শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-১২

0
603

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

-হুম। বাকিটা বলুন। পুরো ঘটনা না জানলে তো আর কিছু বুঝতে পারবো না।
-বলছি।
-জি।

শাইনি চোখ বুজলো। গলা খাকারি দিয়ে আবার তাকালো। বলল, ‘আমি যে অসুস্থ ছিলাম তখন বাসার কাউকে না জানিয়েই হসপিটালে যাই এবং ডাক্তার দেখাই। তিনি আমাকে বিশেষ কিছু পরীক্ষা দিলেন। তারপর প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ দিয়ে দিলেন। রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে তাই সেদিন আর নিয়ে আসিনি। কাকতালীয় ভাবে এই রিপোর্ট আসে আমাদের বিয়ের দিন রাতে, তোমাদের বাসা থেকে ফেরার পর পর-ই। আমি তেমন কিছুই বুঝিনি, তাই আমার ডাক্তার ফ্রেন্ড নাজিমকে ফোন দেই এবং রিপোর্টগুলো পাঠাই। সে দেখে আমাকে কিছু না জানিয়ে রাতেই আমাদের বাসায় চলে আসে। আব্বুর সঙ্গে বিশেষ কারণে কথা বলতে চায়। আমার খটকা লাগে এবং ওকে চেপে ধরি। তখন ও মুখ গম্ভীর করে আমাকে জানায় আমি রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত।’

বেলা চুপ করে রইলো। তাদের বিয়ের দিন রাতেই জেনেছিল বিষয়টা? কী নিষ্ঠুর নিয়তি তাদের। কাকতালীয় ঘটনা কতকিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে! আর এমন আনন্দপূর্ণ একটা দিনে এই ভয়াবহ খবরটা শুনে শাইনির না জানি কী অবস্থা হয়েছিল!

শাইনি ঘাড় বাঁকা করে ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে বেলার কোমড় জড়িয়ে। বেলার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়৷ ঠান্ডা বাতাসেও কেমন কুলকুল করে ঘামতে থাকে। রোদ পড়ে গেছে। বিকেল নামার পায়তারা করছে। আকাশে অনেক রঙের মেলা বসেছে যেন। কোথা থেকে আসছে বুনোফুলের সুগন্ধ! ক্লান্ত-শ্রান্ত পাখিরা ডানা মেলে উড়ছে চলছে দূরে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ওর। এমন সময় একটা গানেই কথাই মাথায় আসলো বেলার।

‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে,
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’

‘আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম,
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর
আমার একলা থাকার সুর,
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায়, কতদূর!’

‘আমার বেসুর গিটার সুর বেঁধেছে, তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’

‘অলস মেঘলা মন, আমার আবছা ঘরের কোণ
চেয়ে রইতো, ছুঁতে চাইতো,
তুমি আসবে আর কখন।
শ্রান্ত ঘুঘুর ডাক, ধুলো মাখা বইয়ের তাক
যেন বলছে, বলে চলেছে
থাক, অপেক্ষাতেই থাক।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’

শাইনির ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো। চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’
-কোথায় হারিয়ে গেলে? কখন থেকে ডাকছি!
-বলুন কী বলবেন।
-তোমার নখ এত বড় কেন? আমাকে খোঁচা দিচ্ছো বারবার!
বেলা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বলল, ‘মিথ্যা বলা বাদ দিন।’
-বড্ড ঝগড়ুটে তুমি।
-তারপর কী হলো?
-কখন?
বেলা বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে কটমট করে বলল, ‘আমাদের বিয়ের রাতে যখন আপনি যখন জানতে পারলেন যে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত তখন কী করলেন? কথাটা কী আপনার ফ্যামিলির লোকজন জানতো না? আমাদের জানানোর উচিৎ ছিল না?’
-না। আমি মানা করেছিলাম। ওনারা ওভার রিয়্যাক্ট করতো।
-কেন?
-বোকা নাকি তুমি? সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ের জামাই দুদিন পর মরে যাবে, কথাটা শুনলে ওনারা কী ঠিক থাকবে নাকি? আজব!
বেলা মাথা নাড়ালো। আসলেই ওর মাথা গেছে। কী যে হচ্ছে খুব নার্ভাস লাগছে। এরকম কথা জানলে ওর আব্বু নিশ্চয়ই ওভার রিয়্যাক্ট করতো আর মা কষ্ট পেতো।
তারপর বলল, ‘ঠিকই বলেছেন।’
-হুম।
-আমাকে জানালেও পারতেন। যাইহোক, নিশা আপুর ব্যাপারে কিছু বলুন।
শাইনি চোখ কুঁচকালো। উঠে বসে বলল, ‘সেদিন রাতে আমাদের বাসার সবার ওপর দিয়ে কী যে গেছে তা বলা বাহুল্য। আব্বু তো হাই প্রেশারের পেশেন্ট, মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর আমার পায়ের নিচ থেকে মাটিগুলো যেন আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। দিশেহারা হয়ে পড়ি, খুব অসহায় মনে হয় নিজেকে। আব্বু আর তোমার মুখটা মনে পড়ছিল। এই পৃথিবীতে তোমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকালেই বুঝে যেতাম তোমরা আমার একান্ত নিজের কেউ, খুব আপন। সেই রাতে নাজিম আর আম্মু সেদিন সবটা সামলায়। আমি ঠিক করি তোমাকে সবটা জানাবো, তাই মাঝরাতে ফোন দিই তোমাকে। মনে আছে?’

