শ্যামারণ্য পর্ব-০৭

0
322

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০৭
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

“নাহ,আপাতত তোমাকে ভয় দেখানোর ইচ্ছা নেই আমার। আমার প্রশ্নটা শুধু বোঝাতে চাই। এই যে তুমি এখন এইভাবে এই জায়গায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো,তোমার কি ভয় হচ্ছে?তোমার কি আমাকে খারাপ লাগছে? সত্যি করে বলবে কিন্তু”

ধরা পড়ে যাওয়ার ন্যায় চমকে উঠে শ্যামা,তার আসলেই খারাপ লাগছেনা। তার যতটা খারাপ লাগবে ভেবেছিলো,ততোটুকু অন্তত নয়।
সত্যিটাই বলে সে,
” হ্যাঁ আমার খারাপ লাগছেনা এভাবে কথা বলতে,আর আপনাকে ভয় হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আমি ভীতু হলে এখানে কখনও আসতাম না। তবে এটা কোনো উত্তর হলোনা আমার প্রশ্নের।
শুধুমাত্র আপনাকে খারাপ লাগছেনা বলেই আমি রাজি হয়ে যেতে পারিনা।”

“সামশের বললো তোমার বাবা নাকি অসুস্থ?উনার চিকিৎসার টাকার জন্যই কি তুমি এখানে আসতে রাজি হয়েছো?”

“আপনি কি এবার আমার দু’র্বলতা তুলে ধরে আমাকে মানানোর চেষ্টা করবেন?”

“একদম না,তুমি তোমার দুর্বলতার কাছে নত হওয়ার থেকে ম’রে যাওয়া শ্রেয় মনে করেছো। আমি সেখানে আঘাত করার কথা ভাবতেও পারিনা।”

“তাহলে কেনো আনছেন এসব কথা?আমি এখানে শুধু আপনার শর্তগুলোর উদ্দেশ্য জানতে এসেছি। আমাকে কোনো সদুত্তর না দিলে আমার পক্ষে আপনার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।”

“আমার পক্ষে যদি তোমাকে সবকিছু বলে দেওয়া সহজ হতো,তাহলে আমি কখনো তোমার কাছে নিজেকে এভাবে লুকাতাম না। আমি আগেই বলেছি,আমি সবসময় সত্য বলার পণ করেছি। আমি যদি এই মুহুর্তে তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে থাকি,তার কারণ আমি সত্যিই অপারগ এই মুহুর্তে।
আমার এটুকু দুর্বলতা কি মেনে নেওয়া যায়না?তুমি একটু আগেই বললে তোমার এভাবে থাকতে খারাপ লাগছেনা,তাহলে একটু চেষ্টা করলেই কি মানিয়ে নিতে পারবেনা আমার সাথে?” বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে লোকটি।

শ্যামা চুপ হয়ে যায়,কোনো জবাব দেয়না। মাথার মধ্যে সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে যেনো। লোকটিকে মন বলছে বিশ্বাস করার কথা কিন্তু মস্তিষ্ক তাতে সায় দিচ্ছেনা। এমন দোটানায় পড়েছে যে কি করবে বুঝতে পারছেনা।

“তোমার মস্তিষ্কে এতো চাপ প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই শ্যামা। তোমাকে যে এক্ষুনি জবাব দিতে হবে তা কিন্তু নয়। ধীরে সুস্থে ভেবে জবাব দিও। এখান থেকে যাওয়ার পরেও তুমি ভাবতে পারো। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”

‘সে তার জন্য অপেক্ষা করবে?’ এমন কথা শুনে আবার শ্যামার হৃদয়ে শিহরণ বয়ে যায়। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। এর জবাবে কি বলবে সে? এদিকে লোকটি বলতেই থাকে,

