শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-১১

0
581

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

সকালবেলা বেলার ঘুম ভাঙলো বেশ দেরি করে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে আশেপাশে তাকালো পিট পিট করে। তারপর চৌকি থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলো শাইনি উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর চুল সব কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। ঘড়িতে বেলা বারোটা। এত বেলা হয়ে গিয়েছে আর শাইনি এখনো ওঠেনি? জ্বর কী বেশি নাকি? হ্যাঁ, অসুস্থই তো। ঘুমের কারণে হয়তো সকাল সকাল ওঠতে পারেনি, আর এজন্যই বেলাকে ডাকেনি। অন্যদিন ভোরে ওঠেই সূর্যোদয় উপভোগ করার জন্য বেলাকে ডেকে তুলতো। আর ও আরামের ঘুম ভেঙ্গে শাইনির সাথে ঢুলুঢুলু পায়ে হেঁটে বাঁশের মাচায় বসতো। ভোরের লালিমা মাখা আকাশ, আর মেঘ ভেদ করে কোমল সোনালী রোদ ধীরেধীরে মাথা তুলে জাগতো। সোনা রোদের কিরণ ছড়িতে দিতো সবুজ গাছগাছালির পাতায় পাতায়, দূর পাহাড়ে অবস্থিত বৌদ্ধ মন্দিরটায়। তারপর ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণায় হাতমুখ ধুয়ে স্টোভে সকালের খাবার তৈরি করে নিতো। খাবার খেয়ে বেলা প্রতিদিন একবার করে পরিবারের লোকজনদের খোঁজখবর নিতো ওর কাছ থেকে। শাইনি অবশ্য বেলার এই কথাটা রেখেছে। তারপর বেলাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে, আদিবাসীদের গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। সুন্দর সময় কাটতো ওদের। কিন্তু কাল রাতে হুট করে শাইনির অসুস্থতার খবরটা শুনে বেলা
নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। খুব খারাপ ব্যবহার করেছে ওর সাথে। আসলে ও ঠিক মানতে পারছেনা সবটা। রাতের ব্যাপারটা মনে পড়তেই বেলার মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেলো। শাইনিকে এতো কথা শোনানোর মানেই নেই। লোকটা কোনোকিছুর ধার ধারে নাকি! নিজে নিজেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। বেলা ওকে না মানলে কিছুতেই ও নিজের চিকিৎসা করবেনা, আর না পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।
বেলা দরজা পেরিয়ে শাইনির বিছানার কাছে চলে এলো। ও মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন দেখা যাক, কতটা কী কর‍তে পারে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা হাতে শাইনির কপাল ছুঁলো। এখনও বেশ গরম আছে। জ্বরের তীব্রতা কমতেই চাইছেনা। এদিকে ঘামে ভিজে গেছে বলে রাতে ঘুমানোর সময় শাইনি ওর পোশাক খুলে ফেলেছিল। তাই বেলার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটাকে জলপট্টি দেওয়া দরকার। আস্তে করে ডাকলো সে,

‘শুনছেন আপনি? এই যে? দুপুর হয়ে গিয়েছে তো! এই সময় ঘুমাতে নেই।’

শাইনির কানে পৌঁছালো কথাটা। অদ্ভুত আওয়াজ করে চোখ খোলার বৃথা চেষ্টা করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো৷ অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ত ত তুমিও ঘুঘুমাওওও!’

‘বেলা বারোটা বাজে, আপনি আমায় ঘুমাতে বলছেন। আশ্চর্য!’

‘না ঘুমালে আমায় ডিস্টার্ব করোনা।’

‘আপনার জ্বর তো একফোঁটাও কমেনি। মাথায় পানি দিবেন?’

