শ্যামসুন্দর স্বপ্ন পর্ব-০৮

0
214

#শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_৮
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

সকালে দেলোয়ার ফরাজির উঠানে বৈঠক বসেছে। গ্রামের প্রায় লোকই সেখানে উপস্থিত। দেলোয়ার ফরাজি ঠান্ডা মাথায় সবার উদ্দেশ্য বললো,“আমার কোন সিদ্ধান্ত আজ অব্দি কারো জন্য খারাপ হয়নি। আপনারা আমার সকল দিক বিবেচনা করেই যেকোন সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি আসা রাখছি কেউ একপাক্ষিক কোন কথা বলবেন না।”
“তা নাহয় বুঝলাম বড় সাহেব। আমরা আপনার সব সিদ্ধান্ত সবসময় মেনে এসেছি, এতে আমাদের লাভ বটে ক্ষতি হয়নি।”(এক লোক বললো)
পাশ থেকে অন্য একজন বললো,“তাই বলে আপনার সব সিদ্ধান্ত সঠিক বলে যে সব শিক্ষা ঠিক তা কিন্তু নয়। আপনার শিক্ষায় ভুল আছে বলেই আপনাদের সন্তানদের পরিনতি এরকম হচ্ছে। কথায় বলে বাহির ঠিক করার পূর্বে ঘর ঠিক করা উত্তম। আপনি তো ঘর ঠিক করতে ব্যর্থ সেখানে বাহির ঠিক করার আসা রাখা অনুচিত বলে মনে হচ্ছে না।”
“আপনার ছেলে কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, তার কুকর্মের শাস্তি আপনি দিয়েছেন তা ঠিক। তবে বাড়ির ভিতরে আপনি নিজের ছেলের বৌকে নির্যাতন করছেন এটা কোন ধরনের শিক্ষা। আপনি গ্রাম প্রধান হয়ে যদি এমন করেন তবে আমরা কি করবো?”

দেলোয়ার ফরাজি বেশ বিচক্ষন কন্ঠে বললেন,“সবসময় যা দেখা যায় তা সত্যি হয় না। আপনারা কাল যেটা দেখেছেন, সেটা হয়তো সত্যি কিন্তু তার যে মানে বের করেছেন তা সত্যি নয়।”
“তারমানে কালকের ঘটনা আপনি অস্বীকার করছেন?”
“না অস্বীকার করছি না। ঘটনার আসল কারনটা জানাতে চাচ্ছি৷ আপনারা হয়তো আমার কথায় ভরসা পাবেন না তাই আমি আমার বৌমার মুখেই আসল সত্যিটা জানাতে চাই।”

দেলোয়ার ফরাজি সাহেদ ফরাজিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো। সাহেদ ঘরের ভিতর চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেহরুন বেগম নুরকে সাথে নিয়ে সভায় এলো।

সুফিয়ানও সভায় উপস্থিত ছিলো। সুফিয়ান তার বন্ধুকে ইশারা করতে তার বন্ধু গ্রামের চারজন লোককে ইশারা করলো। সুফিয়ান তাদের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,“আমার সন্দেহ ঠিক হলে এরা সবকিছুতে দ্বিমত পোষন করবেন।”

দেলোয়ার ফরাজি নুরকে ইশারা করলো কালকের ঘটনা স্বীকার করতে। নুর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,“আসলে কাল শশুড় মশাই হাতটা আমার মাথায় আশীর্বাদসরুপ তুলেছিলেন। কিন্তু আপনারা ভুল ভেবে নিয়েছেন। আমার স্বামী পুনরায় সঠিক পথে ফিরে আসায়। নিজের সব ভুল বুঝতে পেরে আপনারা আগে যেমন তাকে চিনতেন, সেই রুপে ফিরে এসেছেন। যার জন্য শশুড় মশাই আমাকে আশীর্বাদ করছিলেন, যাতে তার সন্তানকে আমি সঠিক পথ দেখাতে পারি।”

গ্রামের সহজ সরল মানুষদের নুরের এলোমেলো কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও বাধ সাধলো সেই চারজন। তাদের মধ্যে একজন বললো,“ঘর থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা মুখস্থ বিদ্যে নয়তো এগুলো?”

