শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-০৩

0
362

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩]

রিতা আন্টির বাড়ি থেকে বিয়ের আমেজ বিদায় নিতেই বাড়িটা নির্জন হতে শুরু করেছে। এই বাড়িটা পুরোনো ও রঙ ওঠা হওয়ায় বাইরে থেকে একটু ছমছমে মনে হয়। জনশূন্যতায় গাছগাছালি ঘেরা চারপাশ যেন নিঝুম হয়ে ডুবে থাকে। বিয়ের দিনের পর টুকটুকি আর রিতা আন্টির বাড়িতে পা রাখেনি। আজ ক্লাস শেষে ফেরার পথে হুট করে বাড়িটার সামনে তার পা থামল। দোতলার বারান্দায় টিশার্ট, প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার ঝুলছে। অর্থাৎ রিতা আন্টির ছেলে এখনো বাড়িতেই আছে। টুকটুকি খেয়াল করল সেদিনের উপেক্ষার সুক্ষ্ম খোঁচাটা তার ভেতরে আবারো নাড়া দিচ্ছে।

হুট করে পায়ের কাছে নরম কিছুর অস্তিত্ব পেয়ে টুকটুকি অবনত হলো। রিতা আন্টির বিড়াল তার পায়ের সঙ্গে গা ঘষছে। টুকটুকি তাকে কোলে তুলে গা চুলকে দিতে দিতে বলল,
“কিরে পামকিন, দুদিন ভালোমন্দ খেয়ে দেখি আরো গুলুমুলু হয়েছিস।”
পামকিন তার গোল গোল নিষ্পাপ চোখজোড়া মেলে মন দিয়ে গোলগাল গড়নের মিষ্টি মেয়েটাকে দেখছে। টুকটুকি আবারো তাকায় ওপরতলায়। অনেক দিন ধরে রিতা আন্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় উনার ছেলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ক্ষীণ ইচ্ছে তার ভেতরে গড়ে উঠেছিল। এবং সেই ইচ্ছেটার প্রথম ধাক্কায় ভরাডুবি হওয়ায় টুকটুকির খারাপই লেগেছে। ভেবেছিল পরে হলেও লোকটা যেচে আসবে পরিচিত হতে। কিন্তু সেদিন বিয়ের আসরে যখন নন্দিনী সকলের হৃৎপিণ্ড নিয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছিল তখনও নিশীথ তাকে পাত্তা দেয়নি। একটা লোক তাকে অগ্রাহ্য করে এভাবে এটেনশন কেড়ে নিল যে টুকটুকি তাকে মাথা থেকে তাড়াতেই পারছে না! টুকটুকি মনে মনে নিজের ওপর চরম বিরক্ত হয়। বন্ধুদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ হওয়া দরকার। এর একটা বিহিত হওয়া চাই। টুকটুকি নাক ফুলিয়ে পামকিনকে বলল,
“তোর মালিক আস্ত অসামাজিক। কোনো সহবৎ জ্ঞান নেই। একটা নাক উঁচু, অহংকারী মানুষ। কী ভাবে অন্যকে? পাত্তা পেতে ম’রে যাচ্ছি?”
সঙ্গে সঙ্গে একটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরের মালিক প্রত্যুত্তর করল,
“ম’রেই তো যাচ্ছেন মনে হচ্ছে!”

টুকটুকি পেছনে ফিরতেই দেখল তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে লম্বাটে যুবক থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভ্রু জোড়া কুচকানো। টুকটুকি ভড়কে গিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। হুট করেই সূর্যের তাপ বেড়েছে নাকি তার অভ্যন্তরীণ অস্বস্তিতে গরম লাগতে শুরু করেছে বুঝতে পারছে না। নিজেকে সামলে উঠতেই খেয়াল হলো লোকটা এবার তাকে শব্দের খোঁচা দিল। বলল,
“কী বোঝাতে চাইছেন?”
টুকটুকির মুখের দিকে তাকিয়ে নিশীথ অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে দ্বিতীয় কথাটা বলল,
“অসামাজিক, নাক উঁচু, অহংকারী কে?”

