শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-০৬

0
154

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ০৬

‘ঐশী, ‌বি‌য়ে কর‌বে আমা‌কে? জীব‌নের বা‌কিটা পথ আমার সা‌থে চল‌বে?’
ঐশীর চোখ বে‌য়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তা কণা ঝরছিল। ওর দৃ‌ষ্টি জ‌মিনপা‌নে। নি‌চের দি‌কে দৃ‌ষ্টি স্থির রে‌খেই ক‌ঠিন ক‌ণ্ঠে বলল,
‘না।’
আ‌মি বেশ অবাক হ‌য়ে ওর দি‌কে তাকি‌য়ে রইলাম। ভাবলাম যে মে‌য়ে আমার জন্য এত অপেক্ষা করল সে কেন এমন ক‌ঠিন ক‌রে না বল‌ছে? ওর দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘তাহ‌লে এত বছর অপেক্ষা কর‌লে কেন? আজ ফি‌রি‌য়ে দেবার জন্য?’
দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে ঐশী বলল,
‘এত বছর অপেক্ষা ক‌রে‌ছি সেটা আমার ভা‌লোবাসা ছিল। ত‌বে আজ না বল‌ছি সেটা আমার রাগ, ক‌ষ্টের ব‌হিঃপ্রকাশ। এত বছর পর আপনার এভা‌বে আমা‌দের বা‌ড়ি আসা, সব স‌ত্যি জানা, আমা‌কে বি‌য়ের প্রস্তাব দেওয়া, সব‌কিছুর পর ম‌নের কো‌ণের এত বছ‌রের জমা‌নো অভিমানটা জে‌গে উঠ‌ছে। সে‌দিন একবার আমার সা‌থে দেখা পর্যন্ত কর‌লেন না‌। শুধু একটা মে‌সেজ দি‌য়েই সব‌কিছু শেষ ক‌রে দি‌লেন। আচ্ছা একটা মে‌সে‌জে শেষ হ‌য়ে যাওয়ার ম‌তো সম্পর্ক ছিল কী আমা‌দের? আমা‌দের সম্পর্ক কী এতটাই হালকা ছিল? কো‌নো গভীরতা ছিল‌ না আমা‌দের অনুভূতি?’
আমি চুপ ক‌রে রইলাম। ও ব‌লে যে‌তে থাকল,
‘এত‌কিছু হওয়ার পর, আপ‌নি প্রস্তাব রাখার সা‌থে সা‌থে আমি হ্যাঁ ব‌লে দিব? আমার কি একটুকুও আত্মসম্মান‌বোধ নেই? এতটাই সহজলভ্য আমি?’

আ‌মি মাথা নিচু করে চ‌লে আস‌তে নি‌লে ঐশী বলল,
‘কী হ‌লো চ‌লে যা‌চ্ছেন? ক‌য়েক মুহূ‌র্তে হাল ছে‌ড়ে দি‌লেন? আর আমি চৌদ্দ বছ‌রে হাল ছা‌ড়ি‌নি। আ‌মি আপনার জন্য চৌদ্দ বছরের অধিক সময় অপেক্ষা কর‌তে পে‌রে‌ছি আর আপ‌নি আমার না কে হ্যাঁ বানা‌তে পার‌বেন না? এই আমার প্র‌তি আপনার মায়া?’
আ‌মি বিস্ময়ে ওর দি‌কে তাকালাম। ও বলল,
‘আ‌মি জা‌নি না, আপ‌নি আমা‌কে ভা‌লোবা‌সেন কি না? ত‌বে এতটুকু জা‌নি আপ‌নি আমা‌র মায়ায় পড়ে‌ছেন। সে কার‌ণে এত বছর পরও আবার আমার কা‌ছে ছুটে এসে‌ছেন।’