“আপনারা ভুল বুঝছেন।”
“আমরা কোন ভুল বুঝছি না। আপনার ঘরে বধু নির্যাতন আজ প্রথম নয়। এর পূর্বেও নির্যাতন হয়েছে।”
সাহেদ ফরাজি রেগেমেগে বলল,“কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? আমাদের ঘরের বধুরা খুব সুখী হয়, কারন তাদের ফরাজি বাড়ি খুব ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেয়।”

“আপন করার নমুনা এটা বুঝি?”
একজন লোক ফোন থেকে একটি ভিডিও চালু করলো। তাতে কালকের রাতে সুমন এবং রাইমার মধ্যে যা হয়েছে তা দেখা গেলো। ফরাজি পরিবার থ মেরে গেলো।
“এটা হচ্ছে আপনাদের বাড়ির আপন করার নমুনা। যেখানে বধুরা স্বামীদের থেকেই সুখ পায় না।”

অন্য একজন বললো,“স্বামীর থেকে এভাবে নির্যাতিত হয়েই বোধহয় আপনার বড় বৌমা বড় ছেলেকে খুন করেছিলো?”
“মেয়েটা বাকহীন ছিলো বলে আপনারা তাকে পাগল বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন তাই তো?”

ভিডিওটা দেখার পর পুরো গ্রামবাসী ফরাজি বাড়ির বিপক্ষে চলে গেলো। সবাই দেলোয়ার ফরাজিকে যা নয় তাই বলে অপমান করতে লাগলো। সবশেষে গ্রামের প্রধান থেকে সবাই দেলোয়ার ফরাজিকে বাদ দেওয়ার ঘোষনা দিলো।

দেলোয়ার ফরাজির অপমানে আড়ালে আবডালে কেউ তৃপ্তির হাসি হাসে। তার চোখের কোণে তৃপ্তির অশ্রু ধরা দেয়। সে মনেমনে বলে,“প্রথম পদক্ষেপ পূরণ হলো, এবার জমবে আসল খেলা।”

দেলোয়ার ফরাজি থমথমে মুখে বসার ঘরে বসে আছেন। সামনে সুমন ফরাজি এবং রাইমা দাঁড়ানো। সাহেদ ফরাজি কঠিন গলায় বললো,“তোমাদের ঘরের ভিতরের খবর বাহিরে গেলো কি করে?”

সুমন ফরাজি স্বাভাবিকভাবে বললো,“সব এই বেডির কাজ। আমার তো মনে হয় দুধ কলা দিয়ে আমরা এতদিন কাল সাপ পুষেছি। এর মতিগতি আমার কয়েকদিন ধরে ঠিক লাগছে না। আমি নিশ্চিত এসব এই মেয়েটাই করেছে।”

দেলোয়ার ফরাজি কঠিন চোখে রাইমার দিকে তাকালো। সুফিয়ান সবাইকে শান্ত হতে বলে বললো,“সুমন যেটা করেছে সেটা ঠিক করেনি। যদি কোনকিছু ঘটে থাকে তবে তার দ্বায়ভার সুমনের উপর পড়ে। আর এখন মাথা গরম করে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং আমাদের সবার মিলে আসল সত্যিটা বের করা উচিত।”

সবাই সুফিয়ানের কথা সমার্থন করে ঘরে চলে গেলো। রাইমাও যেতে নিচ্ছিলো সুফিয়ান তাকে আটকালো। শান্ত কন্ঠে বললো,“আমার ঘরে এসো, আমার কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”

রাইমা চুপচাপ সুফিয়ানের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

নুর সুফিয়ান পাশাপাশি দাঁড়ানো, সামনে রাইমা কালো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,“আমি যখন পড়াশোনার জন্য বাহিরে ছিলাম তখন এখানে কি কি ঘটেছে? ভাবী আপনার কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি ভয়হীন বলতে পারেন। আমি শুধু আমার আড়ালে ঘটা গল্পটা জানতে চাই। দয়া করে আজ আমার থেকে কিছু আড়াল করবেন না।”

রাইমা চুপচাপ বসে আছে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
_______

সকাল সকাল রাজের ফোনে মেসেজ চলে এলো। তাতে লেখা ছিল,“রাজি আছো?”
রাজ সহজ ভাবে বললো,
“হ্যাঁ। আমাকে কি করতে হবে?”
“ফরাজি গার্মেন্টস নাম শুনেছো?”
“হ্যাঁ।”
“গার্মেন্টস এর মধ্যে দেলোয়ার ফরাজি, সাহেদ ফরাজি, সুমন ফরাজি একসাথে যখন থাকবে।”
রাজ কিছুটা ভয় নিয়ে বললো,“তাদের মারতে হবে?”
“উঁহু। তাদের সাথে একটু খেলতে হবে। মৃত্যুর খেলা। এটা এমন একটা খেলা যেখানে মৃত্যু আসবে মনে হলেও ঠিক আসে না।”
“মানে?”
“সেটা বলে দেওয়া হবে।”
রাজ কিছুটা সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আপনি আমাকে দিয়ে এসব কেন করাতে চান?”
“জীবনের একটা অধ্যায় এরিয়ে না গেলে আজ এই প্রশ্নটা করার প্রয়োজন পড়তো না তোমার। সেদিন যদি এরিয়ে না যেতে, যদি একটু আগ্রহ দেখাতে তবে আজ তুমি নিজেই বুঝতে পারতে তোমার সাথে এসব কেন হচ্ছে।”