বেলা মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ ওর মনে আছে। শাইনি ফোন করে বলেছিল, ‘কাল একবার আমার সাথে দেখা কর‍তে পারবে?’
বেলা লজ্জা পাচ্ছিলো। সদ্য বিবাহিত স্বামীটির সঙ্গে ফোনে ওর প্রথম কথা বলা সেদিন। ও নত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় দেখা করবো?’
শাইনি বলেছিল, ‘সানফ্লাওয়ার হোটেলে।’
-হোটেলে?
-হুম। কিছু প্রাইভেট কথা আছে। তাই।
-ওহ আচ্ছা।
-এসো কিন্তু!
-জি।

কথাগুলো মনে পড়ে বেলার। শাইনি বলে, ‘সারারাত না ঘুমিয়ে ভাবতে থাকি কীভাবে তোমাকে সবটা জানবো, তুমি কীভাবে মেনে নেবে এসব কিছু। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। শেয়ার করার মতো কাউকে পাচ্ছিলাম না তাই নিশাকে হোয়াটস অ্যাপ করি। ওর সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা হয়। আমার অসুস্থতার কথাটা খুলে বলি। ও অবাক হয়ে সেদিন কেঁদে দিয়েছিল। অনেকদিনের বন্ধুত্ব ছিল প্লাস একটা রিলেশনশিপ ছিল তাই। পরদিন ও দেখা করতে চায়। আমিও সাতপাঁচ না ভেবে ওকে ওই হোটেলে আসতে বলি যেখানে তোমাকে যেতে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম নিশাও তোমাকে কিছু বুঝাতে পারবে!’

তারপর?

-পরদিন আমি আগে আগেই চলে যাই হোটেলে। একটা রুম বুক করি। তোমাকে আর নিশাকেও আসতে বলি। ও তোমার আগেই পৌঁছে যায়। দেখা হওয়ার পর ও সবকিছু শুনে ইমোশনাল হয়ে পড়ে। তারপর কেঁদে ফেলে। আমি ওকে সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। সে সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আর তখনই তুমি এসে পড়ো। আর ওখানেই একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যায়। আসলে এরকমটা হওয়ারই কথা। কোনো মেয়ে তার স্বামীকে এরকম অবস্থায় দেখলে মানতে পারবেই না। কেউ কি নিজের স্বামীর ভাগ দিতে চায় নাকি! যেমন আমি তোমাকে অন্য কারোর সাথে দেখতে পারবো না, মেনেও নিবো না।’

বেলা আহত চোখে তাকায়৷ বলে, ‘তার মানে সেদিন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল?’
-হুঁ। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি বুক করা রুমের দরজা খোলা ছিল?
-আসলেই না।
-ভাবো, আমরা যদি তেমনই ইন্টিমেন্ট হতাম তাহলে ঘরের দরজা কেন বন্ধ করলাম না!
বেলা মাথা চেপে ধরে বলল, ‘ওহ মাই গড!’
-সেখানে নিশার সাথে তোমার কথা কাটাকাটি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, ঝগড়া থামাতে নিশাকে চলে যেতে বলি। ও বিনাবাক্য ব্যয়েই চলে যায় তোমার ওপর রেগে। তারপর আমি ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম এখন বলা ঠিক হবেনা কারণ তোমার মন ভালো নেই। আর তখন আমি যদি এসব কথা বলতাম তাহলে তুমি ভাবতে আমি নিশার ঘটনা ধামাচাপা দিতে অসুস্থতার নাটক করছি। তাই সেদিন কিছু বলিনি। তোমাকে হুমকি ধমকি দিই যাতে এই ঘটনা বাসার কাউকে না জানাও। কিন্তু সেদিন না জানালেও পরবর্তীতে তুমি সবটা তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে দাও। আর তারা আমাদের সেপারেশনের ডিসিশন নেয়। আমি তো কয়মাস দেশের বাইরেই ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম। সেপারেশনের কথা শুনে আমার তখন খুব রাগ হয়েছিল। তাই ট্রিটমেন্ট ফেলেই সেখান থেকে চলে আসি আব্বুকে না জানিয়ে।’

