সমাপ্তিতে সূচনা পর্ব-০৩

0
184

#সমাপ্তিতে_সূচনা
#পর্ব ৩
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। ফুলি সজলদের বাসার কাজের লোক হিসাবে রয়েছে। সজল খোঁজ নিয়ে দেখেছে, ফুলি যা বলেছে সব সত্য।

সজলের পরিবারে বড় কাকা, কাকী, রায়ান(বড় কাকার ছেলে), সজলের বাবা-মা মোট ছয়জন সদস্য। সজলের বড় কাকা আরো এক ছেলে রয়েছে, তবে তাদের সাথে থাকে না।
*
ফুলি কিছুদিন যাবত রয়েছে তাদের বাসায়। সজলের মা, কাকীমা এখন অব্দি কাজের কোন ক্রুটি খুঁজে পায়নি। মেয়েটা বেশ কাজের। যেহেতু সজল তার মধ্যে কোন সমস্যা খুঁজে পায়নি, তাই তাদের বাসায় সবসময়ের জন্য রেখে দিতে চায়।
ফুলির তাতে দ্বিমত নেই। থাকার কথাও নয়। ফুলির তো থাকার কোন স্থান নেই। কাজের বিনিময় মাথায় ছাদ পেয়েছি, এটাই অনেক তার কাছে।
*
গভীর রাত,
বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সজল কাজে শহরের বাহিরে গিয়েছে, ফিরবে সকালে। তাই সজলের মা তার জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। রায়ানের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। পানি পিপাশা পেয়েছে বড্ড। বিছানার পাশে পানির গ্লাস রাখা ছিলো।

আধ-খোলা চোখে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। গ্লাসটা এগিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসতে চমকে উঠলো। পানির রং লাল।

এক চমকে রায়ানের ঘুমের রেশ কেটে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসের পানিতে দুই আঙুল রাখলো। রায়ানা গ্লাসটা হাত দিয়ে ফেলে দিলো। ভয়ে ভয়ে বললো,“র/ক্ত।”

“হ্যাঁ।”

রায়ান চমকে উঠলো,“ কে কথা বলছে?”

“ পিছনে তাকিয়ে দেখ।”

রায়ান ভয়ে ভয়ে পিছু ঘরে তাকালো। পিছনে ঘুরে যাকে দেখতে পেলো তাকে দেখে রায়ানের প্রা/ন যায় যায়।

রায়ান কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,“ তুমি?”

“ আমাকে দেখে খুশি হওনি? আমাকে ভালো লাগছে না দেখতে?”

রায়ান ভয়ে ভয়ে সামনে থাকা মেয়েটিকে লক্ষ্য করলো। সাদা শাড়ী পড়া এক মিষ্টি রমনী। যার রুপের লাবন্য রায়ানকে আজও মুগ্ধ করতো, শুধু মৃ/ত মানুষকে দেখে মুগ্ধতা জন্মায় না। নয়তো রায়ান সত্যি নতুন করে পুনরায় প্রেমে পড়তো।

রায়ান ভয় নিয়ে বললো,“ তুমি আমার কল্পনা তাই না? সত্যি সত্যি তুমি নেই। আমি শুধু তোমাকে কল্পনা করছি।”

মেয়েটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মেয়েটির হাসির শব্দ রায়ানের ভয় দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ মেয়েটির হাতে একটি ছু/রি চলে এলো। রায়ানের ভয় ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বললো,“ মৃত্যুর পর ভেবো আমি কল্পনা নাকি বাস্তব।”

মেয়েটি মুচকি হেসে ছু/রি হাতে এগিয়ে আসছে। রায়ান ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। রায়ান যত পিছিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটি তত এগিয়ে আসছে। রায়ান পিছিয়ে যেতে যেতে একদম দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো। রায়ানের চোখে হঠাৎ পুরনো দিনের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলো।
ধীরে ধীরে রায়ানের চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেল। রায়নের চোখ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পূর্বে তার কানে ভেসে আসলো,“ যেখান থেকে তুমি সমাপ্ত করেছিলে, সেখান দিয়ে আমি সূচনা করেছি। নতুনরূপে, নতুনভাবে।”
*
সকালবেলা,
চোখ মেলে তাকালো রায়ান। নিজেকে বিছানায় দেখে খুব চমকালো সে। রায়ান ভালোভাবে ঘরটা লক্ষ্য করলো। কই কোন পরিবর্তন নেই। বিছানার পাশে গ্লাসটাও একইভাবে রাখা।

রায়ান গ্লাসটি হাতে নিয়ে ভালোভাবে দেখলো। চোখের দেখায় পানি মনে হচ্ছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুখে নিয়ে দেখলো। রায়ান মনেমনে বললো,“সবকিছু স্বপ্ন ছিলো?”

