শৈবলিনী পর্ব-১২+১৩

0
598

#শৈবলিনী—১২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ভাদ্রের প্রখর গরমে জনজীবন বিধ্বস্ত। গগন চিঁড়ে বের হয়েছে কাঠফাটা রোদ্দুর। লোকাল বাসের যাত্রা শেষ করে ভার্সিটিতে এসেছে নূর।ক্যাম্পাসের মাঠ জুড়ে রোদের তান্ডব। স্বস্তির আশায় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘামে ভেজা কপালটা একটু মুছে নিলো। সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়ে ক্লাসের দিকে এগুলো সে। শিখা আর গিয়াস দুজনেই নাকি আজ আসবেনা। শিখার জ্বর আর গিয়াসের কোনো ফ্যামিলি ফাংশন আছে তাই আসেনি। দুজনকে ছাড়া কেমন খালি খালি লাগছে নূরের। ও নিজেও আসতোনা। তবে ওই নায়কের কাজের জন্য আসতে হলো। কথা যেহেতু দিয়ে ফেলেছে তাই আসতে তো হবেই। আর এখনতো তারওপর আবার ঋণ শোধ করার দায়িত্বও আছে।তাই না এসে উপায় নেই।

ক্লাস শেষে নূরের কিছু নোটের প্রয়োজনে সে লাইব্রেরীর দিকে গেল। লাইব্রেরি ক্যাম্পাসের অন্য ভবনে। এই ভবনে ক্লাস হয়না। শুধু জরুরি এক্সাম,প্রফেসরদের মিটিং আর ভার্সিটির পারিপার্শ্বিক কাজ করা হয়।এইজন্য এদিকে জনসমাগম একটু কম থাকে। লাইব্রেরী আছে তিনতলায়। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডর দিয়ে হেঁটে লাইব্রেরির দিকে যেতে নিলেই হঠাৎ কারোর চিল্লানোর মতো আওয়াজ এলো। আওয়াজ টা পাশের ফাঁকা রুম আসছে এটা বুঝতে পারলো নূর। ঘটনা কী জানার জন্য ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে গেল নূর। রুমের দরজা আস্তে করে হালকা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, কয়েকটা ছেলে মিলে একটা মেয়েকে হ্যারাস করার চেষ্টা করছে। ছেলেগুলো ভার্সিটিরই, ছাত্র রাজনৈতিক দলের উশৃংখল ছেলেগুলো । যাদের কাজই মাস্তানী করা। মেয়েটাকেও চিনতে পারলো নূর। মেয়েটা আর কেউ নয়,সবসময় নূরকে খোঁচা মেরে কথা বলা সেই ধনীর দুলালী, অবনী। নিজের চোখের সামনে কোনো মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হতে দেখে চুপ থাকার মতো মেয়ে নূর না। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো নূর। নূরকে দেখে অবনী কেঁদে উঠে বলল,
–নূর,প্লিজ বাঁচাও আমাকে। প্লিজ হেল্প মি।

নিজেদের কুকর্মে ব্যাস্ত থাকা ছেলেগুলো নূরকে দেখে ভড়কে গেল। হুমকি দিয়ে বলল,
–এই মেয়ে দেখছিস না প্রাইভেট কাজ চলছে। যা ভাগ এখান থেকে। নাকি তোরও ওর সাথে যোগদান করার শখ হয়েছে! মাল খারাপ না। আয় তোরেও এন্টারটেইন করি।

নূরের চোখ মুখ লাল বর্ণ হয়ে উঠলো। অগ্নিশর্মা হয়ে সে বলল,
–ছেড়ে দে ওকে।

–আচ্ছা? না দিলে কী করবি শুনি? যা দিলাম না ছেড়ে। পারলে ছাড়িয়ে নে।

–অ্যাজ ইউর উইশ। পরে বলিসনা আমি ওয়ার্ন করিনি।

–উউউউউ…আমরা তো ভয় পেয়ে গেলাম। এখন কে বাঁচাবে আমাদের।
তিরস্কার করে বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগলো সবাই। দলের ভেতর থেকে একজন এগিয়ে এলো নূরের দিকে। সয়তানি হেঁসে নূরের শ,রী,রে হাত লাগাতে নিলেই নূর,খপ করে লোকটার হাত ধরে ফেলে, পেছন দিকে ঘুরিয়ে হাতটা পটাস করে পিঠের দিকে মুচড়ে দিয়ে হাঁটুর ভাজে লাথি মেরে দিলো। লোকটা পা ভেঙে নিচে পড়ে গেল। এবার আরেকজন তেড়ে এলো। নূর নিজের সাইড ব্যাগের ভেতর থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে আক্রমনকারীর হাঁটুর ওপর ঘেচাং করে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার বের করে নিলো। লোকটা আর্তনাদ করে হাঁটু চেপে ধরে নিচে পড়ে গেল। এবার আরও দুজন একসাথে এলো। নূর একটার পেট বরাবর ঘুষি মারলো, আরেকটার মেইন পয়েন্ট বরাবর সজোরে দিলো লাথি মেরে। লোকটা তার পয়েন্ট চেপে ধরে কাতরাতে কাতরাতে নিচে পড়ে গেল। সবগুলোকে কপোকাত করে নূর অবনীকে ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে এলো। নিচে এসে একটা বেঞ্চে বসিয়ে পানির বোতলটা এগিয়ে দিলো অবনীর দিকে। অবনী পানি খেয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
–আম সরি নূর। আমি তোমাকে কতো কটুবাক্য শুনিয়েছি তবুও তুমি আমার এতবড় উপকার করলে। থ্যাংক ইউ সো মাচ নূর। তুমি না আসলে আজ আমার সাথে কী হতো ভাবতেই কলিজা কাঁপছে।

–কেন? কেন কারোর আসার অপেক্ষা করছিলে তুমি? যেটা আমি করেছি সেটা চাইলে তুমিও করতে পারতে। শুধু সেই সাহস আর মনোবল আনতে হবে। একটা কথা মনে রাখবে, এটা সিনেমা না। এখানে তোমাকে বাঁচাতে দেয়াল ভেঙে কোনো হিরো আসবেনা। এটা বাস্তব জীবন। আর বাস্তব জীবনে নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হয়। আজ নাহয় আমি সময়মত এসে গিয়েছিলাম তাই তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু যদি আমি না আসতাম তখন? তাই নিজের বল নিজে রাখো। অন্যায়কে শক্ত হাতে দমন করা শেখ। মেয়েরা চাইলে সব পারে।

