সম্পর্কের_মায়াজাল পর্ব-০৬

0
3426

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৬

শুভ্রতা আজ কালো কালারের জামা পরেছে। কিন্তু সমস্যা করছে জামার হুক লাগানো। পিছনের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে আটকাতে পারছে না। এক পায়ে দাঁড়িয়ে হাত নিচু করতে গিয়ে স্পন্দনের উপরে পরে যায় ও…….

—” হাতি পরলো গায়ের উপরে। আল্লাহ?”

শুভ্রতা দ্রুত গতিতে উঠতে গিয়ে স্পন্দনের পায়ের উপরে পা ফেলে…..

—” আল্লাহ আমি শেষষষষষষষ। ”

শুভ্রতা এইবার বোকার মতো স্পন্দনের পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে।

—” ওই সরেন আমাকে কি মারার প্ল্যান করছেন না-কি?”

স্পন্দনের চিৎকারে দূরে সরে যায় শুভ্রতা। স্পন্দন কিছুক্ষণ হাত ঝাঁকি দিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো শুভ্রতার দিকে।

—-” সরি আমি বুঝতে পারিনি। ব্যাথা পেয়েছেন বেশি?”

—-” কি মনে হয় আপনার?”

—” আমার বায়ান্ন কেজি শরীরের ভর নেওয়া কম না-কি? স্যার বিশ্বাস করেন নিজ ইচ্ছায় করিনি এইসব। জাস্ট অ্যাকসিডেন্ট।”

—” কি এমন কাজ করছিলেন যে এইভাবে আমার উপরে পরে গেলেন?”

শুভ্রতা লজ্জায় মুখ নিচু করে রেখেছে। স্পন্দন এমনিতে রেগে আছে তার উপর শুভ্রতার চুপ থাকতে দেখে আরো বেশি রেগে গেলো।

—” কি হলো উত্তর দিন!”

স্পন্দনের ধমক শুনে শুভ্রতা উল্টো ঘুরে দেখালো…..

—-” এই সমস্যা!”

স্পন্দন প্রথম ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে শুভ্রতার জামার হুক লাগিয়ে দিলো।

—-” এইভাবে সামনে আসবেন না। ভুলে যাবেন না আমি একজন ছেলে।”

দুজনেই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লো। ঠিক তখনি শুভ্রতার ফোন বেজে উঠলো। ‘ সমুদ্র’ নাম দিয়ে সেভ করা নাম্বার। শুভ্রতা ফোন রিসিভ করলো ওপাশ থেকে সমুদ্র বলে উঠলো……

—-” কি রে নতুন বউ কেমন যাচ্ছে দিনকাল?”

—-” হুম ভালো। তোর?”

—” হুম ভালোই। দুলাভাই কোথায়?”

—-” এইতো এইখানেই।”

—-” মনে হচ্ছে ভুল সময়ে ফোন করলাম।”

—-” শয়তান,অসভ্য ছেলে।”

—-” আচ্ছা আচ্ছা রাখছি পরে কথা হবে।”

—-” হুম।”

সমুদ্রের ফোন কেটে শুভ্রতা আয়নার সামনে বসে সাঁজতে লাগলো।

—-” আমাকে তো কোনোদিন এত সুন্দর করে বকা দেও নি। সমুদ্র ছেলেটাকে এত সুন্দর বকা দিলে। কে এই ছেলে? কি হয় তোমার?”

—-” আপনি আবারো কিন্তু রুলস…..!”

—-” আমি এখন তুমি করেই বলবো। তুমি আমার কর্মচারী ওকে?”

—” হুম।”

শুভ্রতা কথা বাড়ালো না। স্পন্দন খুব রেগে আছে বুঝাই যাচ্ছে। এখন কথা বললে রাগ আরো বাড়তে পারে।

—-” ছেলেটা কে?”

—-” আমার ফ্রেন্ড।”

—” কই আগে তো কোনো ফ্রেন্ডের কথা শুনি নি?”

—-” আগে আপনার সাথে কি আমার পার্সোনাল ব্যাপারে কথা হতো স্যার? যে শুনবেন!”

—” শুধুই কি বন্ধুত্ব না-কি অন্য কিছু?”

শুভ্রতা ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে দিতে স্পন্দনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

—-” যাইহোক তাতে আপনার কি? আমাদের তো ডিভোর্স হবেই তাই না?”

—” এমন তো হতে পারে ডিভোর্স তোমাকে আমি দিবো না।”

—” সত্যিই!”

শুভ্রতা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলো। স্পন্দন তখন জোরে জোরে হাসতে লাগলো। শুভ্রতা এইখানে হাসার কিছু না পেয়ে জিজ্ঞাস করলো…..