ওর কথায় কিছু‌তো দুষ্টু‌মি‌ষ্টি মায়া ছিল। যার দরুণ মুহূ‌র্তেই চ‌ল্লি‌শের আমি সেই পঁচি‌শের সায়নের ম‌তো যুবক অনুভব কর‌তে লাগলাম। মুচ‌কি হে‌সে বললাম,
‘আ‌মি জানি না, মে‌য়েদের না কে কীভা‌বে হ্যাঁ বানা‌তে হয়। তু‌মি শি‌খি‌য়ে দাও।’
‘আ‌মি কেন শি‌খি‌য়ে দিব?’
‘‌প্লিজ?’
আবারও ক‌ঠিন ক‌ণ্ঠে বলল,
‘না।’
আ‌মি মুখ ভার ক‌রে বললাম,
‘তাহ‌লে আমার প‌রিবার এসে বি‌য়ের দিন তা‌রিখ ঠিক ক‌রে যাক?’
‘আগে বি‌য়ের ক‌নেকে তো রা‌জি করান?’
‘আরও অপেক্ষা কর‌তে হ‌বে?’
‘অপেক্ষা আপ‌নি নন আমি ক‌রে‌ছিলাম। যেখা‌নে চৌদ্দ বছর অপেক্ষা হ‌য়ে‌ছে; সেখা‌নে চৌদ্দ সংখ্যা প‌নে‌রো হ‌লে কিছু আস‌বে যা‌বে না। আগে আমার না কে হ্যাঁ ক‌রি‌য়ে দেখান।’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বললাম,
‘এখন কী ক‌রি? সেই পুরা‌নো সায়ন আর আজ‌কের সায়‌নের ম‌ধ্যে হাজার পার্থক্য। সে হয়ত চেষ্টা কর‌লে দু একটা মে‌য়ে পটা‌তে পারত, কিন্তু বর্তমা‌নের সায়ন মে‌য়েদের সা‌থে কথা বল‌তেও ভয় পায়। এই যে তোমার সা‌থে কথা বল‌ছি, অথচ দে‌খো আমার হাত পা কাঁপ‌ছে।’
ঐশী আমার পা‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘‌কোথায়? আমি তো দেখ‌ছি না।’
‘ইন্টারনাল কাঁপুনী। খা‌লি চো‌খে দেখা যায় না।’
‘শীতকা‌লে ওমন একটু আধটু কাঁপুনী হয়।’
‘এত ক‌ঠিন শর্ত দেওয়া কী জরু‌রি?’
‘এটা তো শর্ত না। এটা হ‌চ্ছে ক‌নের না কে হ্য‌াঁ বানা‌তে হ‌বে। শর্ত তো তারপর দেওয়া হ‌বে।’
আ‌মি অসহায় চো‌খে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘আ‌মি স‌ত্যি জা‌নি না মে‌য়ে‌দের বলা না কে হ্যাঁ কীভা‌বে ক‌রে? তু‌মি শি‌খি‌য়ে দাও।’
‘আ‌মি ব্যাংকার কো‌নো টিচার না যে বু‌ড়ো খোকা‌দের শিখাব।’
কঠিন ক‌ণ্ঠে কথাগু‌লো ব‌লে চ‌লে গেল ঐশী। আমি চুপচাপ দাঁ‌ড়ি‌য়ে রইলাম। ম‌নে ম‌নে ভাব‌তে লাগলাম,
‘এখন মে‌য়ে‌কে বি‌য়ের জন্য রা‌জি কীভা‌বে করাব? কো‌নো বি‌শেষজ্ঞ ধর‌তে হবে। হ্যা‌লো পাঠক আপনারা জান‌লে অবশ্যই আমা‌কে বু‌দ্ধি দি‌বেন। মে‌য়ে পটা‌নোর ১০১ উপায়।’

ঐশী‌দের বা‌ড়ি‌তে আরও কিছুক্ষণ থাকলাম। ওর প‌রিবা‌রের সাথে অনেক কথাই বললাম। অনেক অজানা কথা জানলাম, যা আমার জানাটা জরু‌রি ছিল। এত‌দিন চো‌খে বিশ্বা‌সের একটা কা‌লো কাপড় বাঁধা ছিল। আজ সে কাপড় যেন ধী‌রে ধী‌রে খুল‌ছে। তবুও একপ‌ক্ষের কথা শু‌নে তো আর সব বিশ্বাস করা যায় না। প্র‌তিটা মানুষ নি‌জের খারাপ দিকটাও ভা‌লোভা‌বে উপস্থাপন ক‌রে। খারাপ প‌রি‌স্থি‌তি এমনভা‌বে পে‌জেন্ট ক‌রে যে তা দেখ‌তে ভা‌লো লা‌গে। আমি আমার প‌রিবা‌রের সাথেও কথা বলব, তা‌দের কথাও শুনব। সবার আগে কথা বল‌তে হ‌বে ছো‌টো মামার সাথে। তা‌কে সারাজীবন আমি আমার আদর্শ মে‌নে এসে‌ছি, তি‌নি ‌কেন আমার সা‌থে এমন কর‌লেন? কেন স‌ত্যিটা লুকা‌লেন?

