শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-০১

0
732

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
পর্ব-০১
প্রভা আফরিন

সূর্যতপ্ত দুপুরে চারিদিকে ব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি। বিয়ে বাড়ির আমেজে পরিবেশ মুখর। তবে নন্দিনী আপাতত মৌন। মাসখানেক আগেও যে পুরুষটির সঙ্গে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, আজ তারই বিয়েতে অতিথি হয়ে এসেছে সে। কাজল টানা ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে ফুলে সাজানো বিশাল গেইটের দিকে। যাতে বড়ো করে লেখা ‘সিয়াম ওয়েডস নিপা’। নন্দিনী পলকহীন তাকিয়ে থেকে ভঙ্গুর কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল,
“যে মানুষটা এক সময় আমি বলতে পাগল ছিল, আজ থেকে সে নিপার নামে দলিল হতে যাচ্ছে। নিপার জন্যও কি তেমনই পাগল হবে?”

ঘেমে-নেয়ে অনুভবের মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। চড়া রোদ যেন তার উজ্জ্বল ত্বককে উত্য’ক্ত করছে। হুট করে নারী কণ্ঠের আক্ষেপ শুনে এক ভ্রু উঁচু করল অনুভব। দু-পা এগিয়ে এসে নন্দিনীর কাঁধ জড়িয়ে বলল,
“তোর এক্স দেখি ফাইভ-জি স্পিডে চলে, ইকরি। ব্যাটা এক মাসের মধ্যে পাত্রী ঠিক করে একদম বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল!”
পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় দিগন্ত। ঠোঁটের কোণা একপাশে চোখা করে বলল,
“ইকরির চেয়ে কম। সিয়াম যেন তোর কয় নাম্বার এক্স?”

নন্দিনী ঝারা মেরে অনুভবের হাত সরায় কাঁধ হতে। দিগন্তের দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টি ফেলে বলল,
“কাম অন ইয়ার, আমি একটু সেন্টি খাওয়ার চেষ্টা করতেছি। আর তোরা আছস কার স্পিড বেশি তা নিয়া?”

“সেন্টি আর নন্দিনী?” একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল দিগন্ত ও অনুভব। যেন এহেন অবাক করা কথা তারা ইহ জনমে দ্বিতীয়টি কর্ণগোচর করেনি। নন্দিনী কানে আঙুল গুজে বলল,
“ষাঁড়ের মতো চিল্লাস ক্যান? বিয়াতে ঢোকার আগেই বাইর কইরা দিবে তো।”
অনুভব বলল,
“আগে আমায় বল, সেন্টি জিনিসটা তুই চিনিস?”
দিগন্ত সঙ্গে যোগ করল,
“সেন্টি ওরে চেনে কিনা তাই জিজ্ঞেস কর।”
নন্দিনী তার চকচকে, তামাবরন কাঁধ ঝাকিয়ে, দৃষ্টিতে খানিক দ্বিধা ঢেলে বলল,
“সর্ব প্রথম ছ্যাঁকাটা বোধহয় আমি সেন্টিরেই দিছিলাম। ব্যাটা এহন আমারে চিনেই না।”

“ও সেন্টি, ও সেন্টি তুমি উইড়া উইড়া আসো। উইড়া উইড়া বন্ধু তুমি ইকরির মাথায় বসো।”
অনুভবের গানে সকলে হেসে উঠল। গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে তিন ছেলেমেয়েকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখে বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথিরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। বিশেষ করে নন্দিনীর অফ শোল্ডার মেরুন ব্লাউজের ওপরের দৃশ্যমান সুডৌল কাঁধ মানুষের সুক্ষ্ম দৃষ্টির কবলে পড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। নন্দিনী হাসি থামিয়ে বলল,
“নারে দোস্ত। পোলাডা সুন্দর আছিল। ছ্যাঁকা দেওয়ার সময় আমার একটু মায়া লাগছে। সুন্দর মানুষরে ছ্যাঁকা দেওনের সময় আমি আবার একটু আপ্লুত হইয়া পড়ি।”
অনুভব বলল,
“মানবতা এখনো বেঁচে আছে।”