“শ্যামা একটু আগে তুমি তোমার প্রাণ দিতে যাচ্ছিলে। এটা কিন্তু মোটেই ভালো কথা নয়। তোমার বাবা এখনো জীবিত আছেন,মা’রা যায়নি। উনি যদি তোমার এমন একটি দু’র্ঘটনার কথা শুনতো,তাহলে উনি কত কষ্ট পেয়ে মা’রা যেতেন ভেবে দেখেছো?হয়তো শেষ সময়েও শান্তি পেতোনা এটা ভেবে যে তার জন্যই হয়তো তার মেয়েটা প্রাণ হারিয়েছে। নিজেই নিজেকে দোষ দিতো,এভাবেই চরম আত্মগ্লানি নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করতো। শ্যামা মৃ’ত্যুর মধ্যেও একটা আলাদা শান্তি আছে। সবার ভাগ্যে সেই শান্তি নসিব হয়না। নিজেকে আর নিজের বাবাকে এই শান্তি থেকে কখনো বঞ্চিত করবেনা,ঠিক আছে? এরপর আর কখনো এমন কাজ করবেনা।”

শ্যামার মনে তীব্র অনুশোচনার জন্ম নেয়। এভাবে তো ভেবে দেখেনি সে?আসলেই কি বো’কামিই না করতে যাচ্ছিলো। এভাবে বাবা আরোও কষ্ট পেতো। তার চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়াতে থাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। অনেক চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারেনা অশ্রুগুলো।
তখনি সে একটি পুরুষালি হাতের টান অনুভব করে,পরক্ষণেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে একজোড়া শক্ত বাহুর বেষ্টনীতে। সে তখনো কান্না থামাতে করতে পারছিলো না। লোকটি আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
শ্যামার অনেক শান্তি লাগছে,মনে হচ্ছে তীব্র দাবদাহের খরার পর এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে তার হৃদয়ের জমিনে। এটাই তার ঠিকানা,এখান থেকে কোথাও যেতে চায়না সে। এখান থেকে বেরোলেই সে আবার বাস্তবতার অনলের তাপে পু’ড়ে ম’র’বে।

লোকটির মৃদু কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে মাথার উপর থেকে,”কান্না করোনা শ্যামা। কান্না করা মানায় না তোমাকে।
তোমাকে শক্ত আর রোদ্র রুপেই মানায়।”

শ্যামা এখনো নীরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। সে যে এই মুহুর্তে একজন অচেনা পুরুষের বাহুডোরে রয়েছে বিষয়টি বোধগম্য হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে,কিন্তু লোকটির গায়ে অসীম শক্তি যেনো,এতো চেষ্টা করেও তিল পরিমাণ দূরত্বও সৃষ্টি করতে পারলোনা সে তাদের মধ্যে।

তার ব্যার্থ চেষ্টার মাঝেই সে লোকটির নত কন্ঠস্বর আবার শুনতে পেলো, “এরপরের বার যদি কখনো তোমার মনে হয় যে এই জীবন তোমার লাগবেনা,এই জীবন তুমি আর রাখবেনা তাহলে তোমার জীবনটা আমাকেই দিয়ে দিও কেমন? ফেলেই যখন দিবে তখন আমাকে দিতে তো সমস্যা নেই তাইনা?তোমার জীবনের বাকি সময়টুকু আমার,আর তার বদলে আমার সবকিছু তোমার।
কি বলো? প্রস্তাবটা ভালো না?প্রস্তাবটা কিন্তু এখনও বহাল আছে। আমাকে বিয়ে করে নিজেকে আমাকে দিয়ে দাও,তার বদলে আমার সবকিছুই তোমার।”

শ্যামা সেই কন্ঠের মানুষটির দিকে তাকানোর একটি ব্যার্থ চেষ্টা করলো,লজ্জায় তার গাল দুটি আবার গরম হয়ে যায়।
‘লোকটি কি এইমাত্র তাকে প্রপোজ করলো?তার জীবনের বাকি সময়টা তাকে দিয়ে দেওয়া মানে কি এই নয় যে তিনি তার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে চান?’