ঐশী‌দের বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌য়ে ছো‌টোমামা‌কে কল করলাম। সালাম দি‌য়ে, কুশল বি‌নিময় ক‌রে জি‌জ্ঞেস করলাম,
‘মামা, কোথায় আছেন?’
‘এই‌তো মাগ‌রি‌বের নাম‌াজ প‌ড়ে ম‌জিদের দোকা‌নে ব‌সে আছি।’
‘আচ্ছা আমি আস‌ছি, তু‌মি ব‌সো।’
‌’জরু‌রি কিছু?’
‘জরু‌রি না হ‌লে কী এসময় তোমার সাথে দেখা কর‌তে চাইতাম?’
‘আচ্ছা আয়।’

৫!!
মামার দিকে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘মামা, বাবা যখন ছি‌লেন তখনও আমরা সবাই আপনা‌কে একটা বি‌শেষ শ্রদ্ধার নজ‌রে দেখতাম, ঠিক কি না?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাবা মারা যাবার পর আমা‌দের ঘ‌রের মাথা আপ‌নিই হ‌য়ে উঠ‌লেন। আমার তো নি‌জের চাচা নেই। এক ফুপু আছেন তি‌নি তার সংস‌ার নি‌য়ে ব্যস্ত। ব‌ড়ো মামা মারা গে‌ছের বাবারও আগে, তো আমা‌দের প‌রিবা‌রের মাথা বলতে আপ‌নিই। বাবার মৃত্যুর পর ঘ‌রের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধ‌ান্ত আপ‌নি নি‌তে লাগ‌লেন, এখনও নেন? সেটা কেন? কারণ আমরা আপনা‌কে শ্রদ্ধা ক‌রি, মা‌নি ব‌লে, তা-ই কি না?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তুই আজ এসব কথা বল‌ছিস কেন?’
‘মামা, আপনা‌কে আমি আমার আইডল মা‌নতাম, সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভরসা করতাম। তাহ‌লে আপ‌নি কেন আমার সা‌থে এমনটা কর‌লেন?’

মামা বেশ অবাক হ‌য়েই ব‌ল‌লেন,
‘কী ক‌রে‌ছি আমি?’
‘আমার বি‌য়ে ভাঙার পর ঐশীর না‌মে যে এত বা‌জে কথা র‌টে‌ছিল সেটা আপ‌নি জান‌তেন না? ঐশীর যে ভা‌লো কো‌নো বা‌ড়ি‌তে বি‌য়ে হ‌চ্ছিল না সেটা আপ‌নি জান‌তেন না? ঐশীর বাবা দু-তিনবার বি‌য়ের প্রস্তাব পা‌ঠি‌য়ে‌ছিল, মা তা‌দের অনেক অপমান করে‌ছিল সেসব জান‌তেন না? ঐশী যে আজও বি‌য়ে ক‌রেনি তা জান‌তেন না?’

মামা মাথা নিচু ক‌রে রই‌লেন। তার মৌনতা যেন নীর‌বেই সব কিছু সম্ম‌তি প্রদান কর‌ছিল। কিছুক্ষণ মৌন কাটা‌নোর পর আমি বললাম,
‘‌কেন কর‌লেন মামা এমন? আর মা-ই বা আমার সা‌থে এমন না ইনসা‌ফি কেন কর‌লেন?’
‘আ‌মি কিছুই ক‌রি‌নি, কেবল স‌ত্যিটা তোর থে‌কে লু‌কি‌য়ে‌ছি। ত‌া-ও তোর মা‌য়ের অনু‌রো‌ধে।’
‘কেন?’
‘‌শোভা মা‌নে তোর মা আমা‌কে অনেক অনু‌রোধ ক‌রে ব‌লে‌ছিল, এসব কথা যা‌তে সায়ন জান‌তে না পা‌রে।’
‘জান‌লে কী হ‌তো?’
‘সে জানত তুই ঐশী‌কে ভা‌লোবা‌সতি। তার ভয় ছিল বি‌য়ে ক‌রে তুই য‌দি তা‌কে কিংবা তোর অন্য ভাই‌বোন‌দের না দে‌খিস! তা‌দের দি‌কে খেয়াল না রা‌খিস? ও বারবার বলত, তো‌কে যা‌তে এত দ্রুত বি‌য়ের কথা না ব‌লি। এ্যাট‌লিস্ট সা‌মিহা, সা‌মিয়ার পড়া‌লেখা শেষ হ‌য়ে বি‌য়ে হওয়া পর্যন্ত।’