দিগন্ত প্রতিবাদ করে নন্দিনীর উদ্দেশ্যে বলল,
“উহু, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ছেলেটা তোর প্যারা থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। তোর উচিত ওকে হ্যাপি থাকতে দেওয়া। ওকে আরেকটা খাঁটি ও হালাল প্রেমে পড়তে দেওয়া। তা না করে নতুন জীবনের শুরুতেই ধাক্কা দেওয়াটা অনুচিত। আজকে ছেলেটার বাসর রাত। সে তো বউয়ের সাথে নজরই মেলাতে পারবে না।”

নন্দিনী চুকচুক শব্দ তুলে আফসোস করে,
“আহারে, মাঝে মাঝে আফসোস লাগে তোর নীতিবাক্যগুলার জন্য। আমারে না দিয়া বই লিখা ফালাইলে মোটিভেশনাল লেখক হইতে পারতি। ফেইসবুকে পোস্টাইলেও কয়ডা মাইয়া ফলোয়ার পাইতি। একটা প্রেম হইলেও হইতে পারত।”

দিগন্ত নাক ফোলায়। অসন্তোষের সঙ্গে বলে,
“আমার তো মনে থাকে না তোর মাঝে নীতি নামক এপটা ইনস্টল করা নেই যে আমার কথায় আপডেট হবে।”
“কারেক্ট!” নন্দিনী তাল দেয়।
“তুই শুধরাবি না।”

অনুভব দুজনের কথা থামিয়ে সন্ধানী দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। ঘড়ি দেখে বলে,
“কিন্তু যার লেজ ধরে দাওয়াত খাব সেই মেয়ে কই?”

“আসলেই তো। টুকটুকি কই? আমগোরে দাঁড় করাইয়া রাইখা ওই মাইয়া ঘরের কোণা থাইকা বাইর হইতাছে না ক্যা? বরযাত্রী আহনের সময় হইল বইলা। এইদিকে পোলাও, রোস্টের গন্ধে পেটে চো চো করতাছে।”

দিগন্ত কপাল কুচকায়,
“এক্সের বিয়ে খাওয়ার জন্য লালা ঝরে যাচ্ছে?”
“হ, এক্সের বিয়া বইলা কথা। যারে আমি হাতের তালুতে লইয়া নাচাইছি। তালু থাইকা মুছতে কবজি ডুবাইয়া খাওন লাগব মামা।”

আজকের দিনের মধ্যমনি টুকটুকির আগমন ঘটল একটু জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আকাশের গা থেকে তপ্ত কিরণ তখন মোমের মতো চুইয়ে পড়ছে প্রকৃতিতে। বাতাস বইছে ধীর লয়ে। সেই পরিবেশ অবশ্য বিয়ে বাড়ির কাছাকাছি এসেই গমগমে হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে লোকজনের ছোটাছুটি। গরম এখানে কারো সাজ কিংবা উচ্ছ্বাসে ভাটা ফেলেনি। সেই উচ্ছ্বসিত পথে একটি মিষ্টি গড়নের মেয়ে মুখে সীমাহীন য’ন্ত্রণা ফুটিয়ে হেঁটে আসছে। হাঁটার ধরন অবশ্য স্বাভাবিক নয়। মেয়েটি ডান পায়ে সম্পূর্ণ ভর দিয়ে হাঁটছে না। সম্মুখের পাঁচটি আঙুলই ভরসা। গোড়ালিতে মারাত্মক আঘা’তটা সে পেয়েছে মিনিট পাঁচেক আগে। স্নিকার্সে অভ্যস্ত মেয়েটা শখ করে হাই হিল পরতে চেয়েছিল আজ। পরেও ছিল। কিন্তু এরপরই ঘটে গেল ঘটনাটা। পড়ে গিয়ে মচকে গেল গোড়ালি। কাটা কাটা সুন্দর মুখশ্রীর সজিবতা ডুবে গেল অমাবস্যার তমসায়। কাজল ছড়ে যাওয়ার ভয়ে টুকটুকি উদ্বেল কান্নাটাকে গিলে নিয়েছে। বন্ধুদের ক্রমাগত কল আর ম্যাসেজে অতিষ্ট হয়ে তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে রাখা গত সপ্তাহের নিউ মার্কেটের ফুটপাত থেকে সস্তায় কেনা জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে আসতে হলো অগত্যা। অনুভব টুকটুকিকে দেখল প্রথম। অবাক হয়ে বলল,
“কিরেহ! খো’ড়া’চ্ছিস কেন?”