শাইনি বলল, ‘না।’

বেলা বিরক্ত চোখে ওকে দেখলো। মানে কোন ধাতু দিয়ে এই লোক গঠিত? এরকম বেয়াদব লোকদের লাথি মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া উচিৎ। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে অথচ সে মাথায় পানি দিবেনা। বেলাও কম যায় না। ও পাশের ঘর থেকে একটা বোলে করে পানি নিয়ে এলো। শাইনি নড়লো না ওর জায়গা থেকে। যেন দুনিয়া ভেসে গেলেও ওর কিছু যায় আসে না, কিন্তু ঘুমাতেই হবে। বেলা জোর করে ওকে বিছানায় এক কোণে আনলো। লজ্জায় ওর হাত কাঁপছিলো। কিন্তু মানবিকতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! তার ওপর ওর স্বামী হয়। ভালোবাসা না হলেও একটা টান তো আছেই! বালিশটা যাতে ভিজে না যায় তার জন্য ওপরে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে শাইনিকে শুইয়ে দিলো। একদম অচেতনের মতো হয়ে আছে শাইনি, তবে মাঝে মাঝে বিরক্ত গলায় কথাও বলছে। বোঝাই যাচ্ছে,বেলার কাজকর্ম ওর পছন্দ হচ্ছেনা। মেয়েটা যেন বেশিই খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে ওর। কাল রাত থেকেই এরকম খবরদারি করছে ওর ওপর! শাইনি চোখ বন্ধ, চাইলেও খুলতে পারছেনা। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ওর চোখে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এতো সেবা করো না, মায়ায় পড়ে যাবে৷ পরে নিজেকে সামলাতে পারবেনা আমার মতো।’

বেলা ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। পাত্তা দিলো না। এখন ওর প্রধান কাজ মাথায় জলপট্টি দেওয়া৷ একটা লাল রঙের কাপড়ের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে, নিংড়ে শাইনির কপালে রাখলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পরেও জ্বর নামার পায়তারা করলো না। বেলা হতাশ হয়ে কি করা যায় ভাবতে লাগলো। যেই ভাবা সে-ই কাজ৷ তারপর বালিশে হেলান দিয়ে শাইনিকে উঠিয়ে বসালো। তখন ও চোখ খুলে তাকালো। বেলা ভেজা গামছা দিয়ে শাইনির পুরো শরীর মুছে দিলো। লজ্জায় কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো সে। আর শাইনি মিটমিট করে হাসছিলো। বেলা চোখ গরম করে তাকাতেই বলল, ‘জ্বর এমনিই সেরে যাবে, বউয়ের হাতের যত্ন পেয়েছে বলে কথা।’

বেলা লজ্জা গোপন করে বলল, ‘চুপ করুন বেহায়া লোক। রাতের থাপ্পড়টা ভুলে গেলে আরো কয়েকটা দিবো উলটাপালটা কথা বললে।’

শাইনি বলল, ‘মৃতপ্রায় স্বামীকে এভাবে নির্যাতন করা মোটেও ভালো কাজ নয়। আল্লাহ পাপ দিবে।’

বেলা ওর মুখে চেপে ধরে বলল, ‘মুখ সেলাই করে দিব বেশি পটরপটর করলে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। আমি আর কিছুই বলবো না।’

বেলা গটগটিয়ে হেঁটে পাশের রুমে এলো। স্টোভে আগুন দিয়ে গরম পানি ফুটালো, ডিম ভাজলো, আর নুডুলস রান্না করলো। শাইনির জন্য চাল ফুটিয়ে নরম ভাত করলো। খাবারগুলো দেখেই শাইনির বমি পেয়ে গেলো। খড়ের ঘরটার ছোট্ট জানালা দিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলো। বেলা ওকে ধরলো। পানির বোতল এগিয়ে দিলে শাইনি ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নেয়৷ নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠেছে, কাহিল হয়ে গিয়েছে।

বেলা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বমি করলেন যে? কী হয়েছে?’

‘নরমাল। জ্বরের বন্ধু বমি। একজন আসলে আরেকজনকে সাথে করে নিয়েই আসবে।’

বেলা রেগে বলল, ‘আপনার রসিকতা আমার মোটেও পছন্দ নয়।’

শাইনির খাবার খাওয়া শেষে বেলাও খেয়ে সবকিছু ধুয়েমুছে রেখে দিলো। তখন দুপুর দুইটা। শাইনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাইরে বেরুলো। জ্বরের প্রকোপ কমেছে। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। বেলা ঘরে বসে রাগে ফুঁসছে। অসুস্থতা নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনটা কী? একসময় ও বেরুলো ঘর থেকে। শাইনি মাচায় বসে উদাস চোখে চারপাশ দেখছে। বেলা সামনে বসেই বলল, ‘ড্যাবড্যাব করে কী দেখছেন?’

