শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-০৬

0
679

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

ভোরের সূর্য চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙে বেলার। মাথাটা হালকা ভার হয়ে আছে। সে পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকায়। কোথায় আছে প্রথমে বুঝতে পারেনা। আস্তে আস্তে মনে করার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই সবকিছু মনে পড়ে যায়৷ কাল বিকেলে কিডন্যাপ হয়েছিল এখন ভোর! শাইনির চেহারাটা ভেসে ওঠে মানসপটে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই শক্ত কিছুর আভাস পায় সে। বুঝতে পারে এটা বিছানা নয়, সিমেন্টের শক্ত ফ্লোরে খড় বিছানো। তার উপরে এতক্ষণ শুয়ে ছিল বেলা। চারদিকে চোখ বুলায়। একটা বেড়ার ঘরে আছে ও। একটু দূরেই চৌকি পাতা৷ বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসছে সকালের মিঠা রোদ্দুর। আশেপাশে শাইনিকে না দেখতে পেয়ে অবাক হয় বেলা। সে উঠে দাঁড়ায়। বাসার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায়৷ যে করেই হোক, একটা খবর দিতে হবে। ওকে না পেয়ে সবার কি অবস্থা কে জানে। নিশ্চয়ই টেনশনে টেনশনে সবার অবস্থা খারাপ। কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারেনা ও। কোথায় নিয়ে এসেছে ওকে কে জানে! সে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। এমন সময় খ্যাচখ্যাচ শব্দ করে বেড়ার দরজা খুলে যায়। বেলা পেছনে ফিরে শাইনিকে দেখে থমকে যায়। ওর হাতে খাবারের প্লেট। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-কী? পালানোর পথ খুঁজছিলে?
বেলা কয়েক পা পিছিয়ে বলে, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?’
-বলবো না।
-কেন করছেন এমন? কী পাবেন এসব করে?
-তোমাকে।
-আমার মধ্যে তেমন কিছুই নেই। আমি খুব সাধারণ মেয়ে।
-তেজ তো কম না।
-আপনার সাথে কথা বলাই অন্যায়।
-তো বলো না।
-আমার বয়েই গেছে ।
-কথা পরে হবে। খাবার খেয়ে নাও।
-খাব না।
শাইনি শক্ত কন্ঠে বলল, ‘খেতেই হবে। দিস ইজ মাই অর্ডার।’
-আমার ক্ষিধে নেই। আমাকে যেতে দিন দয়া করে।
শাইনি হাত নাড়িয়ে বলে, ‘এসব বললে চলবেনা।’
-আপনি একটা নর্দমার কিট।
-হু তাই। মানলাম।
বলে শাইনি পরোটার একটা অংশ ছিঁড়ে তুলে ধরলো বেলার সামনে। রেগে গিয়ে সে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেললো খাবার। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
-নোংরা লোকদের হাতের খাবার আমি খাইনা।
শাইনি রেগে বলল, ‘এখন যদি না খাও তাহলে কী করব ভাবতেও পারছোনা।’
-কী করবেন? মারবেন? তো মারুন।
-তোমাকে মারলে আমারই ক্ষতি।
-তো বলছেন কেন?
-কারণ তোমার ফ্যামিলির লোক আছে। তাদের এক আধটু ক্ষতিতে আমার কিছুই যায় আসবেনা।
বেলা ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘মানে?’
-মানে ধরো, তোমার বাবাকে বললাম যে তোমাকে মেরে ফেলেছি তাহলে নিশ্চয়ই তিনি হার্ট-অ্যাটাক করবেন। বা, তোমার বাবাকে রাস্তায় একা পেয়ে গুন্ডারা ছুড়ি বসিয়ে দিল। এমন তো করতেই পারি, এটুকু করার ক্ষমতা আমার আছে। তোমার মাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেললাম বা দাদীকে ধাক্কা মারলাম! এমন কতকিছুই করতে পারি আমি।
বেলা আহত চোখে চেয়ে রইলো। শাইনি এত খারাপ ভাবতে পারছেনা। ও মিনমিন করে বলল, ‘এসব কিছু করবেন না আপনি.. ‘
-অবশ্যই করব যদি না খেতে চাও।
বেলা চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো। শাইনি বারবার ভয়ানক হাসি দিচ্ছে৷ ওর হাতে একটা ছুড়ি। বারবার মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটছে। ওকে দেখতে কোনো খুনীর চেয়ে কম মনে হচ্ছেনা। এরকম লোকের পাল্লায় পড়েছে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে বেলার। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে সেখানেই বসে থাকে। শাইনি সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ বেলা বুঝতে পারে অন্যপাশে আরেকটি ঘর আছে। শাইনি আসতেই জিজ্ঞেস করে, ‘খাবার তো খেয়েছি। এবার প্লিজ বলুন আমাকে কোথায় এনেছেন?’
-লোকালয় থেকে দূরে এটাই জেনে রাখো।
-জায়গার নামটা কী?
শাইনি রেগে বলল, ‘কেন? পালাতে চাও নাকি?’
বেলা বলল, ‘এমনি জানতে চাইছি।’
-বোকা তুমি।
-যে অন্যকে বোকা ভাবে, তার মতো নির্বোধ এই পৃথিবীতে নেই।
-বাহ। কথার খই ফুটছে মুখে।
বেলা রাগে বলল, ‘আমি বোবা না। আপনি ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে আটকে রেখেছেন। নইলে সাপের পাঁচ পা আরো আগেই দেখিয়ে দিতাম। এতদিন ভাবতাম আপনি চরিত্রহীন। কিন্তু আপনি যে তার চেয়েও বেশিকিছু তা ভাবিনি।’
