শৈবলিনী পর্ব-৩৩+৩৪

0
438

#শৈবলিনী—-৩৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ঘন্টা দুই তান্ডব চালিয়ে তুফান থেমে গিয়ে সর্বশান্ত সৈনিকের ন্যায় বিমুঢ় হয়ে বসে আছে নূর। তার রঙিন ভুবনটা মুহূর্তেই কালবৈশাখী ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল।শূন্যতার এক পাহাড় এসে ভড় করলো তার ওপর। নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে তার। বুকের যন্ত্রণাদায়ক পীড়া মুমূর্ষু করে দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার আশায় আস্তে আস্তে উঠে জানালার পাশে এসে জানালা খুলে দাঁড়াল সে। জানালা খুলতেই বৃষ্টির ঝাপসা এসে লাগলো মুখে। এরমাঝে কখন বৃষ্টি নেমেছে টেরই পায়নি সে। কীভাবে পাবে,দিনদুনিয়ার কোনো আলোড়ন শুনতে পাচ্ছে না সে। তার ভেতরের আর্তনাদ যে তার সব বোধশক্তি কেঁড়ে নিচ্ছে। জানালা খুলে বৃষ্টির ঝাপসা পেয়ে চোখ বুজতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের আদিত্যর সাথে কাটানো বৃষ্টিতে ভেজা সেই মুহূর্ত টা। ছিটকে চোখ খুলে ফেললো নূর। বুকের পীড়ন যেন আরও অসহনীয় হলো। আজকে এই বৃষ্টিও অসহ্য লাগছে তার। এই বৃষ্টির ফোটা যেন টগবগে গরম তেলের মতো তার শরীরকে ঝলছে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে তার। সহ্য করতে না পেরে জানালাটা আবারও আটকাতে চাইলো সে। হঠাৎ নিচের দিকে নজর যেতেই থমকে গেল তার হাত। বৃষ্টির মাঝেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই পুরুষটিকে চিনতে সে ভুল করলোনা। কীভাবে ভুল করবে! এইতো সেই ব্যক্তি যে,ওর মনটাকে একটু আগেই নির্মম ভাবে হ,ত্যা করেছে। সেই লোক এখন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে ওর জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে এখানে কী করছে? কী চায় সে? এখনও কী খেলা শেষ হয়নি? আরও কী খেলা বাকি আছে তার? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে কী প্রমাণ করতে চাইছে? যা খুশি করুক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। এই ধোঁকাবাজের ফাঁদে আর পা দিবোনা আমি। জানালা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো নূর।

নিচ থেকে সবকিছুই দেখতে পেল আদিত্য।দেখতে পেল নূর ঠিকই ওকে দেখতে পেয়েছে। আর ওকে দেখেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও সে নড়লো না। সে কেন এসেছে জানে না।কেন দাঁড়িয়ে আছে জানে না।নূরকে কী বলবে জানে না। কী করবে তাও জানে না। শুধু জানে নূরকে দেখতে চায় সে। নূরের কথা শুনতে চায় সে। দরকার হলে ইচ্ছেমতো যতখুশি গালি দিক নূর ওকে। তবুও তা শুনতে চায় আদিত্য। চাইলে ওকে মারতে মারতে জান বের করে দিক নূর, তবুও চায় নূর আসুক। সে যে অপরাধ করেছে তারজন্য সব মেনে নিতে রাজি সে।নূরের হাতে খু,ন হতেও রাজি। শুধু নূর এসে ওর সাথে কথা বলুক। নূরের ওই নিরবতা যে আদিত্যর দম বন্ধ করে দিচ্ছে। গলা চিপে ধরেছে। একবার শুধু নূরকে দেখতে চায় সে। নূরের সব নারাজি সহ্য করতে রাজি, কিন্তু নূরের ওই নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারছেনা আদিত্য। কিছুতেই না।

নূর জানালাতো আঁটকে দিয়েছে। কিন্তু নিজের অশান্ত মনকে কীভাবে শান্ত করবে। যে বেহায়া মন গলা কা,টা মুরগির মতো ছটফট করছে। দেখতে চাইছে ওই ছলনাময় লোকটাকে।নিজের অবাধ্য মনের এই বেহায়াপনার জন্য নিজের ওপরই ঘৃণা হচ্ছে নূরের। ওই লোকটাকে ভালোবাসার মতো অন্যায়ের জন্য নিজেকে গলা টি,পে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।এতো চালাক হয়েও এতবড় বোকামির জন্য দুনিয়ার সর্বোচ্চ শাস্তিতে দন্ডিত করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। ভেতরের হৃদপিণ্ডটা টেনে বের করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওই লোকটার জন্য জমা অনুভূতি গুলোকে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চাইলেও এসব করতে না পারায় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে তার। অস্থিরতায় এক জায়গায় টিকতে পারছেনা নূর। অশান্ত মন তাকে একমুহূর্তও শান্তি দিচ্ছে না। ঘন্টা খানিক নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলোনা নূর। আদিত্য আছে না নেই জানার জন্য আবারও জানালা হালকা একটু খুলে নিচে তাকালো। দেখতে পেল ঝুম বৃষ্টির মাঝে এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ব্যক্তিকে। বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থা তার। তবুও একচুলও নড়ছেনা সে। নূর আবারও জানালা আঁটকে দিলো। যা খুশি করুক। ওই ছলনায় আর ভুলবেনা নূর।
__

