শ্যামসুন্দর স্বপ্ন পর্ব-০২

0
318

#শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_২
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

রফিকের মৃতদেহ দেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার স্ত্রী সামিয়া সুলতানা। সাহেরা মানসিক হাসপাতালটা সামিয়া সুলতানার নামে। তার বাবা মানসিক রোগীদের চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসা করতে করতে একটা সময় পর মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের খুব ভালোবেসে ফেলেছেন, সেজন্য তাদের জন্য তৈরি করা এই মানসিক হাসপাতাল। আজ সেই হাসপাতালে তার জামাতা রফিক শেখের মৃতদেহ পাওয়া গেলো।
তদন্তের দায়িত্ব পড়লো রাজ নামক একজন অফিসারের হাতে। রফিকের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হলো। রাজ সবাইকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তাতে যতটা জানা গেলো রফিক শেখ নিতন্তই একজন ভালো মানুষ। সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার, রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য সে সবার কাছে ভালো মানুষই বটে। তার কোন শত্রু আছে বলে জানা যায় নি।

রাজ সামিয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু সামিয়া মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলো। কথা বলার মতো শক্তি নেই। রাজ তাকে একটু সময় দিয়ে বললো,“আমরা বরং কাল দেখা করি”।
সামিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। রাজ হাসপাতালটা ভালোভাবে তল্লাশি করতে লাগলো। তার সাথে তার পুরো টিম আছে।

রাজ তল্লাশি করতে করতে একটা রুমে চলে এলো। আশেপাশের ঘরগুলোতে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের দেখা গেলো। কিন্তু এ ঘরটি ফাঁকা। ঘরটি ফাঁকা তাতে অবশ্য রাজের কোন ভাবান্তর নেই। তবে ঘরটির দেয়ালের উপর লেখা একটি বাক্য রাজকে বিষ্ময়িত করলো। রাজ পলকহীনভাবে বাক্যটির দিকে তাকিয়ে রইলো। দেয়ালে লাল রং দিয়ে লেখা,“চোখের জলে শ্যামসুন্দর স্বপ্ন হাসে”।
রাজ বিরবির করে দু’বার বাক্যটি বললো। বাক্যটি রাজের খুব ভালো লাগলো। কে জানে কোন মানসিক রোগী কি বোঝাতে এমন একটি বাক্য লিখেছে? হয়তো কোন কারন ছাড়াই লিখলো। কেননা এখানে যারা আছে তারা কারনে অকারনে অনেক কিছুই বলে, করে, লিখে।

কিছুক্ষনের মধ্যে সুফিয়ান এবং নুরের বিবাহ সম্পন্ন হবে৷ তার পূর্বে সুফিয়ান একান্তভাবে নুরের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানালো। প্রথমে নুরের বাবা, মা রাজি না হতে চাইনি তবে পরে সকলে বলায় রাজি হলো।
নুর এবং সুফিয়ানকে এক ঘরে কথা বলতে পাঠানো হলো। সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক উল্টোপাশে ভয়মিশ্রিত মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুর। এখনো মাথায় ঘোমটা দেওয়া। ঘোমটাটা এমনভাবে দেওয়া, যার জন্য মুখশ্রীর অর্ধেক ঘোমটার আড়ালে ডাকা পড়ে গেছে। সুফিয়ান শান্তকন্ঠে বললো,“দেখি আমাকে ঘায়েল করা আপনার সেই রূপসী মুখশ্রী”।
সুফিয়ান বাক্যটি বলে নিজেই নুরের কাছে এগিয়ে এসে মাথা থেকে ঘোমটাটি টেনে খুলে ফেললো। নুর ভয়, বিষ্ময় নিয়ে সুফিয়ানের মুখশ্রীতে তাকালো। সুফিয়ান কয়েক মূহুর্তের জন্য নুরের মুখশ্রীতে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো।
দুধে আলতা গায়ের রং, টানা টানা হরিণির মতো আঁখিযুগল, গোলাপের ন্যায় ওষ্ঠযুগল, ওষ্ঠের ডান পাশে ছোট্ট একটি কালো তিল। সবমিলিয়ে ঘায়েল করা রুপই বটে।
অন্যদিকে নুর তার সামনে দাঁড়ানো বলিষ্ঠ যুবকটিকে দেখতে লাগলো।
সুফিয়ানের কথায় নুরের ধ্যান ভাঙলো,“ঘায়েল করা রুপ বটে তবে সুফিয়ান ফরাজিকে রুপ দিয়ে ঘায়েল করা যায় না”।
নুর নিরব চাহনি দিয়ে সুফিয়ানের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। সুফিয়ান হঠাৎ নিজের রুপ বদলে খুব শক্ত করে নুরের বাহু দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলো। নুর কিছুটা ব্যাথা পেলো তাই ‘আহ’ বলে উঠলো। সুফিয়ান খুব রাগ নিয়ে বললো,“লজ্জা করে না নিজেকে কলঙ্কিত করে একজন পুরুষকে বিবাহ করতে। বলো কেন এরকম মিথ্যে নাটক সাজিয়েছো”?
“আমি কোন মিথ্যে বলিনি”।
“তারমানে তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি তোমাকে……”।
সুফিয়ান বাক্যটি শেষ করার পূর্বেই নুর সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। খুব শক্তভাবে। ভয় পেলে মানুষ যেভাবে একজনকে আকড়ে ধরে ঠিক সেভাবে। সুফিয়ান বেশ অবাক হলো। মনেমনে বললো,“মেয়েটার তো আমাকে ভয় পাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমাকে যেভাবে আকড়ে ধরে আছে, মনে হচ্ছে সে অন্যকাউকে ভয় পাচ্ছে”।
সুফিয়ান আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। সুফিয়ান দরজার দিকে চোখ দিতেই একটা ছায়া চলে যেতে দেখলো। সুফিয়ান বিরবির করে বললো,“কে ছিলো”?

