সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-২৫

0
443

#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__২৫
রিমি মুহুর্তের মাঝে চিৎকার দিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। আর তারা দুজন ওখানে থেকে চলে যায় কারণ আশে পাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেলে নিজেদের ফাঁসি নিশ্চিত। কেননা নারী ও শিশুদের ওপর এসিড নিক্ষেপ করা একটি জঘন্যতম অপরাধ। এদিকে যার উপর এসিড ছোঁড়া হয়েছে সে মাটি তে পড়ে চিৎকার করতে থাকে। পুরো মুখ টা যেনো আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশে পাশের কয়েক জন মানুষ চলে আসে কি হয়েছে দেখছে। কে এতো বাজে কাজ টা করেছে সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে কিন্তু কাউকেই আর পায় না। ভিড় ঠেলে লিমা ঢুকে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। লিমনের পিছু ধাওয়া করতে করতে সে এসেছিলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলো তার অনেক টা দেরি হয়ে গেছে। একটু আগেই সে গতকাল অফিসে কি কি হয়েছে তা জেনে নেয়। আর লিমন রিমির ক্ষতি করে দিবে এতে সে নিশ্চিত থাকে। সে বাঁচানোর জন্য এসেছিলো তবে দেরি তে।

লিমা এমন হলে নিজেও অসুস্থ হয়ে যাবে ভেবে সবার সাহায্যে রিমি কে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সবাই জিঙ্গেস করছে ভুক্তভোগী তার কি হয় কিন্তু ও কিছু বলছে না। লিমন এতো হিংস্র কিছু করবে ভাবনায় ও আসে নি। তার চোখের সামনে তার মতোই একটা মেয়ে ছটফট করছে দেখে লিমার আত্মা শুদ্ধ কেঁপে উঠলো। চোখের সামনে ভাসছে একদিনের আগের সেই মেয়েটির মায়া মাখা চেহারাটি। আর আজ তা ঝলসে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা অবস্থা গুরুতর দেখে বললো,

‘কে এমন করেছে উনার? আপনার উচিত পুলিশ কে জানানো!’

লিমা ডাক্তারের কথা শুনে রেগে যায়। চেঁচিয়ে বললো,

‘আর আপনাদের উচিত নিজ নিজ পেশার কাজ করা। মেয়ে টা ওখানে জিবন মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছে আর আপনারা এখানে আসছেন আমাকে জ্ঞান দিতে হ্যাঁ?’

ডাক্তাররা জায়গায় থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি রিমি কে নিয়ে যায়। ততক্ষণে ফেইসের যেই অংশে এসিড ছোঁড়া হয়েছে তা পুড়ে গেছে। একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসেন। বাহিরে এখনো সেই একজন কেই চিন্তিন হয়ে বসে থাকতে দেখে তার দিকেই এগিয়ে আসে।

‘ওনার ফেইসের এক অংশ পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে’

‘এখন কি হবে?’

‘দেখুন আমরা এখন কিছু করতে পারবো না। এটা যখন হয়েছে সাথে সাথে নিয়ে আসতে পারলে হয়তো কিছু করতে পারতাম!’

‘কিছু করতে পারবেন না বললেই হলো নাকি। আমার মনে হচ্ছে আমি অতোটাও দেরি করি নি। যেটুকু পারবেন করুণ প্লিজ!’

‘কিন্তু টাকা?’

‘একটা মেয়ের জীবনের ব্যাপার এটা! আর আপনি সেখানে টাকার কথা তুলছেন? ওকে ফাইন আপনারা আপনাদের কাজ করুণ বিনিময়ে টাকা পাবেন নো প্রবলেম!’

‘আপনাকে তো যা বলার বলেছি ই তাও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। তা উনি আপনার কে হয়?’