নন্দিনীও বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না,
“ঠ্যাং ভাঙল কেমনে?”

প্রশ্ন উঁকি দিল না দিগন্তের মাঝে। বরং তার মায়া হলো মেয়েটার হাঁটার দশা দেখে। সে মানুষটা এমনিতেই আবেগে টইটম্বুর। বন্ধুর দুর্দশা আরো বেশি করে লাগে। এগিয়ে গিয়ে টুকটুকিকে আগলে নিল সে। টুকটুকি যেন বন্ধুদের যত্নে নির্ভার হয়ে উঠল। প্রশমন হলো ব্যথার য’ন্ত্রণা। দিগন্ত ওকে ধরে ধরে দলের কাছাকাছি এনে বলল,
“গোড়ালিতে লেগেছে?”

“হু। শখ করে হাইহিল পড়তে গিয়েছিলাম। দুই পা এগোতেই সুড়ুৎ করে বেঁকে গেল ডান পা। আমিও পুড়ুৎ করে পড়ে গেলাম।”

ওর বলার ধরনে সকলে হেসে ফেলল। অনুভব বলল,
“সুড়ুৎ-পুড়ুৎ! তোর শব্দভান্ডারের দেখি উন্নতি হচ্ছে।”

নন্দিনী তেরছা চোখে গেইটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার এক্সের অভিশাপ মনে হয় আমারে কাবু করতে না পাইরা ইউটার্ন মাইরা টুকটুকির দিকে চইলা গেছে।”

“তোর খালি বাজে কথা।”
বলতে বলতে টুকটুকির চোখ সকলের সাজের ওপর পড়ল। অনুভব আর দিগন্তের পরনে পাঞ্জাবী। অনুভবের লম্বাটে, সুঠাম দেহে গাঢ় বেগুনি রঙা পাঞ্জাবীটা আঁটসাঁট হয়ে আছে। দিগন্ত অনুভবের চেয়ে কিছুটা হ্যাংলা। উচ্চতাও ইঞ্চি দুই কম। তার গায়ের সেইম ডিজাইনের পাঞ্জাবী কিছুটা ঢিলেঢালা। বোঝাই যাচ্ছে একসাথে একই সাইজের কেনা। ফলে দিগন্তের দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। অবশ্য খারাপও লাগছে না দেখতে। দিগন্তের চেহারায় একটা সারল্য আছে যা তাকে কিউট দেখাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে অনুভব এক শব্দে হ্যান্ডসাম। বালিকা থেকে মহিলা সকলের চোখে লেগে যাওয়ার মতো সুদর্শন। টুকটুকি ওদের দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সেই মুগ্ধতায় বজ্রপাত ঘটাল নন্দিনী। সর্বনাশ! এই মেয়ে করেছে কী? প্রিন্টেড শাড়ির সাথে অফ শোল্ডার ব্লাউজ পরে কাঁধ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে! টুকটুকি কণ্ঠে অসন্তোষের গাঢ় ছোঁয়া লাগিয়ে উচ্চারণ করে,
“আজকের দিনে এই পোশাক না পরলে হচ্ছিল না তোর? একেই মেগে দাওয়াত নিয়েছি এরপর আবার তোর খোলা কাঁধ! আমাকে কেস না খাওয়ালে হচ্ছে না?”

“আমি কী উলঙ্গ হইয়া আইছি? শুধু কাঁধের একটুই তো বাইর হইছে।”
নন্দিনীর লাগামহীন ভাষায় দিগন্তের মুখ লাল হয়। সে গম গম করে উঠল,
“পাবলিক প্লেসে একটু তো শরম কর মেরি মা।”
“স্যরি? কী করব?” নন্দিনী কানে আঙুল ঢুকিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে কান বাড়ায় দিগন্তের দিকে। দিগন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“শরম, হায়া, লজ্জা।”
“ওটা আবার কী জিনিস?” নন্দিনী সরল মুখভঙ্গিতে জানতে চায়। দিগন্ত চোখ বুজে রাগ গেলার চেষ্টা করে স্বগতোক্তি করে,
“এই মেয়ে জাস্ট ইমপসিবল!”