ঘন্টাখানিক হলো আদ্রর রুমে রেখে গেছে অমালিয়াকে। তখন থেকেই খাটের এক কোনে হেলান দিয়ে বিষন্ন মনে বসে আছে সে। নিজের বিয়ে নিয়ে কতশত স্বপ্ন ছিলো তার। আর আজ এমনভাবে তার বিয়ে হলো যেন কোনো অন্যায় করে ধামাচাপা দেওয়ার মতো। এসবকিছুর জন্য কোথাও না কোথাও সে নিজেই দায়ী। আপুর কথা যদি আগেই মেনে নিয়ে নিজের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আনতাম তাহলে হয়তো আজ এসব হতোনা আমার সাথে। আপুর কথা তখন অমান্য করার শাস্তি পাচ্ছি আজ। আর আজকের পর হয়তো সেই আপু আর কখনো কিছু বলবেইনা। হয়তো আর অধিকার দেখিয়ে শাসনও করবেনা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়লো অমালিয়ার। নড়েচড়ে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। দরজা খুলে আদ্র ঢুকলো। তাকে দেখতেই মাথায় আগুন ধরে গেল তার। মনে পড়ে গেল ভয়াবহ সেই রাতের কথা। যে রাতের ভয়াবহতা হয়তো তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এই লোকটাকে দেখলেই তার ক্ষত বারবার সতেজ হয়ে যাবে।

আদ্রর ক্ষেত্রেও বিষয়টা খুব একটা সহজতর না। অমালিয়ার সামনে এভাবে থাকা তার কাছেও প্রচুর অস্বস্তিকর ব্যাপার। নেশার ঘোরে সেদিন অতবড় অন্যায় করে ফেললেও এখন সেটা নিয়ে তার মাঝে অপরাধবোধের সীমা নেই। পরিবারের সাথে সাথে সে নিজেও নিজের কাছেই ঘৃণিত হয়ে গেছে। অপরাধ বোধে সে অমালিয়ার দিকে তাকাতেও পারছেনা। কোনরকমে মাথা নুইয়ে কাবার্ডে গিয়ে নিজের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।কতক্ষণ ইতস্তত করতে করতে চুপচাপ আস্তে করে গিয়ে বিছানার একপাশ ঘেঁষে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ পেছন শরীরের নিচ থেকে চাদর সজোরে টান দিলো কেউ। যার দরুন আদ্র বিছানা থেকে উল্টে গড়ে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে হাতে হালকা ব্যাথাও পেল সে। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে উঠে সামনে তাকালে অমালিয়াকে চাদর হাতে রাগী মনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। বুঝতে পারলো তাকে ফেলে দেওয়ার কাজ সেই করেছে। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
–হোয়াট দ্য…. তুমি আমাকে ফেলো দিলে কেন? চাদর লাগলে কাবার্ড থেকে নাও। শরীরের নিচ থেকে টান দেওয়ার কী দরকার?

অমালিয়া চোখ মুখ শক্ত করে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
–তোমার কী মনে হয়? তোমার মতো জঘন্য লোককে আমি আমার পাশে ঘুমুতে দিবো? তুমি যদি ভেবে থাকো আমি এই বিয়ে তোমার সাথে সংসার করার জন্য করেছি তাহলে সেই আশা মাটি চাপা দাও। তুমি কী ভেবেছ, এসবের পরও তোমার সাথে সাধারণ স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক করবো আমি! কক্ষনো না। কান খুলে শুনে রাখো। শুধু সমাজের সামনে নিজের সম্মান রক্ষার্থে আমি এই বিয়ে করিনি। আমি এই বিয়ে করেছি আমার সাথে তোমার করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আইন তোমাকে কী শাস্তি দিতো। তোমার মা বাবা ক্ষমতার জোরে হয়তো তোমাকে বাঁচিয়েও নিতো। তাইতো আমি নিজে হাতে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি এখন থেকে সারাটা জীবন শাস্তি পাবে। তোমার লাইফ হেল করে দিবো আমি। কখনো শান্তিতে থাকতে দিবোনা তোমাকে। সারাজীবন জ্বলতে হবে তোমাকে। না আমাকে ছাড়তে পারবে আর না পারবে আমার সাথে থাকতে। আর এটাই হবে তোমার সর্বোচ্চ শাস্তি।এখন যাও, যেখানে খুশি সেখানে নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করো। কিন্তু খবরদার আমার পাশে শোয়ার চিন্তাও করবেনা।

আদ্র ভারী লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অমালিয়ার কথার কোনরকম জবাব দিলোনা সে। বলার মতো তেমন কোনো শব্দই নেইযে তার কাছে। সে যা করেছে তারজন্য এটাতো তার প্রাপ্য। পাপের শাস্তিতো তাকে ভোগ করতেই হবে। লোকে ঠিকই বলে, পাপ ছাড়েনা বাপকে। আইনের হাত থেকে বাচলেও, এই জেলখানার শাস্তি থেকে আর কীভাবে বাঁচবে। তাইতো সেই চেষ্টাও করতে চায়না আর। এতে করে যদি কিছু পাপ কম হয়। তাই চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে রুমের ডিভানের দিকে এগিয়ে গেল সে। ডিভানের কাছে এসে অমালিয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
–জানি আমি যা করেছি তা মাফ করার নয়।তাই মাফ চাইবো না । তুমি যতো পারো শাস্তি দাও। যতক্ষণ না তোমার আত্মতুষ্টি হয় ততদিন শাস্তি দাও। তবে যেদিন মনে হবে আমাকে শাস্তি দিয়ে তুমি তোমার ক্ষত কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছ সেদিন পারলে এই অপরাধীকে ক্ষমা করে দিও। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো।

