সম্পর্কের বন্ধন পর্ব-০৮

0
4889

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৮.

সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত পৃথিবী। জ্বলসে যাচ্ছে গাছগাছালির পাতালতা। পিচ ডালা রাস্তাঘাট আগুনের ন্যায় গরম। পা ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। দূরদূরান্তে বাতাসের কোনো লেশ দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে গরমে আধসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে শ্যামল। সে ভীষণ হতাশ প্রকৃতির উপর। এত গরম কেনো? তার জন্য একটু শীতল হলে কি হতো? এদিকে বার বার তৃষ্ণা পাচ্ছে। এতবার অন্যের কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে খাওয়া টা তার নিকট বেমানান লাগছে। সে ঠিক করেছে আরেকবার পিপাসা পেলে বোতল টা আর দিবে না, সোজা গলায় ঝুলিয়ে নিবে। তাহলে আর খুঁজতে হবে না, ফটাফট খেয়ে নিবে। সাহেব-বাবার বাড়ী থেকে বেশ খানেক পথ হাটতে হয়। ওইটুকু কাঁচাপথে গাড়ী চলে না। সেজন্য সবাই হেটে আসছে। শ্যামলের ধারনা হচ্ছে বাকিরা হাটছে কম, গল্পগুজব করে হেলেদুলে পড়ছে বেশি। মেয়ে মানুষ মানেই কথাবার্তা। সে হিসেব করেছে এটুকু পথে কম না হলে ১০০০ টা কথা বলেছে। শ্যামল ভেবে পায় না এত কথা কই থেকে আসে? গরমে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে ওদিকে মেয়েরা খুশি খুশি হয়ে গল্প করছে। তাদের দেখলে মনে হবে না আদৌ কোনো গরম পড়ছে কি না? একাধিক মেয়ে মানুষ একসাথে আর সেখানে কথা হবে না এটা দুঃস্বপ্ন বৈ কিছুই নয়। শ্যামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের তাড়া দিয়ে হাটতে লাগলো।

বাড়ীতে আসার পর ইমনের বউয়ের গয়নাগাটি দেখে হতবাক হয়ে গেলো শ্যামল। বারবার হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো সে। এসব স্বপ্ন-টপ্ন নয় তো? তার আবার দিনে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রিপাকে প্রশ্ন করে,

‘ এসব কই পেলে?’

রিপা মুচকি হাসলো। কিছু বললো না। সে পণ করে নিয়েছে কিছু বলবে না। পীরের দরবার থেকে বেরোনার পর সে কতবার চেষ্টা করলো এই সংবাদ শ্যামলকে শুনাতে। কিন্তু শ্যামল শুনলো কই সে তো রেগে ছিলো। রিপাকে পীরের ভক্তের মতো কান্ড করতে দেখেই সে ঘুরে গিয়েছিলো। বারবার তাকে ইশারায় বুঝালো যে এসব সত্য নয়। রিপা বুঝেও না বুঝার মতো রইলো। পরে শেষে সে রেগে বলতেই রিপা তাকে উল্টো ঝারি দিয়ে দেয়। তখন থেকেই শ্যামলের রাগ রিপার উপর। আবার পুরো রাস্তায় পীরের গুণগান গাইতে গাইতে এসেছিলো রিপা। যাতে সে পীর আর তার শাশুড়ির বিশ্বস্ত হতে পারে। কিন্তু শ্যামল তার এমন বিহেভ দেখে উল্টো ধারনা করে নিয়েছিলো। সে থেকেই দুজনের ভেতর মনমালিন্য চলছে।

‘আশ্চর্য! এমন সং হয়ে আছো কেনো? বলো তো এসব কই পেলেন? এগুলো আমার ভাবীর।’

‘প্রথমে ঠিক করেন, আমাকে কি বলবেন? একবার আপনি বলছেন আরেকবার তুমি বলছেন।’

শ্যামল থতমত খেলো। আসলে সে কনফিউজড।কোনটা বলবে ঠিক করে পায় না। তাড়াহুড়োয় তুমি চলে আসে আবার যখন ঠিকঠাক কথা বলে তখন আপনি বলে। শ্যামল স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বললো,

‘আপনি বলুন কি বলবো?’

‘তুমি করেই বলেন। আপনে আমার অনেক বড়। আপনি শুনতে কেমন অড লাগে।’

‘তুমি কি বয়সের গ্যাপ বুঝাতে চাইছো? ‘

‘আশ্চর্য আমি সেটা কেনো বুঝাতে যাবো? আমি শুধু বলেছি, আমাকে ‘আপনি’ ডাকলে অস্বস্তি লাগে।’

শ্যামল কথা বললো না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রিপা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কথার এমন অর্থ কেউ ধারনা করবে এটা সে নিজেই ভাবে নি। তার মনে এমন কিছুই ছিলো না, শুধুমাত্র কথার স্বার্থে বলেছে। লোকটার এমন অভিমানী রুপ মেনে নিতে পারলো না সে। নিজের মনের মধ্যে খচখচ শুরু হয়ে গেলো। মন বলছে, তার এমন বলা উচিত হয় নি। কিন্তু সে তো এমন কোনো ধারনা থেকে বলে নি। রিপা এক পলক বাহিরে উঁকি দিয়ে দরজা টা ভিড়িয়ে দিলো। শ্যামলের পাশে বসে নরম কন্ঠে বললো,