সেদিনই নুর এবং সুফিয়ানের বিবাহ সম্পন্ন হলো। নুর বধু বরন শেষ করে ফরাজি বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করলো। অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই সুফিয়ানের আম্মা মেহরুন বেগম বললেন,“ফরাজি বাড়ির অন্দরমহলে তো প্রবেশ করলে, সামলাতে পারবে তো এ বাড়ির ছোট বৌয়ের দায়িত্ব”?
নুর মুচকি হেসে বললো,“চেষ্টা করবো সবকিছু বদলানোর”।
“মানে”?
“আপনার ছেলের চরিত্র”।
মেহরুন বেগম তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,“আমি বিশ্বাস করি আমার শিক্ষায় কোন ভুল নেই। পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার সুফি নয়”।
“মায়ের ভাষায় না বলে নারীর ভাষা বলুন। তবে খারাপটা খুব সহজেই প্রকাশ পাবে”।
মেহরুন বেগম নুরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো।

নুরের সাথে ফরাজি বাড়ির সবার টুকটাক পরিচয় হলো। দেলোয়ার ফরাজি তার স্ত্রী মেহরুন বেগম এবং তাদের সন্তান সুফিয়ান ফরাজি, সাথে তার ভাই সাহেদ ফরাজি তার স্ত্রী রোকসানা বেগম এবং তাদের সন্তান সুমন ফরাজি তার স্ত্রী রাইমা এই নিয়ে ফরাজি পরিবার গঠিত। এই পরিবারের নতুন সদস্য নুর।

ফুলে সজ্জিত বাসর ঘরে বসে আছে নুর। সাধারনত এই দিনে স্ত্রী তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু নুর চাইছে তার স্বামী জানো এ ঘরে প্রবেশ না করে।
নুরকে নিরাশ ঘরে সুফিয়ান বাসর ঘরে প্রবেশ করলো। নুর ভয় নিয়ে বিছানার এককোনায় গিয়ে বসে পড়লো। সুফিয়ান শব্দ করে হেসে বললো,“আমি জানতাম বাসর ঘরে স্ত্রী স্বামীর কাছাকাছি আসে কিন্তু এখানে তো অন্যকিছু ঘটছে”।
নুর ভয় নিয়ে বললো,“আমি আসলে….”।
“কি ভয় পাচ্ছো”?
একটু থেমে সুফিয়ান পুনরায় বললো,“উঁহু ভয় পাওয়ার তো কোন কারন নেই। বাসর ঘরে যা হয় তা তো আমাদের পূর্বেই হয়ে গেছে। এটাই তো তুমি বললে সবার সামনে। তাহলে ভয় পাচ্ছো কেন”?
সুফিয়ান এক পা এক পা করে নুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নুরের ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান শান্ত কন্ঠে বললো,“আমি যখন তোমায় একলা ঘরে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম তখনও তুমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলে। এখন ভয় পাচ্ছো কেন”?
নুর যখন সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরছিলো তখন সুফিয়ান শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেছিলো নুর তাকে কেন ফাঁসাচ্ছে? তখন নুরের জবাবা ছিলো সে সত্যি বলেছে। এজন্য সুফিয়ান উপরোক্ত কথাটি বললো।
নুর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,“আমি জানি না আপনি এত ধীর কন্ঠে নিজেকে কিভাবে নির্দোষ দাবি করছেন? আমি সত্যি জানি না আমার সাথে কি হচ্ছে? শুধু এতটুকু জানি কালরাতের অন্ধকারটা আমার জীবনে সত্যি এসেছিলো। এটা মিথ্যে নয়”।
সুফিয়ান রাগ নিয়ে বললো,“তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস আমি ধর্ষ*ক”।
“কালরাতে অন্তত তাই ছিলেন”।
“তো দেখ ধর্ষ**ন কিভাবে করে”?
সুফিয়ান অত্যধিক পরিমান রাগ নিয়ে নুরের দিকে এগিয়ে গেলো।