–ঠিক বলেছ নূর। আমি মনে রাখবো তোমার উপদেশ।

–হুমম,তো আরম্ভ এদের দিয়েই করো। এদের আইনের আওতায় এনে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করো। নাহলে এরা কাল আবারও কোনো মেয়ের ক্ষতি করবে।

–হ্যাঁ, আমি আজই বাবাকে বলে এদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

–ঠিক আছে,এখন তাহলে যাই আমি। তুমিও বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।

–ধন্যবাদ নূর। তুমি সত্যিই অনেক ভালো। জীবনে কখনো তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে বলবে। তোমার কোনো কাজে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

–ঠিক আছে। আসি এখন।
__

আদিত্য নিজের ভ্যানে বসে স্ক্রিপ্ট পড়ছিলো। তখনই দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকলো। মাথা তুলে সামাইরাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আদিত্যের। মেয়েটা ইদানীং বেশিই বিরক্ত করছে আদিত্যকে।প্রয়োজন, অপ্রয়োজনে নানান বাহানায় চলে আসে ওর ভ্যানে।সেদিন এতো কথা শোনালাম তাও যেন গায়ে লাগেনি এর। মায়ের আহ্লাদ পেয়ে যেন এর আশকারা আরও বেড়ে গেছে। ছবির শুটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরসাথে কোনো হার্শ আচরণ করতে পারছেনা। তাই অগত্যা বরদাস্ত করতে হচ্ছে একে। আদিত্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–সামাইরা, তোমাকে কতবার বলেছি নক না করে এভাবে হুট করে ঢুকে পড়বেনা। ডোন্ট ইউ নো দিস ইস মাই প্রাইভেট স্পেচ!

সামাইরা হাসিমুখে সামনে এসে বলল,
–আরে আদিত্য, কী তোমার আমার লাগিয়ে রেখেছ? আমাদের মাঝে এখন আর কীসের প্রাইভেসি? কিছুদিন পরতো আমরা এক হতে চলেছি।

আদিত্য কপাল কুঁচকে বলল,
–হোয়াট রাবিশ আর ইউ টকিং??

–এমন ভাব করছ যেন কিছু বোঝোই না। আরে রেহনুমা আন্টি কী এমনি এমনি আমাকে ডিনারে ইনভাইট করেছিল! সেতো আমাদের সাথে আনার জন্যই এসব করছে। সত্যি বলতে আমিতো অনেক খুশি। আমাদের জুটিটা রিয়েল লাইফেও বাস্তব হতে চলেছে।

রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেল আদিত্যের। নিজেকে যথাযথ শান্ত রাখার প্রচেষ্টা করে সে বলল,
–দেখ সামাইরা তুমি বোধহয় বেশিই ধারণা করে ফেলেছ। তুমি যা ভাবছ তা কখনো হ…

আদিত্যর কথার মাঝে সামাইরা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, আদিত্যর দিকে আরও এগিয়ে আসতে আসতে আবেদনে হাসি দিয়ে বলল,
–তোমাকে কিছু বলতে হবে না আদিত্য। আমি সব জানি। আমি জানি আমি যেমন তোমাকে পছন্দ করি তেমনি তুমিও আমাকে পছন্দ করো। শুধু মুখে বলোনা। রাগ দেখাও। আমাকে পরিক্ষা করো। তবে আমিও সকল পরিক্ষা দিতে রাজি। দেখি কতো নাজেহাল করতে পারো আমাকে।
কথা বলতে বলতে সামাইরা একসময় আদিত্যর খুব কাছে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। এবারে আদিত্যের রাগ শেখরে পৌঁছে গেল। সে সামাইরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই হঠাৎ দরজার সামনে থেকে কেউ বলে উঠলো।
–ওহ সরি,আমি বোধহয় ভুল সময়ে চলে এসেছি।

সামনে তাকিয়ে নূরকে দেখে আদিত্যর শিরদাঁড়া অবশ হয়ে এলো। নূর নিশ্চয় ওকে আবারও ভুল বুঝলো। আদিত্য ঝটকা মেরে সামাইরাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। আদিত্য কিছু বলবে তার আগেই সামাইরা নূরের উদ্দেশ্যে কর্কশ গলায় বলে উঠলো।
–এই মেয়ে,কে তুমি? আর তোমার সাহস কী করে হলো এভাবে ঢুকে পড়ার? সেলিব্রিটি দেখলেই হুঁশ থাকেনা তোমাদের তাইনা?

এমন কটুকথা শুনে নূরের মাথা গরম হয়ে গেল। সে প্রতিত্তোরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই গর্জে উঠলো আদিত্য।এমনিতেই সামাইরার ওপর চরম পরিমানে রেগে ছিলো আদিত্য।তারওপর আবার সামাইরার নূরের সাথে এমন আচরণে আদিত্যর রাগ এবার আসমান ছুলো। সে ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
–শাট আপ সামাইরা! জাস্ট শাট আপ। তোমার সাহস কী করে হলো নূরের সাথে এভাবে কথা বলার! নূর এমনি আসেনি এখানে। ওকে আমি আসতে বলেছি। আমার জন্য এসেছে ও। আমার কাজে হেল্প করার জন্য।

আদিত্যর হঠাৎ এতো ক্রোধ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সামাইরা। সামান্য কোথাকার মেয়ের জন্য আদিত্য এতো কেন ওভার রিয়্যাক্ট করছে? কে এই নূর? তবে আপাতত আদিত্যর রাগ কমানোর জন্য বলে উঠলো।
–সরি আদিত্য, আমি জানতাম না। আসলে আগে কখনো দেখিনি তো।

–সরি আমাকে নয়,নূরকে বলো। সে সরি টু হার।
সামাইরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদিত্যর কথা রাখতে নূরের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,
–সরি।

সামাইরার সাথে নূরও একটু অবাকই হলো আদিত্যের হঠাৎ এতো রাগ দেখে। তাই আপাতত সে আর কিছু বললো না। আদিত্য নিজের ক্রোধকে একটু প্রশমিত করে নিয়ে সামাইরার উদ্দেশ্যে বলল,
–সামাইরা তুমি যাও এখন। আমি কাজ করবো।