‘ আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন। এখানে রাগ করার কোনো বিষয় ই নেই। স্বামীরা তো স্ত্রীদের থেকে বয়সে বড়ই হয়। আপনি, আমার আম্মু আর আব্বু কে দেখেন। উনাদের বয়স কত পার্থক্য। আশেপাশে দেখেন সবার একই জিনিস দেখতে পাবেন। উল্টো আমি এমন বললে, লোকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কারণ এটা স্বাভাবিক, সচরাচর বিষয়। সত্যি আমি এমন কিছুই মিন করি নি।’

রিপা করুণ মুখে তাকিয়ে রইলো। লোকটার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না। কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ধীর কন্ঠে বলে,

‘ আচ্ছা, সরি। আর এমন বলবো না।’

শ্যামলের মন গললো। সে রিপার হাত দুটো নামিয়ে বললো,

‘ সরি বলতে হবে না, আমি রাগ করি নি।’

রিপা একটুখানি হাসলো। স্বামীর সাথে সংসার করা খুবই সহজ। কিন্তু মানুষ তা সহজ হিসেবে নেয় না, তারা জটিল থেকে জটিল করে ফেলে। তার মা আর বাবার যখন কোনো কারণে মনমালিন্য হয় তখন তারা একে অপরের সাথে দীর্ঘসময় কথা বলে না। কেউ বিষয় টাকে মিটিয়ে নেয় না । তারা তিন বোন, কেউ মা আবার কেউ বাবাকে বলে কথা বলে নিতে। তখন তাদের হাজারো অভিযোগ বেরিয়ে আসে। কেউই কারো নিকট ছোটো হতে চায় না। তার মা-বাবার ধারনা সরি বলা মানেই ছোট হওয়া, ইজ্জত চলে যাওয়া, ইগো হার্ট হওয়া। সেজন্যই দীর্ঘসময় তাদের মনমালিন্য এবং সংসারে অশান্তি চলে। রিপা এসব ভাবে না, অপরপক্ষ ক্ষমা চাইবে না বলে কি সে ও চাইবে না। তাহলে তো কারোই চাওয়া হবে না উল্টো সম্পর্কের দূরত্ব বাড়বে। আজ সে আগ বাড়িয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে কাল দেখা যাবে তার স্বামী মিটিয়ে নিবে। একেই তো বলে সংসার। রিপার ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে শ্যামলের বারংবার করা প্রশ্নে। শ্যামল উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করছে গয়নাগাটির ব্যাপারে। রিপা খানিক হেসে, সেখানের ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করলো। সব শুনে শ্যামল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

‘ও মাই গড! সিরিয়াসলি রুপু, তুমি এমন কান্ড করেছো? তুমি দেখি আমার ধারনার একধাপ আগে।’

রুপু ডাক শুনতেই শরীর শীতল হয়ে উঠলো রিপার। সে হাসি থামিয়ে দেয়। এই ডাক টা খুবই পুরানো। দাদাজান ছাড়া কেউ তাকে এ নামে ডাকে নি কখনো। আজ শ্যামলের হঠাৎ বলায় তার ভেতর কিছুটা নড়েবড়ে উঠলো। শ্যামল ভ্রু কুচকে তাকে ইশারায় প্রশ্ন করলো কি হয়েছে? রিপা মাথা নাড়িয়ে বললো কিছু না। শ্যামল পাত্তা না দিয়ে হাসতে লাগলো।

নির্মলা বেগম আয়নার সামনে দাড়িয়ে তৈরী হচ্ছেন। মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তিনি বেজায় খুশি। খুশির হবার কথা নয় কি? আজ এত বড় এক কান্ড ঘটেছে। মনে মনে রিপার উপর বেশ গর্ভ করলেন। যাক তিনি ভুল মেয়ে আনেন নি। গত এক বছরে এতটা খুশি হতে তাকে আর দেখা যায় নি। তিনি ঠিক করেছেন, ভালোয় ভালোয় ছেলেটা সুস্থ হয়ে গেলে রিপার মা -বাবার কাছে যেয়ে সব টা বলে ঠিক করে নিবেন। আজ গেলে এসব কিছু বলবেন না। শ্যামলের বউ বলেই পরিচয় করাবেন। রিপাকে নিয়েও টেনশন নেই। মেয়েটা সব মেনে নিয়েছে বরংচ রিপাকে আরো খুশি দেখাচ্ছে। শ্যামলের প্রতি রিপার রাগ দেখেছেন, তার ধারনা রিপার বাবা চাইলেও রিপা শ্যামলকে মানবে না। রিপা আর ইমনের সব ঝামেলা মিটে গেলে, নুহা আর শ্যামলের বিয়ে টা দিয়ে দিবেন। এরপর তিনি আদায়মুক্ত হবেন। মা-বাবার ঘাড়ে সবচেয়ে বড় বোঝা থাকে ছেলেমেয়েদের বিয়ে। এ দিকটা সেরে ফেলতে পারলেই তারা আদায় পেয়ে যান। নির্মলা বেগম তৈরী হয়ে ঘড়ি দেখলেন। এখনো ২ টা বাজে নি। তাদের ২ টা পূর্বে বেয়াইদের বাড়ী পৌঁছাতে হবে। রিপার বাবার বাড়ীতে আজকে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। সকালে রিপা তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার পর তারা জেদ করেছেন আজই মেয়ে কে নিয়ে যেতে। আদরের মেয়ে কখনো একা কোথাও যেতে দেয় নি, আজ এতটা দিন তাদের থেকে দূরে মন তো কাঁদবেই। তাছাড়া রিপার ওইটুকু মুখ দেখে তিনিও বারণ করেন নি। ঠিক করে নিলেন দুপুরের খাবার সেখানে খাবেন। এরপর বিকালের দিকে তারা চলে আসবেন এবং রিপাকে কিছুদিনের জন্য রেখে আসবেন।

