শ্যামারণ্য পর্ব-০৮

0
319

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০৮
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

হাসপাতালে প্রবেশ করে বাবার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই বাবার রুমের সামনে দিব্য ও তার স্ত্রী নীলাকে দেখে অবাক হয়ে যায় শ্যামা। এরা এবার কেনো এসেছে?
দিব্যকে তাও মানা যায়,হয়তো হটাৎ বিবেকে বাধছিলো তাই সে বাবাকে দেখতে এসেছে।
কিন্তু নীলা কেনো এসেছে? সে তো তাদের দুচোখে দেখতে পারেনা।

মা দিব্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে,হেনা একপাশে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে দিব্য ভাবলেশহীন ভাবে মাকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। তার পাশেই নীলা দাঁড়িয়ে এমনভাবে নাক ছিটকাচ্ছে যেনো সে বিদঘুটে কোনো কিছু দেখে ফেলেছে।

শ্যামাকে এখনো কেউ খেয়াল করেনি। এগিয়ে যেতে যেতেই সে দিব্যর বিরক্তিমাখা কন্ঠ শুনতে পায়,
“আহ মা কি করছো?আয়রণ করা শার্টটি পুরো কুঁচকে ফেলেছো তুমি। আমার এরপর আবার অফিস আছে।
এখন এমন কুঁচকে যাওয়া শার্ট পড়েই যেতে হবে তোমার কারণে।”

পাশ থেকে নীলা ফোঁড়ন কাটে,”কাকে কি বোঝাচ্ছো দিব্য?উনি কি এসব আয়রণ করা কাপড় আর কুঁচকে যাওয়া কাপড়ের পার্থক্য বোঝেন নাকি?
সারাজীবন তো ওই সস্তা রংচটা সুতির শাড়ী পড়েই কাটিয়েছেন। তাই নেকামো করার সময় এসব আর খেয়াল থাকে কই।”

মা এসব শুনে দিব্য থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়,অশ্রুসিক্ত নয়ন নীচু করে ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠে মা,
“বউমা ঠিকই বলেছে রে খোকা। আমি সত্যিই এসব বুঝতে পারিনি। তুই তো বাড়ি আসিস না,তোকে দেখার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছিলো এতোদিন।
তাই তোকে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। তুই রাগ করিসনা খোকা।”

“হ্যাঁ হয়েছে হয়েছে,আর তোমার মায়া দেখাতে হবেনা। তোমাদের মায়া কতোটুকু আমার জানা আছে।
এতোদিন কত করে তোমাকে বললাম বাড়িটা বিক্রি করে আমার ভাগ আমাকে দিয়ে দিতে,আমার টাকার প্রয়োজন,কই রাজি করাতে পেরেছো বাবাকে?”

“তা এখানে কি এখন সম্পত্তির ভাগ চাইতে এসেছিস এখন? বাবা ম’রে যাবে শুনে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে আগেই বৈঠক সেরে ফেলতে এসেছিস?”
হঠাৎ শ্যামার কন্ঠ শুনে সবাই চমকে উঠে,এতোক্ষণ পর তাকে লক্ষ্য করে সবাই। মা তাকে দেখেই এগিয়ে আসে।

“এসেছিস মা?কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?চিন্তায় আমার পরাণ যায় যায় অবস্থা এখানে”

শ্যামা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”এইতো মা চলে এসেছি। এতো চিন্তা কেনো করো বলোতো?হেনা বলেছে আমাকে তুমি নাকি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া ও করোনি?
তোমার বিচার আমি পরে করছি। আগে আমাদের অপ্রত্যাশিত মেহমান দুটির সাথে একটু আলাপ করে নি।”
শ্যামার টিপ্পনী শুনে দিব্য এবং নীলা দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।

“কি কথা বলিসনা কেনো?কি কারণে এসেছিস এখানে?”