সামাইরা এখন আর আদিত্যের কথা অমান্য করার সাহস পেল না। তাই মাথা নেড়ে চুপচাপ বেড়িয়ে গেল যাওয়ার আগে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলো নূরকে। কে এই মেয়ে? যারজন্য আদিত্য এতো রেগে গেল? সত্যিই শুধু কাজের জন্য এসেছে, নাকি অন্য কিছু? শুধু সামান্য এসিস্ট্যান্ট এর জন্য কী আদিত্য এতটা পজেসিভ হবে? কই আজপর্যন্ত তো কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা রাগতে দেখিনি। তাও আবার এমন বস্তির মেয়ের জন্য। দেখতেই কেমন জংলী জংলী দেখা যায়। এর নড় নক্ষত্র খুঁজে বের করতে হবেই।

সামাইরা চলে গেলে আদিত্য চোখ বুঁজে নিজেকে একটু শান্ত করে নিলো। নূরকে ভেতরে এসে বসতে বললো। নূর এসে ডিভানে বসলো। আদিত্যর ভেতর ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। নূর নাজানি ওর আর সামাইরার ব্যাপারে কী ভাবছে! এমনিতেও মেয়েটা আমাকে সবসময় ভুলই বোঝে।এমনিতেও তার মনে নায়কদের নিয়ে খুব নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে সে। আর আজকের এই ঘটনা নিশ্চয় তার ধারণা আরও গাঢ় দিবে। নূর অতি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–তো আজ কী করবো?

আদিত্য নূরের দিকে আরচোখে তাকিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
–নূর,তুমি যেমনটা ভাবছ আসলে তেমনটা না। আসলে তখন….

আদিত্যর কথা শেষ হওয়ার আগেই নূর স্বাভাবিক সুরে বলল,
–আমি কিছুই ভাবছিনা। আপনি আপনার পার্সোনাল জীবনে কী করলেন বা করলেন দ্যাট ইজ নন অফ মাই কনসার্ন। আমি এখানে শুধু কাজ করতে এসেছি দ্যাটস ইট। তার বাইরে কোনোকিছু জানার বা বোঝার, ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনোটাই নেই আমার। আর তাছাড়া নায়কের কাজই লুচ্চামি করা, এতে এতো ভাবার কী আছে!

শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললো নূর।তবে আদিত্যর কানে সেটা ঠিকই এলো। কথাটা কেমন আত্মসম্মানে লাগলো আদিত্যর। সে এবার নূরের পানে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
–মিস নূর,তুমি একটু বেশি বলে ফেলছনা! নায়কদের নিয়ে এইযে এমন মহান ধারণা পোষণ করে রেখেছ, তা এর কোনো স্পেসিফিক কারণ আছে? না মানে,এর আগে তুমি কয়জন নায়ককে জানতে বা তাদের কাছ থেকে দেখেছ তুমি?

–কাউকেই না।

–তাহলে তুমি কীভাবে বলতে পারো যে নায়করা কেমন হয়?

–এটা আবার জানার কী আছে। নায়করা কী করে তা বোঝার জন্য তাদের কাছ থেকে জানার দরকার নেই। এমনিতেই বোঝা যায়। সুন্দরী মেয়েদের সাথে ঢলাঢলি করার জন্যই এই লাইনে আসে ছেলেরা।

–তুমি কিন্তু আমার প্রফেশনের ইনসাল্ট করছ নূর। তোমার কাছ থেকে এটা অন্তত এটা আশা করিনি।যেখানে তুমি মেয়ে হয়েও মেকানিকের কাজ করে নিজের আলাদা একটা ব্যাক্তিত্ব তৈরি করেছে, সেই তুমি এমন কথা বলছ! প্রফেশন যেটাই হোক, সেটাকে সম্মান করা উচিত। তুমি যেমন তোমার গ্যারেজে মেহনত করো তেমনি আমরাও করি। চাইলেই কেউ নায়ক হতে পারে না। এরজন্য অনেক স্ট্রাগল করতে হয়। ইচ্ছে মতো খাবার খেতে পারিনা, ইচ্ছে মতো যখন খুশি তখন কোথাও যেতে পারিনা,নিজের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকতে হয়। কখন কোন নিউজ বানিয়ে ফেলে সেটা নিয়ে সবসময় তৎপর থাকতে হয়। মন চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারিনা আমরা। মেহনত কমবেশি সব প্রফেশনেই করতে হয় নূর।নায়িকাদের সাথে ক্যামেরার সামনে যা করি সেটা আমাদের কাজের একটা পার্ট ছাড়া আর কিছুইনা। হ্যাঁ হয়তো কিছুলোক আছে যারা এগুলোর সুযোগে অনেক অযাচিত কাজ করে। তাই বলে সবাইকে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা ঠিক না। এমন কোনো প্রফেশন নেই যেখানে তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে যে,এই প্রফেশনের শতভাগই সৎ লোক। হাজিদের মাঝেও পাজি আছে,আবার গুন্ডা বাহিনীর মাঝেও সৎ লোক আছে। তাই না জেনে কোনো প্রফেশনকে একতরফা জাজ করা ঠিক না। নায়ক বলেই যে সবাই খারাপ এই ধারনাও অনুচিত।

—দেখুন আপনি কেন এতবড় পাঁচ পাতা সমান ভাষণ দিলেন তা আমি বুঝতে পারছি।তো শুনুন, আমি কোনো প্রফেশনকে ছোট করছিনা। সব প্রফেশনকেই সম্মান করি আমি। আর আপনার প্রফেশনকেও আমি খারাপ বলছিনা। তবে,আমি আমার জীবনে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে এই প্রফেশনের লোক চাইনা। এখন আপনি বলবেন কেন, তাহলে শুনুন। আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী এমন কেউ হবে যার জীবনে একমাত্র নারী বলতে শুধু আমিই থাকবো। সে প্রফেশনালই হোকনা কেন। আমি চাইনা সে বাইরে গিয়ে মেয়েদের সাথে রাস্তা ঘাটে নেচে নেচে গান গাঁক।সে কাজের ক্ষেত্রেই হোকনা কেন। হয়তো আমার কথা অনেক ন্যারো মাইন্ডেড মনে হচ্ছে। তবে আমি এরকমই। আমি অতি সাধারণ একটা মেয়ে, আর আমার চাওয়াটাও সাধারণ। আমার কোনো ফেমাস ব্যাক্তির দরকার নেই।আমি কারোর লাখো অপশনের মধ্যে একটা হতে চাইনা। বরং আমি কারোর ওনলি অপশন হতে চাই।

আদিত্য ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–আমি আগেই বলেছি মিস নূর,মানুষ যেটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে সেটাই তার ভাগ্যে যোটে। আপনার সাথেও এমন কিছুই হতে চলেছে।

–এখন এসব প্রেম গবেষণা ছেড়ে যাক? নাকি আমি চলে যাবো?