লিমা চুপ থাকলে ডাক্তার তার আর উত্তরের আশায় না করে চলে যান। রিমি কে একবার ভালো করে দেখে উপস্থিত সব কজন ডাক্তার ই হতাশ হন। সত্যি ই অনেক টা দেরি হয়ে গেছে। হতাশ হয়ে একই জন আবারো লিমা কে বললো,

‘এই ফেইস প্লাস্টিক সার্জারি করে ও কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না!’

‘তাহলে মন কে বাদ দিয়ে নিজেরা চেষ্টা করুন আমি রাতের মধ্যেই আবার একবার আসবো। তবে ওকে কোথাও যেতে দিবেন না।’

তাড়াহুড়ো করে লিমা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। লিমন‌ যদি বাড়ি যায় তাহলে ওকে না পেলে সন্দেহ করতে পারে তাই তার যাওয়া খুব দরকার। সে বাড়ি ফিরে আসে ঠিকই তবে লিমন না আসার আগেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বসে বসে ভাবতে থাকলো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা টা।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি ও চলে আসলো। এটাই সুবর্ণ সুযোগ লিমনের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। লিমন রিমির সাথে যেই অপরাধ যোগ্য কাজ টা করেছে তার জন্য তাকে পুলিশে দিতে গেলে প্রমাণ সবার আগে দরকার হবে। কিন্তু তার কাছে এই মুহুর্তে সেটা নেই। লিমা ভাবলো এই অপরাধের প্রমাণ যদি সে যোগার করতে পারে তো তাহলে লিমনের মৃত্যু কিংবা যাবৎজীবন কারাদণ্ড তো অবশ্যই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ লিমনের অফিসে ফোন দেয় সে। আর জানতে পারে আজ লিমন সেখানে যায় নি।

লিমনের অগোচরে তার কেবিনেই একটা গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলো লিমা। সেটা সে যে কোনো ভাবে সংগ্রহ করলো। ওই সিসি টিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লিমন জোড় করে রিমির সাথে অসভ্যতামি করছে এবং তাকে বেহুঁশ করে আপত্তিকর ছবি তুলছে অন্য ছেলেটার সাহায্যে। কিন্তু এই প্রমাণ ই তো যথেষ্ট নয়। কিছু একটা করতে হবে ঠিক কি করা যায় সে ভাবতে থাকে!

লিমন আর অন্য ছেলেটা সবার চক্ষু অগোচরে চলে আসার পর বাইক থামায়। লিমন‌ তো খুব খুশি। আর খুশি হয়ে অন্য ছেলে টা কে তার চাওয়া ১০ হাজার টাকা দিতে চাইলো। তক্ষুনি গিরগিটির ন্যায় ঐ ছেলের মত পাল্টে যায়।

‘স্যার আপনি কতো বড় মাপের একজন মানুষ আর এত্তো বড় দুইটা কাজের জন্য মাত্র ১০ হাজার টাকা?’

‘মানে?’

‘টাকার অংক টা ছোট হয়ে গেছে যে বড্ড!’

‘কি বলতে চাস তুই?’

‘আমার তো ৫০ হাজার টাকা লাগবে!’

‘হোয়াট!’

‘চিৎকার করবেন না স্যার। আমাকে আমার টাকা টা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিন আর আপনি ও ভালো মতো ঘরে ফিরে যান!’

‘তোকে তো আমি…

‘ভুলে আমার সাথে এসব কিছু করার কথা ভাববেন না স্যার। আমি ঐ মেয়েটার মতো এতো নিরহ নই। আমার সাঙ্গ পাঙ্গ আরো আছে!’

আরো ৪ জন ছেলে এগিয়ে আসে লিমনের দিকে। এসব দেখে ও ভীষণ চমকে উঠে। তাদের লিডার হেসে বললো,

‘ভালো হবে আপনি টাকা টা দিয়ে দিন। নয়তো এই ভিডিও টা পুলিশের কাছে পৌঁছে যাবে!’