দিব্য নাক ছিঁটকে বলে,”তোকে দেখতে আসিনি অন্তত,এতো ফা’লতু সময় আমার নেই। আমি নীলাকে প্রেগ্ন্যাসি চেকআপ করাতে এনেছিলাম,সেখানে মা আর হেনাকে এদিকে দেখতে পাই।
বলি তোর কি আক্কেল জ্ঞান আছে?তুই বাবাকে এতো বড় প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিস?! তুই জানিস এখানের একদিনের ফি কতো? জেনে শুনে সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে এখানে ভর্তি করিয়েছিস কেনো?”

“আমার বাবার চিকিৎসা আমি কোথায় করাবো না করাবো সেই ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার তোকে কে দিয়েছে?আমার বাবার হাসপাতালের বিল কি তোকে ভরতে হবে নাকি? কোনোদিন তো এক পয়সা ওষুধের টাকা দিয়েছিস বলেও বলতে পারবিনা,তাহলে আমার বাবার চিকিৎসা কিভাবে করাবো সেটা নাহয় আমাকেই বুঝতে দে। তোর কাছে টাকার জন্য হাত পাতবেনা কেউ,ভয় পাসনা।”

শ্যামার এমন জবাবে দিব্য লজ্জা পেয়ে যায়,এভাবে তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার ভুল দেখিয়ে দেওয়া হবে সে ভাবতে পারেনি। তবে সেও দমে যাওয়ার পাত্র নয়,নি’র্লজ্জের মতো জবাব দেয়,
” বাবা-মাকে দেখাশোনা করছিস ভেবে নিজেকে এতো মহান ভাবার দরকার নেই। বুড়িয়ে গেছিস তবু্ও এখনো মা-বাবার ঘাড়ের উপর পড়ে আছিস। তোর তো আর কোনো খরচ নেই,তাহলে মা বাবার ভরণপোষণ দিতে সমস্যা কোথায় তোর?তোর দ্বায়িত্ব এটা। এখানে কোনো বড় তীর মারিসনি তুই।
আমিতো জানি এসব ভুলভাল বুঝিয়েই বাবার কান ভাঙ্গিয়েছিস আমার ব্যাপারে,তাইতো বাবা বাড়ি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছেনা। নয়তো বাবা বুঝতো যে আমি ছোট চাকরি করি,তার উপর বিয়ে করেছি,আমার সামর্থ্য নেই তাদের ভরণপোষণ দেওয়ার।
আর এখনো বাবার চিন্তা আছে বলেই বলছিলাম যে কোনো সরকারি হাসপাতালে গেলে সস্তায় মিটে যেতো সব”

নীলা পাশ থেকে মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে দিব্যর কাধে হাত রেখে বলে,”বাদ দাও দিব্য,কাকে কি বলছো। এরা কি তোমার কষ্ট বুঝে নাকি। বিশেষ করে তোমার এই বড়বোন টা তো তোমাকে দুচোখের বিষ মনে করে। তাইতো দেখোনা কিভাবে কথা শোনাচ্ছে সুযোগ পেয়ে।”

“হুমম ঠিক বলেছো নীলা,আমারি ভুল হয়েছে গায়ে পড়ে মায়া দেখিয়ে।”

“শেষ হয়েছে তোমাদের স্বামী স্ত্রীর নাটক?তাহলে ভালোই ভালোই এখান থেকে বিদেয় হও তো দেখি। এখানে আমার বাবা জীবন-ম’র’নের ল’ড়াই করছে ওই রুমটাতে। তোমাদের সাথে তর্ক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি। আমাদের কোনো শখ নেই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপমান সয্য করার। চলে এসো নীলা।”

এই বলে তারা চলে যেতে নেয়,তখনি ডাক্তার অপর পাশ থেকে এগিয়ে আসে তাদের দিকে,
“মিস শ্যামা,টাকার ব্যবস্থা হয়েছে তো?আমি আপনার কথামতো অপারেশন এর প্রিপারেশন নিয়েছি।”

“জ্বি ডক্টর,টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কোথায় জমা দিতে হবে,কি কি ফরমালিটি বাকি আছে তা জানার জন্য আমি আপনার কাছেই আসছিলাম।”

