শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-০৪

0
155

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৪

৪!!
প‌রের দিন বিকা‌লে,
আ‌মি তেমন কিছু না ভে‌বেই ঐশী‌দের বা‌ড়ি যাবার উদ্দেশ্যে বের হলাম। ঐশী‌দের বা‌ড়ির মো‌ড়ে গি‌য়ে বুঝ‌তে পারলাম না, কোন দি‌কে যে‌তে হ‌বে! চৌদ্দ প‌নে‌রো বছর কম ন‌া চারপা‌শের সবকিছু বদলা‌নোর জন্য, বদ‌লে যাবার জন্য। ওদের বা‌ড়ি এখা‌নে আ‌জও আছে কি না তা-ও স‌ঠিক জা‌নি না। একটা খোঁজ নি‌য়ে আসা উচিত ছিল। ভাবলাম এসেই যখন প‌ড়ে‌ছি তখন একটু খুঁ‌জে দেখি। ঐশীর বাবার নাম ছিল এহসান খান। আশাক‌রি তার নাম বল‌লে কেউ না কেউ চি‌নে যা‌বে।

আমি আশে পা‌শে তা‌কি‌য়ে ছোট্ট একটা চা‌’ এর দোকা‌নে গি‌য়ে জি‌জ্ঞেস করলাম,
‘চাচা, এহসান খা‌নের বা‌ড়িটা কোন দি‌কের রাস্তা দি‌য়ে যায়? ডান দি‌কে না‌কি বাম দি‌কের?’
দোকানী বলল,
‘কোন এহসান খান?’
‘ঐ যে যার খান বা‌ড়ি সম্ভবত। তার তিন ছে‌লে মে‌য়ে। ব‌ড়ো মে‌য়ের নাম ঐশী।’
পাশ থে‌কে একটা ছে‌লে বলল,
‘খান বা‌ড়ি‌তে আপনার কী কাজ?’
আ‌মি কিছুটা বিরক্তবোধ করলাম। বেশ বিরক্তি নি‌য়েই বললাম,
‘আমার কী কাজ তা আপনা‌কে কেন বলব? ঠিকানা জান‌লে দয়াক‌রে বলুন।’
দোকানী বলল,
‘ও এহসান খা‌নের ‌ছো‌টো ছে‌লে মাহদী।’
মাহদী দাঁ‌ড়িয়ে বলল,
‘‌কেমন আছেন সায়ন ভাই?’

আ‌মি বেশ অবাকই হলাম। ছে‌লেটা আমা‌কে এখনও মনে রে‌খে‌ছে? আমিতো ওকে চিন‌তেই পা‌রি‌নি। বি‌য়ে ঠিক হবার পর যখন দে‌খে‌ছিল‌াম তখন মাহদীর বয়স বা‌রো বছর ছিল বোধ হয়। ত‌বে ঐশীর সা‌থে ওর চেহারায় কিছুটা মিল আছে। আমি বেশ আন‌ন্দিত হয়ে বললাম,
‘আ‌মি ভা‌লো আছি তু‌মি? তু‌মি দেখ‌ছি অনেক ব‌ড়ো হ‌য়ে গেছ। আমি তো তোমা‌কে চিন‌তেই পা‌রি‌নি।’
মাহদী বিরস ক‌ণ্ঠে বলল,
‘‌মানুষ ভুলে যাবার রোগ আপনার পুরাতন। তা বাবা‌কে কেন খুঁজ‌ছেন?’
মাহদী যে আমা‌কে দে‌খে চূড়ান্ত বিরক্ত তা ওর কুচকা‌নো ভ্রু দে‌খে বুঝা যা‌চ্ছে। আমি মলিন হে‌সে বললাম,
‘ঐশীর বিষ‌য়ে কিছু কথা আছে।’
‘চলুন বা‌ড়ি যে‌তে যে‌তে কথা ব‌লি।’
মাহদী বলে হাঁটা দি‌লে আমিও ওকে অনুসরণ কর‌তে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর মাহদী বলল,
‘এত বছর পর আপুর বিষ‌য়ে কী কথা বল‌বেন?’