টুকটুকি দমে গেল না। এই অহংকারী লোকের সামনে সে একচুলও নত হবে না। বলল,
“অন্যের কথা লুকিয়ে লুকিয়ে শোনাকে তো অসামাজিকতাই বলা উচিৎ।”
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইক বাজিয়ে কথা বলবেন আর সেটা অন্যের কানে গেলেই অসামাজিক?”
টুকটুকি জ্বলে উঠল,
“আপনি আমার গলাকে মাইক বলছেন?”
“যা সত্যি তাই বলেছি।”

রাগে-দুঃখে টুকটুকির হাত-পা ছুড়তে ইচ্ছে করে। প্রথমে উপেক্ষা, এরপর খোঁচা আর এখন সরাসরি তার গলার স্বরকে অপমান? টুকটুকি জোরালো গলায় বলল,
“তাহলে আমিও যা বলেছি সত্যিই বলেছি। আপনি শুধু অসামাজিকই না চূড়ান্ত অসভ্যও।”
নিশীথ হতভম্ব হয়ে গেল। আঠাশ বছরের জীবনে প্রথমবার একজন মেয়ে তাকে অসামাজিক তকমা দিয়ে বোনাসস্বরূপ অসভ্য বলল! নিশীথ তার উদ্বেলিত ক্রোধকে বুকের ভেতর আটকে ধরে আরেকটু গম্ভীর স্বরে বলল,
“আপনার কয় বিঘা জমির ধানে মই দিয়েছি যে আমায় এইসব ফালতু তকমা দিলেন?”

টুকটুকি চুপ রইল। নিশীথ তাকে উপেক্ষা করায় অহংয়ে লেগেছে এই কথা উচ্চারণ করা মানে নিশীথকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়া। উহু, সেটা সে করবে না। নিশীথ ওকে চুপ থাকতে দেখে খানিক শ্লেষের সুরে বলল,
“অবশ্য আপনার কাছে এরচেয়ে ভালো আর কিই বা আশা করা যায়?”
“বলতে চাইছেনটা কী আপনি?”
“আপনি ইচ্ছে করে নিপার বিয়েতে আপনার বান্ধবীকে আনেননি?”
“এনেছি তো কী হয়েছে? আপনাদের খাবার কম পড়েছে? আমরা তো বিনা দাওয়াতে আসিনি, বিনাপয়সাতেও খাইনি। দাওয়াত করে খোটা দিচ্ছেন?”
“আমার সরল মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দাওয়াতটা তো আপনিই নিয়েছিলেন। যেন বিয়েতে সিয়ামের এক্সকে উপস্থিত রেখে হাঙ্গামা বাধানো যায়।”

টুকটুকি যারপরনাই চমকাল। সিয়াম নন্দিনীর পূর্ব সম্পর্কের কথা তো কেউই জানে না৷ নিশ্চিত হতে বলল,
“আপনাকে কে বলেছে? তাছাড়া সিয়ামের এক্স কে সেটা আমি কীভাবে জানব?”
“ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, নিপার স্বামী হওয়ার আগে থেকেই সিয়াম আমার ফ্রেন্ড। আপনার কাছে বান্ধবীর এক্সকে জানা হিমালয়ের রহস্য মনে হলেও আমার কাছে আহামরি কঠিন বিষয় নয়।”

নিশীথের ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। ধরা পড়ে টুকটুকির মুখখানা সাদা হয়ে গেল। যেন শরতের মেঘের একটা দল এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে একটু নেমে এলো তার মুখে বিশ্রাম নিতে। টুকটুকি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কা’ম’ড়ায়। সিয়াম নিশীথের পূর্ব পরিচিত এই তথ্যটা তার একদমই জানা ছিল না। থাকলে জীবনেও এমন রিস্ক নিতো না। রিতা আন্টি জেনে গেলে কী হবে?