অমালিয়া তার মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। এই লোকটার সামনে তার কান্নাও দেখাতে চায়না সে। হঠাৎ আদ্র আবার বলে উঠলো,
–আর হ্যাঁ আরেকটা অনুরোধ করতে চাই তোমাকে। তুমি জানো কিনা জানিনা, তবে ভাইয়া কিন্তু নূর আপুকে ভালোবাসে। সেদিন ভাইয়া আমাদের জানিয়েছিল সে বিয়ে করলে তাকেই করবে। কিন্তু আমাদের এসব ঘটনার কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। আমার জন্য ভাইয়া এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন আবার আমার জন্য সে তার ভালোবাসাকেও হারাক সেটা আমি একদমই চাইনা। তাই পারলে তুমি একটু আপুকে বুঝিয়ে বোলো যে, ভাইয়া এসব ইচ্ছে করে করেনি। আমার আর মায়ের চাপে পড়ে সে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে। ভাইয়াতো আমাকে পুলিশে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু আমার কথা ভেবে মা ভাইয়ার কাছে অনেক কান্নাকাটি করে। মায়ের আকুতির কাছে আটকে গেছে ভাইয়া। তাই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে সে। প্লিজ এই বিষয় টা একটু নূর আপুর কাছে ক্লিয়ার করো তুমি। নাহলে এতো এতো অপরাধের ভার নিয়ে বাঁচতে পারবোনা আমি।

অমালিয়া চমকে গেল। মুখ চেপে ধরে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো সে। অজান্তে সে এটা কী করে ফেললো? আদিত্য আপুকে ভালোবাসে? কিন্তু আপুতো নিশ্চয় আজকের এসবের কারণে আদিত্যকে ভুল বুঝবে। ওর আপুকে ভালো করেই জানে ও। সে একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা কেউ বদলাতে পারবেনা। আজ আমার জন্য আপু আর আদিত্যর সম্পর্ক হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। এখন কী করবো আমি? আপুতো আর আমার মুখও দেখতে চায়না,কথা বলাতো দূরের কথা। তাহলে তাকে কীভাবে বুঝাবো আমি? আজ একটা অঘটন সবার জীবনটাকে কেমন বদলে দিলো। সব আমার কারণে হয়েছে। আমার জন্য আজ আপুর জীবনটাও উলোটপালোট হয়ে গেল। এখন কী হবে? কে জানে এসবকিছু কোন দিকে মোড় নিবে।
__

আরও দুই ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে।রাত তখন দুইটার কাছাকাছি। ঝুম বৃষ্টির শব্দ এখনো থামেনি।মেঘেরও যেন আজ নূরের মতো কষ্ট হচ্ছে। তাইতো কান্না থামছেই না তাদের । মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত আবারও পরাজিত হলো নূর। অশান্ত মনের দায়ে আবারও জানালাটা হালকা খুলে নিচে তাকালো সে। এখনো যায়নি ওই ব্যক্তি। জিদ্দি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির মাঝে। গত প্রায় তিনঘণ্টার বেশি সময় ধরে একটানা ভিজছে সে। এসব করে কী প্রমাণ করতে চায়ছে সে? নাহ,এভাবে আর চলবেনা। ওই বেঈমান পুরুষকে বোঝাতে হবে তার এসব ড্রামার কোনো প্রভাব আর পড়বেনা। এই নূর একবার বোকা হয়েছে, বারবার হবে না।

দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত মজবুত করলো সে। অখন্ডিত পাথরে রুপ নিলো। যে পাথরে নেই কোনো অনুভূতির লেশমাত্র। নিজেকে তৈরি করে ছাতাটা বের করে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো নূর। মেইন গেট খুলে সোজা আদিত্যর সামনে এসে দাঁড়াল সে। বৃষ্টিতে একটানা ভিজে আদিত্যর অবস্থা শোচনীয়। চোখ দুটো লাল ডগডগ করছে। মুখমন্ডল একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আদিত্যর এই হাল নূরের বুকের ভেতর হাজারও পীড়ন দিলেও চেহারায় তার বিন্দুমাত্র ছায়াও আনতে দিলোনা নূর। চোখ মুখ এতটা শক্ত করে রেখেছে যেন,আদিত্য কোনো অপরিচিত লোক। তাকে সে চেনেই না। নূরের এই কঠোর চাহুনিই যথেষ্ট আদিত্যর হৃদয়ে র,ক্ত,ক্ষরণের জন্য। শেষমেশ নূর এলোতো ঠিকই। কিন্তু এই নূর যে ওর নূর না। এ যে পাথরের কোনো মূর্তি মনে হচ্ছে। যার কাছে আদিত্যর ডাক হয়তো পৌঁছাবেও না।

নূর আদিত্যর পানে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো,
–মিঃ সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য। এখানে কি আপনার কোনো মুভির শুটিং চলছে? যদি তা না হয়ে থাকে। তাহলে আপনার এই অতিরঞ্জিত ড্রামার কারণ জানতে পারি কি? এক্সুয়ালি, তারও দরকার নেই। তবে শুধু বলবো, এটা একজন অতি সাধারণ ভদ্র পরিবারের বাড়ি। তাই এখানে এভাবে মাঝরাতে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে, আমাদের যা একটু সম্মান বাকি আছে সেটারও হানী করার যদি আপনার মনকামনা থেকে থাকে তাহলে অতি দুঃখের সাথে বলতে চাই এটা আমি হতে দিবোনা। ভালোই ভালোই এখান থেকে যান। নাহলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো। হ্যাঁ জানি আপনাদের অনেক টাকা আছে,অনেক ক্ষমতা আছে। এসব পুলিশ টুলিশ পকেটে নিয়ে ঘোরেন। অপরাধ করেও, রায় কীভাবে নিজের হিতে আনতে হয় তা ভালো করেই জানেন। তবুও নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতো আমার সামর্থ্য মতো চেষ্টাতো আমি করবোই।

