শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-০৭

0
681

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

কথাটা শুনে শাইনি দু-পা এগিয়ে আসে। বেলা ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিন্তু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।’
শাইনি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। বলে, ‘আমাকে ছেড়ে মরে যাবে? এত আগে? মরতে হলে আমাকে নিয়েই মরে যেও।’
-হুহ!
-চলো দুজন একসাথে ঝাঁপ দিই৷ ইতিহাসের পাতায় গোটাগোটা অক্ষরে আমার পাশে তোমার নামও লেখা থাকবে। চিরকাল সবাই আমাদের জুটিকে মনে রাখবে।
বেলা চোখ বড়বড় করে তাকায়। কি হচ্ছে ওর সাথে! ওফ.. পাহাড়ের উপর থেকে নিচে চোখ গেলেই ওর আত্মা কেঁপে উঠে। ইশ, কী ভয়ংকর! শাইনি ওর হাত ধরতেই বেলা ভাবে সত্যিই বুঝি এখন ওকে নিয়ে ঝাঁপ দিবে। এই লোককে বিশ্বাস নেই। লোকটা যে অতিশয় পাগল এটা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে। আর পাগল লোকদের বেলা ভীষণ ভয় পায়। অনেকটা সময় পার হলেও নড়াচড়া টের না পেয়ে বেলা অবাক হয়।
সে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকায়৷ শাইনির ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। সেইসাথে ওর গালের ডিম্পলগুলোও যেন হাসছে। বেলা চোখ কুঁচকে বলল, ‘হ হাসছেন কেন পাগলের মতো? আপনি কী মদ-গাঁজা খান নাকি?’
শাইনি হাসি থামিয়ে বলল, ‘মদ-গাঁজা খেলে কী হয়?’
-না মানে, এসব খেলে মানুষ পাগলের মতো হাসে শুধু।
-তুমি কী খেয়েছো এসব?
-না।
-জানো কীভাবে?
-মুভিতে দেখেছি।
-আর কী দেখেছো?
-মানে?
-রোমান্স দেখোনি?
বেলা রেগে বলল, ‘আমি আপনার মতো না। সারাদিন নোংরা চিন্তা নিয়ে ঘুরেন, ছিঃ!’
-ছিঃ বলার কী হলো? এসব নরমাল ব্যাপারস্যাপার।
-মোটেও তা নয়। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। নিয়মের বাইরে গেলে সেটা আর নরমাল থাকেনা। নিয়মবহির্ভূত কাজ যেমন জঘন্য তেমনি অপরাধও বটে! অবশ্য কাকে কী বলছি! হোটেলে ওই আপুটার সাথে যা করেছিলেন!
শাইনি চেপে ধরে ওকে নিজের সাথে। বেলার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। গলা কাঁপতে থাকে। কোনোমতে বলে, ‘কি করছেন, ছ ছাড়ুন আমায়।’
শাইনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কী দেখেছিলে সেদিন হোটেল ঘরে? যে বারবার আমাকে নোংরা বলো? ভুলে ভরা একটা ঘটনা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছো।’
-ভুল? কোনটা ভুল? আমি নিজের চোখে সবটা দেখেছি!
-সব দেখা সবসময় সত্যি হয়না। বলিনি বারংবার?
বেলা কটমট করে বলল, ‘ছাড়ুন আমাকে।’
শাইনি ছেড়ে দিলো ওকে। তারপর ঘরের ভিতরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়লো। তীর্যকভাবে রোদ এসে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। হালকা বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। খুব দূরে সরু একটা ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। অন্তনীল আকাশখানি ঘন নীলের সমারোহে ডুবে আছে। শুভ্রসাদা মেঘেরা চোখের পলকেই দূরে ছুটে যাচ্ছে। কিছু মেঘ নিচে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। বেলা অবাক হয়ে গেলো। এ কোথায় আছে সে? এটা ওর নিজের দেশ? এত মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! এত আনন্দিত সে কোনোদিন হয়েছে বলে মনে পড়েনা। পৃথিবী কী আসলেই এতো সুন্দর? কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে মেঘেরা ওর দিকে আস্তে করে এগিয়ে আসছে। বেলা চোখ বন্ধ করে দু’হাত পাখির মতো ছড়িয়ে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেজা ভেজা অনুভব করলো ও। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালো। মেঘ ওর হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেলা খুশিতে চিৎকার করলো খুব জোরে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে সেই চিৎকার আবারও ফিরে এলো ওর কর্ণকুহরে। খুশিতে ওর চোখে জল চলে এসেছে। জাগতিক সব চিন্তাভাবনা ভুলে সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করায় মগ্ন হয়ে আছে। শাইনি কখন থেকে ওকে দেখে চলেছে। মেয়েটার মাঝে শিশুসুলভ এক ধরণের স্নিগ্ধতা, নমনীয়তা আছে যার কারণে কিছুতেই বেলাকে চোখের আড়াল কর‍তে পারছেনা ও। ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই গায়ের পশম কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ শূন্যতা অনুভূত হয়।
বেলার ধ্যান কাটে শাইনির ডাকে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। শাইনি বলল, ‘মেঘ দেখা শেষ হলে ঘরে আসো।’
-কেন?
-বরকে বাইরে রেখে এত ঘুরাঘুরি কীসের তোমার?
-আচ্ছা এগুলো কী সত্যিই মেঘ? নাকি কুয়াশা? প্রশ্ন এড়িয়ে প্রশ্ন করলো বেলা।
শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘উহু। সত্যিই মেঘ। শ্রাবণের মেঘলা দিন, মেঘলা আকাশ।’
-খুব সুন্দর।
-কী?
-জায়গাটা।
-আগে পাহাড় দেখোনি?
-না। সিলেটে একবার দূর থেকে দেখেছিলাম। কাছ থেকে কখনো নয়। এবারই প্রথম।
শাইনি জিজ্ঞেস করলো, ‘একটু পরে আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাবো। সেটাও অসাধারণ।’
বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘কোথায়?’
-আকাশে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘মানে? আপনি মেরে ফেলবেন আমায়?’
-না গো আমার বউ। শ্রাবণ মাসে আকাশের অপরুপ সৌন্দর্য দেখা যায় ওখান থেকে। সেটাই দেখাতে নিয়ে যাবো তোমায়।
-ওহ। কিন্তু এসবের থেকেও বেশি প্রয়োজন আমার এখান থেকে ফিরে যাওয়া।
শাইনি বলল, ‘যেদিন আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা তৈরি হবে সেদিনই যেতে পারবে। তার আগে নয়।’
বেলা তব্দা মেরে রইলো ওর কথা শুনে। এই লোককে ও দেখতেই পারেনা আবার বলে ভালোবাসার কথা! কিন্তু এখান থেকে যেতে হলে কিছু একটা ভাবতে হবে। হোক সেটা নাটক করে বা অন্যকিছু! কেশে বলল, ‘এর জন্য এতদূর নিয়ে আসার কী প্রয়োজন ছিল?’
শাইনি উদাস কন্ঠে বলল, ‘ভালবাসতে, গভীরভাবে ভালোবাসতে। আর ভালবাসানোতে। এই দুইটা জিনিস অনেকটা সূর্যের দুই দিক থেকে ছোঁয়া পাবার মতো৷ প্রকৃতির কাছে থাকলে অনুভূতি প্রগাঢ় হয়। আমাকে ভালোবাসতে হবে তোমার।’
বেলা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘আপনি ভালোবাসার কী বুঝেন?’
-বুঝিনা। তবে বোঝার চেষ্টা করছি। এই এতগুলো দিন পরে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছি নিশা আমার কেউ-ই ছিল না। সে মরিচীকার ন্যায় দৃশ্যমান হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। সত্যটা হলো, তুমি সত্যিই আমার কেউ হও। একদম নিজের কেউ, যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবনা।
রোদ পড়ে যেতেই চারদিকে অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় পাহাড়ে। বেলা নিচে নামতে ভয় পায়। কিছুতেই নামতে চায়না। শাইনি ওর চোখ বেঁধে দেয়। অতি সাবধানে উঁচু পাহাড়টির ওপর থেকে নেমে আসে ওরা। কাঁটায় পা লেগে কতবার ব্যথাও লেগেছে শাইনির। সেসবের তোয়াক্কা না করেই নামতে সক্ষম ও। নিচে নেমে বেলার চোখ খুলে দেয়। সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। বেলা কৌতূহল দমাতে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার মাথায় টুপি কেন?’
শাইনি হাসে৷ বলে, ‘কেন?’
-অচেনা মনে হয়। গুন্ডা গুন্ডা লাগে।
-খুলে ফেলব?
-আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন। আমি জানতে চাইছি ওটা পরে আছেন কেন?
-ভালো লাগে।
-আপনি না অসুস্থ। কী হয়েছিল আপনার?
-জানিনা। ওসব বিষয়ে আরকিছু জিজ্ঞেস করলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব নিচে।
বেলা ভয় পেয়ে চুপ করে যায়। অদ্ভুত লোক, অসভ্য ব্যবহার তার।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকদূর চলে যায়। এদিকটায় কোনো বাড়িঘর নেই। এ সময়ে বেলার বাসার কথা মনে হয়। পা দুটো আর চলতে চাইলোনা। হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শাইনি হতচকিত হয়ে ওকে দেখে। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কাঁদো কেন?’
বেলা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, ‘আম্মুর কথা মনে হচ্ছে!’
-একা থাকতে আর বাঁচতে শিখো। পিছুটান বড় খারাপ জিনিস। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
-আপনি নিষ্ঠুর। আমি কখনো ওদের বিশ্বাস ভাঙতে পারবনা।
-এখানে বিশ্বাস ভাঙার প্রশ্ন আসছে কেন?
-আপনি উল্টোপাল্টা কথা বলে আমার ব্রেইনওয়াশ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমি সেসব শুনবোনা।
শাইনি বেক্কল হয়ে যায়। বেলার হাত মুঠোতে নিয়ে
হাঁটতে থাকে। ওর মুখ গোমড়া। রাস্তার ধারের বুনো লাল রঙের ফুল দেখে বেলা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখফুটে কিছু বলেনা। শাইনি ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েকটা বুনোফুল ছিঁড়ে নেয়। লাল আর গোলাপির মিশেলে জবাফুলের ন্যায় বড় ফুল। হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। হুট করেই বাতাসে উড়ন্ত বেলার কানের পাশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দেয় শাইনি। আলতো হাতে ফুলগুলো পরিয়ে দেয়। বেলা হতভম্ব কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
শাইনি মুগ্ধ কন্ঠে বলল, ‘মাই কুইন লুকস ভেরি নাইস! টু সুইট…’
বেলা ধমকের সুরে বলল, ‘চুপ করুন আপনি।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!