শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-১০

0
574

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

কথাটা যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে বেলার কাছে। এতো শক্ত-সামর্থ্য লোকটার শরীরে এমন ভয়ানক একটা রোগ বাসা বেঁধে আছে এটা কিছুতেই কারোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবেনা৷ ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। বলল, ‘কথাটা আগে জানালেন না কেন?’
শাইনি বলল, ‘কেন? আগে বললে ভালোবাসতে বুঝি?’
-না।
-তাহলে?
-আপনি এই রোগের কথা লুকিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। আপনার কী মনে হচ্ছেনা এটা করা ঠিক হয়নি, এটা অন্যায়?
শাইনি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না।’
-আশ্চর্য!
-তুমি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছো?
-মোটেও তা নয়। আমি শুধু জানতে চাইলাম।
শাইনি আকুতিভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে ভালোবাসবে কবে?’
বেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওর পা টলমল করছে। কষ্ট হচ্ছে, খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মা-বাবার কথা মনে হচ্ছে। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চাইছে। এই কয়টা দিন এত খারাপ লাগেনি, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে বেলার মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাকে দরকার। মায়ের কোলের আশ্রয়টা ওর দরকার। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ও বুঝতে পারছেনা। আসলে বুঝতে পারছে অল্প অল্প, কিন্তু কারণটা মেনে নিতে ওর মন সায় দিলেও কেন জানি মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছেনা।

শাইনির মুখ পাংশুটে দেখাচ্ছে। বেলার নীরবতা আর অন্যমনস্কতা ওর ভালো লাগছেনা। জ্বরের ঘোর গাঢ় হচ্ছে। সবকিছু একটু-আধটু ঝাপসা হয়ে আছে যেন। সে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে একটু ভালোবাসবে আমাকে? তোমার মনে কী আমার জন্য কোনো অনুভূতি নেই? কিছু নেই? দেখো আমি তোমার কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে আছি। আমি চাই আমার শ্রাবণ ঘেরা আকাশটাতে এক টুকরো রঙিন মেঘ হয়ে বসবাস করো। আরো চাই, শ্রাবণের ওই আকাশটা তোমার নামে লিখে দিতে, খুব করে ভালোবাসতে। আমার বেপরোয়া জীবনের রঙিন মেঘ হয়ে আমাকে আপন করে নিতে। কখনো কী সেই ভালোবাসা পাবো না আমি?’