আদিত্য নিশ্চুপ ব্যাথা ভরা করুন চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। কী বা বলার আছে ওর। প্রথমত নূরের মিঃ নায়কের বদলে ওর পুরো নাম ধরে ডাকাটাই ছিলো বিষাক্ত তীর তীব্র বেগে হৃদপিণ্ডে বিঁধে যাওয়ার মতো ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক। আজ যেন নিজের নামটাই সবচেয়ে তিক্ততা পূর্ণ মনে হচ্ছে। যে নাম নূরের মুখে আজ সবচেয়ে বেশি বিশ্রী লাগছে শুনতে। আর নূরের এই তিক্ত বাক্যগুলো মনে হচ্ছে উত্তপ্ত গরম লাভার মতো হৃদপিণ্ড জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তবুও শুনবে সে। নূরের সব ক্রোধ বর্ষিত হোক তার ওপর। নূর ওর ক্রোধের অগ্নিতে দগ্ধ করে দিক ওকে। সব সয়ে যাবে ও। নূরের বিশ্বাস ভাঙার অপরাধে সে মেরে ফেললেও ক্ষতি নেই। তবুও যেন নূর ওকে ছেড়ে না যায়। নূরের দেওয়া সেই শাস্তি কীভাবে মেনে নিবে ও? শুধু এই শাস্তিটাই যেন নূর ওকে না দেয়।

নূর ওর কথা শেষ করে চলে যেতে নিলেই, আদিত্য তীব্র আবেগ আর মায়া ভরা কন্ঠে করুন সুরে ডাকলো নূরকে। না চাইতেও থমকে গেল নূরের পা। বুকের মাঝে মুচড়ে উঠলো। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে আসছে সব। তবুও সব নিজের মাঝেই দমিয়ে রেখে শক্ত চোখে আবারও আদিত্যর পানে ফিরে তাকালো। আদিত্য অপরাধী সুরে বলে উঠলো,
–আমি জানি নূর,আমি তোমার অপরাধী। তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি। তুমি যা চাও শাস্তি দিতে পারো আমাকে।শুধু একবার আমার কথা….

আদিত্যর বাক্য শেষ হওয়ার আগেই নূর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
–এক মিনিট,এক মিনিট মিঃ আদিত্য। আই থিংক আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। নিজেকে বোধহয় একটু বেশিই ইম্পর্ট্যান্স দিয়ে ফেলছেন। নূর কারোর ওপর এতটাও ডিপেন্ড হয়না যে,কেউ ওর ইমোশন নিয়ে খেলতে পারে। আপনি ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসুন। আর হ্যাঁ, আপনার হয়তো আজকের ডেটটা মনে নেই। তবে আমার মনে আছে। আজ সেই দিন যেদিনে আপনার দেওয়া ত্রিশ দিনের সমাপ্তি হলো।

আৎকে উঠলো আদিত্য। আজ ত্রিশ দিন শেষ হয়ে গেছে? ওরতো মাথায়ই ছিলোনা। কিন্তু নূর কেন মনে করিয়ে সেটা? কী বলতে চাইছে সে। ভয়ে অন্তর শুঁকিয়ে আসছে আদিত্যর। আদিত্যর ভয়কে সত্য করে দিয়ে নূর বলে উঠলো।
–তো আপনার দেওয়া আজ ত্রিশ দিন শেষ হলো। আর আপনার প্রতি আমার কোনোরকম ফিলিংস হয়নি। তো এখন আপনার কথা অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ পুরো হয়ে গেল। ওয়াদা পূরণ করার ক্ষেত্রেতো আপনার ট্রাক রেকর্ডের কথা বলতেও চাচ্ছিনা। তবে আশা করি অন্তত এবার নিজের কথা রাখবেন। আর আপনার শর্ত অনুযায়ী আর কখনো আমাকে জ্বালাতে আসবেন না। আপনার সাথে এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ। ভালো থাকবেন। আর পারলে এর পরের বার কাউকে কোনো ওয়াদা করবেন না। গুডবাই মিঃ সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য।

আদিত্যর হৃদপিণ্ডে তীব্র বেগে সহস্র খানেক বাজ ফেলিয়ে চলে গেল নূর। সত্তাটাকে মে,রে ফেলে লাখো তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে রেখে গেল ওকে। অসার হয়ে আসা শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়লো আদিত্য। আজ সে সত্যি সত্যিই চিরতরে হারিয়ে ফেললো নূরকে। এখন এই মৃ,ত হৃদয়টাকে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে ও? নূর ওকে এতো কঠিন শাস্তি দিয়ে গেল! এরচেয়ে তো ওর জানটা বের করে নিয়ে গেলেও পারতো। এখন এই জীবনের বোঝা ও কীভাবে বয়ে বেড়াবে। শরীরটা এবার আরও নিস্তেজ হয়ে গেল। কোনোরকমে একবার অস্পষ্ট সুরে নূরের নাম নিলো। তার পরপরই ঢলে পড়লো মাটিতে।

চলবে…..

#শৈবলিনী—-৩৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আট মাস পর,
“সময়”,বড়োই অদ্ভুত জিনিস সময়।এই নিরবধি বয়ে চলা সময়, একেক জনের জীবনে একেক ভাবে চলে। এই সময়,কারোর জীবনে হয় আনন্দের, সুখের, সাফলতার। কারোর জীবনে হয় দুঃখ,কষ্ট আর বিষন্নতার। কারোর জীবনে এনে দেয় সফলতার চাবিকাঠি আবার কারোর জীবনে নিয়ে আসে ব্যর্থতার দূর্দশা। সময়,কাউকে এনে দেয় নতুন আলোর সন্ধান আবার কাউকে ঠেলে আধারের গভীরতায়। কেউ সময়ের মূল্য বুঝে তার সাথে চলার চেষ্টা করে আবার কেউ নিজের জীবনের চাওয়া-পাওয়া আশা-নিরাশা ভালো-মন্দ সব সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়। কারোর আবার সময়ের কাছে কিছু চাওয়ারই থাকে না, সময় তাকে কী দিলো না দিলো তার ধার ধারে না, সে নিজের মতো করেই চলে। এমনিতেতো কারোর জন্য থেমে থাকে না সময়। সে যতোই কেউ কান্নাকাটি করে নিজের জান দিয়ে দিক তবুও সময় শোনে না কারোর মিনতি। কঠোর হয়ে নিরন্তর ছুটে চলে সময়। তবে কখনো কখনো এই সময়ই আবার কারোর জন্য থমকে যায়। ঘড়ির কাঁটা এক জায়গাতেই আঁটকে যায়। চেয়েও পারেনা সময়কে এগিয়ে নিতে। জীবন থেমে থাকে ওই সময়ইটাতে।

