শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-০৫

0
161

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৫

ঐশীর মা বল‌লেন,
‘তোমাদের জন্য আমার মে‌য়ের ভা‌লো জায়গা থে‌কে বি‌য়ের সম্বন্ধ আসত না। যেসব ছে‌লে‌দের জন্য ওকে পছন্দ করা হ‌তো, তারা অধিকাংশ বিবাহিত, ‌বিপ‌ত্নীক, দুই এক বাচ্চার বাবা কিংবা ডি‌ভো‌র্সি, আবার কো‌নো ছে‌লের বয়স অতি‌রিক্ত বে‌শি। দেখ‌তে খারাপ, ভু‌ড়ি বের করা, টাক মাথা। যা-ও দুই একটা ভা‌লো সম্বন্ধ আসত তাদের কেউ না কেউ ভাঙানি দিত। এভা‌বেই অনেক বছর যাবত আমাদের প‌রিবার সহ্য ক‌রে আস‌ছে। অথচ আমার মে‌য়েটা‌কে দে‌খো, আজও কোথাও না কোথাও তোম‌ার জন্য অপেক্ষা কর‌ছে। তু‌মি তো বি‌য়ে ভাঙার পর ওর একটা খোঁজ পর্যন্ত নাও‌নি, কিন্তু ঐশী তোমার সব খবর রাখত। ও তো এটা পর্যন্ত ব‌লে‌ছে তোমার বি‌য়ের পরই ও বি‌য়ে কর‌বে। তা‌তে যত বছর লাগে লাগুক। আমি আজও ভে‌বে পাই না ও তোমা‌কে কেন এত পছন্দ ক‌রে‌ছিল। দেখ‌তে তো তু‌মি আহাম‌রি তেমন কেউ না, তোমার টাকা পয়সাও বে‌য়ে ছে‌য়ে প‌ড়ে না। ত‌বে তোমার জন্য আমার মে‌য়েটার এত কেন টান? সেটাই বুঝ‌তে পার‌ছি না।’

আ‌মি দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বললাম,
‘আ‌ন্টি, এটা আমার সৌভাগ্য যে, আমার প্রতি ঐশীর এতো টান! আঙ্কেল-আন্টি আমি য‌দি ঐশী‌কে বি‌য়ে কর‌তে চাই ত‌বে কী আপনারা রা‌জি হ‌বেন?’
ঐশীর বাবা বেশ ক‌ঠিন গলায় বল‌লেন,
‘কখ‌নো ন‌া। তোমার প‌রিবার যেভা‌বে বারবার আমা‌দের অপমান ক‌রে‌ছেন তা‌তে তোমা‌দের প‌রিবা‌রে মে‌য়ে দেওয়ার কথা ভাব‌তে পার‌ছি না।’
আন্টি কিছুক্ষণ চুপ থে‌কে বল‌লেন,
‘তু‌মি, স‌ত্যি ঐশী‌কে বি‌য়ে কর‌তে চাও?’
আ‌মি বেশ দৃঢ়তার সা‌থে বললাম,
‘‌জি, আপনারা আজ চাই‌লে আজই বি‌য়ে করব।’
ঐশীর বাবা, ওর মা‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘ফা‌হিমা, তু‌মি কী বল‌ছো?’
আন্টি দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বল‌লেন,
‘আমি তো মা, তাই রাগ পু‌শে রাখ‌তে পা‌রি না। সন্তা‌নের ভ‌া‌লোর জন্য আমা‌কে অনেক অপমান ভুল‌তে হয়।’
আ‌ঙ্কেল বেশ রাগী ক‌ণ্ঠেই বল‌লেন,
‘তোমার কী‌ ধারণা ঐ প‌রিবা‌রে গি‌য়ে তোমার মে‌য়ে সুখী হ‌বে? সায়‌নের মা বোন বারবার ওকে নি‌য়ে যা তা কথা ব‌লে‌ছে। বি‌য়ের পর যে ওকে জ্বালা‌বে না তার কী গ্যারা‌ন্টি?’