আমি খা‌নিক সময় নি‌য়ে নি‌জের কথাগু‌লো গোছালাম। বললাম,
‘ঐশী এখনও বি‌য়ে ক‌রে‌নি কেন?’
তা‌চ্ছিল্য হে‌সে মাহদী বলল,
‘ও তো বেহায়া। নয়‌তো যে মানুষ ওর কদর পর্যন্ত কর‌তে জা‌নে না তার জন্য অপেক্ষা ক‌রে? যার জন্য ওর জীবন নষ্ট হ‌লো, যার জন্য পু‌রো এলাকায় ওর এত বদনাম হ‌লো, ওর বি‌য়ে হ‌লো না। ভা‌লো কো‌নো জায়গা থে‌কে বি‌য়ের প্রস্তাব আসল না। যার জন্য বি‌য়ে না ক‌রেও আমা‌দের আত্মীয় স্বজন, এলাকার সবাই ওকে ডি‌ভো‌র্সি ভা‌বে তার জন্য অপেক্ষা ক‌রে?’

আ‌মি বিস্ম‌য়ে বললাম,
‘বদনাম, ডি‌ভো‌র্সি এসব কী বল‌ছো মাহদী?’
‘হ্যাঁ, আমা‌দের এলাকার সবাই, আত্মীয়-স্বজন সবাই জা‌নে আপ‌ুর সা‌থে আপনার ডি‌ভোর্স হ‌য়েছে।’
তা‌চ্ছিল্য হে‌সে মাহদী বলল। আমি বেশ অব‌াক হ‌য়েই বললাম,
‘‌বি‌য়ে না হ‌লে ডি‌ভোর্স কীভা‌বে হ‌বে?’
‘‌ঠিক সেভা‌বে যেভা‌বে সবাই এটা র‌টি‌য়ে‌ছিল আপ‌নি আপুর সা‌থে ঢাকা দেখা করতে ‌গি‌য়ে‌ছি‌লেন। আপনারা এক হো‌টেলে রাত কা‌টি‌য়ে‌ছিলেন।’

‌বি‌স্ম‌য়ে আমার চোখ কোটর থে‌কে বের হ‌য়ে আসার উপক্রম হ‌লো। আমি হতভম্ব হ‌য়ে বললাম,
‘এসব কী যা তা বল‌ছো? হ্যাঁ বি‌য়ে ঠিক হওয়ার পর আমি ঢাকা গি‌য়ে তোমার বো‌নের সা‌থে একবার দেখা ক‌রে‌ছিলাম ব‌টে ত‌বে সেটা মাত্র ঘন্টাখা‌নিকের জন্য। তা-ও তে‌ামার আপুর ক‌লেজ হো‌স্টে‌লের পা‌শের রেস্ট্রু‌ি‌রে‌ন্টে ব‌সে কথা ব‌লেছিলাম শুধু।’