–আরে না না চলে কেন যাবে! কাজ করবো তো।
আদিত্য ল্যাপটপ অন করে একটা সীন দেখিয়ে বলল,
–এখানে বন্ধুদের সাথে আড্ডার একটা সীন আছে, দেখতো এখানে কোনো কারেকশন করতে হবে কিনা।
নূর ল্যাপটপ টা ধরে নিজের দিকে ঘুরাতে নিলে হাতে কেমন ব্যাথা পেল। নূর হাতটা সরিয়ে এনে তাকিয়ে দেখলো হাতের কব্জিতে আঘাত লেগেছে। হয়তো তখন ওই বদমাইশ গুলোর সাথে মারামারি করতে গিয়ে লেগেছিল। নূর আর সেটা মালুম না করে কাজে মনযোগ দিতে চাইলো। তবে পারলোনা সে, তার আঘাত যে এতক্ষণে আদিত্যর নজরেও পড়ে গেছে। নূর মালুম না করলেও আদিত্য উদ্বিগ্ন হয়ে গেল। অতি উদ্বেগ নিয়ে সে বলল,
–কী হয়েছে হাতে? দেখি।

নূর স্বাভাবিক সুরে বলল,
–কিছুই হয়নি। কাজে মনযোগ দেন।

আদিত্যর রাগ হচ্ছে। সে আবার বলল,
–নূর হাতটা দেখি।

–বললাম তো কিছু হয়নি।

–নূর আমি হাতটা দেখাতে বলেছি।

–প্রয়োজন নেই।

ব্যাস, হয়ে গেল। আদিত্যর ক্রোধে মাথা গরম হয়ে গেল। আদিত্য এবার নিজেই নূরের হাতটা খপ করে ধরে নিজের সামনে নিয়ে আসতে আসতে গর্জে উঠে বলল,
–আই সেড, শো মি ইউর হ্যান্ড নূর।

আদিত্যর এই হঠাৎ পরিবর্তিত রুপ দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল নূর। চোখ রাখলো আদিত্যের পানে। আদিত্যর অশান্ত নজর নূরের হাতে। হাতের ক্ষতস্থান পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত সে। ক্ষত দেখতে দেখতে আদিত্যর মুখমণ্ডল কেমন কঠিন হয়ে উঠছে। শক্ত হয়ে ফুলে উঠছে তার চামড়ার আবরণে ঢাকা রগগুলো। ক্রোধিত নজর মেললো নূরের পানে। চোয়াল শক্ত করে থমথমে গলায় সে বলল,
–কিছুই না? এটা তোমার কাছে কিছুই না?হাতের অবস্থা দেখেছ! কেমন ভয়ংকর লাল হয়ে ফুলে আছে। কীভাবে হলো এটা? আর এটা নিয়ে তুমি চুপচাপ বসে আছ!

নূর নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
–ছাড়ুন, এমন আহামরি কিছু হয়নি।গ্যারেজে কাজ করতে গিয়ে এমন চোট দিনে হাজার বার লেগে থাকে।এসব নিয়ে এতো ন্যাকামি করার সময় নেই আমার। একাই ঠিক হয়ে যাবে। এতো ওভার রিয়্যাক্ট করার কিছু নেই।

নূরের ব্যাখায় আদিত্যর ক্রোধ আরও বাড়লো বৈ কমলো না। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আদিত্য দুই হাতে নূরের দুই বাহু চেপে ধরে নিজের মুখের একেবারে কাছাকাছি এনে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–তোমার জন্য এটা কিছু না হতে পারে, কিন্তু আমার অনেক কিছু। অনেক কিছু মানে অনেক কিছু। তোমার সামান্য থেকে সামান্য ব্যাথাও আমার কাছে অনেক কিছু। তোমার চুল পরিমাণ কষ্ট হলেও আমার দুনিয়া ছন্নছাড়া হয়ে যায়, বুঝতে পেরেছ তুমি! না, তুমি কী করে বুঝবে! তুমি তো চোখ থাকতেও অন্ধদের কাতারে পরো। তা না হলে কী আর আমার যন্ত্রণাগুলো এভাবে আনদেখা করতে তুমি! এই চোখের ভাষা একবার হলেও পড়তে তুমি। এই হৃদয়ের দহন একবার হলেও আঁচ করতে তুমি। কিন্তু না,তুমিতো পণ করে নিয়েছ,এই দহনে পোড়াতে পোড়াতে একেবারে নিঃশেষ করে দিবে আমাকে। ঠিক আছে দাও, যত খুশি পোড়াও। কিচ্ছুটি বলবোনা আমি। আমাকে যত ইচ্ছে আঘাত করো, তবে তোমার কিছু হলে সহ্য করবোনা আমি। কিছুতেই না।তোমার কিছু হলে পুরো দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিবো আমি।
এন্ড আই মিন ইট। এটাকে কোনো ফিল্মি ডায়লগ ভাবার ভুল করবেনা মোটেও।

আদিত্যর এই রুপ আজ প্রথম দেখছে নূর। লোকটার চোখের ভাষায় কেমন আকুলতা দেখতে পাচ্ছে সে। কেমন প্রখর সেই দৃষ্টি। তাকালেই ঘোর লেগে যায়। লোকটা কী সত্যিই আমার জন্য এতটা ব্যাকুল হচ্ছে! তার এতো ক্রোধের হেতু কী শুধুই আমার আঘাত। নাহ! মোহে ডুবলে হবেনা আমাকে। নূর আবারও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই আদিত্য হুমকি দিয়ে বলল,
–চুপ,একদম চুপ। নট আ সিঙ্গেল ওয়ার্ড। তোমার এসব গুন্ডীপনা অন্যদের সামনে চলবে আমার সামনে না। সো ডোন্ট ওয়েস্ট ইউর এনার্জি। এখন চুপচাপ এখানে বসে থাকো। একপাও নড়বে না।