‘বউকে। আজ এত যত্ন নিলো তাই ভীষণ অবাক হয়েছি৷ ভালোবেসে ফেললে নাকি আমাকে?’

‘জি না। মানবতার খাতিরে যত্ন করেছি। শুরুতেই আপনার মেয়েবাজ ক্যারেক্টর দেখে রুচি বদলে গেছে। এখন সবটাই মানবিকতা।’

শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘শিওর?’

‘অফকোর্স।’

‘আমি যদি বলি তুমি আমাকে ভুল জানো, ভুল ভাবো, হোটেলঘরের সবটাই তোমার ছোট মস্তিষ্কের ভুল, তাহলে কী মেনে নিবে?’

বেলা দৃঢ় চিত্তে বলল, ‘না।’

শাইনিও কাঠ কাঠ গলায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘কিন্তু মানতে তোমার হবেই৷ কারণ ভুলটা তোমার। আবার আমারও।’

বেলার এসব কথা নিয়ে আলোচনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। কিন্তু শাইনির কথায় রহস্যের আভাস পেয়ে কৌতূহল জাগছে ধীরে ধীরে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক কী বলতে চাইছেন ওই হোটেলঘরের ব্যাপারটা নিয়ে?’

‘তোমার ভুলটা ভাঙাতে চাইছি।’

‘যেমন?’

শাইনি বেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ও উঠে যেতে চাইলে বলল, ‘প্লিজ। বাইরে শুতে ইচ্ছা করছে।’

‘বলুন কাহিনী কী?’

‘কলেজ লাইফ থেকে নিশা ছিলো আমার বন্ধু। আস্তেধীরে আমরা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যাই, তারপর একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। দুজনেরই টাকাপয়সা আছে। সেই সুবাদে দুজনেই টাকা উড়াতে থাকি। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে চলে যাই, ফাইভ স্টারে খাওয়াদাওয়া করি, লং ড্রাইভে যাই এসব করেই চলছিলো আমাদের। পড়াশোনার প্রতি মনোযোগটা ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। একসময় সবকিছু বিষন্ন লাগতে শুরু করলো। বাসায় আম্মু থেকেও যেন নেই, আমাকে অদ্ভুত কারণে পছন্দ করে না আমি বুঝতে পারি। ছোট বোনটার প্রতিই আম্মুর সব খেয়াল, ভাবনা। আর আব্বু ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কোনোদিনই আমার চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি তিনি। জন্মদিনে আম্মু পায়েস রেঁধে না খাওয়ালেও আব্বু ঠিকই আমার জন্য গিফটটা নিয়ে আসতো। পারিবারিক অবহেলা আর বেপরোয়া জীবনের প্রতি একসময় বিতৃষ্ণা এসে যোগ হলো। মাঝে কিছুদিন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। সব ঝাপসা দেখতাম, মাথা ঝিমঝিম করতো, আরো নানান প্রবলেম। আব্বুকে জানালাম না। কিছুদিন নিজেকে একা রাখতে ঢাকার বাইরে চলে যাই৷ তারপর এদিক-সেদিক কিছুদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা ফিরে যাই এবং সেদিনই তোমার কলেজের সামনে তোমাকে প্রথম দেখি। হয়তো কোনো ছেলে তোমাকে ডিস্টার্ব করছিল, তাই তোমার আব্বু ছেলেটাকে শাসাচ্ছিলো। তুমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে কলেজ ড্রেসে। দেখতে খুব স্নিগ্ধ, মায়াবতী আর বাচ্চাদের মতো লাগছিল। আমার চোখ তোমাতেই আটকে গেলো। মনে হলো তোমার মতো একটা স্নিগ্ধ মেয়ে আমার প্রয়োজন। তারপর খোঁজখবর নিয়ে আব্বুকে জানাই এবং যেভাবেই হোক তিন মাসের মধ্যে আমাদের বিয়েটাও সেরে ফেলি। নিশাকে বিয়ের কথা জানালেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, শুভেচ্ছা জানিয়েছে।’

লম্বা সময় নিয়ে কথাগুলো বলার পরে শাইনি থামলো। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো। বেলা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর কী?’

‘তারপর! আরো জানতে চাও দেখছি?’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!