শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-০৯

0
608

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

রাত বারোটা। ঘুমের মধ্যেই পায়ে কারোর ছোঁয়া টের পাচ্ছে বেলা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইতেই দেখলো চারদিকে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কিন্তু ও স্পষ্ট পায়ে কোনো কিছুর ছোঁয়া পাচ্ছে৷ কিন্তু এ ঘরে ও ছাড়া তো আর কেউ নেই। তাহলে কী ভূত? না পাশের ঘরে তো শাইনি আছে, তাহলে? ও নয়তো আবার!! বেলা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মৃদু চিৎকার করে চৌকির ওপর উঠে বসলো। চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,
-প্লিজ প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। কে আছো বাঁচাও আমায়..ইয়া আল্লাহ!
পাশের ঘরে শাইনি ঘুমাচ্ছিলো। জ্বরের কারণে শরীর দুর্বল, চোখ পর্যন্ত জ্বলছে। সারা শরীর ব্যথা করছে৷ হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যে এত অসুস্থ হয়ে পড়বে তা ভাবেনি ও। বেলার চিল্লানো শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর। জ্বরের কারণেই ও পাশের ঘরে শুয়েছে যাতে বেলা কিছু টের না পায়৷ নয়তো বেলার ঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়তো। যাইহোক, চিল্লানো শুনে ও শোয়া থেকে উঠে টলমল পায়ে একপ্রকার দৌড়ে এলো বেলার ঘরে। তাড়াহুড়ো করে বাতি জ্বালিয়ে দেখলো বেলা কাঁথা জড়িয়ে ধরে হুদাই চেঁচাচ্ছে। হয়তো ভয় পেয়েছে ভেবে শাইনি ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে? এরকম করছো কেন আজব?
বেলা চোখ খুলে ভয় ভয় কন্ঠে বলল,
-ভূত। এ ঘরে ভূত আছে।
-কোথায় ভূত? আরে এখানে কেউ নেই আমি, তুমি ছাড়া।
-ত ত তাহলে আমার পায়ে কে হাত দিচ্ছিলো?
শাইনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়াট? কী বলছো তুমি?’
-সত্য বলছি৷ আ আমার পায়ে কারোর ছোঁয়া পেয়েছি।
-কিন্তু এ ঘরে তো কেউ নেই। তুমি হয়তো ভুল অনুভব করেছো।
-না। খুব স্পষ্ট।
শাইনি বুঝতে পারছেনা এখানে কে আসবে। কে এই কান্ড করবে। কিন্তু বেলার ভয় পাওয়া দেখে মনে হচ্ছে ও সত্যিই কিছু অনুভব করেছে। সন্দেহ নিয়ে শাইনি এদিকওদিক দেখতে লাগলো এবং খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে চৌকির তলায় একটা বিড়ালের ছানাকে দেখতে পেলো। এবার বুঝতে পারলো আসল কারণ। মুচকি হেসে ছানাটাকে কোলে নিয়ে বেলার কাছে গিয়ে বসলো। বেলা বিড়ালটাকে দেখে ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেলো। বলল,
-এটা কী?
-আজব। বিড়াল চেনো না? ভাবসাব দেখে তো মনে হয় দুনিয়ার সব চেনো!
বেলা কড়া গলায় বলল, ‘চুপ করুন। আমিও দেখতে পাচ্ছি এটা বিড়াল। কিন্তু এত রাতে একে কোথায় পেলেন?’
-চৌকির তলায় ম্যাডাম।
বেলা থতমত খেয়ে বলল, ‘কখন আসলো এটা?’
-জানিনা। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল আর বেরুতে পারেনি৷ আর এতক্ষণ এটার নরম, কোমল শরীরে তোমার পা লাগছিল হয়তো। আর তুমি ভাবলে ভূত..!
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘কেন এরকম করছিল ও?’
-বসে বসে আমার বউকে পাহারা দিচ্ছিলো।
-বাজে কথা বন্ধ করুন। এটা নির্ঘাত অন্যকিছু। আমি শুনেছি রাতবিরেতে কিছু একটা অনেক কিছুর রুপ ধরে মানুষকে ভয় দেখায়। এটাও হয়তো তেমনকিছু..প্লিজ এটাকে বাইরে রেখে আসুন!
শাইনি হু হা করে হাসতে লাগলো। বেলা অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে বলল, ‘অন্ধকারে হয়তো আপনি ছিলেন। এখন বিড়ালটার দোষ দিচ্ছেন যাতে আমার কাছে ধরা না পরেন। আমার কাছে ভালো সাজতে পারেন! তাই না?’

