শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-০৫

0
345

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫]

সদ্য ঘুম থেকে উঠে অপরিচিত এক মেয়ের সামনে নিজের নামের বে’ই’জ্জ’তি হতে দেখা ঠিক কতটা হৃদয়বিদারক ঘটনা তা অনুভবের চেয়ে এই মুহূর্তে কেউ ভালো বুঝবে না৷ সে বিচিত্র ভঙ্গিতে সম্মুখের মেয়েটিকে আগাগোড়া দেখে নেয়। কড়া গলায় বলে,
“তুমি তাহলে নতুন কাজের লোক?”
প্রিয়ার মুখটা শুকনো হয়ে আসে। শব্দটা তার কানে বড়োই কটূ শোনায়। সে কি কাজের লোক? উত্তরটা ভাবার আগেই অনুভব কড়া গলায় নির্দেশ করল,
“ভেতরে এসো।”

অনুভব দরজা ছেড়ে ভেতরে চলে গেল। প্রিয়া একটু দ্বিধান্বিত পায়ে দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালা গলে ঝলমলে রোদ এসে গড়াগড়ি করছে ফ্লোরে। সাদা টাইলসের ঝলকানিতে চোখ ঝলকে ওঠে। প্রিয়ার ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও দৃষ্টি সবল। অনুভব বিছানায় হেলে বসেছে। পরনে ট্রাউজার, কালো শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। তাতে গৌড় দেহের রঙ খুলেছে। প্রিয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙুল দ্বারা ব্যাকব্রাশ করতে করতে বলে উঠল,
“ওভাবে কী দেখছো? জীবনে হ্যান্ডসাম ছেলে দেখোনি?”
“দেখেছি।” প্রিয়ার গলা স্বাভাবিক।

অনুভবের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। কণ্ঠ হয় ক্ষুরধার,
“কিন্তু আমার মতো হ্যান্ডসাম দেখোনি, তাইতো?”
প্রিয়া সরল মুখে মাথা নাড়ে। তা দেখে অনুভবের ঠোঁটের কোণে দাম্ভিক, গৌরবান্বিত হাসি ঠাঁই পায়। পরক্ষণেই তা ঝুলে পড়ে পরবর্তী বাক্যদ্বয় শুনে।
“কিছু সুন্দর পুরুষ দেখলে মনে হয় ওরা কেন মেয়ে হলো না। আপনি সে রকম সুন্দর।”
“বলতে কি চাইছো তুমি?”

প্রিয়া অতি মনোযোগী ছাত্রীর ন্যায় অনুভবের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার গালে যদি দাড়ি না গজাতো, চুলগুলো যদি লম্বা হতো আর মেয়েদের জামাকাপড় পরতেন তাহলে অপরূপা লাগত।”
অনুভব খ্যাকিয়ে ওঠে,
“সে তো তোমার গালে যদি দাড়ি গজাতো, চুলগুলো কদমছাঁট হতো, ছেঁড়া ফাটা শার্ট-প্যান্ট পরতে, গলায় কতগুলো মালা আর হাতের পাঁচ আঙুলে আংটি ঝুলিয়ে ক্যারাম খেলতে তাহলে তোমাকেও পাড়ার মোড়ের ব’খা’টে রঞ্জুর মতো লাগত।”

প্রিয়া চুপসে গেল। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় মেঝেতে। মনে মনে নিজেকে অনুভবের বর্ণনায় কল্পনা করার চেষ্টা করে। ছেলেরূপে কী তাকে খুব বেশি জ’ঘন্য লাগত? একদম ব’খাটে রঞ্জুর মতোন? ছিঃ! প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। রঞ্জুকে সে চিনেছে কলোনির বস্তিতে ওঠার পর। ময়লা, তেলচিটে জামা-কাপড় পরে, মাথায় একটা রুমাল বেধে ঘুরে বেড়ায়। মধ্যমা ও অনামিকার ভাজে গোজা থাকে সস্তার বিড়ি। দাঁতে মাখা থাকে মোটা স্তরের গুল। কথা বললে ভকভক করে গন্ধ ছোটে ঠোঁটের ফাঁক গলে। তল্লাটের এমন কোনো মেয়ে তার দৃষ্টির অগোচরে থাকেনি। রঞ্জু আবার নারীদের বেলায় ধর্ম, গায়ের রঙ, জাত কিছু মানে না। মেথর কন্যা থেকে প’তি’তা পল্লীর লাস্যময়ী, সবাইকেই প্রেমের নজরে দেখে। জেন্ডার ফিমেল হওয়া নিয়েই কথা। রঞ্জুকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করতে হলে বলা যায় নারী অন্তপ্রাণ। নারীর সেবায় চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত। তার নজর প্রিয়ার ওপরও পড়েছে বটে। অনুভবের কথায় সে সচকিত হলো।

