সমাপ্তিতে সূচনা পর্ব-০২

0
235

#সমাপ্তিতে_সূচনা
#পর্ব ২
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

এস আই সজল থানায় নিজ স্থানে বসে কিছু কেস ফাইল চেক করছিলো। অফিসার রিপন তখন সজলের সামনে এসে দাঁড়ালো। রিপনকে দেখতে পেয়ে সজল জিজ্ঞেস করলো,“ ময়না তদন্তের রিপোর্ট এনেছো?”

“ জ্বী স্যার।”

“ কি কি তথ্য জানা গেল?”

“ ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী মি. রাব্বি(সাহানার স্বামী) ছুরির আ/ঘা/তে মারা গেছেন। আর হ্যাঁ মৃত্যুর পূর্বে রাব্বি সাহেব কিছু একটা দেখে ভীষন ভয় পেয়েছিলেন। মূলত ভয় পাওয়ার জন্য তিনি নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেনি, বা বলা চলে করতে পারেনি।”

“ ভয়?”

“ হ্যাঁ স্যার।”

“ ভয়কে বাদ দিয়ে যদি পুরো ব্যপারটা ভাবি তবে সাহানা বেগমের দোষী হওয়ার অনেকটা চান্স রয়েছে। ভয় নিয়ে ভাবলে, সাহান বেগমের কাছে এমন কি থাকতে পারে যা দেখে তার স্বামী প্রচন্ড ভয় পেলো।”

“ এক্ষেত্রে সাহানা বেগম নির্দোষ হতে পারে, তবে তিনি তার কথার প্রমাণ দিতে পারেনি। তার ফোন থেকে অচেনা নাম্বার পাওয়া যায়নি। এদিকটা দেখলে সাহানা বেগম নিজ স্বামীকে খু/ন করে একটা গল্প তৈরি করেছেন এমনটা হতে পারে।”

“ ঠিক এজন্য আমার সন্দেহ তার দিকে রয়েছে। তাছাড়া আজকাল স্ত্রীর হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রী খু/ন বিষয়টা অবাক করা নয়। খবরের কাগজ খুললে এরকম ঘটনা অহরহ দেখা যায়।”

“ তাহলে আমরা সাহানা বেগমকে দোষী ধরে এগোবো?”

“ আমরা তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখে এগিয়ে যাবো। তবে পুরোপুরি তাকে দোষী ভেবে এগোনো ঠিক হবে, সাহানা বেগম নির্দোষ হলে আসল অপরাধী সেই সুযোগে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে। তাই আমাদের সবদিক খুঁটিয়ে দেখতে হবে।”

“ আমরা এখন কি করবো তবে?”

“ প্রথমে তোমরা খোঁজ নাও রাব্বি সাহেবের কারো সাথে কোন ঝামেলা ছিলো কিনা, সাহানা বেগমের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিলো, সবকিছু খোঁজ নিতে হবে।”

“ আচ্ছা স্যার। আমি খোঁজ নিচ্ছি।”

রিপন চলে গেল। সজল বসে বসে হিসাব করতে লাগলো। যত দ্রুত সম্ভব তাকে এই কেসটা সমাধান করতে হবে।

সজল নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো, সেখান থেকে এক জোড়া নুপুর বের করে দেখতে লাগলো। নুপুরের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে বললো,“ কেসটা সমাধান হোক, তারপর আমি তোদের খোঁজ নেবো। আমি খুব শীর্ঘ্রই ফিরবো।”
____
অফিস শেষে শান্ত বাসা এসে দেখলো নীলি তার আগে চলে এসেছে। শান্ত গিয়ে নীলির পাশে বসলো। নীলি উল্টোদিকে ঘুরে গেল। শান্ত নীলির বাহু ধরে তাকে তার দিকে ঘোরালো। তারপর বললো,“ বিশ্বাস করো নীলি সবকিছু মিথ্যা। আমার সাথে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বেশ কিছুদিন যাবত হচ্ছে।”

“ আমাকে মনভোলানো কথা বলতে এসেছো শান্ত?”

“ না। সত্যি সব।”

“ বেশ কিছুদিন ধরে যদি তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয় তবে আমাকে এতদিন বলোনি কেন?”

“ ভয়ে।”

“ ভয়?”

“ হ্যাঁ ভয়। তোমাকে হারানোর ভয়। এই যে এখন তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না, ঠিক এই ভয়টা পেয়েছি আমি। একজন আমাকে অনেকদিন যাবত এসব আজেবাজে ছবি দেখিয়ে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছিলো, তোমাকে দেখানোর ভয় দেখাচ্ছিলো। আমি ভয় পেয়ে গেছি। যদি তুমি এগুলো দেখে সত্যি ভেবে নাও, তবে আমার কি হবে? সেই ভয় পেয়েছি আমি। বিশ্বাস করো ছবির মেয়েটি কে আমি জানি না, আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”

“ আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো?”