“গুড, আপনি আপনার বাবার ফাইল নিয়ে রিশেপসনে যান। সেখানে টাকা জমা দিয়ে কিছু কাগজ পূরণ করতে হবে। সেখানে আপনাকে বলে দিবে সবকিছু। আমি যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে রেডি করছি অপারেশনের জন্য।”

“ধন্যবাদ ডক্টর”

ডাক্তারকে জবাব দিয়ে রিশেপসনের দিকে যেতে নিবে তখনি পথ আটকে দাঁড়ায় দিব্য, দিব্যর এমন ব্যবহারে বিরক্ত বোধ করে শ্যামা।
“কি সমস্যা তোর?যেতে বলেছি না তোকে?এভাবে পথ আটকে দাঁড়ানোর মানেটা কি?”

“তুই এতোগুলা টাকা কোথায় পেলি?সত্যি করে বল,আমার অগোচরে তুই অলরেডি বাড়ি বিক্রি করে দিস নি তো? এমন করলে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবোনা বলে দিলাম,ওই বাড়িতে আমার হক আছে,ছেলে হিসেবে আমি তোদের থেকে ভাগ বেশি পাবো। আমার ভাগের টাকা আমাকে না দিলে আমি কিন্তু কোর্টে যাবো বলে দিলাম।”

শ্যামা তার ভাইয়ের এমন কথা শুনে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে,বাবার অপারেশনের টাকা যোগার হয়েছে। সে খুশি না হোক,অন্তত ঝামেলা করবেনা এতোটুকু আশা করেছিলো। আর এই ছেলে কিনা তার বাবার অপারেশনের টাকায় ভাগ বসাতে চাচ্ছে। এটা কি সত্যিই তার সেই ছোট্ট দিব্য,যে টিফিনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে বাবার হাতে দিয়ে বলতো,”তুমি দেখো বাবা,আরেকটু বড় হই,তারপর আমিও টাকা কামাবো। তোমাকে আর কাজে যেতে হবেনা অসুস্থ শরীরে”
পুরনো স্মৃতি মাথায় আসতেই আবার মনটা বিষিয়ে উঠে শ্যামার,সে নিজেকে সংযত করে জবাব দেয়,
“দুঃখিত মিস্টার দিব্য,আপনাকে হতাশ করে বলতে হচ্ছে যে এই টাকাটি বাড়ি বিক্রির টাকা নয়। তাই আপনার যা করার আপনি করতে পারেন। এবার আপনি যেতে পারেন।”

“তাহলে এতো টাকা কোথায় পেলি তুই?”

“সে জবাব আমি তোকে দেওয়া জরুরি মনে করিনা।”

নীলা মুখ ভেঙ্গচিয়ে বলে,” জবাব দিবে কি করে,হয়তো জবাব দেওয়ার মুখ নেই তাই দিতে চাইছেনা। রাতারাতি এতো টাকা তো এমনি এমনি আসেনা। দেখো গিয়ে কোন কানাগলিতে গিয়ে কোন পুরুষের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এসেছে হুহ।”

দিব্য নীলার কথা শুনে এমনভাবে হেসে ফেলে যেনো অনেক হাসির একটা কৌতুক শুনে ফেলেছে সে,”কি যে বলোনা নীলা?চেহারা দেখেছো এর?একে কোনো পুরুষ মানুষ ফ্রী তে দিলেও ছুঁবেনা।”

শ্যামার কথাগুলি বোধগম্য হওয়ার আগেই থা’প্প’ড়ের শব্দটি গুঞ্জিত হয় করিডোরে। পাশে ফিরে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে,চোখেমুখে তার রাগ ঘৃ’ণা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
দিব্য তার গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে, সে কখনো ভাবেনি মা তার গায়ে হাত তুলতে পারে।
শ্যামাও কম অবাক হয়নি। দিব্য মায়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান,তার উপর হাত তোলা দূরের কথা তাকে কখনো শক্ত গলায় বকেছেন বলেও মনে পড়েনা তার। তাই মাকে এই রূপে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।