আ‌মি বললাম,
‘সা‌মি‌য়ার বি‌য়েও হ‌য়ে‌ছে আজ চার বছর হ‌য়ে গেছে। ওর দেড় বছ‌রের একটা বাচ্চাও আছে। ওর বি‌য়ে দি‌তেই আমার সব‌চে‌য়ে ‌বে‌শি কষ্ট হ‌য়ে‌ছে। একে‌ তো ওর গা‌য়ে‌র রঙ ময়লা দে‌খে ভা‌লো সম্ব‌ন্ধ আসত না। যা-ও দুই একটা আসত, ওর ঝগড়া করার আর হুটহাট রাগ করার বদ অভ্যা‌সের কার‌ণে তা ফি‌রে যেত। ওর বি‌য়ে‌তে আমা‌কে মোটা অং‌কের যৌতুক দি‌তে হ‌য়ে‌ছিল। ওর বর‌কে পাঁচলাখ টাকা ক্যাশ আর ওর ঘর সা‌জি‌য়ে দি‌তে হ‌য়ে‌ছিল। তো সা‌মিয়ার বি‌য়ের পর কী মা ভে‌বে‌ছি‌লো আমার বি‌য়ের কথা?’
‘সা‌মিয়ার বি‌য়ের পর আমি অবশ্য তোর জন্য ক‌য়েকটা বি‌য়ের প্রস্তাব নি‌য়ে গি‌য়ে‌ছিলাম, কিন্তু তোর মা ব‌লে‌ছি‌লে সা‌মিয়ার বি‌য়ে‌তে অনেক ধার‌দেনা হ‌য়ে‌ছে তা শোধ করার পর। তারপর বল‌লে শ‌ফি‌কের চাক‌রির জন্য মোটা অং‌কের ঘুষ দিতে হ‌বে। সে টাকা ম্যা‌নেজ হ‌লেই তোর বি‌য়ে দি‌বে।’

আ‌মি তা‌চ্ছিল্য হে‌সে বললাম,
‘মামা, তাহ‌লে আমি কেবল আমার প‌রিবা‌রের প্র‌য়োজন মেটা‌নোর মেশিন ছিল‌াম? কেউ একবার আমার কথা ভাব‌লো না? আমার নি‌জের জীবনে শখ আল্হাদ কিছুই থাকতে পা‌রে না মামা? নি‌জের প‌রিবার হ‌তে পার‌বে না? নি‌জের স্ত্রী, সন্তান হ‌বে না আমার? আমি ম‌রে গে‌লে আমার কো‌নো অংশ পৃ‌থিবী‌তে থাক‌বে না? আমি মরে যাবার সা‌থে সা‌থে সব শেষ হ‌য়ে যা‌বে? আমি কেবল অন্যের জন্যই ক‌রে যাব?’
মামা মাথা নিচু ক‌রে ব‌সে রইল। ক‌ষ্টে আমার বুকটা যেন ফে‌টে যা‌চ্ছে। চোখ থে‌কে টপটপ জল পড়‌তে লাগল। আমি আর মামার কা‌ছে বসলাম না। হাঁট‌তে হাঁট‌তে চ‌লে গেলাম।

উদ্ভ্রা‌ন্তের ম‌তো রাস্তায় অনেকটা সময় হাঁটলাম। কতক্ষণ হাঁটলাম ম‌নে পড়‌ছে না। ত‌বে ঘ‌ড়ি‌তে তখন রাত এগা‌রোটার ম‌তো বা‌জে। খি‌দে পে‌য়ে‌ছে খুব। রিকশা নি‌য়ে শহ‌রের সব‌চে‌য়ে ব‌ড়ো ফাইস্টার হো‌টেলে চ‌লে গেলাম। প্রায় দশ হাজার টাকার খাবার অর্ডার করলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হ‌চ্ছে, সাম‌নে এত এত সুস্বাদু খাবার থাকা স‌ত্ত্বেও আমি তা মুখে দি‌তে পার‌ছি ন‌া। এই রেস্ট্রু‌রে‌ন্টে এসে খাবার শখ আমার বহু বছ‌রের। কখনও আসি‌নি, ভে‌বে‌ছি শুধুমাত্র খাবার খে‌য়ে হাজার হাজার টাকা নষ্ট ক‌রব? কা‌দের জন্য ভে‌বে‌ছিলাম? কা‌দের জন্য নি‌জের কথা ভা‌বি‌নি? আমার নি‌জের মা-ও মমতার আঁচল স‌রি‌য়ে নি‌জে‌দের স্বার্থ খুঁজল? বি‌রিয়া‌নি থে‌কে ক‌য়েক লোকমা খে‌য়ে বা‌কি খাবারের সা‌থে আরও কিছু বাড়‌তি খাবার অর্ডার ক‌রে প্যাক ক‌রে দি‌তে বললাম। বি‌লি মি‌টি‌য়ে রিকশা নি‌য়ে চ‌লে গেলাম আজমলের বাসায়। আজমল আমার ছোট্ট অফিসের পিওন। মা‌সে তা‌কে মাত্র দশ হাজার আটশ টাকা বেতন দি। তার বাসায় দরজায় কড়া নাড়লাম। আশ্চর্য এত রা‌তেও ঘরে আলো জ্বল‌ছে, ঘর থে‌কে ছোট্ট বাচ্চার কান্না শব্দ আস‌ছে। এ কান্নার ধ্ব‌নি কতটা মধুর! এমন কান্না ধ্বনি আমার ঘর থে‌কেও তো আস‌তে পারত! এমন ধরাবাঁধা নিয়ম মানা জীবন থে‌কে ছু‌ুটি নি‌য়ে রাত জাগতাম, প্রিয়তম‌কে সময় দিতাম, নিজ সন্ত‌ান নি‌য়ে কত আল্হাদ করতাম। অথচ সবই আজ দীর্ঘশ্বাস।