আদিত্যর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। তার সময় আঁটকে আছে আট মাস পূর্বের ওই রাতে। যেদিন ওই নিঠুর রমনী ওকে জীবন্ত লা,শে পরিণত করে চলে গিয়েছিল।হৃদয়টাকে মৃ,ত করে এই নির্জীব শরীরটাকে ফেলে গেছে। সেদিনের সেই কালো রাত থেকে আজও আলোর দেখা পায়নি সে। বেঁচে থাকাটা কেবলই দায়ভার তার। নিঃশ্বাস গুলোও বোঝা হয়ে গেছে তার। কিন্তু চাইলেও এই নিঃশ্বাসের বোঝা একেবারে বন্ধ করতে পারছেনা আদিত্য।এটাই যে নূরের দেওয়া শাস্তি। তার শাস্তি ভোগ না করে কীভাবে পালাতে পারে ও। বেঁচে থাকার মতো ভয়াবহ যে শাস্তি নূর দিয়েছে তা ভোগ না করে কীভাবে চলে যাবে।
সাতাশ বসন্ত পেরিয়ে আসা এই জীবনে আদিত্যর হঠাৎই সবকিছু মিথ্যে মনে হচ্ছে। সব জানা অজানা জ্ঞান আজ নিজের ওপরই উপহাস করছে। এই পর্যায়ে এসে জীবনের হিসাব খাতায় কেবলই শূন্য মিলছে। সম্পর্ক, বন্ধন মায়া,মমতা এসব শুধুই মিথ্যে জাল।আসলে সব হলো স্বার্থের খেলা। যতক্ষণ স্বার্থ ঠিক আছে ততক্ষণই সব ঠিক আছে। স্বার্থে আঘাত পড়লেই তখন মিথ্যে জালও ছিঁড়ে যায়। পৃথিবীর বাস্তব রুপ দেখা যায় তখন। এই স্বার্থময় পৃথিবীতে নিজেকে বড়োই বেমানান মনে হয় এখন আদিত্যর।

দশ তালা বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ছাঁদের রেলিঙের ওপর বসে এক হাতে ম,দে,র বোতল আরেক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে আছে আদিত্য। একবার অ্যা,ল,কো,হ,ল গিলছে তো আরেকবার নিকোটিন টানছে। ভেতরের জ্বলনকে বাইরের অগ্নি দ্বারা নিভানোর বৃথা চেষ্টা করছে। কারণ সে অগ্নি নেভার পরিবর্তে আরও জ্বলে উঠে পুড়িয়ে দিচ্ছে আদিত্যকে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ টান দিয়ে রেলিঙ থেকে ছাঁদের ফ্লোরে এনে ফেললো। আদিত্য হকচকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, আবির। আদিত্যকে নিচে নামিয়ে হাঁটুর ওপর হাত ঠেকিয়ে রিতীমত হাঁপাচ্ছে সে। আসার সময় নিচ থেকে আদিত্যকে এভাবে রেলিঙের ওপর বসে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায় আবির। তাই প্রাণপণে দৌড়ে আসে সে। আদিত্যর মনমানসিকতা এখন স্বাভাবিক নেই। এই অবস্থায় যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে ও। সোটরই ভয় হচ্ছিল ওর। তাই দৌড়ে এসে ওকে নামিয়েছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু ঠিক করে আবির ক্ষেপে গিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–শালা, হা,রা,মি রেলিঙের ওপর কি কোনো মুভির শুটিং করছিলি? জানোস এক্ষুনি আমার কোটি টাকা দামের পরানডা লাফ দিয়া বারাই যাইতো। তোর দেবদাস গিরির চক্করে আমার ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যেত এক্ষুনি। বিষয় টা শুধু আমার মরার না। আমি মরে গেলে এই লাখো নারীর কল্যাণ কে করতো? নারীদের এই মহা সর্বনাশের জন্য দায়ী থাকতি তুই।

আদিত্য মাতালের মতো হেঁসে বলল,
–“মৃ,ত্যু”!মৃ,ত্যু,কে লোক শুধু শুধুই বদনাম করেছে। আসল যন্ত্রণাতো শালী এই জীবন দেয়।

–দেখ এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে। তারওপর তোর ঠ্যাং, মাথা ছাড়া কথা বলে আমার মগজের আলু ভাজা করিসনা।
আবির আদিত্যর পাশে গিয়ে বসলো। আদিত্যর হাত থেকে ম,দে,র বোতলটা হাতে নিয়ে বলল,
–শালা, সকাল সকাল হয়রানি করালি। এমন দৌড় অলিম্পিকে দিলে দেশের জন্য আজ গোল্ড মেডেল কনফার্ম ছিলো। গলাও শুকিয়ে গেছে। দে, গলা ভেজাই।

আদিত্য ছাদের রেলিঙের দেয়ালের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
–তা সকাল সকাল কে টপকাতে বললো তোকে? নিশ্চয় উনি তাইনা?