সঙ্গে সঙ্গে শাইনির হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ও চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘এরকম করার প্রয়োজন নেই আমার৷ কারণ প্রথম থেকেই তুমি আমাকে জানো। আমি চাইলে যখন খুশি তোমাকে টাচ করতে পারি। আর চোরের মতো তোমাকে টাচ করতে বয়েই গেছে আমার। নিজের মতো উলটাপালটা ভাবা বন্ধ করে মানুষকে একটু বিশ্বাস করলে মাঝে মাঝে ক্ষতি তো আর হয়না। যত্তসব!’
বেলা আর কিছু বললো না। বিড়ালটাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করছে। কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিল। আরেকটু হলে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যেতো। এমনিতেই কত চাপের ওপর আছে তার ইয়ত্তা নেই। শাইনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিড়ালটাকে ওই ঘরে রেখে আসি।’
বলেই পাশের ঘরে চলে গেলো। তারপর আবার ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্ষিধে পেয়েছে? খাবে তো?’
-হুম।
শাইনি খাবারের ব্যবস্থা করলো। সে স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে কড়াই বসালো। ডিম সেদ্ধ করে, পানি গরম করে আধঘন্টার মধ্যেই নুডুলস তৈরি করে ফেললো। সাথে বনরুটি আর কলা। যেটা বেলা দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তাই ও নুডুলসই গিলতে লাগলো। যদিও খেতে ততোটা মন্দ হয়নি, বরং ভালোই।
শাইনি কুঁড়েঘরে আগেই এসব খাদ্যদ্রব্য, স্টোভ এবং প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস জোগাড় করে রেখেছে। এমনকি কিছু কাপড়চোপড়ও পরার জন্য। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজায় কাপড়ের অভাবে ভুগতে হয়নি তাদের। এসবকিছু দেখে বেলা বুঝতে পারলো শাইনি আঁটঘাট বেঁধেই ওকে তুলে এনেছে। এদিকে
জ্বরের শরীর নিয়ে রান্না করতে গিয়ে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়লো শাইনি। খাবারগুলো কেমন বিস্বাদ লাগছে। কোনো ঘ্রাণই পাচ্ছেনা, যেন ওর ঘ্রাণশক্তি লোপ পেয়েছে। অথচ বাইরে বৃষ্টিতে ভেজা সোদা মাটির গন্ধ, ফুলের গন্ধ ঠিকই পাচ্ছে। ঘামে ওর সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে৷ তাই মাথা থেকে টুপিটা খুললো ও। বেলা খাওয়া থামিয়ে ‘হা’ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই তিনদিনে প্রথম টুপি ছাড়া ওকে দেখতে পেয়েছে ও!

ঝাকড়া চুলের শাইনিকে দেখে বেলা মাথা নিচু করে ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘একী! আপনার চুল এত বড় কেন? গুন্ডাদের মত?’
শাইনি হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। টুপিটা আবার মাথায় জড়িয়ে বলল, ‘ও কিছুনা। বাদ দাও তো।’
-এড়িয়ে যাওয়ার কী হলো?
-বাদ দাও।
-তার আগে বলুন কেন?
-কী কেন?
-এই যে এত বড় বড় চুল। আপনি কী সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন?
শাইনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘নিজে নিজেই যখন এতকিছু আন্দাজ করতে পারো তাহলে জিজ্ঞেস করো কেন আজব!’
বেলার মুখ দিয়ে ফট করে বেরিয়ে এলো, ‘আপনি না আমাকে ভালোবাসেন? এই তার নমুনা? আসলে মনে মনে সব শয়তানি। কিছু যদি লুকালেনই তাহলে ভালোবাসা কী করে হলো? ভালোবাসা হয় বিশ্বাস, ভরসায়। এসব কিছুই তো নেই। খালি জোর করে আটকে রাখা আর মেয়েদের লাইন মারা এটাই আপনার কাজ।’
শাইনি রুক্ষ স্বরে বলল, ‘উঁহু। শেষ কথাটা ভুল বললে, মেয়েদের সাথে লাইন মারতাম বহুকাল আগে। প্রাচীনকালে। এখন বউ হয়েছে তার সাথেই লাইন মারবো বলে ঠিক করেছি। ‘
বেলা ভ্রু কুঁচকালো। বলল, ‘তাহলে বলুন চুল এত বড় কেন? কাকে ইম্প্রেস করতে চান?’
শাইনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাউকে না।’
-তাহলে?
-জানতে যখন এতই উৎসুক তবে বলি, চুলগুলো কিছুদিন পর আর থাকবেনা।
-কেন?
-কারণ আমিই আর থাকবোনা।
বেলা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে? কী বলছেন এসব?’
শাইনি বেলার হাতটা টেনে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো৷ বেলা ওর কথা শুনে এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে কিছু ঠাহর করতে পারছেনা। শাইনি ওর হাতটা নিজের কপালে রাখলো। বেলা চমকে উঠলো। বলল, ‘আপনার গায়ে তো অনেক জ্বর!’
-হুম।
-কীভাবে হলো এত জ্বর হঠাৎ?
-বৃষ্টিতে ভিজায়।
-তাহলে ভিজলেন কেন?
-তুমি ভিজলে তাই। একসঙ্গে ভেজার আনন্দই আলাদা। তাও আবার পাহাড়ে৷ আর তুমিতো মনে মনে চাইছিলেই যে আমি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে মরে যাই, যাতে তুমি আমার থেকে পালাতে পারো।

বেলা ওর হাতটা সরিয়ে নিলো। গিয়ে বসলো চৌকির আরেক কোণে। এই শাইনি লোকটা কী? ওর মনের সব কথা কেমন করে বুঝে গেল? আর বেলার নিজেরও বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়, ঠান্ডা লাগে। কিন্তু কই আজ তো ওর তো জ্বর হয়নি। কিন্তু শাইনি এত অসুস্থ হয়ে পড়লো কেন? লোকটার আসলে কি হয়েছে? এত অদ্ভুত ব্যবহার। চুলগুলো বড়, কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো সব কর্মকাণ্ড করছে! বেলা নির্লিপ্ত চোখে শাইনিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ঠিক ঠিক উত্তর যেন পাই!’
শাইনি বলল, ‘কী?’
-আপনার আসলে কী হয়েছে? মানে এত অসুস্থ কেন আপনি? সবাই শুধু বলে আপনি অসুস্থ, কিন্তু রোগটা কী তা বলে না।
শাইনি আলতো হেসে বলল, ‘সত্যিই জানতে চাও নাকি?’
-হুম। বলুন।
-খুশি হবে খুব।
-তা তো বটেই। ভনিতা না করে বলে ফেলুন তো!ঠিকটা বলবেন।
-লিউকেমিয়া। বলতে পারো রক্তের বা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!