‘সত্যিটা আপ‌নি বা আমরা জান‌লেও বা‌কিরা জানত না। আর জান‌লেও কেউ বিশ্ব‌াস করেনি। আপ‌নি বি‌য়ে ভাঙার পর পু‌রো এলাকায় আপুর না‌মে নানা রকম বা‌জে কথা ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল। অনে‌কের ম‌তে আপনা‌দের বি‌য়ে হ‌য়েছিল, বি‌য়ের পর আপ‌নি আপু‌কে ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছেন। আপ‌নি আপুর সা‌থে ঢাকা গি‌য়ে দেখা কর‌ার কথা তার বান্ধবীরা জানত। সে বান্ধবীর ম‌ধ্যে আমার চাচা‌তো বোনও ছিল। সে পু‌রো এলাকায় ছ‌ড়িয়ে দি‌য়েছে আপু‌কে নি‌য়ে আপ‌নি হোটেলে থে‌কে‌ছেন। আরও অনেক নোংরা কথা যা বলার ম‌তো ভাষা আমার নেই। আপ‌নি হয়তো জা‌নেন না আমা‌দের প‌রিবা‌রের সবাই আপনা‌কে ঘৃণা ক‌রে। আপ‌নি নি‌জের জীবন গোছা‌তে বি‌য়ে ভে‌ঙে আমার আপুর জীবনটা নষ্ট ক‌রে‌ছেন। আপ‌নি নি‌জের প‌রিবারের সু‌খের জন্য আমা‌দের প‌রিবা‌রের অশা‌ন্তির আগুন জ্বে‌লে‌ছি‌লেন। আপনার একটা সিদ্ধান্ত আমা‌দের প‌রিবার‌কে অনেক ভু‌গি‌য়ে‌ছে। এখনও ভোগা‌চ্ছে। আপ‌নি চাই‌লে ক‌য়েক বছর পরও আপু‌কে বি‌য়ে কর‌তে পার‌তেন, ‌কিন্তু আপ‌নি আপুর একটা খোঁজ পর্যন্ত নেন‌নি। এখন বু‌ঝে‌ছেন কেন আপুর বি‌য়ে হয়‌নি? ডি‌ভো‌র্সি, কলঙ্কী‌নি মে‌য়ে‌দের সহ‌জে বি‌য়ে হয় শুনছেন?’

আ‌মি মাথা হেট ক‌রে চুপ ক‌রে হাঁট‌তে লাগলাম। ঐশী‌দের বা‌ড়ি পৌঁছা‌নোর পর দরজার খুলল ঊনিশ কি বিশ বছ‌রের এক‌টি মে‌য়ে। দেখ‌তে বেশ মি‌ষ্টি। মে‌য়ে‌টি‌কে দে‌খি‌য়ে মাহদী বলল,
‘ও ঝুমা। আমার স্ত্রী।’
‌বেশ লজ্জাই লাগল। সে‌দি‌নের মাহদীও আজ বি‌বা‌হিত। আমি মে‌য়েটার দি‌কে তাকা‌তেই মে‌য়েটা সালাম দি‌য়ে ভিত‌রে আস‌তে বলল।

আমার সাম‌নে ব‌সে আছে মাহদীর মা, বাবা। মাহদীর মা বেশ ঝাঁঝা‌লো আর ক্রুদ্ধ ক‌ণ্ঠেই বললেন,
‘এখা‌নে কী চাই তোমার? কী জন্য এসে‌ছো?’
তার রাগ করাটা স্বাভা‌বিক। সে কার‌ণে তার ক্রুদ্ধ কথা গা‌য়ে না মে‌খে স্বাভা‌বিক ক‌ণ্ঠেই বললাম,
‘আ‌মি ঐশীর জন্য এসে‌ছি।’
‘‌কেন?’
‘আ‌মি জান‌তে এসে‌ছিলাম, ঐশী কেন এত বছর বি‌য়ে করে‌নি। যার অধিকাংশ বিষয় জে‌নে‌ছি। ত‌বে‌ আমি এটা বুঝ‌তে পার‌ছি না, এতো কিছু হ‌য়ে যাবার পরও আপনারা আমার সাথে কিংব‌া আমার প‌রিবা‌রের সা‌থে যোগা‌যোগ কেন ক‌রেন‌নি?’

