শ্যামসুন্দর স্বপ্ন পর্ব-০৭

0
240

#শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_৭
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

দেলোয়ার ফরাজি মুখ কালো করে ঘরে আসলেন৷ দেলোয়ার ফরাজির মুখের ভাবভঙ্গি দেখে মেহরুন বেগমের ভালো ঠেকছে না। তিনি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন,“কি হয়েছে আপনার মুখ শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
দেলোয়ার ফরাজি গায়ের জোরে ঘরের দেয়ালে একটা লাথি মারলেন। মেহরুন বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। দেলোয়ার ফরাজি খুব কঠিন গলায় বললেন,“ডাকো তোমার ছোট ছেলেকে, তার জন্য আমার মান-সম্মান সব নষ্ট হয়ে গেছে। সমাজে আমি মুখ দেখাতে পারছি না।”
“মানে?”
“তোমার ছেলের কুকীর্তির জন্য আজ গ্রামের লোক আমাকে প্রধান হিসাবে মানতে দ্বিমত পোষণ করেছে। তাদের মতে আমি নিজের ঘর সামলাতে পারি না, অন্যের ঘর কিভাবে সামলাবো?”
একটু থেমে দেলোয়ার ফরাজি পুনরায় বললেন,“এই সেই গ্রামের লোকজন যাদের জন্য আমি এতদিন এতকিছু করেছি। যাদের কথা ভেবে ঐ চালচুলাহীন গরিব রহিমের মেয়েকে ঘরের বউ করেছি। আজ অব্দি যে মেয়ের সাথে ভালো মন্দ কথা বলিনি। আজ সেই গ্রামের লোক আমার মুখের উপর কথা বলছে। এ সবকিছু তোমার জন্য হয়েছে।”
মেহরুন বেগম করুনচোখে তাকিয়ে বললেন,“আমার জন্য?”
“হ্যাঁ তোমার জন্য। খুব তো বলেছিলে বড় ছেলে ভালো নয়, আমার শিক্ষায় বড় হয়েছে বলে ও নষ্ট হয়ে গেছে৷ ছোট ছেলেকে তো সবসময় নিজের কাছে রাখতে, আমাদের সাথে মিশতে অব্দি দিতে চাইতে না। সবসময় বলতে না সে তোমার শিক্ষায় বড় হয়েছে তাহলে এরকম একটা কাজ করলো কিভাবে?”

“আমার ছেলে কিছু করেনি। যা কিছু হয়েছে সব আপনার ভাইয়ের চরিত্রহীন ছেলের জন্য।”
“মানে?”
মেহরুন বেগম রাগের মাথায় সব বলে দিলেন। দেলোয়ার ফরাজি এতে দ্বিগুন রেগে গেলেন।
“এক ভাইয়ের দোষের জন্য অন্য ভাইকে ফাঁসিয়েছে আর তুমি তা মেনে নিয়েছো। আবার সেই মেয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলো।”
“হ্যাঁ বলি। ও যা করেছে তা হয়তো ভুল। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবে জানি তোমার ভাইয়ের চরিত্রহীন ছেলের নজর যার উপর পড়েছে তার জীবনটা কতটা নরকীয় হতে চলেছে। মেয়েটা যদি নরক থেকে বাঁচতে আমার সুফিকে বেছে নেয় তবে দোষ কি?”
দেলোয়ার ফরাজি গায়ের জোরে মেহরুন বেগমের গালে থাপ্পড় মারলেন। মেহরুন বেগম তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন। দেলোয়ার ফরাজি রাগ নিয়ে বসার ঘরে আসলেন। চিৎকার করে বললেন,“ছোট বৌমা। ছোট বৌমা।”
নুর তৎক্ষনাৎ সেখানে চলে আসলো। নুর আসতেই দেলোয়ার ফরাজি নুরকে বললেন,“তোর সাহস কি করে হয় আমার নির্দোষ ছেলেকে ফাঁসিয়ে গ্রামের সকলের সামনে আমাদের ছোট করার।”
বাক্যটি বলে গায়ে হাত তোলার জন্য হাতটি তুলতেই অবাক হয়ে গেলেন। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। তিনি হাত তোলার সময় গ্রামের কিছু লোকজন ঘরের ভিতরে ডুকে গেলেন। একজন লোক বলে উঠলেন,“বাহ বাহ ফরাজি সাহেব। বিচারসভায় ছেলের বৌ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন এজন্য, যাতে ঘরের মধ্যে নির্যাতন করতে পারেন।”