আ‌মি বেশ আত্ম‌বিশ্বা‌সের সা‌থেই বললাম,
‘না জ্বালা‌বে না। আমি খেয়াল রাখব ঐশীর। আঙ্কেল, আমার মা, ছো‌টো মামা, বে‌ান যে‌ এতকিছু ক‌রে‌ছিল তা সম্প‌র্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আপ‌নি যে আবার বি‌য়ের প্রস্তাব দি‌য়ে‌ছি‌লেন সে বিষ‌য়েও আমি জানতাম ন‌া। তারা যেটা ক‌রে‌ছে সেটা অবশ্যই অন্যায়। তার দায় আমার উপরও বর্তায়। প্লিজ আমা‌কে একটা সুযোগ দিন।’
আঙ্কেল দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বল‌লেন,
‘‌তোমার কথা বিশ্বাস ক‌রলাম, কিন্তু তে‌ামার কী উচিত ছিল না বি‌য়ে ভাঙার পর একবার ঐশীর খোঁজ নেওয়া? ও কেমন আছে? বি‌য়ে ক‌রে‌ছে কি ন‌া জানার? তু‌মি কী জান‌তে না ও বি‌য়ে ক‌রে‌নি?’
‘‌সেটা আমার চরম ভুল, অন্যায়। ত‌বে আমি বছর দে‌ড়েক আগে জে‌নে‌ছিলাম ঐশী বি‌য়ে ক‌রে‌নি। এর আগে জানতাম না। আমা‌কে একবার ঐশীর সা‌থে কথা বল‌তে দিন।’
‘ঐশী তো বাসায় নেই। ব্যাং‌কে, বা‌ড়ি ফির‌তে ফির‌তে সাতটা বাজ‌বে।’
‘আচ্ছা তাহ‌লে আমি অপেক্ষা ক‌রি।’
ঐশী মা বল‌লেন,
‘‌তোমার ইচ্ছা।’

আ‌মি চুপচাপ ড্র‌য়িং রু‌মে ব‌সে রইলাম। সা‌ড়ে পাঁচটা বা‌জে কেবল ঐশীর আস‌তে এখ‌নো দেড়ঘন্টার বে‌শি সময় বাকি। চার‌দি‌কে মাগ‌রি‌বের আযান দি‌চ্ছে। শীত কা‌লের ন‌ভেম্বর মাস। দিন শুরু হ‌তেই শেষ হ‌য়ে যায়। আমি ঐশীর মায়ের কা‌ছে ব‌লে বাই‌রে চ‌লে আসলাম। মস‌জিদ থে‌কে নামাজ আদায় ক‌রে রাস্তাুয় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। ঘ‌ড়ির দি‌কে তা‌কি‌য়ে দেখলাম কেবল ছয়টা দশ বা‌জে। অপেক্ষার প্রহর স‌ত্যি কা‌টেনা।

হুট ক‌রে মাথায় চিন্তার উদয় হ‌লে‌া, আমি মাত্র দেড়ঘন্টা সময় অপেক্ষা কর‌তে গি‌য়ে হা‌ঁপি‌য়ে উঠে‌ছি ঐশী চৌদ্দ বছর কীভা‌বে অপেক্ষা ক‌রে‌ছে? এত ধৈর্য্য কোথা থে‌কে পে‌য়ে‌ছিল ও? বারবার ম‌নে হ‌চ্ছিল একটা মানু‌ষের ভা‌লোবাসা কতটুকু গভীর হ‌লে সে চৌদ্দ বছ‌রের অপেক্ষার ম‌তো দীর্ঘ পথ পা‌রি দেয়!ঐশীর ভা‌লোবাসা যত অনুভব কর‌ছিলাম ঠিক ততটাই নি‌জের করা ভুলটা অনুভব কর‌ছিলাম। মে‌য়েটার সা‌থে কতটা অন্যায় ক‌রে‌ছি আমি এবং আমার প‌রিবার।

সন্ধ্যার আকাশ ধী‌রে ধী‌রে ধূসর থে‌কে কা‌লো হ‌চ্ছে। বাড়‌ছে অন্ধকার, কিন্তু এই তীব্র অন্ধকা‌রেও আমা‌র ম‌নের কু‌ঠরীর অন্ধকার স্থান আলো‌কিত হ‌চ্ছে। হয়‌তো এত বছর অন্ধকা‌রে থে‌কে থে‌কে সেখা‌নে স্যাত স্যা‌তে শ্যাওলা জমে‌ছে। আচ্ছা, ঐশী কি আমা‌কে বি‌য়ে কর‌তে রা‌জি হ‌বে? বি‌য়ে কর‌বে আমা‌কে? আমি ওকে যতটা কষ্ট দি‌য়ে‌ছি তারপর কী স‌হ‌জে মে‌নে নি‌বে আমা‌কে? আজ হঠাৎ ক‌রেই ভয় কর‌ছে খুব। ঠিক ততটা ভয় যতটা ভয় পেয়ে‌ছিলাম সে রা‌তে যে রা‌তে বাবা মারা গি‌য়ে‌ছি‌লেন। কারও সা‌থে নি‌জের কথাগু‌লো বল‌তে পার‌লে ম‌নে শা‌ন্তি লাগত, কিন্তু প‌রিবা‌রের হাল ধর‌তে গি‌য়ে ভূ‌তের ম‌তো প‌রিশ্রম কর‌তে গি‌য়ে বন্ধু‌দের থে‌কে দূ‌রে বহু দূ‌রে চ‌লে গে‌ছি। কা‌রও সা‌থে প্রী‌তি আন্ত‌রিকতা নেই আমার, যা আছে তা কেবল ফরমা‌লি‌টির সম্পর্ক। নি‌জের ম‌নের কথা বলার ম‌তো বন্ধু কেউ নেই। কেউ না।