ঐশীর বাবা শীতল ক‌ণ্ঠেই বল‌লেন,
‘‌তোমা‌কে য‌দি ক‌য়েকটা চড় মার‌তে পারতাম তাহ‌লে গা‌য়ের রাগ কিছুটা হ‌লেও কমত, কিন্তু ঘ‌রে আসা অতিথীদের স‌া‌থে ছো‌টো‌লো‌কের ম‌তো ব্যবহার করার শিক্ষা আমা‌দের প‌রিবা‌রে নেই, যেমনটা তোমা‌দের প‌রিবা‌রে আছে।’
আ‌মি বেশ ক‌ঠিন ক‌ণ্ঠে বললাম,
‘কী বলতে চান সরাস‌রি বলুন।’
‘তোমার বি‌য়ে ভে‌ঙে দেওয়ার পর যখন সমস্যাগু‌লো শুরু হয়; তখন আ‌মি তোমা‌দের বা‌ড়ি গি‌য়ে‌ছিলাম, কিন্তু তোমার মা অপমান ক‌রে বের ক‌রে দিয়ে‌ছি‌লেন। ব‌লে‌ছি‌লেন মে‌য়ে নি‌য়ে গা‌ঙে প‌ড়ে‌ছি সে কার‌ণে তা‌দের ছে‌লের কা‌ছে গ‌ছি‌য়ে দি‌তে চা‌চ্ছি। তারপর আর তোমা‌দের বা‌ড়ি যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তারপর ঐশী পড়া‌লেখা শেষ করল। গ্রাজু‌য়েশন শেষ করার পর পরই ওর ব্যাং‌কে চাক‌রি হ‌য়ে গেল। ও তখনও তোমা‌কে ভুল‌তে পা‌রে‌নি। এতো কিছুর পরও ও তখনও তোমা‌কেই বি‌য়ে কর‌তে চাই‌তো। আমার মে‌য়েটা আমার ব‌ড়ো শ‌খের। ওর কো‌নো আবদার অপূর্ণ রা‌খিনি। ওর কি‌শোরী বয়‌সের প্রথম পছন্দ তু‌মি ছি‌লে না। বোকা, নরম ম‌নের মে‌য়েটা আমার তো‌মা‌কে কিছু‌তেই ভুল‌তে পার‌ছিল না।
আমি মে‌য়ের দি‌কে চে‌য়ে আব‌ারও তোমার ছো‌টো মামার সাথে কথা বললাম। তি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন তোমা‌দের সা‌থে কথা ব‌লে‌ আমা‌কে জানা‌বেন। দু‌দিন পর তি‌নি জা‌নি‌য়ে‌ছি‌লেন, তু‌মি না‌কি তা‌কে ব‌লে‌ছি‌লে তোমার প‌ক্ষে কখ‌নো ঐশী‌কে বি‌য়ে করা সম্ভব ন‌া। তখন তোমার মায়ের সা‌থেও কথা হ‌য়ে‌ছিল। তিনি তখনও কারণ ছাড়া অপমান ক‌রে‌ছি‌লেন। তখন বলে‌ছি‌লেন, আমরা মে‌য়ে নি‌য়ে বিপ‌দে পড়‌ছি, আমার মে‌য়ে‌কে কেউ বি‌য়ে কর‌তে চায় না, তা-ই তোমার পিছ‌নে প‌ড়ে আছি। লজ্জা থাকলে যেন তোমা‌দের সা‌থে যোগা‌যোগ না ক‌রি। তারপর আর তোমাদের সাথে যোগাযোগ ক‌রি‌নি।’

আ‌মি বিস্ম‌য়ে হতভ‌ম্বে যেন পাথর হ‌য়ে ব‌সে রইলাম। মা, ছো‌টোমামা মি‌লে এতো কিছু ক‌রেছেন অথচ আমি কখ‌নো টের পর্যন্ত পাই‌নি। টের পা‌বোইবা কী করে, গত চৌদ্দ বছ‌রের সংসা‌রের ঘা‌নি টান‌তে টান‌তে কো‌নো দি‌কে তো হুশই দেই‌নি। প্রথ‌মে চাক‌রি, তারপর নি‌জের ছো‌টোখা‌টো ইট, বালু, সি‌মে‌ন্টের ব্যবসায় সময় দি‌তে গি‌য়ে ঘ‌রে তেমন সময়ই দিতাম না। যে যখন যা চাইত দি‌য়ে দিতাম। কখ‌নো নি‌জের প্রয়োজন, না নি‌জে দে‌খে‌ছি, ব‌লে‌ছি; না প‌রিবা‌রের বা‌কিরা জি‌জ্ঞেস ক‌রে‌ছে। আজ এত বছর যেন সবার আসল রূপগু‌লো সাম‌নে আস‌ছে। কিছুক্ষণ চুপ থে‌কে বললাম,
‘আ‌মি কী ঐশীর সা‌থে কথা বল‌তে পা‌রি?’

চল‌বে…