—” হাসার মতো কোনো কথা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে। আপনি এত হাসছেন কেনো?”

—” হাসবো না তো কি করবো বলেন আপনি? আমি মজা করে কিছু কথা বললে আপনি কেমন যেনো সিরিয়াস হয়ে যান। হাহাহাহা।”

—” ওহহ আপনার এইসব মজা ছিলো। আসলে কি জানেন আমি আজও আমাদের এই সম্পর্কের কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। মাঝে মাঝে আপনার কথার ধাঁচ কেমন যেনো লাগে । ”

—-” কি-রকম লাগে?”

—” মায়াজাল মায়াজাল মনে হয়। যার অর্থ হটাৎ বুঝি আবার বুঝি না। আমাদের এই সম্পর্কের মায়াজালের ব্যাপারটা এখনও ক্লিয়ার না আমি।”

—” আপনার কি ক্ষুধা লেগেছে?”

—” এই যে আবার সেই অদ্ভুদ কথা বার্তা। হটাৎ করেই আপনি যে কিভাবে চেঞ্জ হয়ে পরেন বুঝি না আমি।”

—” আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি খাবেন কিছু?”

—” হুম। আমার জন্য গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি করে আনুন। তাহলে ভাববো এই জীবনে সব’চে কঠিন,অসাধ্যকর , চিন্তা-ভাবনার বাহিরে একটি কাজ করতে পেরেছি।”

—-” ওকে আপনি ওয়েট করুন আমি আসছি।”

।।

।।

।।

একটি পুরানো ভাঙ্গা বাড়িতে একটি মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারপাশটা খুবই খারাপ ভাবে রাখা হয়েছে। ভাঙ্গা ঘরের চালের ফুটো দিয়ে বিন্দু বিন্দু রোদ এসে পড়ছে। হাত ও পা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। মুখ খুলে রাখা হয়েছে। এই জঙ্গলে কেউ আসবে না বলে মেয়েটির মুখ বাঁধা হয়নি। পানির তেষ্টা পেয়ে মেয়েটি চিৎকার করছে। চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বার বার ঢোক গিলছে……

—” কেউ আছেন? প্লিজ আমায় একটু পানি দিন। আমি আর পারছি না। ”

কেউ শুনছে না তার কথা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে……

দুটি লোক বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির চিৎকার শুনেও তারা জবাব দেয়নি।

—” মেয়েটিকে এইভাবে ধরে আনার কোনো কারণ ছিলো কি?”

—-” আমি জানি না। বস কিছু বলেনি।”

—” কত কষ্ট করছে দেখতে পাচ্ছিস? পানির জন্য কত কিছুই না করলো।”

—-” এত দরদ দেখাতে আসিস না। পরে বস আর টাকা দিবে না। পাহারা দিবো শুধু তবুও কত টাকা দিচ্ছে দেখতে পাচ্ছিস না?”

প্রথম লোকটি চুপ করে থাকে। মেয়েটির কষ্ট তার সহ্য হচ্ছে না কিন্তু টাকার লোভ যে বড় লোভ সেখানে এত দরদ দেখানো ঠিক না।

।।

।।

।।

স্পন্দন পরোটা,ডিম ভাজি আর গরুর মাংস রান্না করলো। রান্না শেষে খাবার টেবিলে সাজিয়ে শুভ্রতাকে ডাকতে গেলো।

শুভ্রতা স্পন্দনের দেরি দেখে শুয়ে পরে আর ঘুমিয়ে যায়। অবাধ্য চুল গুলো মুখের কাছে এসে পরে থাকে। শুভ্রতা খুব সাধারণ একজন মেয়ে। কিন্তু স্পন্দনের কাছে তাকে এখন অসাধারণ লাগছে। স্পন্দন চুল সরিয়ে গভীর ভাবে চুমু খায় শুভ্রতার ঠোঁটে। স্পন্দন ঘুমন্ত শুভ্রতাকে কোলে উঠিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে নিজেকে হাওয়ায় উড়ছে মনে করে শুভ্রতা চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে স্পন্দনের কোলে আবিষ্কার করে। এক অদ্ভুদ অনুভুতি হচ্ছে শুভ্রতার।

স্পন্দন শুভ্রতাকে নিচে নামিয়ে সামনে তাকানোর ইশারা করে। চকোলেট কেক,মোমবাতি, পরোটা,ডিম ভাজি,গরুর মাংস দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো শুভ্রতা……

—-” এতকিছু কেনো?”