বেলা শুনলো। অনেকক্ষণ পর একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, তাইনা?’
-হুম!
-ঘরে আমার ভালো লাগছেনা। বাইরে যাব।
-এখন? এত রাতে?
-হুম। আপনি থাকুন। আমি বাইরে যাই।
শাইনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমিও যাব। একা যাওয়ার কী প্রয়োজন!’
বেলা হাসলো। বলল, ‘ভয় নেই। পালাচ্ছি না। এত রাতে পাহাড়ের উপর থেকে নামতেই পারবোনা আর পালাবো কী! আর এখন পালিয়ে যাব-ই বা কোথায়। সো টেনশন ফ্রি থাকুন!’
-না যাব।
-আপনার শরীর খারাপ, বিশ্রাম নিন।
-না।
বেলা রেগে গেলো। বলল, ‘যাব-ই না আমি।’
বলে চৌকির ওপর উঠে বসলো। গাল ফুলিয়ে রাখলো। শাইনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আচমকাই বেলাকে অবাক করে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। বেলা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কী করছেন কী? ছাড়ুন আমাকে।’
-ছাড়ব না।
বেলা কটমট করে বলল, ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু…’
-হোক। চলো বাইরে বসে গল্প করি।
-আমি কোথাও যাবো-না।
-যেতে হবে।
বেলা বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। আমার রাগ সম্বন্ধে আপনার ধারণা নেই মিস্টার শাইনি।’
-আহ!
বেলা ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘কী হলো?’
শাইনি ঈষৎ হেসে বলল, ‘কী মধুর লাগলো তোমার মুখে আমার নাম।’
বেলা মুখ কালো করে বলল, ‘বেহায়া লোক!’
-আমার ছোট্ট বউটার জন্য যদি বেহায়া হতে হয়, তাহলে তাই-ই হবো।
-এরকম করার কারণ? আপনি অসুস্থ, নিশ্চয়ই এরকম কিছু করা উচিৎ নয়।
শাইনি উদাস গলায় বলল, ‘আমার বউ একটা আবদার করেছে, আর আমি সেটা পালন করবো না? অসুস্থ বলে রোগীর মতো পরে থাকব, তা কখনোই হবেনা।’
-আমি আবদার করিনি। ঘরে ভালো লাগছিলো না তাই বাইরে বসতে চাচ্ছিলাম একা।
-বিয়ে হয়েছে তোমার। একা একা আবার কী?
-আপনার সাথে কথা বলাই অন্যায়।
-তা বটে!
বেলা মুখ ভেঙালো। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘নামিয়ে দিন না প্লিজ। আপনি অসুস্থ, আমি হেঁটে যাব প্লিজ!’
শাইনি ধমকে বলল, ‘চুপ। আর একটা কথাও নয়।’
-গুন্ডা লোক। রোগে ধরেছে তাও ভিমরতি যাচ্ছেনা আপনার। কোথায় সব পাপ মোচনের জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করবেন, নিজের সুস্থতা চাইবেন তা না। হিরোগিরি, গুন্ডাগিরি করতে আসছেন!

শাইনি ‘হা হা’ করে হাসলো। শরীরের উত্তাপ ক্রমশই বাড়ছে। বেলাকে নিয়ে চৌকাঠ পেরুনোর সময় একটু হেলে গেলো শাইনি। বেলা ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওর কাঁধ খামচে ধরলো। আর তখনই ওর ঘাড়ে হাত পড়ায় বুঝতে পারলো জ্বর বাড়ছে ওর৷ ও ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখলো এত তাপমাত্রায় জ্বর নিয়েও একটা লোক কীভাবে ওর চাওয়া পূরণ করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বেলা নিচু স্বরে বলল, ‘জ্বর তো বাড়ছে।’
-তেমনই আছে।

তারপর ওকে নিয়ে শাইনি বাইরে চলে এলো। খড়ের ঘরটার সামনের সমতলে যে গাছটা আছে তার নিচেই বাঁশ দিয়ে বানানো একটা মাচা আছে। সেখানে ইচ্ছেমতো হাত-পা মেলে বসা যায়। শাইনি বেলাকে ওখানে বসিয়ে নিজেও বসলো। হাঁপাচ্ছে সে। বেলা ঘর থেকে পানির বোতল এনে ওকে দিলো। তারপর পাশে বসলো। শাইনি অবাক হয়ে দেখলো, পানিটাও খেয়ে নিলো। কিন্তু কিছু বললোনা। ওর চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে।