শাইনি খড়ের গাদার উপর শুয়ে পড়ে। তার মাথায় এখনো একটা টুপি। এই গরমে কেন টুপি পরে আছে বেলা বুঝতে পারেনা। আর ওর বোঝারও দরকার নেই৷ গুন্ডা, মাস্তানরা একেক সময় একেক রুপ ধারণ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। গিরগিটি নিজেকে বাঁচাতে রঙ পাল্টায়। আর মানুষ নামের এসব অমানুষরা লোকজনকে ঠকাতে রঙ পাল্টায়। সেদিন নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় লোকটাকে এতোটা হিংস্র মনে হয়নি, যতোটা এখন হচ্ছে। বিচিত্র এই পৃথিবী! এর চেয়েও বেশি বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষজন। অথচ এখন বেলার কিছুই করার নেই। সে চুপচাপ বসে থাকে। মাথা ঘুরিয়ে ঘরটাকে পরখ করে।
মাঝারি আকারের রুম। একপাশে চৌকি, চেয়ার, মাথার ওপর খটখট শব্দ তুলে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। অন্যপাশে একটা শোকেস রাখা। এই ভাঙা ঘরে কেন শোকেস রাখা হয়েছে ভেবে পায়নি বেলা। মাটিতে বিছানো খড়ের গাদা। সেখানে শাইনি হাত-পা মেলে শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে সে। বেলার হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগলো। একলা পেয়ে শাইনি যদি ওর কোনো ক্ষতি করে দেয়? তাহলে ও কার কাছে সাহায্য চাইবে? ঘেমে উঠলো ও।
এক-পা, দু-পা করে চৌকি থেকে নামে বেলা। ওমনি শাইনি পেছন থেকে খপ করে ওর হাত ধরে টান মারলো। বেলা একটু পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। শাইনি রুক্ষ স্বরে বলে ওঠে, ‘খুব সাহস তোমার? চেষ্টা করে দেখো পালাতে পারো কিনা! এমনি এমনিই তো আর হাত-পা বাঁধিনি। পালাতে চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারো। কিচ্ছু করতে পারবেনা।’
বেলা নিচু স্বরে বলল, ‘আ আমি পালাচ্ছিলাম না।’
-তাহলে?
বেলা ইতস্তত করে বলল, ‘আমি ওয়াশরুমে যাব।’
শাইনি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুমি চিনো? জানো কোথায় যেতে হবে?’
-না।
-তাহলে? আমাকে বোকা ভাবো তুমি?
-না, আমি সত্যিই ওয়াশরুমে যাব। কোথায় সেটা?
শাইনি ওঠে এসে ওর হাত এমনভাবে ধরলো যেন হাত ছাড়লেই বেলা পালিয়ে যাবে। তারপর ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চললো। ঘরের সাথেই লাগোয়া একটা টিনের বাথরুম। কোনো উপায় না পেয়ে অগত্যা ওটাতেই যেতে হলো বেলাকে। মিনিট দু’য়েক পর বাইরে বেরিয়েই দেখল শাইনি একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বোঝার চেষ্টা করলো ও কোথায় আছে। অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো ও কোনো পাহাড়ের উপরে আছে। কারণ চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, সবুজে ঘেরা টিলা। দূরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কিছু বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা। বেলার মন খারাপ হয়ে গেলো। এত উঁচু পাহাড়ে আছে সেখান থেকে চাইলেও পালানো যাবেনা। উপর থেকে পড়ে নির্ঘাত মৃত্যু। এই শাইনি লোকটা তো ভীষণ বদমাশ! কিছুতেই ওকে শান্তি দিচ্ছেনা। কিন্তু পরিবেশটা মনোমুগ্ধকর! কালো কালো মেঘকুঞ্জ ঠিক পাহাড়ের চূড়ায় লেগে আছে। ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। অপরুপ সেই দৃশ্য। বেলা গুনার চেষ্টা করছে এখন কী মাস!
-এখন শ্রাবণ মাস। বললো শাইনি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কীভাবে জানেন?’
-ফোন থেকে জেনেছি। বর্ষাকালে এখানে প্রায়ই আসি।
-তো আমাকে নিয়ে আসার কারণ?
-বউয়ের সাথে হানিমুনে এসেছি। এখন এটা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেনা যে আমার বউটা কে!
বেলা বিরক্ত চোখে চাইলো। বলল, ‘বউ কে? আপনি তো ডিভোর্সের কাগজে সাইন করেছেন।’
-বোকা আমি? তক্ষুনি কাগজ হাজারকুচি করে ডাস্টবিনে ফেলেছি!
বেলা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ও মাই গড!’
শাইনি জোরে হাসে। বেলার মাথাব্যথা হচ্ছে। বাবার সব পরিশ্রম ব্যর্থ হলো তাহলে। বুঝতে পারে এই লোকটার কাছ থেকে এত সহজে মুক্তি পাবেনা ও। শাইনি সামনে থেকে এগিয়ে আসে। বলে, ‘খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
-বাসায় ফোন করব।
-মগের মুল্লুক? এত সহজে প্ল্যান নষ্ট করব? আবাল না আমি।
-প্লিজ। সবাই চিন্তা করবে।
শাইনি চিন্তাভাবনা করে বলল, ‘আমি জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। নো টেনশন।’
-আপনি কিডন্যাপার। কখনো বিশ্বাস করিনা আপনাকে।
-সে তোমার ব্যাপার। হা হা।
বেলা ছলছল চোখে তাকালো। রাগে সে বলে ফেলল, ‘খুনী, নর্দমার কীট!’
কথাটা শুনে শাইনি দু-পা এগিয়ে আসে। বেলা ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিন্তু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!