“ আমি তোমাকে ভালোবাসি নীলি। তুমি যদি কথা দাও আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না, তবে আমি কথা দিচ্ছি আমাদের সাথে এসব যে করছে তাকে আমি খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবো। আমি প্রমাণ করে দেবো আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”

নীলি শান্তর চোখের দিকে তাকালো। শান্ত চোখ দিয়ে ভরসা দিলো। নীলি বললো,“ আমিও তোমাকে ভালোবাসি শান্ত৷ তাই আজও ভরসা করলাম। আমাদের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করলাম।”

“ তোমার এই বিশ্বাস আমি কখনো ভাঙবো না। সত্যি বলছি আসল ষড়যন্ত্রকারীকে আমি তোমার সামনে নিয়ে আসবো।”

নীলি শান্তর বুকে মাথা রাখলো। শান্তও নীলিকে জড়িয়ে ধরলো।
_____
গভীর রাত,
সজল বাসার উদ্দেশ্য এগিয়ে যাচ্ছে। বাসার কাছাকাছি এসে পড়েছে। মিনিট পনেরো লাগবে। মাঝরাস্তা হঠাৎ এক শাড়ী পড়া মেয়ে সজলের বাইকের সামনে ছুটে আসছে। এক মেয়েকে ছুটে আসতে দেখে সজল বাইক থামিয়ে দিলো, একটুর জন্য শেষ রক্ষা হলো। মেয়েটি বাইকের থেকে কিছুটা দূরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সজল এগিয়ে গেল। সজল মেয়েটির সামনে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো।
“ নিন উঠুন।”

মেয়েটি মুখশ্রী উপরে তুললো। সজল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলো, মেয়েটি উপরের দিকে তাকাতে দু’জনের চোখাচোখি হলো। মেয়েটি তার একটি হাত এগিয়ে দিয়ে সজলের হাতে রাখলো।
সজলের সাহায্যে মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ মেয়েটি নিজের হাত সজলের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।

সজল মেয়েটিকে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। সস্তার একটি শাড়ী পড়া, দেখে মনে হচ্ছে ফুটপাত থেকে কেনা। গায়ের গড়ন কালো বর্নের। কালো গড়নের মধ্যে ডাগর ডাগর দুটো আঁখি। মুখশ্রী বেশ মায়াবী লাগছে। সাঁজ পোশাক দেখে বস্তির মনে হচ্ছে।

সজল স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“ এতরাতে রাস্তায় ছোটাছুটি করছো কেন?”

মেয়েটি বললো,“ জে পিছনে..।”

মেয়েটি বাক্যটি শেষ করার পূর্বে সজল মেয়েটি যেদিক দিয়ে ছুটছিলো সেদিকে তাকালো। কয়েজন ছেলে ছুটে পালালো। সজল বললো,“ ওরা কারা?”

“ বাজে লোক।”

“ তোমার সাথে অসভ্যতামি করছিলো?”

“ জে।”

“ তোমার নাম কি? আর এতরাতে রাস্তাঘাটে কি করছিলে?”

“ জে আমি ফুলি। লোকের বাড়ি কাম কইরা খাই। আমি যে বাড়িতে কাম করতাম, তারা আমারে চোর অপবাদ দিয়া বাইর কইরা দিছে। এত রাইতে আমি কই যাইতাম, রাস্তার পাশে বেঞ্চে বইসা ছিলাম, তহন ঐ লোকগুলা আইয়া….(কান্না করে দিলো)।”

“ কোন বাড়িতে কাজ করতে?”

“ এহান থেইকা মেলা দূর।”

“ আমার সাথে চলো।”

“ কোথায়?”

“ সেই বাড়িতে। আমি তোমার কাজটা আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

“ না সাহেব। আমনে আমারে যদি সাহায্য করতে চান তয় একখান কাম খুঁইজা দেন। তাও ঐ বাড়িতে যাবার কথা কইয়েন না। আমি অনাথ হইতে পারি, গরিব হইতে পারি কিন্তু আমারো আত্মসম্মান আছে। যে বাড়ি থেইকা আমারে অপমান কইরা বাইর কইরা দিলো, আমি সেই বাড়ি আর যামু না।”

“ এতরাতে তোমাকে কি কাজ খুঁজে দিবো?”

“ দেহেন আমনে কাজ খুঁইজা না দিতে পারলে নাই। আমি যাই।”

“ কোথায় যাবে তুমি এখন?”

“ রাস্তার আবর্জনা রাস্তায় ছাড়া কই থাকমু।”(চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো)

সজলের বেশ মায়া হলো। সজল বললো,“ চলো।”

“ কোথায়?”

