শ্যামসুন্দর স্বপ্ন পর্ব-০১

0
486

#শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#সূচনা পর্ব
#নুশরত_জাহান_মিষ্টি

যুবতি মেয়ের বিছানায় বলিষ্ঠ এক যুবককে অর্ধনগ্ন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ চমকালেন রহিম এবং তার স্ত্রী রাহেলা। ঘরটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলেন, ঘরের এককোণে তাদের মেয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। রাহেলা বেগম দৌড়ে মেয়ের কাছে গেলেন। রাহেলা বেগম মেয়ের কাছে যেতেই মেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। রাহেলা বেগম আস্তে করে মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,“কি হয়েছে”?
মেয়ে মায়ের মুখশ্রীতে নিরব চাহনি দিয়ে তাকিয়ে রইলো। রাহেলা বেগম বুঝলেন, মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে তাই শোকে নির্বাক হয়ে গেছে।

রহিম সাহেব বিছানায় শুয়ে থাকা যুবকটির মুখশ্রী দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলেন। অস্পষ্ট সুরে মুখ দিয়ে বের হলো,“ছোট সাহেব”।

ফরাজি বাড়ির উঠানো দাঁড়িয়ে আছে রহিম, তার স্ত্রী। রাহেলা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে বসা দেলোয়ার ফরাজি। পাশে তার ভাই সাহেদ ফরাজি। অন্য পাশে দাঁড়ানো সুমন ফরাজি এবং সুফিয়ান ফরাজি, সাথে গ্রামের কিছু লোকজন।
রহিম সাহেব মেয়ের মুখে তার করুন পরিনতির কথা শুনে সাথে সাথে আশেপাশের প্রতিবেশিকে ডেকে নিয়ে আসেন। তখনি তারা যুবকটিকে ঘুম থেকে তোলা হয়নি। রহিম সাহেব বেশ বিচক্ষন মানুষ, তিনি বুঝে গেছিলেন তার মেয়ের জীবনে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। প্রমাণ ছাড়া সেই অন্ধকারের গল্পটা কেউ শুনবে না। সবাই তার মেয়ের অঙ্গেই কলঙ্ক ছড়াবে, কেননা তার কলঙ্কের জন্য যে দায়ী সে তাদের গ্রামের প্রধান দেলোয়ার ফরাজির ছোট ছেলে সুফিয়ান ফরাজি। তাই তৎক্ষনাৎ প্রতিবেশি ডেকে এনে সুফিয়ানকে হাতেনাতে ধরিয়ে দেয়।

এখন সবাই দেলোয়ার ফরাজির সামনে বিচারের আসায় দাঁড়িয়ে আছে।
দেলোয়ার ফরাজি ক্ষমতাশীল ব্যক্তি হওয়ার সুবাদে গ্রামে তার প্রভাব একটু বেশিই। গ্রামের সাধারণ লোকজন তার কাছে ভালো, খারাপ দু’টো পরামর্শের জন্যই আসে। দেলোয়ার ফরাজি তাদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সেই সুবাদে দেলোয়ার ফরাজি গ্রামের সবার প্রধান হিসাবে গন্য হন। সবাই তার কথা মান্যগন্য করেন। সবাই জানে দেলোয়ার ফরাজি কখনো অন্যায়কে সমার্থন করেন না। তাই তো সবাই ন্যায় বিচারের জন্য তার কাছে ছুটে এসেছে। যদিও সবাই জানে দেলোয়ার ফরাজি ন্যায় বিচারই করবেন। তবুও কারো কারো মনে সংশয় বাসা বাঁধছে৷ যতই হোক এবারের অপরাধী তার নিজের সন্তান।

বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করছিলো বিচারসভায়। নিরবতা ভেঙে দেলোয়ার ফরাজি বললেন,“রহিম মিয়া তোমার মেয়ের সাথে কি হয়েছে? আজকের এই বিচারসভা কেন ডাকা হয়েছে”?
সবার মনে সংশয়টা আরো বেশি করে বাসা বাঁধছে। রহিম সাহেব বলতে লাগলেন,“বড় সাহেব আপনারে আমরা ভালো মানুষ বইলাই জানি৷ আমরা আপনারে সম্মান করি বইলাই আমাগো বড় সাহেব বইলা মানি। আপনার পোলারে আমরা সবসময় সম্মানের চোখে দেখে আসছি। সবসময় ছোট সাহেব বইলা জানছি”।
সাহেদ ফরাজি বলে উঠলেন,“এসব কথা না বলে আসল কথা বলো”।
রহিম সাহেব পুনরায় বললেন,“কাল বিকালে আমি আর আমার বউ ছোড মাইয়াডা লইয়া আমার শশুড়বাড়ি গেছি, বড় মাইয়াডা বাসায় ছিলো। সকালে আইসা আমরা ঘরের দরজা খোলা পাইয়া ভিতরে ডুইকা দেখি, আপনার পোলা আমার মাইয়ার ঘরে। আর আমার মাইয়া বিধ্বস্ত অবস্থায়…..”।
রহিম সাহেব কেঁদে দিলেন। বাকিটা সম্পন্ন করতে পারেননি। সুফিয়ান নিজের রাগী দৃষ্টি রহিম সাহেবের দিকে দিয়ে বললো,“রহিম চাচা মিথ্যে বলছেন, এসব সত্যি নয়”।
দেলোয়ার ফরাজি বললেন,“তবে তুমি বলো সত্যিটা কি”?
লোকজনের ভিতর কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে দেলোয়ার ফরাজি তার ছেলের হয়ে রায় দিবেন, তাই হয়তো ছেলের থেকে জানতে চাচ্ছেন। দেলোয়ার ফরাজি পুনরায় বললেম,“বিচারকার্যে দোষী এবং বাদী উভয়ের কথাই শোনা উচিত। আমার পূর্বের বিচার এভাবেই সম্পন্ন হয়েছে, আজকেও তাই হবে। আপনারা কেউ চিন্তা করবেন না দোষী উপযুক্ত শাস্তি পাবে”।
সবাই চুপ করে গেলো। মনে মনে ভরসা পেলো দেলোয়ার ফরাজির কথায়।
সুফিয়ান বলা শুরু করলো,“কাল রাতে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রহিম চাচার সাথে দেখা হয়। তিনি বললেন চাচী খুব অসুস্থ আমি যদি একবার তাকে দেখে যাই। আমি তাই রহিম চাচার বাসায় গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি চাচী পেটে হাত দিয়ে চিৎকার করছে। আমি তাকে দেখছিলাম, একটা ঔষধের নাম লিখে দিলে রহিম চাচা সেটা আনতে যায়। যাওয়ার পূর্বে আমাকে বলে যায়, সে ফিরে না আসা অব্দি জানো আমি এখানে থাকি। আমি তার কথা রাখতেই সেখানে থেকে গেলাম। আমি পানি চাইলে বাচ্চা মেয়েটি আমার জন্য পানি নিয়ে আসে। পানি খাওয়ার পর আমার কি হলো আমি জানি না? আমার তারপর কিছু মনে নেই। আমি এটাও জানতাম না রহিম চাচার বড় একটি মেয়ে আছে। তাছাড়া আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি, এখনো অব্দি আমি ঐ মেয়ের মুখশ্রী দেখেনি যার সাথে আমাকে জড়ানো হচ্ছে”।
সুফিয়ানের কথা শেষ হতেই রহিমের এক প্রতিবেশী বলে উঠলো,“আপনের কথা ঠিক না। রাহেলা যখন বিকালে বাপের বাড়ি যাচ্ছিলো তখন ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে। ও আমাকে বইলাও গেছিলো বড় মেয়েটারে রেখে যাচ্ছি একটু দেখো”।
রাহেলা বেগম তার কথায় সাঁয় দিলেন। গ্রামের সব লোকজনই সুফিয়ানকে মিথ্যাবাদী বলতে লাগলো। কারন তারা স্বচক্ষে সুফিয়ানকে মেয়েটির ঘরের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছে। সুফিয়ান নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য বললো,“যার সাথে ঘটনা ঘটেছে সে কেন চুপ করে আছে? আপনারা নিজেরা না বলে মেয়েটিকে বলার সুযোগ দিন। সে বলুক কালরাতে তার সাথে কি হয়েছিলো”?
সুফিয়ান বিশ্বাস করে কোন মেয়ে নিশ্চয় বিনা কারনে নিজের সম্মান নষ্ট করবে না। মানুষ তো কলঙ্কিত হয়েও স্বীকার করতে চায় না, সেখানে কলঙ্কিত না হয়ে নিশ্চয় বলবে না সে কলঙ্কিত।
সুফিয়ানের কথা শুনে রাহেলা বেগম বললেন,“আমার মাইয়াডা শোকে পাথর হইয়া গেছে। নিজ মুখে কেমনে ঘৃণ্য কাহিনি বলবে সে”?
সুফিয়ান জোরালো কন্ঠে বললো,“আপনাদের মতো মিথ্যে বলতে পারবে না সেজন্য আটকাচ্ছেন তাই তো? আর যাই হোক নিজেকে কলঙ্কিত করতে অন্তত তার জবান কাঁপবে তাই তাকে বলতে দিচ্ছেন আপনারা”?
সুফিয়ানের জোরালো কন্ঠ শুনে রহিম এবং তার স্ত্রী চুপ করে গেলো। দেলোয়ার ফরাজি মেয়েটিকে বলার জন্য আদেশ দিলেন। রাহেলা বেগম মেয়ের হাত ধরে রইলেন। মেয়েটি আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,
“কাল রাতে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে খুলে দিতেই ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। পানি চাওয়ার বাহনায় ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, আমি বাঁধা দেওয়ায় ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দেয়। তারপর…… (কান্না করে দিলো)। আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছি”।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। একজন প্রতিবেশী আক্ষেপের সুরে বলতে লাগলেন,“মেয়েরি সুন্দরী হওয়ায় সবসময় লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতো রাহেলা। আড়ালে রেখে লাভ কি হলো সেই ক্ষতি তো হলোই”?
রহিম সাহেব কান্নারত কন্ঠে বললেন,“বড় সাহেব আমার মাইয়ার এহন কি হইবো”?
সুফিয়ান চিৎকার দিয়ে বললো,“আমি কিছু করিনি। মেয়েটি মিথ্যে কথা বলছে। আব্বা আপনি তো জানেন, আমি কেমন চরিত্রের মানুষ। গ্রামের সবাই জানে সুফিয়ান ফরাজির চরিত্রে কোন দোষ নেই”।
সভার মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো,“মাইয়ার রুপ হয়তো তোমার চরিত্রে দোষের সৃষ্টি করছে”।
সুফিয়ান অবাক চাহনি দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। ওড়না দিয়ে এমনভাবে ঘোমটা দেওয়া, যার কারনে মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে না।
সুফিয়ানের মন হঠাৎ বলে উঠলো,“সুফিয়ান ফরাজির চরিত্র হরন করার মতো রুপসী এই মেয়ে”।
পরক্ষনেই অন্যমন বলে উঠলো,“না অসম্ভব”।
উপস্থিত গ্রামবাসীর কথোপকথনে বোঝা যাচ্ছে সবাই সুফিয়ানের শাস্তি চাচ্ছে। সুফিয়ান নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার এই মূহুর্তে বলার মতো কিছু নেই।