এবার লিমন আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। এতো দিনের চেনা হয়ে ও ওর লোক ওর সাথেই বেঈমানি করবে ভাবতে পারে নি। তাছাড়া ভিডিও টা ঐ ছেলের সাঙ্গদের একজন করেছে। যা লিমন ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। এই ভিডিও পুলিশের হাতে পড়লে সে তো একদম বরবাদ হয়ে যাবে বুঝতে পেরে লিমন বললো,

‘আমি তোদের টাকা দিবো আগে ভিডিও টা ডিলেট করতে হবে!’

‘পাক্কা?’

‘হ্যাঁ!’

‘ওকে বস এক হাতে টাকা দিন আর নিজের হাতেই ভিডিও ডিলেট করে দিন!’

লিমন‌ ৫০ হাজার টাকার একটা চেক লিখে দেয়। আর ঐ ফোন থেকে ভিডিও টা ডিলেট করলে ছেলে গুলো ফোন টা নিয়ে নেয়। ওদের যাওয়ার আগে লিমন রেগে গিয়ে বললো,

‘আর কারো সাথে এভাবে বেঈমানি করিস না! খুব খারাপ তোরা!’

‘আপনি আবার কবে থেকে নিজেকে সাধু ভাবতে শুরু করলেন? আমরা খারাপ হলে আপনি তাদের বস। পরে টাকা লাগলে আবার হাজির হয়ে যাবো নো চিন্তা ডু ফুর্তি!’

সবাই একসঙ্গে হো হো করে হাসলো। ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

‘হাজির হয়ে যাবি মানে?’

লিমন কে শক্ড করে দিয়ে ঐ ছেলে গুলো তাদের একজন ব্যতিত প্রত্যেকের ফোনে ভিডিও টা দেখালো।

‘আপনি ডালে ডালে চললে আমরাও পাতায় পাতায় চলি! তবে আমরা আমাদের টাকা পেলে আপনার কোনো কিছু পাবলিক করবো না প্রাইভেট ই থাকবে বিশ্বাস করতে পারেন। আমরা খারাপ তবে আপনার মতো নই বস!’

ওরা আর এক মিনিট ও না দাঁড়িয়ে চলে যায়। আর ঐ মানুষ টা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তার কি করা উচিত নিজেও বুঝতে পারলো না।

—————-

এদিকে লিমা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সে গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। যেই মানুষ টা দরজা দিয়ে ঢুকলো তাকে বেশ হাসি খুশি আর প্রাণবন্ত দেখালো। সেই মানুষ টি তার দিকে ফিরে ও না তাকিয়ে সোজা চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। অপরজন ঠায় দাঁড়িয়ে সেটা দেখছিলো। আর ভাবছিলো,

‘একটা মানুষ কিভাবে এতো টা খারাপ হয়? আর আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে সেই মানুষ গুলোই কিভাবে অন্য জনের সর্বনাশ করে দিব্যি হেসে যায়? কিভাবে?’

রিমির সেই ক্ষত বিক্ষত চেহারা টা চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠছে লিমার সামনে ফলে কিছুতেই কোনো আইডিয়া মাথায় আসছে না। তাছাড়া এখন তো এই লোকটার সাথে এক ঘরের থাকতেও ঘৃণায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাহ তার কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। এই মানুষ টা কে প্রকৃতির নির্মল বায়ু তে বিশ্বাস নিতে দেওয়া যাবে না। আল্লাহর কাছে মনে মনে সাহায্য প্রার্থনা করতেই ঝটপট খুব ভালো একটা আইডিয়া চলে আসে। সে উঠে গিয়ে লিমনের রুমের বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখলো সে রুমে নেই। ভাবছিলো গেছে টা কোথায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চলে ও এলো। আর ইজি চেয়ারে বসে ফোন নিয়ে কি যেনো দেখতে লাগলো। এটাই চূড়ান্ত সুযোগ!