নি‌জে‌কে কেমন একা নিঃস্ব ম‌নে হ‌চ্ছে। এত বছর যাবত এত টাকা পয়সা রোজগার ক‌রে কী পেলাম? শুধু একা‌কিত্ব? আপনজন‌দের টাকার মে‌শিন? নি‌জের যৌব‌নের ঐ সময়টা‌কে বিসর্জন দিলাম, যা কি না একটা মানু‌ষের জীব‌নে সব‌চে‌য়ে সুন্দর অনুভূতিগু‌লো ব‌য়ে আনে? কা‌রও ভা‌লোবাসা পেলাম না। পেলাম না শুন‌তে শিশুর মুখ থে‌কে বাবা ডাক। কী করলাম জীবনে? শুধু টাকা আয়? সে টাকায় নি‌জের জন্য কী ক‌রে‌ছি? না ভা‌লো খে‌য়ে‌ছি। না প‌রে‌ছি। না‌কি কোথাও গি‌য়ে নি‌জের জন্য কিছু টাকা ব্যয় ক‌রেছি? এসব কথা ভাব‌তে ভাব‌তে আনম‌নে চো‌খের জল শা‌র্টের হাতায় মুছলাম।

আমার নি‌জের মা-ও আমা‌কে টাকা কামা‌নো মে‌শিন ব্য‌তিত অন্যকিছু ভাবল না? আজ‌কের বিকাল যেন সত্য উদঘাট‌নের বিকাল হ‌লো। স‌ত্যিটা চো‌খের সামনে ঝরনার জ‌লের ম‌তো স্বচ্ছ হ‌লো? এক‌বিকা‌লে এতকিছু জে‌নে মুহূ‌র্তেই যেন হতাসা, মান‌সিক অসুস্থতা আমা‌কে গ্রাস কর‌তে লাগল। মন চা‌চ্ছে ম‌রে যাই, কিন্তু প‌রোক্ষ‌ণে ম‌নে ম‌নে দৃঢ় প্র‌তিজ্ঞা করলাম, আমি নি‌জে‌কে ভা‌লোবাস‌বো, খু‌শি রাখব। আর তার প্রথম ধাপ হ‌বে ঐশী‌কে বি‌য়ে ক‌রে। সবাই আমা‌কে যেভা‌বে ব্যবহার ক‌রে‌ছে সেভা‌বে আর ব্যবহার কর‌তে দিব না নি‌জে‌কে। আমি মেশিন না, আমি মানুষ।

ঐশীর সাথে কথা হ‌লো সা‌ড়ে সাতটার দি‌কে। আমি কো‌নো ভ‌নিতা না ক‌রে সরাস‌রি জি‌জ্ঞেস করলাম,
‘এত বছর তোমা‌দের সা‌থে কী হ‌য়ে‌ছে? কেন হ‌য়ে‌ছে? তু‌মি ‌কেন বি‌য়ে করে‌ানি? এসব জান‌তে চাইব না। শুধু জান‌তে চাইব এত বছর অপেক্ষা কর‌তে কীভা‌বে পার‌লে? কোন ভরসায় অপেক্ষা কর‌লে? এতটা ভা‌লো কেন বাস‌লে?’
ঐশী মাথা নিচু ক‌রে বলল,
‘‌চৌদ্দ বছর আগে আপ‌নি যখন আমা‌র সা‌থে দেখা কর‌তে ঢাকা গি‌য়েছি‌লেন, সে‌দিন দুজন ওয়াদা ক‌রে‌ছি‌লাম, জীব‌নের প্র‌তি‌টি শ্রাবণ একসা‌থে কাটা‌বো। একসা‌থে ভালো‌বে‌সে শ্রাব‌ণের প্র‌তি‌টি বৃ‌ষ্টি অনুভব করব। তারপর কপা‌লে এঁকে‌ দি‌য়েছি‌লেন ভা‌লোবাসার ছোট্ট চিন্হ। সে চি‌ন্হের গভীরতা এতটাই ছিল যে, আজও আমার ম‌নে তার ছাপ র‌য়ে গে‌ছে। সে‌দিন নি‌জে নি‌জে প্র‌তিজ্ঞা ক‌রে‌ছিলাম আর কো‌নো ঠোঁট আমার কপাল ছোঁ‌বে না। যে ছুঁ‌য়ে‌ছি সে-ই সারাজীবন আমার অস্তি‌ত্বে বিরাজ কর‌বে।’

চল‌বে…