“তুমি কি জানো তুমি একটা বে’য়া’দব গোছের মেয়ে?”
“জি না।”
“আবার বে’য়া’দবি? তামাশা করো? এই মুহূর্তে তোমার চাকরি নট করে দিতে পারি জানো?”
এ পর্যায়ে প্রিয়া জবাব দিল না৷ সে ঠিক কোথায়, কীভাবে বে’য়া’দবি করল ধরতে পারছে না। মেয়েটির নত মুখ অনুভবকে তৃপ্তি দিল। যেই না চাকরি যাওয়ার কথা বলল অমনি জোকের মুখে নুন পড়েছে। এইসব পাকা মেয়েদের অনুভবের হাড়ে হাড়ে চেনা। সে জিজ্ঞেস করল,

“পরিচয়ই তো জানা হলো না। তোমার নাম কী মেয়ে?”
প্রিয়া নিচু গলায় বলল,
“প্রিয়া।”
অনুভব ভ্রু কুচকে মেয়েটির মাথা থেকে পা অবধি চোখ বোলায়। খানিক সুর টেনে ব্যঙ্গ করে বলল,
“কাজের মেয়ের নাম প্রিয়া! আসল নাম তো?”
“জন্ম নিবন্ধন দেখাতে হবে?”
প্রিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে অনুভব কিছুটা দমে গেল। তবে তা প্রকাশ না করে বলল,
“আজকাল পয়সা দিয়েই সেসব বানানো যায়।”
প্রিয়া চুপ করে রইল। নাম নিয়ে জীবনে এই প্রথম বিড়ম্বনায় পড়ল বোধহয়। অনুভব আবার বলল,
“উহু উহু, এ ধরনের নাম এলাও না।”
“কেন?” প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায়। কাজ করতে হলে নামও যে ভাবনার বিষয় তা জানা ছিল না। অনুভব বলল,
“কাজের লোকের নাম হবে সখীনা, জরিনা, ফরিদা, মতির মা, হাসুর মা…”
“আমি বিবাহিত নই।” প্রিয়ার তড়িৎ উত্তর।
“ও! তাহলেও প্রিয়া নাম চলবে না। একেই আমি এলিজিবল ব্যাচেলর, বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একা থাকি। তারওপর তুমিও যুবতী। লোকে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। উম… তোমার নাম দিলাম হাসু। হা…সুউউ। রান্নাঘরে যাও হাসু। পানি গরম দাও। গোসল করব।”

প্রিয়া করুণ চোখে তার নামের মৃ-ত্যু দেখে প্রস্থান করল। খানিক বাদে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবার ফিরেও এলো। অনুভব পা নাচিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল। প্রিয়াকে দেখে চোখ সরিয়ে অসন্তোষের সঙ্গে বলল,
“কী ব্যাপার?”
“আমি ছুটা বুয়া নই। অন্তরা আপা আমাকে বাবুর টেক কেয়ার করতে এনেছেন। তবুও আমি পানি গরম দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এই গরমের মধ্যে কে গরম পানি দিয়ে গোসল করে?”
অনুভব থতমত খেয়ে গেল। হুকুম দেওয়ার সাধে মুখে যা এসেছে বলে ফেলে নির্বুদ্ধিতা করলেও দমে গেল না।
“আমি করি, তোমার কোনো সমস্যা?”
“না। আপনি একটু বাবুকে রাখুন। করে দিচ্ছি আমি।”
প্রিয়া অনুভবের কোলে তার ভাতিজাকে রেখে চলে গেল। মিনিট খানেক বাদেই তার কোল ভিজে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল অনুভব,
“অ্যাই হাসু? বাবুকে ডায়পার পরাওনি কেন?”
প্রিয়া ছুটে এসে বলল,
“আপনাকে আনতে বলেছিল তো।”
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। বাবুকে প্রিয়ার কোলে ধরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“দূর হও চোখের সামনে থেকে। তৃ-সীমানায় দেখলে খু-ন করে দেব।”