উনি বলতে যে আদিত্য ওর মায়ের কথা বলছে তা জানে আবির। আবির বলল,
–নাহ,রেহনুমা আন্টি পাঠায়নি। আসলে কাল একটা নিউজ দেখলাম। ভাবলাম তুই দেখেছিস কিনা…

–হুম দেখেছি। তবে আমি অবাক হয়নি। এমনটা হবে আমি জানতাম। নূর ওর গাড়ি বানানোর কাজে সফল হয়েছে। সেই নিউজ দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বড়ো বড়ো কোম্পানি নূরের সাথে কোলাবোরেশান করতে চাচ্ছি। এই সবকিছুই জানি আমি। এটাতো হওয়ারই ছিলো। নূরের এই সফলতা ও ডিজার্ভ করে।

–আর তুই? তোর কী? তুই কী এসব ডিজার্ভ করিস? যে তোকে ভালোবাসেনা। তোকে চায়না।তার জন্য কেন নিজে সন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটাচ্ছিস। এইযে নিজের পরিবার ছেড়ে একা এই ফ্লাটে এসে পড়ে আছিস। বেঁচে থাকার নামে শুধু নিঃশ্বাসটাই নিচ্ছিস। এসব কী তুই ডিজার্ভ করিস?

–ভুল বলছিস তুই আবির। ও ভালোবাসে আমাকে। অনেক ভালোবাসে। আমি এতটাও অন্ধ না যে,ওর চোখের ভাষা পড়তে ভুল করবো। ওই চোখে আমি নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম। আমি এসব ডিজার্ভ করি, কি করি না তা জানা নেই। তবে যাতনা শুধু একটাই, ও যেতে যেতে মিথ্যে বলে গেল আমাকে। আর সেটাই বেশি অসহনীয় পীড়া দেয় আমাকে। বুকের ভেতর সর্বক্ষণ দাবানল জ্বলছে আমার।

দুঃখজনক এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আবির। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এমন বেহাল দশা আর দেখতে পারে না ও। নিজের ওপরই রাগ হয় ওর। এসব ভালোবাসা টালোবাসার চক্করে ওকে পড়তে দেওয়াই উচিত হয়নি। তখনই যদি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এসব থেকে বের করে আনতো তাহলে হয়তো আজ ওর এই দশা হতোনা। ওতো জানে, ভালোবাসা জিনিসটাই দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য অনুভূতি। যা কখনো কাউকে সুখী করেনা। ভালোবাসা শুধু গ্লানী আর দূর্দশাই এনে দিতে পারে। ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না ভালোবাসা। আই জাস্ট হেট লাভ।
আবির আদিত্যর হাত ধরে ওকে উঠাতে উঠাতে বলল,
–হয়েছে, তোর দেবদাস কথন শেষ হলে ভেতরে চল। সকাল সকাল খালি পেটে অ্যা,ল,কো,হ,ল খেয়ে নিলাম। এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা করি চল। নাহলে আজ বাথরুম সংসার শুরু করতে হবে।
বলেই আবির আদিত্যকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে।

আদিত্য সেদিনের পর থেকেই একা ওর কেনা এই ফ্ল্যাটে থাকে। মায়ের ওই কাজের পর থেকে পরিবারের উপর তার কেমন বিতৃষ্ণা এসে গেছে। তাইতো একাই এখানে পড়ে থাকে। দিনরাত ম,দে,র নেশা আর ধোঁয়ার নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। নূরের দেওয়া কষ্ট থেকে এভাবেই বাঁচার উপায় খোঁজে সে। যদিও তা খুব একটা কাজে দেয়না। বুকের যন্ত্রণা থেকে একবিন্দুও মুক্তি পায়না সে। আজ আট টা মাস সে হৃদয় ছাড়াই বেঁচে আছে। এই দেহটাকেও হয়তো এতদিন দাফন করার ব্যবস্থা করে দিতো আদিত্য। শুধু নূরের দেওয়া শাস্তি ভোগ করার জন্যই সে বেঁচে আছে। তার অপরাধের শাস্তিযে তাকে মরতেও দেয়না।নূরকে দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী সেদিনের পর আর নূরের সামনে যায়নি আদিত্য। তবে নূরের সব খবরই তার জানা থাকে। নূর ওকে তার সামনে যেতে মানা করেছে। তবে নূরের কথা জানতে তো আর কেউ ঢেকাতে পারবেনা ওকে। সেই দিনের পর একমাসের মাথায়ই নূরের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়ে যায়।তারপরে আর নূর ভার্সিটিতে আসে না। আদিত্যও তাই আর সেখানে শুটিং করতে যায়না। আদিত্যর কোনো কিছুই আর করতে ইচ্ছে করে না। পারলে তো এসব মুভির শুটিং টুটিং সব ছেড়ে দিতো সে। কিন্তু অনেক গুলো মুভির কন্ট্রাক্ট সাইন করে রেখেছিল সে। তাই না চাইতেও শুটিং এ যেতে হয় ওকে।যদিও ও না গেলে কোনো কনট্রাক্ট ওর কিছুই করতে পারবেনা। তবু্ও নিজের জন্য কারোর ক্ষতি চায়না আদিত্য। যেহেতু কথা দিয়েছিল তাই মন না চাইলেও কাজে যায় আদিত্য। তবে সে ভেবে নিয়েছে পেন্ডিং কাজগুলো শেষ হলে আর কোনো মুভি টুভি করবেনা । এখান দূরে কোথাও চলে যাবে। আদিত্যর কাছে নূরের সব আপডেট থাকে। নূর অনেক ভালো রেজাল্টে পাশ করেছে। এবং নিজের স্বপ্নও পূরণ করেছে সে। তার সেই গাড়ি উদ্ভাবন করতে পেরেছে। প্রত্যেক টা নিউজ মাধ্যমে এখন তারই আলোড়ন শুধু। নূরের সফলতায় আদিত্যও খুশি। “নাহোক সে আমার, তবুও তার জীবন হোক খুশির সমাহার।”
__