প্রতিত্তোরে সত্যিই যেন নূর কিছু বলতে পারলোনা। লোকটার ভাবসাব আজকে তাকে কেমন ভাবাচ্ছে। আদিত্য উঠে গিয়ে ক্যাবিনেটের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আবার নূরের সামনে বসলো।প্রথমে তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে নূরের হাতের ক্ষত পরিস্কার করতে লাগলো।খুব মনযোগ সহকারে একবার স্যাভলন লাগাচ্ছে তো তিনবার করে ফু দিচ্ছে। চিন্তাগ্রস্ত মুখমণ্ডল ঘেমে একাকার। মনে হচ্ছে সে কারোর ওপেন হার্ট সার্জারী করছে। একটুও এদিক ওদিক হলে রুগীর জান চলে যাবে। আবার নূরকেও আস্বস্ত করে বলছে,
–একটু জ্বলবে, কষ্ট করে একটু সহ্য করো হ্যাঁ।

আদিত্যর এমন ভীতিগ্রস্ত চেহারা দেখে নূরের ভীষণ হাসি পেল। আবার আমাকে বলছে যেন ভয় না পাই। অথচ লোকটাকে কে বোঝাাবে এগুলো তো নূরের কাছে ভাতমাছ। আদিত্য স্যাভলন লাগানো শেষে পেইন কিলার স্প্রে করে দিলো। নূর তাকিয়ে দেখছে আদিত্যকে। লোকটার এতো ব্যাকুলতা কী সত্যিই আমার জন্য? সত্যিই কী তার কপালের ওই চিন্তার ভাজ, ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল, অশান্ত চোখের ওই অস্থিরতা সবই কী আমার জন্য? নাকি কোনো ছলনা?

চলবে…..

#শৈবলিনী—১৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ওই দেখ আসছে নূর।চ্যালেঞ্জ মনে আছে তো তোর শিখা? চ্যালেঞ্জ-এ হারলে আমারে ট্রিট দিবি। আর জিতলে তোর কাছ থেকে আমি ট্রিট নিবো।
–হ্যাঁ ঠিক আছে, এই এক মিনিট! দুই দিকেই তাহলে আমি ট্রিট দিচ্ছি।
–হ দেখছস তোর মনডা আসলেই উদার। চ্যালেঞ্জ-এ হাইরাও ট্রিট দিতে চাছ। তোর মতো বন্ধুরে তো দেয়ালে টাঙ্গাইয়া রাখা উচিত। সকাল সন্ধ্যা ফুলচন্দন দিয়া পূজা করা উচিত। আর আজকাল কার মাইয়াগো দেখ, একটুও দয়া-ধর্ম নাই। প্রেম হইতে না হইতেই ফহিন্নির মতো এইডা সেইডা দাও, কইলজা ফোপড়া বাইর কইরা “বিয়ার গ্রীলস” এর মতো কাচা চাবাইয়া খাইতে আসে। ঢং কইরা কয়, বেবি আজ না আমরা গ্রীল চিকেন খাবো, ইউ নো আই লা….ভ গ্রীল চিকেন। আরে ফহিইন্নির ঘরের ফহিন্নি,বাপের জন্মে কোনোদিন মুরগীর পাখাও চোখ দেখস নাই আবার গ্রীল চিকেন। আগের প্রেমিকেরা তো দুই টাকার বাদাম আর পাঁচ টাকার একখান ফুল দিয়ে গাছের পেছনে গিয়ে চুম্মা লইয়া লইতো। আর এহন দেখ মাইয়াগো হাত ধরতে গেলেও শপিং মলে যাইয়া সর্বশান্ত হইতে হয়। বুঝছস,আজকের বাজারে আমগো মতো বেচারাগো একখান গার্লফ্রেন্ড পালা অনেক ব্যয়বহুল হইয়া গেছে।

অতিশয় আপসোসের সহিত কথাগুলো বলল গিয়াস। তার এই দুঃখের বানী শুনে শিখা ধমকে উঠে বলল,
–হইছে অফ যা এহন, নাইলে আমার হাসি বের হয়ে যাইবো

শিখা আর গিয়াসের কথার মাঝে নূর সেখানে এসে উপস্থিত হলো। যথারিতি এসেই আগে পানি খেয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে স্থির করলো। গিয়াস নোটখাতা বের করে বাতাস শুরু করলো নূরকে আর শিখা রুমাল বের করে নূরের কপাল মুছতে আরম্ভ করলো। এদের কান্ড দেখে নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কাহিনী কী মামা! দেখ আমার ঘী একদমই পছন্দ না তাই ঘী মারা বন্ধ কর আর ঘটনা কী বল। কী চাই তোদের?

গিয়াস বেকুব মার্কা হাসি দিয়ে বলল,
–কিযে কসনা! আমগো কী তোর সুবিধাবাদী লোক মনে হয়? আরে আমরাতো জনম জনমের বন্ধু। তিন দেহ এক জান, তিন কলিজা এক পরান, তিন মাথা এক জ্ঞান, তিন টিউমার এক অপারেশন। আমারতো প্রিয় গানও ওইটা, ♬ আমরা তিন বন্ধু, দুই আর একে তিন। আর তুই এমনে কইতে পারলি? দিলে চোট পাইলাম।

–তোর দিলের মোরব্বা বানাইয়া তোরেই খাওয়াই দিমু। সত্যি করে ক কী চলছে?

এবারে শিখা বলল,
–আরে কিছুই চলছেনা। তুইও না শুধু শুধু হাইপার হয়ে যাস।

–দেখ শেষবার জিজ্ঞেস করছি। পরে কিন্তু বললেও আর শুনবোনা।

শিখা মেকি হেসে বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে তুই যখন এতো ইনসিস্ট করছিস করছিস তাহলে বলছি।

–হুম এখন এলিতো লাইনে। বল কী বলবি।

–তার আগে প্রমিজ কর আমি যা বলবো তুই শুনবি আর আমার কথা রাখবি।

–কোনো প্রমিজ টমিজ করতে পারবোনা। তোদের কোনো ভরসা নেই। নিশ্চয় কোনো স,য় তা,নি বুদ্ধি চলছে তোদের মাথায়। আগে বল।

–তুই এভাবে বলতে পারলি? আমি না তোর কলিজার বান্ধবী। প্লিজ না ইয়ার, আমার জন্য প্রমিজ করনা প্লিজ। এতটুকু ভরসা নেই তোর আমার ওপর!

–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে যা প্রমিজ করলাম। বল এখন।

–আসলে তুই নিশ্চয় শুনেছিস কাল আমাদের ভার্সিটির বিশবছর পূর্ণ হবে। আর সেই উপলক্ষে ভার্সিটিতে বর্ষপূর্তি উদযাপন আর কালচারাল প্রোগ্রাম করা হচ্ছে কাল।

নূর শিখার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–হ্যাঁ শুনেছি,তো?