রাজ থ মেরে গেলো। জীবনের অধ্যায় সে এরিয়ে গেছে। কই তার তো মনে পড়ছে না? কি এরিয়ে গেছে সে? রাজ বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো।
________
রাইমা তখন থেকেই চুপ করে আছে। রাইমাকে চুপ দেখে নুর বললো,“আমি থাকায় সমস্যা হলে চলে যাচ্ছি।”
“না তেমন নয়। তুমি নতুন এসেছো, তোমাদের সম্পর্কের সূচনা হয়েছে তার গভীরতা বাড়ুক তারপর পুরনো গল্প নিয়ে পড়ো। তাছাড়া যা কিছু হচ্ছে তাতে ওসব ঘটনা জড়ানো নয়, তাই পুরনো কথা বাদ দেওয়াই ভালো।”
সুফিয়ান সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,“ঐ ঘটনা জড়ানো নয় সেটা আপনি জানলেন কিভাবে?”
রাইমা থতমত খেয়ে গেলো। তবুও নিজেকে সামলে নিলো।
“তার তো কোন আপনজন ছিলো না, তাই মনে হচ্ছে এসব তার সাথে জড়ানো নয়।”
সুফিয়ান কিছু বলতে চাইলে রাইমা থামিয়ে দিয়ে বললো,“এরপরো কিছু জানার থাকলে নিজের বাবা-মাকে গিয়ে প্রশ্ন করো।”

সুফিয়ান চুপ করে গেলো। রাইমা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।
নুর সুফিয়ানকে প্রশ্ন করলো,“আপনি আপনার বড় ভাই, তার স্ত্রীর কথা জানেন না?”
“আমার বড় ভাইয়া যখন বিবাহ করে তখন আমি পড়ালেখার জন্য হোস্টেলে ছিলাম। বাবা-মা কেন জানি না আমাকে বিয়ের খবর জানায়নি। যখন বাড়িতে আসলাম তখন জানতে পারলাম ভাইয়া বিয়ে করেছিলো। ভাবী পাগল ছিলো তা তারা বুঝতে পারিনি। ভাবী নিজের হাতে ভাইয়াকে মেরে ফেলেছিলো। তারপর তারা তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠায়।”
“মানসিক হাসপাতাল?”
“হ্যাঁ। সাহেরা মানসিক হাসপাতাল। আমি একবার দেখা করতে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু….।”
“কিন্তু?”
“তার আগে জানা গেলো ভাবী পালিয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে খোঁজ নেওয়া হয়েছিলো কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।”

নুর বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো। সুফিয়ান যে ভাবনায় নেই তা নয়। সেও ভাবনায় আছে। আজ সভায় যখন তার ভাবীকে বাকহীন বলা হয়েছিলো তখন থেকে একটা প্রশ্ন সুফিয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাকে মেসেজ পাঠানো মানুষটি কোনক্রমে তার ভাবী নয়তো।

সুফিয়ান বিরবির করে বললো,“একবার সাহেরা মানসিক হাসপাতালে যাওয়া উচিত্র।”
বিরবির করে বললেও নুর শুনতে পেলো। নুর বললো,“তার পূর্বে আপনাদের বাড়িতে তার সাথে কি হয়েছিলো সেটা জানা জরুরি।”

সুফিয়ান ঘুরে নুরের দিকে তাকালো। শান্তকন্ঠে বললো,“চলো দু’জন স্বাভাবিকভাবে সংসার করি। একসাথে মিলে সমস্যার সমাধান করি।”
“সমস্যার সমাধান করাই যায় কিন্তু সংসার…”
“সেটা করা যায় না?”
“জোর করে জোড়া সংসার আদো হয় কখনো স্বাভাবিক। সেখানে কি ভালোবাসার জন্ম হয়?”

“চাইলে হয়। মানুষ মানিয়ে নেওয়া শব্দটায় বেশি বিশ্বাসী। মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে ভালোবাসার জন্ম হয়। আমরা চাইলে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার জন্মানো সম্ভব।”
“ভালোবাসাটা না জন্মানোই ভালো। ভালোবাসা সে তো বড় বেদনার ডাক।”

নুর একমনে কথাটি বললো। সুফিয়ান জবাবে বললো,“বেদনার অশ্রুতে পদ্ম ফুল ফোটে কবিরা বলে।”
“কোন কবি এমন উদ্ভট কথা বলছে?”
“অবশ্যই আমি।”
বাক্যটি বলে সুফিয়ান হেসে দিলো। নুরও হাসলো।

চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)