অনুভব ওদের ঝ’গড়া শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। টুকটুকি আতঙ্কিত, দ্বিধান্বিত, ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“দেখ, ইকরি সোনা।”
“কী দেখাবি টুকি সোনা?” নন্দিনীর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
“উফ কথা শোন।”
“আইচ্ছা ক।”
“আন্টির থেকে আমি যেচে তোদের জন্য দাওয়াত নিয়েছি। ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইমপ্রেশন ইউ নো। আন্টি প্রথমেই তোকে এমন লুকে দেখে ভিরমি খেয়ে যেতে পারে। উনি এমনিতে ফ্রেন্ডলি। আমি চাই আমার ফ্রেন্ডদেরও উনি পছন্দ করুক। তুই জাস্ট চুলগুলো কাঁধে ফেলে দে। তাতে তোর সৌন্দর্যের সামান্যতম ঘাটতি হবে না। বিলিভ মি।”

সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে নন্দিনীর দিকে। যেন তার উত্তরে এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে যেতে পারে। নন্দিনী গোমড়া মুখে বলল,
“এক্সের বিয়া খাইতে আইছি। কই লুক দিয়া ব্যাটার মাথা ঘুরাইয়া দিমু তা না তুই মুরুব্বিয়ানা দেখাইতাছোস! আইচ্ছা যা ঢাকলাম কাঁধ।”

টুকটুকি মিষ্টি হাসে। হাসলে তার দুপাটি সুন্দর ঝকঝকে দাঁত প্রদর্শিত হয়। স্নিগ্ধ হাসিটার জন্যই ওর মুখে অনাবিল এক সৌন্দর্য ভর করে যা নজরে গেঁথে যাওয়ার মতো। টুকটুকির ভালো নাম হুমায়রা হক। দাদি আদর করে ডাক নাম রেখেছিলেন টুকটুকি। মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে এটাই এখন তার আসল নামে পরিনত হয়েছে। হুমায়রা শুধু কাগজে-কলমে। আজকের বিয়েতে ওদের সকলের নিমন্ত্রণ টুকটুকির মারফতে। টুকটুকির প্রতিবেশী রিতা আন্টির সঙ্গে আলাদা একটা খাতির আছে। সেই সুবাদে আন্টির বোনের মেয়ে নিপার বিয়েতে দাওয়াত করা হয়েছিল পুরো পরিবারকে। টুকটুকির পরিবারের কেউ যাবে না। এদিকে জানা গেল নিপার হবু স্বামী টুকটুকির চেনা। সে নিজেও বিয়েতে যাবে কিনা সংশয়ে ছিল। ব্যাপারটা নন্দিনীর কানে উঠতেই সে ভয়াবহ আবদার ধরল। তার নাকি লাইফের বিরাট স্বপ্ন এক্সের বিয়ে খাবে। তার কথায় তাল দিল অনুভব। দিগন্ত নিরপেক্ষ। এদিকে টুকটুকির মনও মজা দেখার লোভ সামলাতে পারছিল না, আবার ভয়ও করছিল। অবশেষে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে রিতা আন্টিকে একটু দুর্বল কণ্ঠে জানাল পরিবার তো আসতে অপারগ। আবার বন্ধুরাও নেই। তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব ছাড়া কোথাও একা গিয়ে অভ্যাস নেই। আবার আন্টির মনে কষ্টও দিতে চাইছে না। রিতা টুকটুকির কথার ধরনেই বুঝে গিয়েছিলেন সে কী বলতে চাইছে। তিনি একবার শুধু বললেন,
“বন্ধুদেরও ডেকে নাও। তাদের সাথে আমারও পরিচয় হয়ে যাবে।”
রিতা আন্টি নিঃসঙ্গ মানুষ। একা বাড়িতে থাকেন। মানুষজন বাড়ি আসলে তিনি বরং খুশিই হন। উনার বিশাল বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে বিধায় বোনজির বিয়ের আয়োজন এখানেই হচ্ছে। টুকটুকিকে একটু বেশি স্নেহ করেন বলেই বোধহয় ওর বন্ধুদেরও বিয়েতে আসতে বলতেও কার্পণ্য করেননি। টুকটুকির উচিৎ ছিল প্রথমবার বলাতেই মেনে না নেওয়া। কিন্তু সে এক কথাতেই রাজি হলো। পাছে আবার মত ঘুরে যায়! তখন নন্দিনীর পুরো রাগ তাকেই হজম করতে হতো।