আদ্র অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। বাবার বিজনেস জয়েন করেছে সে। এই কয়মাসে নিজেকে অনেক টাই শুধরে নিয়েছে। দায়িত্ববান একজন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। অতীতের ভুলগুলোকে তো আর ঠিক করা যাবে না। তবে সামনের জীবনে যাতে আর কোনো ভুল না হয় সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে সে। যদিও তার এই প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসু হয়েছে তা জানা নেই। অমালিয়া এখনো তাকে মাফ করেনি। আজও তার অন্যায়ের শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে অমালিয়া ওকে। যদিও আদ্রর কাছে এসব এখন আর শাস্তি মনে হয়না। ওই রাগী, জিদ্দি মেয়েটার ক্রোধের সম্মুখীন হতে হতে কখন যে ওই নারীতে মন হেরে বসে আছে তা বুঝতেও পারেনি। এখনতো তার দেওয়া শাস্তিও মজাদার লাগে আদ্রর কাছে। এখনতো কেবল একটাই চাওয়া, কবে অমালিয়া ওকে মাফ করে দিবে। আর ওকে স্বামী হিসেবে নিজের জীবনে জায়গা দিবে।

ভাবনার মাঝেই হঠাৎ মুখের ওপর প্রচন্ড বেগে টাওয়াল এসে লাগলো। আদ্র খুব একটা অবাক হলোনা। এটাযে ওর বউ নামক আগুনের গোলার কাজ তা ভালো করেই জানে সে। আদ্র মুখের উপর থেকে তোয়ালেটা নামিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো অমালিয়া যথারীতি অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্র মুচকি হেঁসে বলল,
–মনে হচ্ছে স্বামীকে তোয়ালে দেওয়ার রীত এর ব্যাপারে তোমাকে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে। প্রথমত তোয়ালে গোসলের সময় দিতে হয়। আর দ্বিতীয়ত এভাবে গুগলির মতো ছুঁড়ে দিতে হয়না। ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে একটু লাজুক, মোহনীয় ভঙ্গিতে স্বামীর হাতে নিয়ে দিতে হয়। আর স্বামী তোয়ালের বদলে পুরো বউটাকেই ভেতরে নিয়ে নেয়।এটা হলো তোয়ালে আদান প্রদানের আসল প্রটোকল।

আদ্রর হেয়ালি পূর্ণ কথা অমালিয়ার রাগের আগুনে আরও ঘী-এর কাজ করলো। সে ফুঁসে উঠে বলল,
–নোংরা মনের মানুষের মাথায় সবসময় শুধু নোংরা চিন্তাই চলে। তোমার মতো জঘন্য মানুষের কাছ থেকে আর আশাই কী করা যায়। তোমাকে কতবার বলেছি গোসল করে নিজের তোয়ালে ওয়াশরুমে ফেলে রাখবেনা। তোমার তোয়ালে দেখলেও আমার ঘেন্না হয়।

আদ্রর মুখে আঁধার নেমে এলো। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। মেয়েটা তাকে বিষাক্ত কাটার ঘাঁ দেওয়ার একটা সুযোগও ছাড়েনা।ওই ঘটনা কিছুতেই ভুলতে দেয়না। বারবার সেই একই জায়গায় নিয়ে থামিয়ে দেয় সব। কী আর করার, এসব ওরই কর্মের ফল। ও যে অপরাধ করেছে তার তুলনায় তো এসব কিছুই না। হয়তো সারাজীবনই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে ওকে। আদ্র কাটার আঘাত হজম করে নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–আচ্ছা সরি,আর হবেনা। তুমি প্লিজ রাগ করোনা। তুমি গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও। সমস্যা নেই আমি টেবিলে থাকবোনা। আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি প্লিজ না খেয়ে থেকোনা।

আদ্র ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাগে দুঃখে বিছানায় গিয়ে ঠাস করে বসে পড়লো অমালিয়া। গত আটমাস হলো আদ্রর সাথে কঠিন থেকে কঠিনতম ব্যবহার করছে সে। ও এতো এতো বাজে কথা শোনায় আদ্রকে। তবুও ওর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়না সে। উল্টো সে আরও ওর সবসময় কেয়ার করে। আর এই জিনিসটাই অমালিয়ার রাগ বাড়িয়ে দেয়। লোকটা এমন কেন করে? এতো খারাপ ব্যবহারেও কেন তার কষ্ট লাগেনা? একতরফা ভাবে বাজে ব্যবহার করতে করতে কেমন যেন হয়রান হয়ে গেছে অমালিয়া। সেতো চায় ওই লোকটাকে অশান্তিতে দেখতে। দূর্দশায় দেখতে চায় তাকে। কিন্তু তা হয়না কেন? আমি কী এখানেও অপারগ হয়ে গেলাম। উল্টো ওই লোকের যত্নসুলভ আচরণ দেখলে কোথাও না কোথাও নিজেরই কেমন খারাপ লাগা কাজ করে। যারজন্য নিজের ওপরই চরম রাগ হয় অমালিয়ার। যে আমার সাথে এতবড় অন্যায় কাজ করলো,যারজন্য আপু আমাকে পর করে দিলো। সেদিনের পর আপু আর কথা বলেনা আমার সাথে। দেখা হলেও পাশ কেটে এড়িয়ে চলে যায়। আর যার কারণে এসব হলো আজ তার প্রতিই নাচাইতেও কেমন মায়া কাজ করে। এটা ভাবতেই নিজের ওপরই ঘৃণা হয় অমালিয়ার।

আদ্র নিচে আসতেই দেখলো ওর মা সোফায় বসে টিভির দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। টিভিতে আদিত্যর সিনেমা চলছে। ছেলেকে দেখেই তিনি কাঁদছেন বুঝতে পারলো আদ্র। এগিয়ে গিয়ে বসলো মায়ের পাশে। মায়ের চোখের পানি মুছে বলল,
–এভাবে কাঁদলে কী ভাইয়া ফিরে আসবে মা?