-এরকম করা আপনার মোটেও উচিৎ হয়নি।

শাইনি করুণভাবে তাকিয়ে বলল, ‘কি করতাম বলো? মরে গেলেও আমি তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তাতেও আনতে পারবো না। অন্য কারো সাথে তোমার নামটা জুড়ে থাকুক আমি চাই না কখনোই। আর তোমার কর্মকান্ডে আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। সামনে থাকলে মেরেই ফেলতাম তোমায়। তুমি শুধু আমার। আকাশে যেমন মেঘেদের মানায়, তেমনি তোমার নামটাও আমার পাশেই মানায়। অথচ তোমার ফ্যামিলি আর তুমি নিয়মের বিপরীতে উল্টোটা ঘটাতে চেয়েছিলে। তাই আমি ঠিক করি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তাই কিছুদিন নজর রাখি তোমার ওপর এবং সুযোগ বুঝে এখানে নিয়ে আসি!’

বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নির্লিপ্ত চোখে রোদের লুকোচুরি খেলা দেখতে লাগলো। এই লোকটা এতটা পাগল? এত বড় রোগ হওয়ার পরেও সে নিশ্চিন্তে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! শুধুমাত্র বেলাকে ছাড়তে পারবে না বলে? মানে মৃত্যুর ভয় কি একটুও নেই তার? সে প্রশ্ন করে,

-যাইহোক, ট্রিটমেন্ট না করাটা বা ওখান থেকে চলে আসা আপনার ঠিক হয়নি। আগে নিজের সুস্থতা তারপর বাকি সবকিছু ভাবার দরকার ছিল! কেন এরকম করলেন? আমি হয়তো থাকতাম না আপনার জীবনে, কিন্তু জীবনসঙ্গীর অভাব হতো না আপনার জীবনে! এই পাগলের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার ফ্যামিলির লোকদের কথা মাথায় আসেনি একবারও?

-এসেছে। তোমার আর আব্বুর! আর কারোর না।

-মাথা খারাপ হয়েছে আপনার! কে হই আমি আপনার?

-বউ।

-মা-বোনের কথা একবারও মনে পড়েনি, যিনি আপনাকে জন্ম দিয়েছেন! নিষ্ঠুর আপনি, ছেলে হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই আপনার।

-যা ভাবতে পারো তাই।

বেলা ঘাড়ত্যাড়া লোকটার কথা শুনে মনে মনে চটে গেলেও ভাষায় প্রকাশ করলো না। মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি! ওর কোলে থাকা শাইনির মাথার চুলগুলোতে আঙুল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে ভালোবাসেন তাইনা?’

-হুম, তোমাকে ভালোবাসি।

-আমি যা বলবো, তা শুনবেন?

শাইনি অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘বলেই দেখো না। তবে একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমার থেকে দূরে যেতে বলবে না। আমি কীসের কথা বলছি বুঝতে পারছো তুমি?’

-হুম।

-বলো, কী বলতে চাও?

বেলা কাঁপানো গলায় বলল, ‘বাসায় ফিরে চলুন আর ট্রিটমেন্ট শুরু করুন।’

শাইনি ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। রাগী স্বরে বলল, ‘কখনোই না। ওখানে গেলে সবাই তোমাকে আমার থেকে দূরে করে দেবে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, তখন আমি এমনিই মরে যাবো। কখনোই যাবো না।’

বেলাও উঠে দাঁড়ালো। আলতো হাতে শাইনির গাল ছুঁয়ে বলল, ‘যাবো না আপনাকে ছেড়ে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট না করালে তো আপনার অসুখ ভালো হবে না। আমি তো ভালোবাসেন আমাকে, আমার এই রিকুয়েষ্টটা শুধু রাখুন। প্লিজ! কখনোই কিছু চাইবো না আপনার থেকে। আপনার আব্বুর কথাটা ভাবুন, ওনার মনের অবস্থাটা চিন্তা করুন! আপনার জন্য নিশ্চয়ই চিন্তা করছে তাইনা?’

শাইনি জ্বরে ক্ষয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘সত্যি তো? ছেড়ে যাবেনা তো?’

বেলা চোরা গলায় বলে, ‘সত্যি।’

কথাটি বলার সময় ওর কন্ঠ কেঁপে ওঠে। জীবনের প্রথম কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে ওর চোখে জল চলে এসেছে!

চলবে…