মা এদিকে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠে,”আমার মেয়ের নামে আর একটা বা’জে কথা বলবি তো শ্রেফ খু’ন করে ফেলবো এখানে বলে দিলাম। ছিহ! আমারতো ভাবতেই ঘৃ’ণা হচ্ছে যে তোর মতো কু’লা’ঙ্গা’র পেটে ধরেছি আমি। নিজের বোনের নামে এসব বলতে লজ্জা লাগেনা তোর? তুই অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিস,তবুও আমি কখনো তোকে ঘৃ’ণা করিনি। সবসময় দোয়া করেছি আমার ছেলেটা যেখানে আছে ভালো থাকুক। কিন্তু তোর এতো অধ’পতন হয়েছে কে জানতো?আরে আমার মেয়ে আমার গর্ব,তার নাম মুখে নেওয়ার যোগ্যতা নেই তোর।
এক্ষুনি দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে,যদি লজ্জা শরম কিছু থেকে থাকে এরপর আর কখনো আমাদের সামনে আসবিনা!”

দিব্যর চোখমুখ রাগে শক্ত হয়ে গেছে,এখনো গালের একপাশ ধরে রেখেছে সে। সে একবার মায়ের দিকে আরেকবার শ্যামার দিকে ঘৃ’ণামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গটগট করে চলে যায় সেখান থেকে। নীলাও যায় তার পিছু পিছু,যাওয়ার আগে একবার মুখ ভে’ঙ্গাতে ভুলেনা সে।

শ্যামা মায়ের কাধে হাত রাখে,মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে,”আমাকে ক্ষমা করে দিস মা,এমন ছেলে পেটে ধরেছি আমি।”

“মা তুমি শুধু শুধু কষ্ট পেওনা তো,আর আমি একদম ঠিক আছি। এসব কথা আমার গায়ে লাগেনা আর। কে আমাকে নিয়ে কি ভাবে তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসেনা।”

মা তখনো কাঁদতে থাকে,শ্যামা মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে,”মা এসব ছাড়ো তো। এসবে মাথা ঘামানোর সময় নয় এখন,বাবার অপারেশন হবে আজকে,তোমার এখন উপরওয়ালাকে ডাকার সময়,দোয়া করো যাতে অপারেশন সফল হয়। তাহলে বাবা সুস্থ হয়ে যাবে।”

বাবার কথা বলায় কাজ হয় এবার,মা চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শ্যামা মাকে শান্ত করে রিশেপসনের দিকে হাটা দেয়।

কথাগুলো তার গা সওয়া হয়ে গেছে,তার মানে এই নয় যে তার কষ্ট হয়না। এমন কথা শুনলে অনেক কষ্ট হয় তার। কিন্তু এই কষ্ট দেখানো যাবেনা কাউকে। কেউ যদি জানতে পারে তাদের কথায় সে প্রভাবিত হচ্ছে তাহলে সেটা তাদের জয় হবে। আর সে তাদের জিততে দিবেনা।

এই মুহুর্তে কেনো জানি সেই অজ্ঞাত পুরুষটির কথা খুব মনে পড়ছে তার,কি জানি বলেছিলো সে?
‘খোলা চুলে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে শ্যামাবতী’ আর সে সেটাকে মিথ্যে প্রশংসা বলায় কিভাবে রেগে গিয়েছিলেন তিনি।
কথাগুলো মনে পড়তেই আনমনেই হাসি চলে আসে তার মুখে। হাসপাতালের লোকগুলি কেমন আড়চোখে তাকাচ্ছে তার হাসি দেখে। শ্যামা তা খেয়াল করে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে,কিন্তু মুখে তখনও স্মিত হাসি লেগেই থাকে তার।
মনে মনে নিজেকে শাসায় সে,’উফফ শ্যামা কি হয়েছে তোর?এভাবে নিজে নিজে হাসলে লোক তোকে পাগল বলবে।
তুই কি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছিস নাকি?’

নিজের ভাবনা শুনে নিজেই চমকে উঠে শ্যামা,’সে কি লোকটিকে পছন্দ করে নাকি?’

মনের গহীন থেকে তখন একটি জবাব আসে,’হ্যাঁ শ্যামা,তুমি তাকে পছন্দ করো’

(চলবে)