লা পুলিশ প্রশিক্ষণ সেন্টারে যখন আমাদের বাস পৌঁছাল তখন বিকাল পাঁচটা। দুপুরের খাওয়াটা হয়নি কারো। খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করছে। ডালা খুলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালাম সবাই। অনিক দত্ত ছেলেটা আমার পিছে আঠার মতো লেগে আছে। না পারছি দুটো কড়া কথা শোনাতে, আর না পারছি সহ্য করতে। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই ভিতরে ঢুকলাম আমরা। জানামতে পনেরো একর জমিতে এই ট্রেনিং সেন্টার নির্মিত। গেটের ডানদিকে একটা দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন। এর অপজিটের অল্প দূরত্বে সিনিয়র অফিসারদের ব্যারাক। উত্তর পাশে একটি পাকা একতলা মসজিদ। পশ্চিম দিকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যথাক্রমে দুইটি করে টিনসেড ব্যারাক। দূর থেকেই লক্ষ্য করা যায় একটা মহিলাদের, অন্যতিনটি পুরুষ ট্রেইনারদের। ফায়ারিং রেঞ্জটা হয়তো আশেপাশে কোথাও হবে। মাঝখানে বিশাল মাঠ। প্রথমত আমরা প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কাজকর্ম সেরে নিলাম। এরপর যখন বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখন কিছু অল্পবয়স্কা মেয়ে পুলিশ এসে আমাদের গাঁটরি-বোঁচকাগুলো যেচে নিজেদের হাতে নিয়ে নিলো। বুঝলাম এরাও মহিলা ট্রেইনার। সবাই যখন দিতে ইতস্ততঃ বোধ করছিল তখন বয়োজ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক হেসে বললেন,
—- আরে দাও সমস্যা নেই। দিয়ে ওদের সঙ্গে খেতে যাও। খাবারের ব্যবস্থা আছে। ওরা তোমাদের জুনিয়র হতে চলেছে। দিতে লজ্জা কোথায়? ওরাও কয়েকদিন হলো এসেছে। ছ মাস থাকবে। সিনিয়র জুনিয়র মেইনটেইন করে চলবে। মিলেমিশে চলবে। আর ছেলেদের মধ্যে লাজুকলতা কেউ থাকলে লাজুকতা মুড়িয়ে ফেল। এই চাকরিতে লাজুকতা চলেনা। জানোই তো,
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

এতো পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে বিবশ শরীরে কবির কবিতায় সবার মাঝে একটা অস্বস্তির উদ্রেক করল। কেউ আর শুনতে চাইলোনা। মেয়েরা নিজ নিজ অবস্থান হতে শশব্যস্ত হয়ে ব্যাগগুলো তুলে নিলো। একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে ব্যাগটা নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,
— দিন ভাইয়া।
অনিক দত্ত ছেলেটা আমার পাশে ছিল। সে জ্বলে উঠে চাপা কণ্ঠে বলল,
—- ভাইয়া কী রে? স্যার বলবে!
মেয়েটা একটু মুখ কালো করে ফেলল। পরক্ষণেই আবার গালভর্তি হেসে আমার ব্যাগটা তুলে নিল। সেই হাসিটাই অনিকের কাছে যেন ভেংচির মতো ঠেকল। সে জলন্ত উনুনের মতো চোখ করে তাকাল। মেয়েটা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাকে বলল, “আসুন”
আমি গেলাম মেয়েটার পিছুপিছু। ব্যাগগুলো একপাশে রাশীকৃত করে রেখে পুকুরের সবুজাভ পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিল সবাই। ব্যারাক থেকে অদূরে একটা আধাপাকা খাবার ঘর। মেয়েটার পিছুপিছু সেখানে গেলাম আমি। একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। ইতিমধ্যেই টেবিলে খাবার রাখা হয়েছে। আলু দিয়ে মুরগীর মাংস। মেয়েটাও আমার সামনে এসে বসলো। আমি বললাম,
—- তুমি বসলে যে? কাজ নেই?
—- নাহ, বিকাল চারটায় ট্রেনিং শেষ হয়। এখন স্যার আমাদের কাজ দিয়েছে আপনাদের পুরো সেন্টারটা ঘুরে দেখানোর। সিনিয়র বলে কথা। আমাদের তো কেউ চিনিয়ে দেয়নি। নিজেরাই চিনেছি। একটা চাপা আক্ষেপ ঝরে পড়লো মেয়েটার কণ্ঠে।
আমি খেতে শুরু করেছিলাম। খেতে খেতেই বললাম,
—- ওও আচ্ছা। আপনি টায়ার্ড হলে রেস্ট নিতে পারেন। সমস্যা নেই। আমি নিজেই ঘুরে নিতে পারব।
—- নাহ, সবাই থাকবে,আমাকেও থাকতে হবে। নাহয় খারাপ দেখায়। —মুখখানা পানসে করে বললো মেয়েটা।
আমি খাবার থেকে চোখ তুলে তাকালাম মেয়েটার পানসে মুখটা। বয়স কত হবে! তেইশের কাছাকাছি হতে পারে। লম্বা ছিপছিপে মিষ্টি ডৌল। পানপাতার মতো লম্বাটে মুখে একটা পেলবতার ছায়া আছে।আদুরে বিড়ালের ন্যায় ঈষৎ বাদামী রঙের চোখদুটো তীক্ষ্ণ ধারালো,তবে মায়াবী। টিকোলো নাক। প্রসাধনহীন শুষ্ক ঠোঁটজোড়া কমনীয়। পুরো চেহারা ঘুরতে ঘুরতে আমার চোখদুটো আটকে গেল ডানপাশের বুকের উপরে নেইম প্লেটের উপর। কপাল কুঁচকে সরু চোখে পড়লাম নামটা। জুহি চৌধুরী। মেয়েটা চোখদুটো এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গলা খাঁকারি দিল। আমি চমকে ওঠে নাম প্লেট থেকে চোখ তুলে তাকালাম। বললাম,
— স্যরি, ডোন্ট মাইন্ড! নামটা দেখছিলাম।
জুহি রক্তশূন্য মুখে শব্দহীন “ওও” বলে ঠোঁট গোল করে অনুচ্চ হাসলো। পরবর্তীতে আর কোন কথা না বলে সলজ্জে মাথা নিচু করে বসে রইল। খাবার ভোজনের পরবর্তী সময়টা আমিও অস্বস্তিতে গুম মেরে বসে রইলাম। ইশশ্ আসতে না আসতেই অচেনা মেয়েটা কি ভেদজ্ঞানটা পোষণ করে নিলো আমার সম্পর্কে। কী দরকার ছিল ওমন সেনসিটিভ জায়গায় তাকানোর!

চলবে…