দেলোয়ার ফরাজি হতভম্ব হয়ে গেলো। বিষ্ময় নিয়ে বললো,“আপনারা?”
“কেন ভুল সময়ে এসে পড়লাম বুঝি? আপনার খুব অসুবিধা হলো?”

দেলোয়ার ফরাজির কিছু বলার মতো কোন ভাষা নেই। গ্রামের লোকজন এমনিতেই ক্ষেপে আছে, তার উপর সরাসরি তাকে গায়ে হাত তুলতে দেখলো। দেলোয়ার ফরাজি তবুও বোঝানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু তারা কোন কথা শুনতে আগ্রহী নয়।
“কালকে সভায় আসবেন, আমরা সেখানে বসে ঠিক করবো আপনাকে গ্রাম প্রধান রাখা যায় কি যায় না?”

সবাই চলে গেলো। দেলোয়ার ফরাজি চিৎকার করে বললেন,“তাদের ঘরে ডুকতে দিয়েছে কে?”
রাইমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো,“আমি দরজা খুলে দিয়েছিলাম।”
দেলোয়ার ফরাজি আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাইমার দিকে। রাইমা ভয়ে চুপসে গেলো। দেলোয়ার ফরাজি নুরের উদ্দেশ্য বললো,“যা হয়ে গেছে সেসব নিয়ে মাথা না ঘামাই। কাল আমি তোমাকে যা বলবো তাই সভায় বলবে।”
নুর আস্তে করে মাথা নাড়ালো। দেলোয়ার ফরাজি ঘরের মধ্যে চলে গেলো।

সুফিয়ান বাসায় ফিরলো রাত করে। আজ রোগী দেখার বড্ড চাপ ছিলো। ঘরে ফিরতে না ফিরতেই রাইমা বললো,“জানো আজ কাকা তোমার বউয়ের গায়ে হাত তুলতে নিচ্ছিলো।”
“কি?”
“হ্যাঁ সেসময় গ্রামের লোকজন চলে আসে। আর…।”
রাইমা সুফিয়ানকে সব বলে দেয়। সুফিয়ান হতভম্ব হয়ে নুরের কাছে যায়।

নিজের ভাইয়ের কৃতকর্মের জন্য নুর সুফিয়ানকে ফাঁসিয়েছে তার জন্য নুরের প্রতি রাগ আছে। তাই বলে তার বাবা এমন একটি কাজ করবে সেটা সে কল্পনাতে ভাবতে পারেনি।

নুর ঘরের কোণে বসে ছিলো। নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এমন সময় সুফিয়ান ঘরে ডুকলো। সুফিয়ান নুরের কাছে গিয়ে নুরের কাঁধে হাত রাখলো। নুর পিছনে ফিরে সুফিয়ানকে দেখলো। সুফিয়ান শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“আমি বাবার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।”
“ভুল তো আমারি তাই ক্ষমা চেয়ে ছোট করবেন না প্লীজ।”
“ভুল করার পূর্বে এটা ভাবলে আজ এরকম হতো না।”
“হু।”