—” সন্ধ্যা নেই তো কি হয়েছে আমরা আছি। চলো আজ তুমি আর আমি সন্ধ্যার বার্থ ডে পালন করি।”

কেকের উপরে থাকা মোম আর মাঝে রাখা বড় মোম জ্বালিয়ে দিলো। স্পন্দন শুভ্রতাকে ইশারা করলো দুইজন একসাথে মোম গুলো নিভাবে। স্পন্দনের ইশারার সাথে সাথেই মোম নিভাতে লাগলো। কেক কেটে শুভ্রতার মুখে তুলে দিলো স্পন্দন। দুইজন একসাথে খাবার খেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো…..

—-” থ্যাংকস আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। ”

—” থ্যাংকস দিতে হবে কেনো? আমি তো আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার সঙ্গ দেওয়া এইটা তো আমারই দায়িত্ব, কর্তব্য।”

—” আজ যা হয়েছে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু এই জন্য আপনি ভাববেন না আমরা প্রকৃত পক্ষে স্বামী স্ত্রী। আমাদের বিয়ে জাস্ট এক বছরের জন্য ওকে। ”

শুভ্রতা এখন আগের সেই স্পন্দনকে দেখতে পেলো। একটু আগের স্পন্দন এখনকার স্পন্দন দুইজন ভিন্ন। সঙ্গ পাওয়ার জন্য নাটক করেছে সে তার কাছে? বার বার এমন মনে হতে লাগলো শুভ্রতার। নিজেকে সান্তনা দিয়ে বাসায় ফোন দিলো। শুভ্রতার বাবা যা বললো মোটেও তা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না শুভ্রতা। সাধনার খুঁজ না-কি পাওয়া গিয়েছে। সাধনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। কিডন্যাপার ফোন দিয়ে বলেছে সে না-কি সাধনাকে বিয়ে করবে। সাধনা ভালো আছে বলে ফোন কেটে দেয় সে। শুভ্রতা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে…..

—-” কি হয়েছে?”

স্পন্দনকে বলতে গিয়েও থেমে যায় শুভ্রতা। যে তার সাথে সঙ্গ পাওয়ার জন্য অভিনয় করতে পারে তার সাথে ব্যাক্তিগত কথা বলবে না সে……

—” আমার পার্সোনাল কথা আপনাকে জানাতে ইচ্ছুক না আমি।”

একটা দিন এইভাবেই কেটে গেলো। সাধনার চিন্তায় রাতে ঘুম হলো না শুভ্রতার। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের মহিলার সাথে টুকটাক কাজ করতে লাগলো। রান্না শেষে স্পন্দনকে ডাক দিলো। স্পন্দন ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করলো। স্পন্দনের বাবা মা এখনও আসেনি।

দুইজন একসাথে অফিস চলে গেলো। দরকারি কথা ছাড়া কেউ কারো সাথে কথা বললো না। অফিস যাওয়া মাত্রই কাজের চাপ বেড়ে গেলো শুভ্রতার। এতদিনের সব কাজ রেখে দিয়েছে স্পন্দন তার জন্য। অন্য কাওকে করতে দেয় নি। কারণ, শুভ্রতা তো বেতন কম নিবে না তাহলে ওর কাজ অন্য কেউ কেনো করবে? এমন কথা শুনে শুভ্রতার রাগ এখন প্রচুর। রাগের বশে সবার সামনে স্পন্দনের গায়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে চলে আসে। নিজের কেবিনে আসতেই সাধনার নাম্বার থেকে ফোন দেখে দ্রুত গতিতে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বললো…..

—-” আমি বিয়ে করে ফেলেছি আপু। সরি রে আপু, সব কিছু স্পন্দনের প্ল্যান। ওনি নিজেই আমাকে যা যা করতে বলেছে আমি তাই করেছি। খুন করার হুমকি দিয়েছিলো। আমি আমার বয়ফ্রেন্ড মুগ্ধকে বিয়ে করেছি। আমার খুঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিস না আমি খুব ভালো আছি। যদি পারিস তাহলে স্পন্দনকে ভালো রাস্তায় নিয়ে আয়। ও ভালো ছেলে না। তোর কোনো বিপদ হওয়ার আগেই নিজেকে বাঁচা।”

এইটুকু বলেই সাধনা ফোন কেটে দিলো। শুভ্রতা বার বার ফোন দেওয়ার পর আবারো বন্ধ ফোন। শুভ্রতা বুঝতে পারছে না কি করা উচিত এখন ওর। সাধনা শুভ্রতাকে খুব ভালোবাসে সে জানে। বোন ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে। তাহলে সে মিথ্যা কথা বলেনি। কিন্তু স্পন্দনকে ও যেভাবে চিনে তাতে স্পন্দনের খারাপ কিছু এখনও দেখিনি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। দুইজনেই তার কাছের মানুষ। সম্পর্কের এই মায়াজাল থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না শুভ্রতা…….

চলবে,…..

বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।