পামকিনও বোধহয় মালিকের কথায় সায় দিয়ে টুকটুকির কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে সুড়সুড় করে চলে গেল নিশীথের কাছে। টুকটুকি ওর দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যেন বোঝাতে চাইল,
“আর জীবনে উঠিস আমার কোলে।”
মুখে বলল,
“ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন বরযাত্রী আসার আগে আমরাও জানতাম না নিপার স্বামী কে। সিয়াম যেমন চমকেছে আমরাও চমকেছি।”
চমৎকার মিথ্যাটা বলতে পেরে টুকটুকি নিজের ওপর অভিভূত হয়ে গেল। আত্মবিশ্বাসের প্রদীপ জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গে। ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সম্মুখের অহংকারী লোকটির দিকে।

নিশীথের ভাবান্তর হলো না। বরং সেও অপমান করার আরো একটা সুযোগ পেয়ে বসল। বলল,
“জানার পরও ইচ্ছে হলো না প্রস্থান করার? উল্টে আপনার ছেলেবাজ বান্ধবী বিয়ের আসরে রুচিহীন তামাশা করে এসেছে।”
ছেলেবাজ কথাটা টুকটুকির গায়ের বিঁ’ধল। বন্ধুদের অপমান সে কখনোই সইতে পারে না। সেখানে এই চরম অ’সভ্য লোক সরাসরি তার বন্ধুকে ছেলেবাজ বলে দিল? টুকটুকির মনে ক্রমেই লোকটির জন্য ঘৃ’ণা জন্মাতে লাগল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আমার বন্ধু ছেলেবাজ হলে আপনার বন্ধু লু’ই’চ্চা।”
“ওহহ আচ্ছা! কী লু’চ্চা’মি করেছিল সে?”

নিশীথ টুকটুকির প্রতিটি ভঙ্গি খেয়াল করছিল। খেয়াল করল তার প্রশ্নে মেয়েটা কেমন লাল হয়ে গেল। টুকটুকি বলল,
“এতকিছু বলেছে আর আসল কারণটাই বলেনি? এই আপনার বন্ধুত্ব? আমরা তো বন্ধুদের কাছে কিছু লুকাই না।”
“অবশ্যই বলেছে। প্রেমের দুই সপ্তাহের মাথায় যেই মেয়ে আরেক ছেলের হাত ধরে চলে যায়, তার সঙ্গে ব্রেকাপ করবে না তো বসে থাকবে কখন ফিরে আসে?”
“আপনার বন্ধুত্বের দৌড় বোঝা হয়ে গেছে আমার। ব্রেকাপের সত্যিটা পর্যন্ত জানেন না।”

নিশীথ বুকে দুই হাত গুজে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তো ব্রেকাপ কেন হয়েছিল আপনিই বলুন, শুনি।”
“সিয়াম ইকরিকে মোটা হতে বলেছিল।”
নিশীথ আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“তো এখানে খারাপের কী আছে? গার্লফ্রেন্ডের স্বাস্থ্যের কথা বয়ফ্রেন্ড ভাবতেই পারে।”
“মোটেও স্বাস্থ্যের কথা ভাবেনি। সে..সে..”
টুকটুকির কথা আটকে গেল। আড়ষ্টতায় জিভ অনড় রইল। নিশীথ পামকিনের লেজ নিয়ে খেলতে খেলতে জিতে যাওয়ার ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দোষ দেওয়ার জন্য আর লেইম কারণ ভেবে পাচ্ছেন না, তাইতো?”

নিরাক দুপুরে একের পর এক বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে টুকটুকির চোখ টলটল করে উঠল। তা দৃষ্টিগোচর করে নিশীথ থ বনে গেল।
“আপনি এত আশ্চর্য কেন? এখানে কান্নার কী হলো?”
টুকটুকির মনে জেদ চেপে বসল। এই লোকের সামনে পরাস্ত হবে না সে। বলল,
“এক মিনিট ওয়েট করুন। একদম যাবেন না।”

টুকটুকি নিশীথের পাশ থেকে সরে ফোনে ঢু মা’রল। ম্যাসেঞ্জারে তাদের বন্ধুদের একটা চ্যাট গ্রুপ আছে। যার নাম ‘শ্রাবণ কিংবা ফাগুন, একটুখানি বর্ষণ।’ সেখানে মন খারাপের শ্রাবণ, আনন্দের আশ্বিন, অভিমানের পৌষ, রাগের চৈত্র কিংবা প্রেমের ফাগুন সবটাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরে। একজনের অনুভূতির বর্ষণ ভিজিয়ে দেয় অন্যদের। সেখানে মনের কোনো পর্দা থাকে না। টুকটুকি গ্রুপে ঢুকে ভিডিও কল দিল। ভাগ্য ভালো ইকরিই আগে জয়েন করল। টুকটুকির ভেজা চোখ দেখে বলল,
“কীরে ছেড়ি? কান্দস ক্যা? রাস্তায় ঝামেলা হইছে?”