রায়ান কিছুক্ষণ থ মেরে রইলো। বিছানা থেকে উঠে আলমারি খুলে নিজের ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিটি বের করলো। দিনপঞ্জির মধ্যে রাখা একটি ছবি বের করে গভীরভাবে দেখলো রায়ান। এক সুন্দরী রমনীর হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী। রায়ান ছবিটির দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে বললো,“আমার ভালোবাসায় কোন ছলনা ছিলো না।”

রায়ান হঠাৎ পাগলের মতো হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে কান্না করে দিলো। আপনমনে বিরবির করতে করতে বললো,“হাজারটা খারাপ স্বভাবের মধ্যে তোকে ভালোবাসাটা ছিলো আমার একমাত্র ভালো স্বভাব। তুই বুঝলি না।”

সজল পিছন থেকে বললো,“কি করছো ভাইয়া?”

রায়ান চমকে উঠলো। রায়ানের হাত থেকে ছবিটি পড়ে গেল। সজল এসে ছবিটি তুললো। সজল ছবিটি ঘুরিয়ে দেখতে নিবে এমন সময় রায়ান হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললো,“তুই কখন বাসায় ফিরলি?”

সজল মনে করলো রায়ানের ব্যক্তিগত বিষয়, তাই ছবিটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো না।

“মাত্র ফিরলাম। তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো। তোর সাথে কথা বলে আমাকে আবার ফিরতে হবে।”

“হ্যাঁ বল। কি জানতে চাস?”

সজল নিজের ফোন থেকে রাব্বি সাহেবের একটি ছবি সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলো,“তুই একে চিনিস?”

রায়ান আমতা আমতা করে বললো,“এর সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

“রাব্বি সাহেব কিছুদিন হলো মা/রা গিয়েছি। তাকে কেউ তার বাড়িতে খু/ন করে গেছে।”

“ওহ।”

“তুই তাকে চিনিস?”

রায়ান মনেমনে বললো,“অস্বীকার করা ঠিক হবে না। সজল কিছু জানতে না পারলে শুধু শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করতো না।”

রায়ান বললো,“হ্যাঁ। আমার বন্ধু। তুই রাব্বিকে চিনতে পারছিস না? ও তো আমাদের গ্রামের করিম চাচার ছেলে।
বিয়ে করে শহরে উঠেছে, তারপর আমাদের তেমন কথাবার্তা হয়নি। সেদিন একটা শপিংমলে দেখা হলো। তারপর আমি ওর বাসায় গিয়েছিলাম।”

“করিম চাচার ছেলে? রাব্বি?”

“হ্যাঁ। তুই চিনতে পারিসনি? অবশ্য তোর চেনার কথা নয়, ও তো ছোটবেলা থেকে শহরে মামার বাসায় থাকতো, গ্রামে গেল মধ্যমে। ততদিনে তুই গ্রাম ছেড়েছিস। তারপর কিছুদিন গ্রামে থেকে ও আবার শহরে এসেছে। সেদিন দেখা হওয়ার পর জানলাম, বিয়ে করেছে, মেয়ে হয়েছে।
আমি যে রাব্বিকে চিনি এটা তুই কিভাবে জানলি?”

“তার স্ত্রীর থেকে জানতে পারলাম। রাব্বির বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে আসে কিনা, জিজ্ঞেস করায় বললো। তেমন কাউকে রাব্বি বাসায় নিয়ে আসতো না, তবে সেদিন তোকে নিয়ে গেল। নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করায় তোর নাম বললো। কৌতূহল নিয়ে তোর ছবিটা দেখিয়েছি।
তারপর জানতে পারলাম তুই তার বন্ধু।”

“ওহ। কিন্তু ওকে মা/র/লো কে?”