সুফিয়ান শান্তকন্ঠে নুরকে জিজ্ঞেস করলো,“আমার ভাইয়ের নজর থেকে বাঁচতেই শুধু আমাকে ফাঁসিয়েছো নাকি অন্যকারো চাপে?”
নুর অবাক হয়ে সুফিয়ানের মুখশ্রীতে তাকালো। সুফিয়ান পুনরায় শান্ত ভাষায় বললো,“আমাকে সত্যিটা বলতে পারো।”
নুর শব্দ করে কান্না করে দিলো। সুফিয়ানকে দু’হাতে জড়িয়ে নিলো। সুফিয়ান বললো,“একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিলো। তাতে তোমার বাধ্যতার কথা লেখা ছিলো। এবার অন্তত বলো।”

নুর নিজেকে সামলে বললো,“সুমন ফরাজির নজর থেকে বাঁচার জন্য যখন উপায় খুঁজছিলাম তখন আমার বাবার কাছে একটা ফোন আসে। ফোনের ওপাশ থেকে আমার বোন কথা বলে উঠে। পরক্ষনেই অন্য একজন বললো, আপনার ছোট মেয়ের অব্দি পৌঁছানো কতটা সহজ দেখেছেন? আমরা যা যা বলবো তাই তাই করুন নয়তো আপনার ছোট মেয়েকে মেরে ফেলতে আমাদের কোন কষ্ট হবে না।

বাবা হন্তদন্ত হয়ে সেদিন বোনের স্কুলে গেলো। সেখানে গিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলো তোর সাথে কে ছিলো কিন্তু ও বলতে পারলো না। ছোট মানুষ তো। আমরা ভয় পেলেও রাজি হলাম না। তখন লোকটি আমার বোনকে সত্যি সত্যি তুলে নিয়ে যায়। বাবা যতক্ষণ কাজটি করতে রাজি না হয় ততক্ষণ আটকে রাখে। বাবা রাজি হওয়ার পর, লোকটি আমার মাথায় হাত দিয়ে শপথ করতে বলে বাবাকে যে কাজটি করবে। বাবা তাই করলো। তারপর বোনকে ছেড়ে দেয়। বোন শুধু কালো পোশাক পড়া লোক ছাড়া কিছু বলতে পারলো না।

সেদিন রাতেই আমরা আপনার সাথে এসব কিছু করি।”

সুফিয়ান আজ আর নুরকে অবিশ্বাস করলো না। কেননা তার কাছে পূর্বেই মেসেজ করে এসব কথা বলা হয়েছে। সুফিয়ান কল করলে তা রিসিভ হয়নি। তখন বাধ্য হয়ে সুফিয়ান মেসেজে লিখেছিলো,“আপনি এসব কেন করছেন? করেছেন যখন তখন আবার স্বীকারই বা কেন করলেন?”

উল্টো দিকের লোক তখন বলেছিলো,“আমার উদ্দেশ্য আপনাকে ফাঁসানো ছিলো না। ফরাজি বাড়ির সন্তান হয়ে আপনি যে পাপ করেছেন তার কিছুটা শাস্তি তো আপনাকেও পেতে হবে। তবে আমার উদ্দেশ্য আপনি কিংবা নুরের ক্ষতি করা নয়। তাই আপনাদের মধ্যে যাতে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সেজন্য ব্যপারটা পরিস্কার করে দিলাম।”

“আপনার উদ্দেশ্য কি?”
“আপনার সম্মানের সাথে জড়ানো আপনার বাবার সম্মান নিয়ে খেলা করাটাই হলো আমার উদ্দেশ্য।”
“মানে? কি চান আপনি? শুনুন?”
তারপর আর কোন মেসেজ আসেনি। নাম্বারটিতে কল দিলেও বন্ধ বলেছে। তারপর সুফিয়ান নিজে রহিম চাচার বাড়ি যায়, সেখান থেকে একই কথা শুনে। তখন থেকেই সুফিয়ান নুরকে ক্ষমা করে দিয়েছে। এখন তার উদ্দেশ্য অপরিচিত এই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা। সেই সাথে তার পরিবারে তার অজান্তে ঘটা ঘটনাকে খুঁজে বের করা।