দ‌রজায় কড়া নাড়তেই অপরপাশ থে‌কে আজমল বলল,
‘‌কে?’
‘আজমল আমি, তোমার সায়ন স্যার।’
আজমল দরজা খু‌লে চূড়ান্ত অব‌াক। বলল,
‘স্যার, এতরা‌তে আপ‌নি?’
‘‌ভিত‌রে ঢু‌কে কথা ব‌লি?’
‌ভিত‌রে ঢু‌কে দেখলাম, আজম‌লের আঠা‌রো কি উনিশ বছ‌রের স্ত্রী নুপু‌রের কো‌লে ওর ছয় মা‌সের ছে‌লে ইব্রা‌হিম। পা‌শে পঞ্চা‌শের কা‌ছাকা‌ছি বয়সী ওর মা। আজম‌লের বয়সও কত হ‌বে। ছা‌ব্বিশ সাতাশ। আমা‌কে দে‌খে আজম‌লের মা আর স্ত্রী খুব খু‌শি হ‌লে‌া। পূ‌র্বে দুই বার আমি এ বাসায় এসে‌ছিলাম। তা‌দের সা‌থে কুশল বি‌নিময় ক‌রে আজম‌লের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘এত রা‌তে জে‌গে কেন?’
‘স্যার, আমার ছে‌লেটা সারা‌দিন ঘুমায় রাত জে‌গে খে‌লে। ও সা‌থে সা‌থে আমরাদেরও জে‌গে থা‌কতে হয়। কী করব ব‌লেন বাচ্চা মানুষ বু‌ঝে তো না কিছুই। আপ‌নি এত রা‌তে এখা‌নে?’
‘ফাইব স্টার হো‌টে‌লে ডিনার কর‌তে গে‌ছিলাম। তু‌মি প্রায়ই ব‌লতে, তোম‌ার খুব শখ তোমার মা আর স্ত্রী‌কে ফাইব স্টার হো‌টে‌লের খাবার খাওয়া‌বে? এই প্যা‌কেটগু‌লো ধ‌রো, এখা‌নে এ শহ‌রের সব‌চে‌য়ে ব‌ড়ো ফাইব স্টার হো‌টে‌লের খাবার আছে।’

আজমল বেশ অবাক হ‌য়ে বলল,
‘স্যার এসব কেন?’
‘আজ আমি আমার জীব‌নের বি‌শেষ কাউ‌কে পে‌তে চ‌লে‌ছি। যে হারি‌য়ে গি‌য়ে‌ছিল। সেটা তোমার কার‌ণেই। এগু‌লো আমার তরফ থে‌কে ছোট্ট উপহার।’
‘বুঝলাম না স্যার।’
‘এক‌দিন অফি‌সে ব‌সে সব খু‌লে বলব। এখন চ‌লি।’
‘স্যার চা খে‌য়ে যান? আপ‌নি জা‌নেন নুপুর খুব ভা‌লো চা বানায়।’
‘আচ্ছা দাও তাহ‌লে। চি‌নি ছাড়া চা দিও।’
চা খে‌য়ে একদম শহ‌রের অপরপ্রা‌ন্তে একটা থ্রি স্টার আবা‌সিক হো‌টে‌লে গেলাম। ক‌য়েকটা দিন এখা‌নেই কাটাব। বা‌ড়ির কারও সাথে যোগা‌যোগ করব না। একটা শিক্ষা তো সবাই‌কে দি‌তেই হ‌বে। দে‌খি আমার অনুপ‌স্থি‌তি‌তে কে কতটা বিচলিত হয়। তা‌দের আমা‌কে প্র‌য়োজন না‌কি আমি নামক টাকার মে‌শিনটা‌কে? মা‌ঝে মা‌ঝে একটু স্বার্থপর হ‌তে হয়।

চল‌বে…