লিমা দৌড়ে তার রুমে যায় আর একটা সিম তার ফোনে ঢুকিয়ে নেয়। যেটার সম্পর্কে লিমন অবগত নয়। আর ঐ সিম থেকেই সে মেসেজ দিলো,

‘একটা মেয়ের উপর এসিড মারার মতো অপরাধ করেছো। এর প্রমাণ আমার কাছে আছে। আর খুব তাড়াতাড়ি সেটা পুলিশের কাছে চলে যাবে!’

আর সঙ্গে সঙ্গে সিম টা খুলে ফেললো লিমা। আর লিমনের ঘরের সামনে পর্দার আড়ালে খুব সাবধানে লুকিয়ে পড়লো। ওর যাওয়ার আগে ওবধি হয়তো বা ঐ ব্যক্তি মেসেজ টা দেখে নি। যখনি সে রিয়েকশন দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনি ঐ ব্যক্তি মেসেজ টা পড়ে একে বারে ভড়কে যায়।

মুহুর্তের মধ্যে তার হাসি খুশি তে ফাটল ধরলো। আর ইজি চেয়ার থেকে জলদি উঠে বসে। আচমকা এসব দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। যেখানে তার ভয় না পাওয়ার কথা ছিলো সেখানে সে খুব ভয় পেয়ে যায়। কেননা ঐ ছেলে গুলোর কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। তবে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় তো বলেছিলো এমন কিছু করবে না তাহলে?

হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে লিমন সঙ্গেই সঙ্গেই কোথাও যেনো ফোন দিলো। আর লিমা সেসব ফোনে ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর মনে মনে আল্লাহ কে ডাকে যেনো একটি বারের জন্য ঐ মানুষ টি তার অপরাধ টা মুখে নেয়! ঠিক তাই হলো ফোন টা কানের সাথে চেপে ধরে লিমন বললো,

‘আমি মানছি আমি রিমির উপর এসিড নিক্ষেপ করেছি তবে আমি তো একা ছিলাম না তুই ও ছিলি আমার সাথে। আমার থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার পর ও এখন আবারো এসব করছিস? তোদের সব কয়টার মুখ ও না আমি এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দিবো শুয়রের বা**!’

লিমা যেনো প্রাণে বেঁচে গেলো। আর সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে ছুটতে বাড়ি থেকে বের হয়। আর বাড়ির বাহিরেই তালা মেরে দেয় যাতে লিমন বাড়ির বাহিরে না বেরোতে পারে।

টানা আধঘন্টার মতো কথাকাটাকাটির পর্ব চললো তাদের মধ্যে। এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে লিমন আবারো গতকালের ন্যায় জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর শুরু করে।

‘লিমা এই লিমা কোথায় তুই? এদিকে আয় এক্ষুনি!’

কিন্তু কোথায় সে কোথায় কি! সারা ঘর খুঁজে ও কাউকে পাওয়া গেলো না। যখন মাথা হালকা ঠান্ডা হয়ে তার মনে পড়ে ঐ মেসেজ যদি ছেলে গুলোর না হয় তো কার। কল ট্রেস করতে হবে ভেবে সে রুমে যায়। আর নাম্বার টা লিমার রুমের মধ্যেই দেখতে পেয়ে ভারী অবাক হয় লিমন। যখন সব টা বুঝতে পেরে বাড়ির বাহিরে পা রাখার জন্য দরজা খোলার চেষ্টা আর তখনি দেখলো দরজা ওপাশ থেকে বন্ধ। যখন শেষ বারের মতো খোলার চেষ্টা করতে গেলো তখনি ঘটলো অঘটন।

দরজা ওপাশ থেকে কেউ খুলে দিলো কিন্তু লিমন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের পোশাক পরিহিত মানুষ গুলো কে দেখে বাড়াবাড়ি রকমের অবাক হয়। আর সবার শেষে তার দৃষ্টি যার উপর পড়লো সে হচ্ছে লিমা। তার চোখে মুখে লেপ্টে আছে তৃপ্তির হাসি!

চলবে_____________