টুকটুকি কান্না চেপে বলল,
“দোস্ত, সিয়াম তার বন্ধুর কাছে নিজেকে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা আর তোকে ছেলেবাজ বলে আখ্যা দিয়েছে।”
“আরেহ, ওয় যদি দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হয় তাইলে ওইটা কু’ত্তা’র দুধ। কিন্তু হেরলগে তোর কান্দনের কী লিংক বইন?”
“উনার বন্ধু আমাকে অপমান করছে।”
টুকটুকি সবটাই খুলে বলল। ইকরি শুনে বলল,
“এই কথায় কান্দন লাগব? তুই কি বালিকা হইয়া গেছোস যে কেউ চোখ গরম করলেই কাইন্দা দিবি? আমি এহন সামনে থাকলে চটাস চটাস কইরা দুই থা’প্প’ড় লাগাইতাম তোরে। খালি চোখ দিয়া না, তখন নাক দিয়াও পড়ত।”
টুকটুকি অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“আর আমি যে তোর জন্য ফাইট করছি তার বেলায়?”
“ফাইট করতে গিয়া দাঁত খুইল্লা ফালাইতাছো এক্কেরে। ওই ব্যাটার থোবড়াখানি ক্যামেরার সামনে ধর। উত্তরটা আমিই দিতাছি।”

টুকটুকি ফিরে গেল নিশীথের সামনে। নিশীথ এতক্ষণ অবাক চোখে ওর কান্ডকারখানা দেখছিল। যেন এমন আজব মেয়ে সে জীবনে দুটো দেখেনি। এর সঙ্গে তার মায়ের ভাব কী করে হলো সেটাও বিস্ময়ের ব্যাপার। মনে মনে ঠিক করল মাকে বলবে মেয়েটার সঙ্গে যেন মেলামেশা কমিয়ে দেয়। টুকটুকি সরাসরি নিশীথের মুখের সামনে ফোন ধরে বলল,
“কথা বলুন।”

স্ক্রিনে এক মেয়েকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশীথ ভড়কে গেল। নন্দিনী তার হলের রুমে বসে ছিল। পরনে টিশার্ট। চুলগুলো চুড়ো করে তালুতে বাধা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছে। নিশীথকে দেখে তার সামান্যতম ভাবান্তর হলো না। উলটে তাকে দেখে নিশীথ সংকুচিত হলো। নন্দিনী শুদ্ধস্বরে বলল,
“আপনার বন্ধুর সাথে আমার ব্রেকাপের কারণ সে আমায় মোটা হতে বলেছিল এ পর্যন্ত ঠিক। তবে সেটা আমার স্বাস্থ্যের জন্য নয়। সিয়াম বলত মোটাদের নাকি ধরতে আরাম। শুকনোদের গায়ে শুধু হাড্ডি। এরচেয়ে ভেঙে বলতেও অসুবিধা নেই যদি আপনার শুনতে অসুবিধা না থাকে।”

নন্দিনীর অকপট শব্দে নিশীথ আড়ষ্ট হয়। কী জাদরেল মেয়ে! মুখে কোনো জড়তা, লাগাম কিচ্ছু নেই? নিশীথের মুখ দেখে টুকটুকির হাসি পেয়ে গেল। তাকে বোকা পেয়ে কথা শুনিয়েছে এবার শোনাও দেখি! দাঁত খুলে দেবে একদম। নন্দিনী বাঁকা হেসে বলল,
“ব্রো, আমি ছেলেবাজ হতে পারি কিন্তু শরীরবাজ নই। নিপা নাদুসনুদুস আছে। সংসারটা ভালোই হবে মনে হচ্ছে। তবুও খেয়াল রাখবেন। দেহের ভেতরের মন আর মাথার ওপরের আকাশ, দুটোরই কোনো বিশ্বাস নেই। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। শুধু পার্থক্য হলো মাথার ওপরের আকাশের কোনো গোপনীয়তা নেই। কিন্তু মন দেহের ভেতর সীমাবদ্ধ। তাই তার পরিবর্তন বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর।”

চলবে…