নুর সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরে আছে বেশ কিছুক্ষন। সুফিয়ানের তার হাত জোড়াও নুরের পিঠ স্পর্শ করেছে। সুফিয়ান নুরকে জড়িয়ে ধরেই মনেমনে বললো,“কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে আমি জানি না। আমি আমার সব দিয়ে চেষ্টা করবো সত্যি মিথ্যা খুঁজে বের করার।”


সুফিয়ান সে রাতেই গ্রামে তার বিশ্বস্ত বন্ধুকে খোঁজ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদের বাড়িতে ঐসময় গ্রামের লোকজন কেন এসেছিল এবং কে কে চায় না তার বাবা গ্রাম প্রধান থাকুক? সুফিয়ানের মন বলছে এর মাধ্যমে কিছু জানা যাবে।

ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে মুক্ত আকাশ দেখছে সুফিয়ান। আকাশের পানে তাকিয়ে ভাবছিলো, “ধমকা হাওয়ার মতো জীবনটা বদলে গেলো। একটা ঘটনা জীবনের গল্পটাই বদলে দিলো। সত্যি মিথ্যার বেড়াজালে আটকা পড়ে গেছে জীবন।”

বেশ কিছুক্ষন সুফিয়ানকে দেখতে না পেয়ে নুর ছাদে চলে এলো। নিঃশব্দে এসে সুফিয়ানের পাশে দাঁড়ালো। সুফিয়ান নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকালো। নুরকে দেখতে পেয়ে চুপচাপ আকাশের পানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

দুটি মানুষ পাশাপাশি দাঁড়ানো। সম্পর্কের নামটা খুব গভীর। তবুও একে-অপরের অচেনা। যাদের মধ্যের দূরত্বটা বেশ বড়।

দূরত্ব আছে তবুও দু’জনের দু’জনার পাশাপাশি দাঁড়াতে ভালো লাগছে। হয়তো মনের কোনে কোথাও অনুভূতিরা খেলা করছে।

ছাদ থেকে ঘরে ফেরার পথে সুমন ফরাজির ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো দু’জন। ভিতর থেকে সুমন ফরাজির রাগী কন্ঠ বেরিয়ে আসছে।
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মুখে মুখে কথা বলার?”
রাইমা কান্নারত কন্ঠে বললো,“তোমরা সবসময় আমার উপর অত্যাচার করবে আর আমি চুপ থাকবো ভাবলে কি করে? আমি আর চুপ থাকবো না। দেখা যাবে একদিন আমার দশাও তোমরা বড় ভাবীর মতো করবে।”
“তুই আবার কথা বলছিস?”

ভিতর থেকে থাপ্পড়ের শব্দ পাওয়া গেলো। সুফিয়ান দরজা ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ খুললো না। ভিতর থেকে সুমন বললো,“আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে কেউ ডুকুক তা আমি চাই না। যেই হও নিজের ঘরে চলে যাও।”
“ভাইয়া দরজা খোলো।”
“ওহ সুফি।”
“হ্যাঁ আমি সুফি।”
“অহেতুক ঝামেলা না করে ঘরে যা। পারলে ঘরে গিয়ে নিজের বউকে শিক্ষা দে। তবুও অন্যের ঘরে ডুকিস না।”
“ভাইয়া?”
সুফিয়ান চিৎকার করে উঠলো। নুর সুফিয়ানকে করুনসুরে বললো,“আমাদের চলে যাওয়া উচিত।”
সুফিয়ান নুরের মুখের পানে তাকিয়ে সম্মতি জানালো। আপাতত যতক্ষন পর্যন্ত রাইমা ঘটনাটা সামনে না নিয়ে আসে ততক্ষন পর্যন্ত ওটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যপার। সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই ভেবে সুফিয়ান চলে গেলো।

চলবে,