“এখনো অব্দি জানা যায়নি। তোর কাছে আমি এসেছি কিছু জিনিস জানতে। রাব্বির স্ত্রী সাহানা বেগম বললো, তোরা ছোটবেলার বন্ধু। এজন্য আমার মনে হলো তুই ওর সম্পর্কে ভালো জানবি।”

“ছোটবেলার বলতে ঐ গ্রামে যতদিন ছিলো, একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো।”

“আচ্ছা। রাব্বি সাহেব মানুষ হিসাবে কেমন ছিলো?”

“ভালো ছিলো।”

সজল রায়ানের থেকে টুকটাক আরো কিছু জেনে নিলো। সজলকে বেশ চিন্তিত দেখে রায়ান জিজ্ঞেস করলো,“এত চিন্তা করছিস কেন?”

“তোর কথা অনুযায়ী রাব্বি খুব ভালো লোক ছিলো। তার কোন শত্রু থাকতে বলে তোর মনে হয় না। যদি তাই হয় তবে তাকে মারলো কে? এতদিন হয়ে গেল, কেসটার কোন দিক খুঁজে পাচ্ছি না। এমন এক বিল্ডিং এ ছিলো লোকটা যে একটা সিসিটিভি ফুটেজ অব্দি নেই।”

“চিন্তা করিস না। সমাধান হয়ে যাবে।”

“কোন রাস্তাই তো পাচ্ছি না।”

“আমি ভেবে পাচ্ছি না রাব্বিকে তার ফ্লাটে এসে কেউ কিভাবে মে/রে যেতে পারে? রাব্বি চিৎকার অব্দি করলো না?”

“চিৎকার করেছে কিনা জানি না। তবে মৃত্যুর পূর্বে রাব্বি সাহেব এমন কিছু দেখেছে যেটা দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। বেশ ভয়।”

রায়ান চমকে উঠে বললো,“ভয়?”

এমন সময় ফুলি দুই মগ কফি নিয়ে আসলো। এক মগ সজলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,“স্যার আপনার কফি।”

“হ্যাঁ।” কফি হাতে নিতে নিতে

ফুলি দ্বিতীয় মগটি রায়ানের হাতে দিলো। ফুলি বললো,“স্যার আপনারা ভয় নিয়া কইতে ছিলেন?”

রায়ান বললো,“তোর জানতে হবে না।”

সজল বললো,“তুমি নিজের কাজে যাও। আর ভাষাটা হয় শুদ্ধ করো নয় আঞ্চলিক। মেশানো কেমন শোনা যায়।”

ফুলি বললো,“আচ্ছা স্যার।”

ফুলি চলে গেল। সজল রায়ানকে বিদায় জানিয়ে তার কর্মস্থলে চলে গেল।
______

নীলির শরীরটা বেশ খারাপ। গত দু’দিন ধরে বাসায়। শান্ত তার জন্য দু’দিন অফিস কামাই দিয়েছে। দু’দিন শান্ত ঘরের সব কাজ করেছে, এমনকি নীলিকে খাইয়ে অব্দি দিয়েছে।
আজ নীলির কিছুটা ভালো লাগছিলো, তাই শান্তকে জোর করে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। নীলিও যেতে চাইছিলো স্কুল, তবে শান্ত যেতে দেয়নি।

নীলি শুয়ে শুয়ে বেশ বিরক্ত হচ্ছিলো। তাই ফোনটি হাতে নিলো। ফোন হাতে অন করতে মেসেজের নোটিফিকেশন আসলো। নীলি মেসেজ দেখে মনেমনে বললো,“অচেনা নাম্বার, নিশ্চয় আবার ভুলবাল বলে আমার সংসার নষ্ট করতে চাচ্ছে। না দেখবো না।”

দেখবো না বলেও কৌতূহল দমাতে না পেরে নীলি মেসেজটি চেক করলো। মেসেজটি পড়ে নীলি অবাক হয়ে গেল। মেসেজে লেখা ছিলো,“নিজের বাচ্চার সাথে সুন্দর জীবন কাটাতে চাও, তবে শান্তকে ছেড়ে দাও। শান্তর সাথে দূরত্বই তোমাকে তোমার সন্তানের কাছে রাখতে পারে।”

নীলি সাথে সাথে নাম্বারটিতে কল দিলো। বন্ধ বললো। নীলি ভেবে পাচ্ছে না, কে তার সাথে এমন করছে এবং কেন?

*
চলবে,