তার ভাবনার মাঝে হুট করেই ছেড়ে দেয় লোকটি তাকে। সাথে সাথে একরাশ শূন্যতা গ্রাস করে শ্যামাকে। তার এতটা খারাপ লাগছে কেনো বুঝতে পারলোনা সে। একটু আগেতো নিজেই ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো।

“সামশের সকালেই তোমার একাউন্টে ২৫লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করে দিবে। বাবার চিকিৎসা নিয়ে আর কোনো চিন্তা করোনা। উনি খুব শীগ্রই ঠিক হয়ে যাবেন।”

শ্যামা অবশেষে নিজের ভাষা খুঁজে পায়,চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,”টাকা ট্রান্সফার করে দিবে মানে?আমিতো এখনো হ্যাঁ বলিনি।”

“এই টাকাটা আমার জন্য কিছুই নয় শ্যামা। এগুলো আমার কোনো প্রয়োজনেই আর লাগেনা। তুমি এগুলো আমার বিয়ের আগের উপহার ভেবেই নিয়ে নাও”

“আপনার মাথা ঠিক আছে তো?টাকাগুলো পেলে আমার এখানে ফিরে আসার কারণটাই শেষ হয়ে যাবে। আমি হয়তো আর কখনোই এখানে ফিরবোনা। তাহলে?”

“একদম নয়। বরং এর বিপরীতটা হবে বলে আমি মনে করি।
তোমার মতো আত্মসম্মানী মেয়ে যে সৎ পথে উপার্জিত অর্থ দিয়েই তার বাবার চিকিৎসা করাতে চায়। সে নিশ্চয়ই এতো বড়ো একটা এমাউন্ট নিয়ে পালিয়ে যাবেনা। আমার টাকায় যদি তোমার বাবা সুস্থ হয়ে উঠে,তাহলে তুমি চির জীবনের জন্য আমার কাছে ঋণী হয়ে যাবে। তখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। তোমার ব্যক্তিত্ব তোমার বিবেক তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে।
এই টাকাটা আমি তোমার উপকারের চেয়ে বেশি নিজের স্বার্থের জন্যই দিচ্ছি। তুমি নিরদ্বিধায় এগুলো গ্রহণ করতে পারো।”

“আপনি আমাকে একটু বেশিই মহান ভাবছেন। তবে আপনাকে হতাশ হতে হবে বলে সতর্ক করে দিতে চাই,আমি কিন্তু এতটা মহান নয়। আমি টাকাটা অবশ্যই নেবো। টাকাটা আমার ভীষণ প্রয়োজন তাই মানা করার প্রশ্নই আসেনা। তবে আমি কোনো কথা দিতে পারবোনা যে আমি ফিরে আসবো। আপনি এবার ভেবে দেখুন আমাকে টাকা দিতে চান কিনা।”

আবার লোকটির মৃদু হাসির কম্পন টের পার শ্যামা,
“ঠিক আছে শ্যামা। তাহলে দেখাই যাক কি হয়। দেখি কার বিশ্বাসের জয় হয়।”

এর পর আবার সেই দমকা হাওয়া। তারপর সব চুপ। উপস্থিত দ্বিতীয় সত্ত্বাটি চলে গেছে। হয়তো তার চোখ বন্ধ এখন তাই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এতোটা প্রখর এই মুহুর্তে।
আস্তে আস্তে চোখের কালো কাপড়টি খুলে নেয় সে। চোখ খুলে যথারীতি সে দেখতে পায়,সে সম্পুর্ন একা দাঁড়িয়ে আছে কক্ষটিতে।

———————–

ট্রেনে বসে এখনো কাল রাতের কথাগুলো ভেবে চলেছে শ্যামা। সামশের সকালেই তাকে গাড়ি করে নিয়ে এসে ট্রেনে তুলে দিয়েছে। তার মনিব মানুষটির কোনো উপস্তিতি টের পায়নি সে সকাল থেকে।
ট্রেনে বসে গন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই তার ফোনে এসএমএস আসে,তার একাউন্টে ২৫লক্ষ টাকা জমা হয়েছে।

মেসেজটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামা।
লোকটি তাহলে আসলেই সিরিয়াস ছিলো? এতোগুলো টাকা এভাবেই দিয়ে দিলেন উনি? তার মনের অস্থিরতা শুধু বেড়েই চলেছে এদিকে। লোকটি অদ্ভুত,ভারী অদ্ভুত।

মস্তিষ্ক বলছে ‘পালাও শ্যামা,এই মোহে পড়বে তো জ্ব’লে পু’ড়ে ছার’খার হয়ে যাবে’ আবার মন বলছে ‘একবার বিশ্বাস করতে ক্ষতি কি?তোর জন্য কি আর কেউ কখনো এতটা করেছে?তাহলে তাকে একবার মনে ঠায় দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?’