চারবন্ধু বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই রিতা আন্টির দেখা পেল। তিনি টুকটুকিকে দেখেই ছুটে এলেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
“এসেছ তাহলে? পায়ে কী হয়েছে তোমার?”
“মচকে গেছে আন্টি।”
রিতা আন্টির মুখটায় মমতা খেলে গেল। পরম যত্নে টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ইশ! বিয়েতে তোমাদের মতো মেয়েরা ছুটে, খেলে বেড়াবে তাহলেই না সেটাকে বিয়ে বাড়ি মনে হবে। মাঝখান দিয়ে ব্যথা পেয়ে বসলে।”
টুকটুকি বলল,
“আমাকে নিয়ে ভাববেন না আন্টি। আমার বন্ধুরা অপারেশন থিয়েটারেও মাতিয়ে রাখতে পারে।”

রিতা আন্টির তখন যেন খেয়াল হলো বাকি তিন ছেলে-মেয়েকে। প্রথমে ভ্রু কুচকে তিনজনের মাথা থেকে পা অবধি দেখলেন। নন্দিনী, অনুভব ও দিগন্ত সেই দৃষ্টির সামনে ইচ্ছাকৃত কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। রিতা আন্টি চমৎকার ভঙ্গিতে বললেন,
“কি সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েরা! বন্ধুরা দেখি এক একটা ফুটন্ত ফুল। তোমাদের কথা রোজ শুনি টুকটুকির কাছে। আমার সাথে গল্প না করে যাবে না কিন্তু।”
ওরা সকলে খুশি হয়ে গেল। ফার্স্ট ইমপ্রেশন তাহলে মন্দ হয়নি। নন্দিনী চাপা গলায় দিগন্ত ও অনুভবকে বলল,
“মামা, তোগোরে ফুল কইছে। দেখলি আমি আগেই কইছিলাম ফুলতোলা পাঞ্জাবীতে তোগো সালোয়ার-কামিজ পরা মাইয়া লাগতাছে।”
দিগন্ত আলগোছে নন্দিনীর চুলে টান মেরে চোখ পাকিয়ে বলল,
“তোকে কে বলেছে ফুল শুধু মেয়েদের উপমা হয়? ফুল ছেলেরাও হতে পারে।”

ওদের চাপা ফিসফিসানি ঝগড়ার মাঝেই রিতা আন্টি বললেন,
“ওহহ শোনো টুকটুকি, আমার ছেলে এসেছে আজ বিকেলে। তোমার সঙ্গে পরিচয় করাই হয়নি। দাঁড়াও ডাকছি ওকে।”
টুকটুকির গাল গরম হয়ে গেল। চোখে খেলে গেল চাঞ্চল্য। রিতা আন্টি হাত উঁচিয়ে কাউকে ডাকলেন। লম্বাটে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের অধিকারী এক বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ এসে দাঁড়ায় টুকটুকির ঠিক হাত তিনেক দূরে। কোলে একটি জিঞ্জার কালার পারসিয়ান বিড়াল আয়েশে আদর খাচ্ছে। গত সন্ধ্যায় যে আদর খাচ্ছিল টুকটুকির কোলে। লোকটা এখনো চোখ তুলে টুকটুকিকে দেখেনি। রিতা আন্টি বললেন,
“নিশীথ, এই হচ্ছে আমাদের টুকটুকি।”
টুকটুকি হেসে “হ্যালো!” বলতে যাচ্ছিল। আচমকা বিড়ালটা নিশীথের কোল থেকে লাফিয়ে পড়ল। নিশীথ কোনোরূপ বাক্যালাপ ছাড়াই বিড়ালটার পেছনে ছুটে গেল। টুকটুকি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটা তাকে উপেক্ষা করল!

চলবে…