শিখা মনে সাহস জুগিয়ে চোখ বুজে দ্রুত বেগে বলে উঠলো,
— তো তুই কাল প্রোগ্রামে আসবি।

–হোয়াট! পাগল হয়ে গেছিস তুই? তুই ভালো করেই জানিস এসব আজাইরা অনুষ্ঠানে আসার জন্য অযথা সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই আমার। এসব নাচগান,হুরোহুরি বিরক্ত লাগে আমার।

–দেখ তুই কিন্তু প্রমিজ করেছিলি আমার কথা রাখবি। আরে একটা দিনেরই তো ব্যাপার। আয়না প্লিজ এমন করছিস কেন! আমার সোনা মোনা, ময়না পাখি প্লিজ রাজি হয়ে যা প্লিজ।

–উফফ তোর জ্বালায় আর শান্তি নাই। আচ্ছা ঠিক যা আসবোনে। কিন্তু অল্পসময়ের জন্য।

শিখা নূরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–ইয়েএএ…থ্যাংক ইউ সো মাচ ইয়ার।

গিয়াস বলে উঠলো।
–আমার সাথেও একটু হাগাহাগি করনা।

শিখা নাক শিটকে বলল,
–ছিহহ…যা দূরে গিয়ে ম,র হা,রা,ম,জা,দা।

শিখার মনে চলছে আরেক চিন্তা। কোনোরকমে নূরকে আসার জন্য তো রাজি করালো।কিন্তু ওই কাজের জন্য ওকে কীভাবে রাজি করাবে? সেটাতো বলতেই ভয় লাগছে। শেষে না ও বিয়ের আগেই পরপারে চলে যায়। কিন্তু কাজটা করতেই হবে, আদিত্য ভাইয়াকে প্রমিজ করেছি তার কাজটা করে দিবো। এখন যে করেই হোক রাজিতো করাতেই হবে। শিখা তার প্ল্যান এক্সিকিউট করতে পরদিন সকাল সকালই নূরদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। নূরের পরিবারের সবাই তাকে দেখে খুশি হয়ে ভেতরে বসতে বললো। শিখা এসে প্রথমে।সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। নূর এসে শিখাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কীরে এত সকাল সকাল তুই এখানে? ও আচ্ছা আমাকে নিতে এসেছিড তাইনা? দেখ আমি যখন প্রমিজ করেছি তখন যাবোই ভরসা রাখ।

শিখা মেকি হেসে বলল,
–হ্যাঁ নিতেতো তোকে এসেছিই, তবে সাথে আরেকটা কাজও করতে এসেছি।

–কী?

শিখা তার হাতে থাকা কাগজের শপিং ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে নূরের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–তোকে এটা দেওয়ার জন্য। আজ তুই এটা পড়েই যাবি অনুষ্ঠানে।

–কী এটা?

–খুললেই দেখতে পাবি।

নূর প্যাকেট টা খুলে দেখলো একটা হালকা গোলপী রঙের ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ি আছে তাতে। নূর চোখ ছোট ছোট করে শিখার দিকে তাকিয়ে বলল,
–তুই সকাল সকাল মেয়াদ উত্তীর্ণ গা,ঞ্জা খেয়ে এসেছিস? নাকি তোর মাথায় গ্যাস্টিক জমেছে? তুই ভাবলি কী করে আমি এই শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে যাবো? এমন উদ্ভট ভাবনা তোর মাথায় এলোও কর করে?

শিখা মিনুতির সুরে বলল,
–এটা উদ্ভট ভাবনার কী হলো? শাড়িইতো এনেছি, বি,কি,নি তো আর আনিনি।দেখ আমার অনেক শখ তুই আর আমি এক রঙের শাড়ি পড়ে যাবো। কত্তো মজা হবে। প্লিজ না ইয়ার আমার জন্য পড়। দেখ আজ বাদে কাল আমি মরে গেলে তখন আপসোস করবি। আহারে ছেমরিটা বলেছিল একটু শাড়ি পড়তে। তাও পড়লাম না।

–দেখ এসব ড্রামভর্তি মেলোড্রামা করে কোনো লাভ হবেনা। এসব শাড়ি ফাড়ি তো জীবনেও পরবোনা।

শিখা মিছে নেকি কান্না করে বলল,
–ব্যাস এই ছিলো তোর বন্ধুত্ব? আজ একটা কথাও তুই রাখতে পারলিনা! যা আর খেলমুনা তোর সাথে। আড়ি তোর সাথে।

নূরের মা লতিকা বেগম শিখার সমর্থন করে বলল,
–এমন করছিস কেন? মেয়েটা এতো করে

–বলছে যখন পড়না শাড়ি। আমার কথায়তো কোনোদিন পড়লিনা আজ নাহয় শিখার মন রাখতেই পড়।

মিছরিও বলল,
–হ্যাঁ আপু পড়োনা, আমারও খুব মন চাচ্ছে তোমাকে শাড়িতে দেখতে। অমালিয়া আর নিয়ে নিভানও অনেক অনুরোধ করলো নূরকে শাড়ি পড়ার জন্য।

সবার এতো অনুরোধ আর জোরাজুরিতে নূর বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে গেল। এতগুলো মানুষের অনুরোধ কীভাবে উপেক্ষা করবে ও। তবে শাড়ি পরবে কীভাবে? শাড়ি নামক এই বস্তুর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি কখনো। যেখানে নূর মেয়েলী ড্রেসই পড়েনা বললেই চলে সেখানে শাড়িতো অনেক দূরের কথা। তবুও সবার মন রাখতে রাজি হয়ে গেল। শিখা শাড়িটা নূরকে পড়াতে সক্ষম হলেও সেটা সামলানোই এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মনে হচ্ছে নূরের। সাজের নামে শুধু চুলটা আঁচড়াতে পেরেছে শিখা। এরবেশি আর করতে দেয়নি নূর। শিখাও আর জোর করেনি। শাড়ি পরাতে পেরেছে এইতো হাজার শুকুর। আদিত্যর দেওয়া শাড়িটা নূরকে পড়াতে পেরেছে।এতবড় অসাধ্য সাধন করার জন্য তো শিখাকে এইবছরের নোবেল পুরষ্কার দেওয়াই যেতে পারে। শাড়ি পড়া শেষে বেড়িয়ে এলো নূর। ড্রয়িং রুমে থাকা নূরের পরিবার বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। লতিকা বেগমের চোখ ভরে এলো। আজ প্রথম যেন মেয়েটাকে পরিপূর্ণ নারী দেখাচ্ছে। তার মেয়েটা কতো সুন্দর আজ বুঝতে পারছেন তিনি। নজর না লাগে তার পরীর মতো মেয়ের। মিছরি, অমালিয়া আর নিভানও হা হয়ে তাকিয়ে আছে। নিভানের চোখ জোরাও চিকচিক করছে। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী ওর আপু। এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবারের দায়িত্ব বহন করতে করতে আপু নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেলেছিলো। আজ শুধু সামান্য শাড়িতেই তাকে কতো সুন্দর লাগছে। আপু যদি বউ সাজে তখনতো তার সৌন্দর্যে ঝলমল করবে সারা শহর। কিন্তু আপুর জীবনে সেইদিন কী আসবে কখনো?