সবকিছু শুনে দেলোয়ার ফরাজি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার নাম কি”?
রাহেলা বেগম বলে উঠলেন,“ওর নাম নুর-ছাকিন”।
দেলোয়ার ফরাজি পুনরায় বললো,“নুর তুমি বলো তুমি সুফিয়ানের কি শাস্তি চাও”?
রাহেলা কিছু বলতে নিলেই দেলোয়ার ফরাজি হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,“নুরের কাছে প্রশ্ন করেছি”।
নুর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,“আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ ওনি কেঁড়ে নিয়েছেন। ওনাকে শাস্তি দিলে কি আমি সেটা ফেরত পাবো? পাবো না। পরবর্তীতে দেখা যাবে আমার বিবাহর বয়স পার হয়ে যাবে কিন্তু বিবাহ হবে না। কারন কলঙ্কিত নারীকে কেউ ঘরনি করতে চায় না। তাই আমি চাই ওনি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে, আমার যে সম্মান কেঁড়ে নিয়েছে সে সম্মান ফিরিয়ে দিক”।
সুফিয়ান বিষ্ময় নিয়ে নুরের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমাকে অন্য যেকোন শাস্তি দেওয়া হোক, তবুও এ শাস্তি নয়। আমি সারাজীবন এমন একটা মেয়ের সাথে কাটাতে পারবো না, যার কাছে নিজের ইজ্জত বাজারের পন্যের মতোই সস্তা”।
দেলোয়ার ফরাজি ধমকের সুরে বললো,“সুফিয়ান”।

সুফিয়ানের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে তার সাথে নুরের বিয়ে ঠিক করা হলো। গ্রামের মানুষজন সাধারণ, তাদের মতে এটাই ঠিক কাজ। এতে নুরের সম্মান বেঁচে যাবে বলে তাদের ধারনা।
___________
সাহেরা মানসিক হাসপাতাল। হাসপাতালের ডাক্তার রফিকের রুমে পড়ে আছে তার গলা কাটা মৃতদেহ। মৃতদেহের পাশে রক্ত দিয়ে লেখা,“খেলা শুরু”।

চলবে,