রেহনুমা ব্যাথিত কন্ঠে বললেন,
–তাহলে কী করলে ফিরে আসবে বলনা? মায়ের জন্য কি ওর একটুও মায়া হয়না? একবারও কী আমাদের কথা মনে হয়না ওর? আজ আট টা মাস হলো বাড়ি ছেড়ে গেছে।তারপর একদিনের জন্যও এলোনা দেখা করতে। ফোন করলেও ধরে না।মা নাহয় একটু ভুল করেছিল।নাহয় ছেলের জন্য একটু স্বার্থপর হয়েছিল। তাই বলে তার এতবড় শাস্তি দিবে ও?

আদ্র অপরাধী সুরে বলল,
–তোমার কোনো দোষ নেই মা। সব দোষ আমার। আমার একটা ভুলের জন্য আজ সবার জীবন উলোটপালোট হয়ে গেল। ভাইয়া আর নূরের মাঝে দূরত্বও হয়েছে হলো আমার কারণে। আমার অপরাধের শাস্তি আজ ভাইয়া পাচ্ছে। এরজন্য নিজেকে আমি কখনো মাফ করতে পারবোনা। এমন হবে জানলে আমি পুলিশের কাছেই আত্মসমর্পণ করে দিতাম। লিয়া ঠিকই বলে, আমি আসলেই একটা জঘন্য মানুষ।
__

নূরের জীবনে এই কয়মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভালো নাম্বারের সাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেছে তার। আর সে তার স্বপ্নও পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার সেই গাড়ি সে তৈরি করতে পেরেছে। দেশের বড়ো এক কোম্পানি তার সাথে কোলাবোরেশান করেছে।আরও বেশি করে গাড়ি তৈরি করে মার্কেটে আনার জন্য ইনভেস্ট করছে। দেখতে গেলেতো তার জীবনে এখন সফলতার বহর এসেছে। সুখী হওয়ার সময় এসেছে। তবুও এতকিছুর পরও দিনশেষে সে শূন্যতায় ডুবে যায়।সেদিনের পর থেকে নূর নিজেকে আরও শক্ত করে নিয়েছে। অনুভূতিহীন পাথরে তৈরি করেছে নিজেকে। কাজের মাঝে নিমজ্জিত করে দিয়েছে নিজেকে। যার ফলস্বরূপ পেয়েছে আজকের সফলতা।ওর সংঘর্ষ সফল হয়েছে আজ। উপরে উপরে দেখতে গেলে সে এখন সর্বসুখী। তবে কেউ জানে না তার ভেতরের সত্তাটা আজও বিষন্নতার নিচে গুমরে মরছে। না চাইতেও আদিত্যর শূন্যতা ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওকে। চেয়েও পারেনা ওই বেঈমান লোকটাকে ভুলতে। কেন যেন মনে হয় এতকিছুর পরও তাকে এখনো ঘৃণা করতে পারেনি ও। আর এই মনোভাবের জন্য নিজের ওপরই চরম রাগ হয় নূরের। একটা মানুষ ওকে এতটা কীভাবে বশ করতে পারে? দূরে গিয়েও কীভাবে এতো প্রভাব ফেলতে পারে? তবুও নিজেকে আর ওই দূর্বলতায় গলতে দিবেনা। ফেলে আসা ওই গলিতে আর যাবেনা সে।

ইনভেস্টিগেটর দের সাথে মিটিংয়ে এসেছে নূর। এস এস কোম্পানির সিইও সোহান সোহরাব এসে নূরের সাথে হাত মিলিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
–গুড মর্নিং মিস নূর।

নূর সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল
–গুড মর্নিং। ক্যান উই স্টার্ট?

–ইয়া শিওর।

সোহান চেয়ারে বসলো। নূর ওর ল্যাপটপ থেকে প্রজেক্টরে সব ডিটেইলস দেখাতে লাগলো। সোহান প্রজেক্টরে দেখছে কম,নূরের দিকেই বেশি চোখ যাচ্ছে তার। নূরের মতো এমন রুপে, গুণে, প্রতিভা, সাহসিকতায় পরিপূর্ণ নারীকে সে এর আগে কখনো দেখেনি। মেয়েটার মাঝে একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। না চাইতেও আকর্ষিত করে। নূরের প্রেজেন্টেশন শেষে সোহানসহ মিটিং রুমের সবাই হাতে তালি দিয়ে প্রশংসা জ্ঞাপন করলো নূরকে। সোহান বলে উঠলো,
–তো সবতো ঠিক ঠাক আছে। তাহলে এখন প্রোডাক্টের প্রমোশনের জন্য একটা কমার্শিয়াল অ্যাড তৈরি করা জরুরি। এই ব্যাপারে কোনো সাজেশন আছে আপনার?

অ্যাডের কথা আসতেই নূরের হঠাৎ আদিত্যর কথা মনে পড়ে গেল। সেই খেয়াল ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে নূর বলে উঠলো,
–সেটা আপনারা যা ভালো বোঝেন, করেন। আপনাকে তো আগেই বলেছি এসব ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবোনা৷

–হ্যাঁ বলেছিলেন,আর তাই আপনাকে আর পেরেশান বা করে আমি নিজেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অ্যাড শুটের জন্য মডেলও সিলেক্ট হয়ে গেছে। আজই শুরু হবে কাজ। এখুনি হয়তো চলে আসবেন উনি?

–উনি? কে উনি?

সোহান নাম বলতে যাবে ঠিক তখনই দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
–আরে ওইতো চলে এসেছেন উনি।

নূর দরজার দিকে তাকাতেই থমকে গেল সে।

চলবে……