প্রিয়া ভীত পায়ে বেরিয়ে গেল। প্রথমদিনের যা অভিজ্ঞতা হলো তাতে এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর সঙ্গে সে টিকতে পারবে বলে মনে হয় না।
_______________

চায়ের দোকানে মুখোমুখি বেঞ্চিতে বসেছিল টুকটুকি ও দিগন্ত। মিনিট গড়াতেই কোত্থেকে উড়ে এসে দিগন্তের বেঞ্চিতে ধপ করে বসল নন্দিনী। সঙ্গে সঙ্গে ভুমিকম্পের মতো নড়ে উঠল দিগন্ত। ভরা কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল কোলে। দিগন্ত লাফিয়ে উঠল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি কুরবানির বকরি। দিনে দুপুরে পু’ড়ি’য়ে মা’রতে চাস?”
নন্দিনীর পরনে একটা মেরুন সেমি লং টপস ও প্যান্ট। সে দুই পা তুলে বাবু হয়ে বসল। দিগন্তের কথা শুনে নিজের বড়ো নখ দ্বারা ওর গায়ে একটা সজোরে চি’মটি কা’টল। দিগন্ত আরেকদফা আ’র্ত’নাদ করে উঠল,
“আহ! অ’সভ্য মহিলা। চি’মটি দিলি কেন?”
“যেমনে চায়ের গরমে শইল পু’ইড়া যাওনের অপবাদ দিলি, দেখলাম তোর ত্বক মোমের নাকি চামড়ার।”
“তোর বিরুদ্ধে আমি সাভার থা’নায় জি’ডি করে রাখব। তোর ওই ডা’ই’নির মতো বিশাল নখ দ্বারা যেকোনো দিন মারাত্মক জ’খম হয়ে যাওয়ার চান্স আছে আমার।”
“তোর তো নিজেরে শোকেসে তুইল্যা রাখন উচিত।”
“আর তোর উচিত নিজের রা’ক্ষসের মতো হাত দুইটাকে ডোবায় ফেলে আসা। ইয়াক!”

টুকটুকি মিটিমিটি হেসে চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে দুজনের ঝগড়া গিলছিল। এ পর্যায়ে মাথা নেড়ে বলল,
“আসলেই ইকরি। তোর নখগুলো বেশি বড়ো হয়ে গেছে। দেখতে ভাল্লাগছে না।”
নন্দিনী রহস্যময়ী হাসি দেয়। নখের ধার পরখ করতে করতে বলে,
“খাড়াও মামা। আগে দুই একটা ব’ল’দের চামড়া কাটি। এরপরে পার্লারে গিয়া মেনিকিওর কইরা আসমু।”
“তোর মতলবটা কী?” টুকটুকি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। নন্দিনী সেই কথা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল,
“শিকু কই? ওই হালায় এত লেইট ক্যান?”