সারারাত কান্না করেও নুর ছাড়া পেলো না। পরিশেষে মনকে বুঝ দিলো,“স্ত্রী না হয়েই যে যন্ত্রনা ভোগ করেছি, সেখানে স্ত্রী হয়ে ভোগ করাটা তো স্বাভাবিক”।
_______
খুব সকালে রাজ চলে এলো সামিয়ার কাছে। সামিয়া এবং রাজ মুখোমুখি বসে আসে। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে রাজ জিজ্ঞেস করলো,“আপনাদের কোন শত্রু ছিলো, যে রফিক সাহেবকে খুন করতে পারেন”?
“না। আমাদের শত্রুর চেয়ে বন্ধু ছিলো”।
“বন্ধুই যদি থাকে তবে কে রফিক সাহেবকে খুন করলো? নিশ্চয় কোন বন্ধু এ কাজ করবে না”?
“আমাদের অজান্তে আমাদের কোন শত্রু জন্ম নিলে সেক্ষেত্রে আমার বলার মতো কিছু নেই”।
“কিছু মনে না করলে, আপনাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কে কেমন ছিলো”?

“খুব ভালো এবং সুখী দম্পতি ছিলাম আমরা। আপনি নিশ্চয় আমাকে খুনি ভাবছেন না”?
“এই ধরনের কেসে অনেককিছুই ভাবতে হয়”।
“তবে বলবো আপনি মরিচীকার পিছনে ছুটছেন”।
“মাঝেমধ্যে মরিচীকারাও অনেক কিছু বলে যায়”।
“এক্ষেত্রে বলবে না”।
“দেখা যাক। তা আপনাদের হাসপাতাল নিয়ে কারো সাথে ঝামেলা হয়েছে এরকম কোন ঘটনা আছে”?
“না। আমি আবারো বলছি আমার জানা মতে আমাদের কোন শত্রু নেই”।
“হ্যাঁ শুনলাম। তা আপনাদের সম্পর্ক সত্যিই খুব ভালো ছিলো”?
“হ্যাঁ। আপনি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমরা খুব সুখী দম্পতি ছিলাম, আছি থাকবো। হয়তো মানুষটা থাকবে না আর পাশে”।
“এতটাই সুখী দম্পতি যখন তখন আপনার স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত হলো কেন”?
“মানে”?
সামিয়া বিষ্ময় নিয়ে রাজের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। রাজ মুচকি হেসে সামিয়ার সামনে একটি ছবি তুলে ধরলো। যেখানে রফিক সাহেবকে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় একটি মেয়ের সাথে দেখা যাচ্ছে।
“এটা কি? রফিক আমাকে ঠকাচ্ছিলো”?
“আপনার স্বামীর কীর্তি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না”?
সামিয়া মাটিতে বসে পড়লো। কান্নারত কন্ঠে বললো,“এই ছবিটা সত্যি নয়। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ। আপনি আমার স্বামীর খুনিকে খুঁজে না বের করে উল্টাপাল্টা কাজ করছেন”।
রাজ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সামিয়ার মুখশ্রীতে। শান্তভাবে বললো,“চিন্তা করবেন না, খুনি এবং খুনের কারন দুটোই বের করবো”।
রাজ সামিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। সামিয়া বেশ অবাক হলো রাজ তাকে আর কোন প্রশ্ন না করে চলে গেলো।

রাজ ময়না তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে বাসায় চলে এলো। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রিপোর্টে পরিস্কার রফিক সাহেবের গলা কাটার সময় সে অজ্ঞান ছিলো। প্রথমে তাকে অজ্ঞান করা হয় তারপর গলা কাটা হয়। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয় প্রশ্ন হলো, “খেলা শুরু” এর মানে কি? এরমানে এই খু*নটা দিয়ে শেষ নয় শুরু। রাজের মন বলছে নতুন কিছু ঘটতে চলেছে।

চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)