বেলার মন বিষন্ন। চোখদুটো রাতের প্রকৃতিকে দেখায় ব্যস্ত। মাথার উপর ছাদ নেই, আছে বিশাল আকাশ। আর আছে শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদ। কোটি কোটি তারায় ভরা রুপোলি আভা ছড়ানো চাঁদের আকাশ। দূরের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গড়ে ওঠা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি গুলোতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। বৃষ্টি হওয়ার কারণে চারদিকে যেমন সতেজতা নেমে এসেছে, তেমনি হাওয়ায়ও কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। ঝর্ণার ছুটে চলার আওয়াজ, নিশুতি পাখিদের উড়ে চলা আর নিঃশব্দতার গান সব মিলিয়ে অসাধারণ এক দৃশ্য! শ্রাবণ মাসে বুঝি পাহাড়ের প্রকৃতি এতো সুন্দর হয়? জীবনের মূল্যবান বিশটা বছর কাটিয়ে ফেলার পর জীবনের এই প্রথম, এতো জাদুকরী একটা রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে বেলার। সে আদৌ তা উপেক্ষা কর‍তে রাজি নয়! অথচ এই অসাধারণ লোভনীয় মুহূর্তগুলোর পদার্পণ ঘটিয়েছে ওর জীবনের সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তিটি, যে নাকি ওর স্বামী! যে ভয়ানক একটা রোগে আক্রান্ত এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যতই হোক, বেলা চায়-না কেউ অকালে মারা যাক। আর এতদিনে ওর সাথে থাকতে থাকতে কেমন একটা মায়াও বসে গেছে। যদিও ওকে অন্যায়ভাবে তুলে এনেছে। কিন্তু মনকে সে কি দোষ দেবে! মন তো অবাধে ছুটে চলছে! হঠাৎ ওর চোখের কোণে দু-ফোটা জল চলে এলো। শব্দ করে কেঁদে দিলো বেলা। শাইনি হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?’
বেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘লিউকেমিয়া হলে কী মানুষ মরে যায়?’
শাইনির বুক কেঁপে উঠলো। ঢোক গিলে বলল, ‘তুমি জানোনা? সায়েন্সের ছাত্রীর এটুকু তো অন্তত জানার কথা।’
বেলা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘প্লিজ বলুন!’
-হুম, মারা যাওয়ার চান্স থাকে। ভালো চিকিৎসা হলে অনেক মানুষই সুস্থ হয়ে যেতে পারে।

বেলা ওর দিকে তাকালো। ওর চোখ ভেজা৷ শাইনির কথা শুনে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেগে গেলো অনেক। তারপর উন্মাদিত কন্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘তাহলে আপনি চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন? এখানে আমাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি, মাতামাতি করার প্রয়োজনটা কী? আমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানো, ঠান্ডা লাগানোর কী দরকার? আমাকে কোলে তুলে নেওয়ার কী দরকার? আমার কী পা নেই? নাকি আমি অন্যের ওপর নির্ভর করে চলি? আমি বলেছি আমাকে পাহাড়ে নিয়ে আসতে? এত সৌন্দর্য উপভোগ করাতে বলেছি একবারও? এত দুর্বলতা, অসুস্থতা নিয়ে এতসব করে আপনি নিজেকে মহান প্রমাণ করতে চান? ভালো স্বামী সাজতে চান? কেন এতসব করছেন? আপনি বুঝতে পারছেন না আমার এগুলো চাইনা? আমি এমনই ঠিক আছি?’

শাইনি শুধু হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আর অবাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনছে। কিন্তু কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছেনা। ওর চুপ থাকাটা বেলার আর সহ্য হলোনা। মাথা থেকে টুপিটা খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো। ওর চুল টেনে ধরে বলল, ‘আর এই চুলগুলো রেখেছেন কেন? এত লম্বা লম্বা গুন্ডাদের মতো চুল, সন্ত্রাস হতে চান নাকি দেবদাস? আমার ভালোবাসা না পেলে মেঘ হবেন, আকাশ হবেন যত্তসব কাব্যিক কথাবার্তা! এই চুল যদি না কেটেছেন তাহলে আপনার কী অবস্থা করবো ভাবতেও পারবেন না। নির্লজ্জ লোক কোথাকার! মেয়েদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে এখন আসছে দেবদাস হতে। বড়লোক বাপের ছেলে তো, জীবনকেও আপনারা খেলনা মনে করেন।’

বেলা ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে থাকে। বাঁশের মাচায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। শাইনি পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বলা শেষ আপনার? পানি খান।’

বেলা এবার উঠে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো শাইনির গালে! কটমট করে বলল, ‘আপনি খান!’

শাইনি হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। বেলার কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি। কী হলো হঠাৎ করে মেয়েটার?

চলবে…ইনশাআল্লাহ!