মন মস্তিষ্কের এই দোটানার মাঝেই হেনাকে মেসেজ করে জানায় সে,যে টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
তারপর ফোনটি রেখে দিতে যাবে,তখনি তার মাথায় হঠাৎ একটি ভাবনা খেলে যায়। গুগলের সার্চ অপশনে টাইপ করে ‘নির্জনা কুঠি’, তারপর অপেক্ষা করতে থাকে রেজাল্টের।
বাড়িটি যেহেতু পুরোনো জমিদার বাড়ি,তাহলে তার কোনো রেকর্ড অবশ্যই থাকবে ইন্টারনেটে। নার্ভাস হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে শ্যামা রেজাল্ট দৃশ্যমান হওয়ার।

অবশেষে তার কাঙ্খিত রেজাল্টটি ভেসে উঠে স্ক্রিনে। তবে সেখানে তেমন কিছুই লেখা নেই,যা তার মনের প্রশ্নগুলোর জবাবের প্রতি কোনো ইঙ্গিত বহন করে।

‘নির্জনা কুঠি’ বাড়িটি ইংরেজ আমলে তৈরি হলেও, ‘তালুকদার’ বংশ যারা এখানের জমিদারির দখলে ছিলো তারা বেশ কয়েক যুগ ধরেই জমিদারি করে আসছিলো।
তাদের জমিদারি সেই যুগে বেশি বিস্তৃতি লাভ করেনি তেমন।
তবে শেষ কয়েক বছরের রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে তাদের জমিদারি রাতারাতি যেনো কয়েক গ্রাম বিস্তৃত হয়েছে।
বলা হয়েছে জমিদার জমির তালুকদার তার পুত্র মাত্র ২১বছর হতেই তার নিকট জমিদারি হস্তান্তর করেন।
এবং তার পরেই তাদের জমিদারি ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
এমনকি বর্তমানের ‘ নির্জনা কুঠি’ টি তিনিই নির্মাণ করেছেন।
তবে এই বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক, যেই লোকটি তালুকদার বংশের জমিদারি এতটা বিস্তৃত করেছেন
তার ব্যপারে ধরতে গেলে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই।
তার নামটি পর্যন্ত উল্লেখ নেই। এরপর কি হলো তার সাথে,সে কবে মারা যায়,তালুকদার বংশের কি হয়েছিলো এরপর?এমন কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। যেনো ইতিহাসের পাতা থেকেই মুছে গেছে এই শত বছরের গৌরব,শত বছরের জমিদারি প্রথা। যেনো একজন কিংবদন্তিকে ইতিহাসের পাতা থেকেই মুছে দেওয়া হয়েছে হঠাৎ করে। স্ট্রেঞ্জ!

এসব ভাবতে ভাবতে আবার হঠাৎ তার মনে পরলো। সে তো লোকটির নাম জিজ্ঞেস করতে আবার ভুলে গেছে। ভাবা যায় লোকটির সম্পর্কে কাল থেকে অনবরত ভেবে চলেছে সে,তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে,সে তাকে এতোগুলো টাকা পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। অথচ সে এখনো লোকটির নাম অবদি জানেনা।
হঠাৎ করেই মানুষটির নাম জানার তীব্র বাসনা জাগে তার মনে।
আদোও কি কখনো জানা হবে তার নাম যদি সে ফিরে না যায়? ভাবনাটি মনে আসতেই অজানা কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়,অথচ তার এখন হাসিখুশি থাকার কথা। সে যে উদ্দেশ্য গিয়েছিলো তা সফল হয়েছে। বাবার চিকিৎসায় আর বিলম্ব হবেনা। তবুও মনের এক অপরিচিত শূন্যতা যেনো মিলিয়ে যেতেই চাইছেনা।

জানালার বাইরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হটাৎ তার মনে একটি অসম্ভব ভাবনার উদয় হয়,’এই লোকটিই সেই শেষ জমিদার নয় তো?’
পরক্ষণেই সে তার ভাবনাটি হেসে উড়িয়ে দেয়। অবশ্য সে বেশিক্ষণ ভাবার সময়ও পেলোনা।
ট্রেন গন্তব্যে পৌছে গেছে।
সে দ্রুত কদমে উঠে বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

(চলবে)