“ কাজ চাইছিলে না, চলো আমার সাথে, তোমাকে কাজ দিবো।”

ফুলি সন্দিহান দৃষ্টি দিলো সজলের দিকে। গায়ে পুলিশের পোশাক, তবে সব পুলিশ কি ভালো হয়? ফুলি মনেমনে বললো,“ যদি আমারে নিয়া গিয়া কিছু করে, আমি তাইলে কি করমু? আমার যাওয়ার কোন জায়গাও নাই, রাস্তায় এমনে থাকলেও বিপদ। তারচেয়ে বরং তার লগে যাই, যদি ভালো লোক হয়।”

“ কি ভাবছো?”

সজলের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলো ফুলি। নিজেকে সামলে বললো,“ চলেন যাই।”

“ আচ্ছা চলো।”

সজল ফুলিকে নিয়ে তাদের বাসা আসলো। বাসার কলিংবেল বাজালে সজলের মা এসে দরজা খুলে দেয়। সজলের সাথে এক মেয়েকে দেখে চমকে উঠে।

“ মেয়েটা কে সজল?”

সজল কিছু বলার পূর্বে ফুলি বলে,“ খালাম্মা আমি ফুলি, আমনেগো বাড়ি কাম করতে সাহেব নিয়া আইছে।”

“ সজল ও কে? এভাবে কথা বলছে কেন?”

এবারো সজল বলার পূর্বে ফুলি বললো,“ খালাম্মা কামের মাইয়া। দশ বাড়িতে কাম কইরা দশ রহমের ভাষা শিখছি, লগে আমাগো ভাষা। সব মিলাইয়া আমার ভাষা পাঁচ মেশালি হইয়া গেছে।
তয় আমার কামের কোন ক্রুটি খুঁইজা পাইবেন না খালাম্মা।”

সজল বিরক্ত হয়ে বললো,“ এই মেয়ে চুপ করো।(ফুলি চুপ) আম্মু ও ফুলি। কাজ খুঁজছিলো তাই বাসায় নিয়ে আসলাম। কাল থেকে মিনুর সাথে কাজ করবে।”

সজলের মা ফুলির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে বললেন,“ এ কোন মেয়েকে ধরে নিয়ে আসছিস, রাতে বাতি নিয়া খুঁজলেও তো চোখে দেখা যাবে না।”

ফুলি মন খারাপ করে বললো,“ আমার গাড়ের রং লইয়া মজা নিচ্ছেন নেন খালাম্মা, তবে আমার কামে সত্যি আমনে কোন খুঁত পাইবেন না। বিধাতা বানাইলো কালা কইরা, এতে আমার কি দোষ খালাম্মা কন?”

সজলের মায়ের বেশ খারাপ লাগলো। তিনি অনুশোচনা নিয়ে বললেন,“ আমি এভাবে বলতে চাইনি ফুলি। আসলে তোমার গায়ের রং এতটাই কালো যে, খালি চোখে দেখে মনে হচ্ছে গায়ে ইচ্ছে করে কালি মেখে এসেছো।”

ফুলি চমকে উঠলো। সজলও বেশ চমকালো। সজল এবার বেশ ভালোভাবে ফুলিকে লক্ষ্য করলো।
ফুলি বললো,“ কেউ নিজ থেইকা ঘৃণা পাইতে চায় খালাম্মা। গায়ের রং কালো দেইখা কতলোক ঘৃণা, অবজ্ঞা করলো। যদি রং বদলানোর সুযোগ থাকতো তবে নিজের গায়ের কলঙ্কিত এই রং বদলাইতাম খালাম্মা। তারপর আপনাগো মতো সুন্দর হইতাম। তাইলে সবাই মেলা ভালোবাসতো আমারে। কেউ আর ছাইড়া যাইতো না।”

ফুলির চোখে অশ্রু দেখা দিলো। সজলের মা কথা ঘুরিয়ে বললো,“ চলো তোমাকে তোমার থাকার ঘর দেখিয়ে দেই।”

“ আইচ্ছা খালাম্মা।”

সজলের মা সজলের উদ্দেশ্য বললো,“ তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি খাবার দিচ্ছি।”

সজল মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। নিজ রুমে এসে সজল কাউকে একটা ফোন দিয়ে বললো,“ … এই ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে দেখো ফুলি নামের কোন কাজের লোক ছিলো কিনা।”

ওপাশ থেকে কি বললো শোনা যায়নি। সজল ফোন রেখে ফ্রেশ হতে গেল। পথে আসতে আসতে ফুলির থেকে টুকটাক সব তথ্য জেনে নিয়েছে। যতই হোক বিনা প্রমাণে কাউকে বিশ্বাস করে ঘরে রাখা ঠিক হবে না।
*
চলবে,