নূর দুই হাতে শাড়ি উঁচু করে ধরে হেঁটে আসছে। খুবই অসহ্য লাগছে তার। মানুষ এই অদ্ভুত জিনিস কেন পড়ে? ঝামেলা একটা। অমালিয়া নূরের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
–একি আপু তুমি শাড়ির সাথে স্কেটস পড়েছ কেন? শাড়ির সাথে কেউ স্কেটস পড়ে? লোকে দেখলে তো হাসবে। চলো আমার এক জোরা হিলস দেই তোমাকে।

–আরে না না তোর ওই উঁচু হিল পড়ে আমি হাঁটতে পারবোনা। আমার জন্য এটাই ঠিক আছে। শাড়ি পড়েছি এই অনেক আর কিছু পড়তে পারবোনা।

একটু পর শিখা আর নূর বেড়িয়ে গেল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

–ভ্যানিটির ভেতর অস্থির হয়ে পায়চারী করছে আদিত্য। ওর দেওয়া শাড়িটাতে নূরকে দেখার জন্য ছটফট করছে মন। শিখা কী পেরেছে নূরকে শাড়িটা পড়াতে? নাকি ফেইল হয়ে গেছে? কিছুই তো বললোনা মেয়েটা। ফোনও ধরছেনা। নূর কী আজ আসবে না আসবেনা। এসব ভাবনাতেই অধীর হয়ে উঠছে মন। জিদান আদিত্যর এই অস্থিরতা দেখে চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বলে উঠলো,
–কি হয়েছে স্যার? এসিডিটি প্রবলেম হয়েছে? ইনো আনবো স্যার? তাড়াতাড়ি খেয়ে পেট ক্লিয়ার করে নিন। আজকের ফাংশনে আপনাকে চিপ গেস্ট করা হয়েছে। স্টেজের মেইন ভিআইপি ফ্রন্টে বসতে হবে আপনাকে।তখন সবার সামনে গিয়ে পেট গড়বড় করলে তো মান ইজ্জতের ভাজি হয়ে যাবে স্যার।

জিদানের এই অবাঞ্ছিত কথায় আদিত্য বিরক্তির চরমে উঠে কিছু বলতে যাবে তখনই দরজা দিয়ে প্রবেশ হলো আবিরের। এসেই জিদানের উদ্দেশ্যে কাব্যিক ভঙ্গিতে বলে উঠলো।
–আরে জিদান মিঞা এই এসিডিটি সেই এসিডিটি নারে পাগলা। এইটা হইলো পিয়ার,ইষ্ক, মোহাব্বত-এর এসিডিটি। যা তোমার ইনো দিয়া যাইবো না মিঞা।

আবির ভেতরে এসে বসলো। জিদান কৌতুহলী হয়ে বলল,
–স্যার প্রেমের আবার এসিডিটিও আছে নাকে?

–আরে আছে মানে। প্রেমের অপর নামইতো গ্যাস্টিক।

–কিন্তু স্যার,আমিতো শুনেছি প্রেমের অপর নামতো বেদনা।ওইযে গানে কয়, ♬ প্রেমের নাম বেদনা,একথা বুঝিনি আগে…..

–আরে বেদনাটা তো হলোই গ্যাস্টিকের কারণে। এই গ্যাস্টিক মানুষের পেট থেকে শুরু ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ড তারপর মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ গ্যাস্টিকের তুলনায় এই গ্যাস্টিক অতিব মাত্রায় ভয়ংকর বুঝেছ জিদান মিঞা।সাধারণ গ্যাস্টিকে তবুও তোমার পেছনের নলকূপ দিয়ে বায়ূ নিষ্কাশন করতে পারো। কিন্তু প্রেমের গ্যাস্টিক বের করার কোনো পথ নেই। চল্লিশ পাওয়ারের ডাবল সেকলো খেলেও কাজ হয়না। দিস গ্যাস্টিকস আর ভেরি হার্মফুল।

–তাইলে স্যার এর চিকিৎসা কী?

–এর কোনো চিকিৎসা নাই জিদান মিঞা। এই গ্যাস্টিক লইয়াই জীবন কাটাইতে হইবো। এমনেই কী কয় পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না। তারে নারে নারে না…
আবির ছোট টেবিলের ওপর তবলা বাজানোর মতো করে আঙুল ঠুকিয়ে গান গাইতে লাগলো। জিদান বেচারা ভাবনায় পড়ে গেল। তবে কী তারও প্রেমে পড়লে এই অবস্থা হবে?