যথাসময়ে রুবেল সাহেবের বাড়ীতে এসে পৌঁছায় রিপার শশুড়বাড়ীর লোকজন। সবাই বেশ সেজেগুজে এসেছে। নুহা, আজ লাল রং এর জামা পরেছে। তাকে দেখতে একদম নায়িকা নায়িকা লাগছে। সে বেশ ভাব নিয়ে শ্যামলের পাশে দাড়িয়ে আছে। রিপা ভারী শাড়ী পরেছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ীতে প্রথমবার আসছে, দামী শাড়ী তো পরতেই হবে। নুহাকে শ্যামলের এত কাছে দেখে, সহ্য করতে পারছে না সে। একটু পর পর চোখ কটমট করে শ্যামলের দিকে তাকায়, শ্যামল তখন অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে রিপা খুব জোরে জোরে চিমটি কাটে তাকে। শ্যামল দাত মুখ খিঁচে নিজেকে সংযত করে। সে পড়েছে বেকায়দায়। কোনোরকম শব্দ করলেই বাজবে ভেজাল। নিজের রাগ টা কলিং বেলের উপর দেখাতে লাগলো সে। দ্রুত দরজা না খুললে তাকে আর পাওয়া যাবে না। দু সেকেন্ডের মাথায় চেঁচাতে চেঁচাতে দরজা খুলে দিলেন বুড়ি মহিলা। সম্পর্কে তিনি রিপার দাদী।

‘ কি গো বাপুরে। কান ফাটিয়ে দিবে নাকি? দরজা খোলার জন্য সময় তো লাগে। এতবার যে বাজাইতেছো এটা নষ্ট হইলে আবার কিনে দিবা নি?’

শ্যামল লজ্জতি ভঙ্গিতে বললো,

‘দুঃখিত। ‘

রিপা হা করে দাদীর দিকে তাকিয়ে আছে। দাদী কখন আসলো? দাদী তো ফুফির বাড়ীতে ছিলেন। সে বিরবির করে বললো, ‘ইয়া আল্লাহ মাবুদ, তুমি বাঁচাইয়ো।’ রিপা দ্রুত মাথা নিচু করে দাদীর পা ধরে সালাম করে বললো,

‘ আসসালামু আলাইকুম, দাদী। ভালো আছেন নি? ‘

রুপসী বানু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছি ভালো আছি ভালো আছি বললেন। শ্যামল ও রিপার দেখাদেখি রুপসী বানুর পায়ের দিকে ঝুঁকলো সালাম দিতে। সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে সরে গেলেন তিনি । শ্যামল হকচকিয়ে তাকালো। কি হলো বুঝতে পারছে না সে।

‘নাউজুবিল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! এ কি কান্ড। ও নিপা,ও শিপা, তাড়াতাড়ি জমজম কূপের পানির বোতল টা নিয়া আয়। ‘

শ্যামল অবাক হয়ে বললো,

‘কি হয়েছে? ‘ তার ধারনা উনার পায়ে কিছু হয়েছে। সে রুপসী বানুর পা দেখতে যেতেই তিনি চেঁচিয়ে বললেন,

‘ একদম কাছে আইবি না। নাহলে মাথা ফাটিয়ে দিবো। পুরুষ আর বিড়াল এই দুই জাতকে বিশ্বাস করতে নেই, এরা যেখানে সেখানে মুখ দেয়।’

রিপা চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন কিছু ঘটবে তার আগাম ধারনা ছিলো। তার দাদী সূচীবায়ু টাইপের! কোনো পুরুষ মানুষকে তার আশেপাশে দেখতে পারেন না। এমনকি তার ফুফা এবং ফুফাতো ভাই পর্যন্ত না। শ্যামল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে নির্বাক। বুড়ো বেটি তাকে এমন কিছু বলবে এর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

চলবে!