আজ অনুভবের ক্লাস শেষ হতে হতে দুপুর একটা বেজে গেছে। অবশ্য সে ক্লাস করেছেই মোটে একটা। অনুভব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসোফির ছাত্র। অন্যদিকে নন্দিনী, দিগন্ত ও টুকটুকি ফিজিক্সে পড়াশোনা করছে।
এত এত গাছগাছালি, পাখপাখালির, সরোবর ও সবুজ সমারোহের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে অনুভবের মনটা মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়। প্রেম ও প্রকৃতি দুটোই হলো হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটার অনুপস্থিতিতে অন্যটি ম্লান হয়ে যায়। অথচ অনুভবের চারপাশে দুটোই আছে। তবুও বুকের ভেতরটা খা খা করে এই প্রেম ও প্রকৃতির সদ্ব্যবহার করতে না পেরে। একটা কোমল হাতের ভাজে হাত গুজতে না পেরে। বিমর্ষচিত্তে সে করিম আলীর চায়ের দোকানে উপস্তিত হলো। টুকটুকির পাশে বসতেই নন্দিনী বলে উঠল,
“কিরে বেডা? চাপা চোপা ভসকাইয়া রাখছোস ক্যা?”
“আর কইস না বেডি। জীবনে প্রেম নাই, তাই চেহারায় জৌলুশ নাই। এদিকে ভাবীর নামের অ’ত্যা’চার আমাকে বাইরের মানুষের সামনেও অপদস্ত করছে।”

“আবার কী হয়েছে?” দিগন্ত জানতে চাইল।
“আর বলিস না। গতকাল মাঝরাত অবধি এক মেয়ের সাথে ভাব জমাচ্ছিলাম বলে ঘুমাইতে লেইট হইছে। সকালে দুরুম দারুম দরজা ধাক্কানোর শব্দে উঠলাম। দরজা খুলতেই ভাতিজাকে টেক কেয়ার করতে আসা নতুন মেয়ে বলে অনু আপুকে ডেকে দিন। বাচ্চার ডায়পার কিনতে যেতে হবে। লাইক সিরিয়াসলি! ভাবী আমার নামটাকে জেন্ডার ক্রাইসিসে ফেলে দিছে!”
সকলে একযোগে হেসে উঠল। নন্দিনী গলা উঁচিয়ে চায়ের দোকানীকে বলল,
“মামা, আমাদের অনু আপারে একটু বেশি চিনি মা’ইরা চা দেও।”
অনুভবের মুখটা আরেকটু গম্ভীর হলো। বলল,
“হ, তোমরাই বাকি ছিলা খিল্লি উড়ানোর। আসল কথা তো এখনো বাকি আছে।”
“জলদি বল।” টুকটুকি তাড়া দিল।
“ওই কামের মাইয়া বলে, কিছু সুন্দর পুরুষ দেখলে মনে হয় ওরা কেন মেয়ে হলো না। আমি নাকি সেই রকম সুন্দর। আমিও কী ছাইড়া দেওয়ার পাত্র! দিলাম তার সুন্দর নাম বদলাইয়া। প্রিয়া থেকে ডিরেক্ট হাসু।”

নন্দিনী আফসোস করে বলে,
“আসলেই। তোর যেই রূপ, তার অর্ধেকটা পাইলে খালি বাংলাদেশ ক্যান বিশ্বব্যাপি এক্স সাপ্লাই দিতাম।”
টুকটুকি ফোড়ন কেটে বলল,
“এই রূপেই যা লীলা তুমি দেখাও মাগো। যে হারে তোমার এক্সের উৎপাদন হচ্ছে তাতে আমি তো টেনশনে পড়ে গেছি বিয়ে করতে গিয়ে না দেখতে হয় স্বামী, দেবর, ভাসুর সব ইকরির এক্স।”
সকলে আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল। দিগন্ত মাঝখান থেকে বলল,
“তা মধ্যরাত অবধি যার পেছনে শ্রম দিলি, সেই মেয়েটার সঙ্গে কদ্দুর এগোলো?”
নন্দিনী সঙ্গে যোগ করল,
“ডেট-ফেট হবে?”
অনুভব মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল,
“মেয়ে ক্যাম্পাসেরই। বাংলা ডিপার্টমেন্ট-এর। দিনক্ষণ ফিক্সড। কালকে আনন্দ দিঘির সামনে মিট করবে।”
সকলে একযোগে আশার আলো দেখে। এবার যদি একটা কিছু হয়। নন্দিনী মাঝখান দিয়ে বলে উঠল,
“মামা, এই খুশিতে আজকের খাওনের বিল তোমার।”
অনুভব মুখ ঝামটা দেয়,
“খয়রাতি কোনহানের।”

চলবে…