এদের কথাবার্তায় আদিত্যের বিরক্ত বাড়লো বৈ কমলো না। তার শান্তি কেবল নূরের দর্শনেই ফিরবে। জানিনা আজ ওর কাঙ্ক্ষিত দর্শন কপালে জুটবে কিনা। ঠিক তখনই আদিত্যর ফোনে শিখার একটা ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজে লেখা ছিলো।
“আমার জন্য নোবেল পুরষ্কার আর নিজের জন্য হসপিটালের ইমার্জেন্সি বিভাগে বুকিং দিয়ে বাইরে আসুন। পরে অ্যাটাক ফ্যাটাক এসে গেলে আমি দায়ী নই”

ম্যাসেজ পড়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো আদিত্যের।হৃৎস্পন্দনের গতী বেড়ে গেল হাজার গুণ। তারমানে নূর আসছে। ওর দেয়া শাড়ি পরে আসছে। শাড়িতে দেখতে পাবে সে নূরকে। ইশশ, উত্তেজনায় পাগলই না হয়ে যায় আদিত্য। হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই আজ। আদিত্য মুখে মাস্কটা লাগিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটে বেড়িয়ে গেল বাইরে। জিদান ঘাবড়ে গিয়ে আদিত্যের পেছনে যেতে যেতে বলল,
–কী হয়েছে স্যার? কোথায় যাচ্ছেন? পেটের গড়বড় কী বেড়ে গেল? বাথরুম তো ভেতরেই আছে স্যার।

আবির পেছন থেকে নিরবে হাসলো। জিদান মিঞা কী আর বুঝবে আদি কেন ছুটে গেল। নিশ্চয় আমার বন্ধুর গ্যাস্টিকের ওষুধ এসে গেছে। যাই দেখি আমিও একটু ভাবির দর্শন করে আসে। দেখিতো কে সেই মহান নারী যে, আমার বন্ধুর এই বেহাল দশা করলো। বলতে বলতে আবিরও উঠে পিছে পিছে গেল। আদিত্য দৌড়ে এলো ভ্যানের বাইরে। এখান থেকে ক্যাম্পাসের মেইন গেট দেখা যাচ্ছে। আদিত্য অধীর নয়নে তাকিয়ে রইলো সেদিকে, নূরকে দেখার আশায়। হৃদবক্ষে চলছে ভয়াবহ বিদ্রোহ। স্পন্দনের গতি হচ্ছে তুফান মেল।

আদিত্যর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে আগমন ঘটলো সেই কাঙ্ক্ষিত নারীর। যার দর্শনমাত্র থমকে গেল আদিত্যর অন্তর্দেশ। থেমে গেল সব কোলাহল মুহুর্তেই। সক্রিয় আঁখি যুগল কেবল

–আবদ্ধ হলো নূরের ওপর। কোনো নারী এতটাও মুগ্ধময়ী কীভাবে হতে পারে? ওই হৃদহরণীকে দেখে আদিত্যর ধাবিত স্পন্দন এবার অব্যাহতি নিলো যেন। বুকের বাম হাত রেখে শরীরের ভর ছেড়ে পেছন দিকে পড়ে যেতে নিলে পেছন থেকে আবির ধরে ফেললো। আদিত্য নূরের দিকে চোখ রেখেই বলে উঠলো।
–ইয়ার আবির, আজ আমি নিশ্চিত রিয়াজ ভাইয়ের গানের মতো ♬ জ্ঞান হারাবো, মরেই যাবো বাঁচাতে পারবেনা কেউ…

আবির সুযোগ সন্ধানী হয়ে বলে উঠলো,
–তাইলে মরার আগে তোর বিএমডব্লিউ কনভার্টার কারটা, আমারে দিয়ে যাইস। তোর জন্য পুরো দুই টাকা চার আনা দান করমু। সাথে তোর গাড়িতে যাদের নিয়ে ঘুরবো তারাও তোর রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবে। এমন আকর্ষণীয় অফার কেউ দিবোনা তোরে।ডিল ডান কর।

আদিত্যকে এভাকে দেখে জিদানও এগিয়ে এসে বলল,
–স্যার, কী হলো আপনার? অবস্থা কী বেশি খারাপ হয়ে গেল? আবির স্যার দেখেন, স্যারের শরীর কেমন কাঁপছে। কোনো কথাও বলছেনা। স্যারের গ্যাস্টিক বোধহয় এবার ম্রিগী রোগে পরিনত হয়েছে। স্যারের নিশ্চয় ম্রিগ্রীর অ্যাটাক হয়েছে। জলদি জলদি স্যারের নাকে জুতা ধরতে হবে। জুতা শুঁকলে স্যার ঠিক হয়ে যাবে।

আবির দম ফাটানো হাসি চেপে রেখে বলল,
–বাহ,পাইজামা মার্কা সাইন্টিস্ট বাহ্। কী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বের করেছ রোগ সারানোর। এতো ট্যালেন্ট নিয়া রাতে ঘুমাও কেমনে মিঞা ? নিজেকে লুকিয়ে রেখ নাহলে নাসার লোক তোমার খবর পেলে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে।

জিদান গর্বে গদগদ হয়ে বলল,
–জি স্যার, ওই সব উপরওয়ালার কৃপা আরকি।এসব নিয়ে কখনো অহংকার করিনি।

–বাইদা ওয়ে জিদান মিঞা আমাদের ভাবি নিশ্চয় ওই সামনের মেয়েটা তাইনা?

–জি স্যার।

–তো ভাবির পাশে ওই আউট অফ ফোকাস মেয়েটা কে? পুরো তিনঘন্টা ধরে সিঙ্গেল চলছি আমি। আমার আবার বেশিক্ষণ সিঙ্গেল থাকলে এসিডিটি হয়ে যায়। তাই ভাবছি মিঙ্গেল হওয়ার জন্য এইটারে ট্রাই করি কী বলো।

জিদান তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো।
–স্যার স্যার প্লিজ, ওই আউট অফ ফোকাসের উপর আমি ফোকাস মারছি। তাই দয়া করে এটাকে আমার জন্য ছেড়ে দেন।

–ঠিক আছে জিদান মিঞা, যাও তুমিও কী মনে রাখবে কোন মহান ব্যাক্তির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আজ আমি তোমার জন্য সেক্রিফাইস করলাম। যাও বৎস,জিলো আপনি জিন্দেগী।

অন্যসময় হলে হয়তো এদের উদ্ভট কথাবার্তায় আদিত্য এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে রাম ধমক দিয়ে বসতো। তবে আজ আদিত্য নিজের মাঝে আছে কোথায়।সেতো হারিয়ে গেছে তার প্রিয়তমার মাঝে। আশেপাশের সবকিছু তার জন্য এখন অদৃশ্য। দৃষ্টির সীমানা জুড়ে কেবল ওই এক মানবিই প্রতীয়মান হচ্ছে। যে নারীকে দেখতে দেখতে সে নিজের শেষ নিঃশ্বাসটা খুশি খুশি ত্যাগ করতে পারবে।
“বক্ষস্থলের কম্পায়মান যন্ত্রটাও তোমার রুপে আত্মহুতি দিয়েছে।
নিজ অস্তিত্বকে হারিয়েছি তোমার মাঝে, সে খোঁজ কি তোমার মন নিয়েছে?”

চলবে…..