সম্পর্কের_মায়াজাল পর্ব-০৫

0
4265

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৫

—-” ৩১ মিনিট ৫ সেকেন্ড লাগলো এই জিনিস গুলো বানানোর জন্য? আপনার আশায় থাকলে পেটের ক্ষুদা পেটেই রাখতে হবে।”

—-” আমি চলে যাওয়ার পর থেকে কি হিসাব করে রাখছিলেন? ”

—-” হিসাব ছাড়া কোনো উপায় আছে কি? কফিটা দিন।”

স্পন্দন শব্দ করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো অমৃত খাচ্ছে। শুভ্রতার শব্দ করে চা বা কফি খাওয়া মোটেও পছন্দ না কিন্তু আজ তার কাছে স্পন্দনের কফির মগে চুমুক দেওয়া এক অন্যরকম লাগছে। সে নিজেও শব্দ করে চুমুক দিতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললো…..

স্পন্দন ল্যাপটপ সরিয়ে শুভ্রতার হাত থেকে চা-এর কাপ সরিয়ে হাত দিয়ে বাতাস করতে থাকে শুভ্রতার মুখে। স্পন্দনের এমন বোকা বোকা কান্ড দেখে শুভ্রতা হেসে বললো…….

—-” মুখে গরম কিছু পড়লে কি হাত পাখা করতে হয়? আমার জানা ছিলো না!”

—” উহু। মুখে ঠান্ডা জাতীয় কিছু রাখা উচিত। ”

—-” তাহলে আপনি এমন করলেন কেনো?”

—-” বুঝবেন না। একটা কথা বলবো?”

স্পন্দন আজ নিজ থেকেই শুভ্রতাকে কিছু বলার জন্য বলছে। শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় বললো…..

—-” হুম বলেন?”

—-” আজ আমার সাথে শীতের রাতের জোসনা বিলাস করবেন? ”

স্পন্দনের রোমান্টিক কথাগুলো শুভ্রতার কাছে অদ্ভুদ লাগলো। শুভ্রতা স্পন্দন কে চিনে অনেকদিন। স্পন্দনের সম্পর্ক নিয়ে ধারণা তার ভিন্ন।

—-” হুম যেতে পারি যদি আগামীকাল আমাকে নিয়ে ফুচকা খেতে যান। যাবেন?”

স্পন্দন এক গাল হেসে শুভ্রতার কথায় রাজি হয়ে গেলো। স্পন্দন একটি চাদর তার কফির মগ,নুডলস রোলের প্লেট সাথে নিলো।

চারপাশ খুব ঠাণ্ডা। স্পন্দন ভেবেছিলো শুভ্রতা সাথে করে চাদর এনেছে কিন্তু শুভ্রতা কিছুই আনেনি। শুভ্রতাকে কাপতে দেখে চাদর ভাগাভাগি করলো। তাদের মাঝে দুরত্ব থাকায় শীত যেমন ছিল তেমনই থাকছে। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে শুভ্রতার হাত ধরে টান মেরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে চাদর দিয়ে দুজনের শরীর ঢেকে দিলো। শুভ্রতা প্রথম লজ্জা পেয়ে দূরে যেতে নিলে স্পন্দন এক হাত দিয়ে জাপটে ধরে শুভ্রতাকে।

—-” আমরা এখন স্বামী স্ত্রী একে অন্যের কাছে থাকা খারাপ না। হুম এক বছর পর আমাদের ডিভোর্স হবে কিন্তু বর্তমানে তো আমরা স্বামী স্ত্রী। ”

—” তবুও আমাদের এত কাছাকাছি থাকাটা ঠিক না স্যার। আপনি পুরুষ মানুষ আপনার সমস্যা নাও হতে পারে কিন্তু আমরা মেয়েরা তাদের তো অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। দুরত্ব আগে থেকে থাকাই ভালো।”

স্পন্দন কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো…..

—-” বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না আমরা?”

—” শুধু বন্ধু?”

—-” এখন আমরা বন্ধু হয়েই থাকি। ভবিষ্যতে যদি মন অন্য কিছু বলে তখন ভাবা যাবে। আমাদের তো এখন স্বামী স্ত্রীর যে সম্পর্ক থাকা দরকার তাতো হচ্ছে না বা হবে না।”

শুভ্রতার খুব খারাপ হতে লাগলো স্পন্দনের কথায়। নিজেকে মনে মনে সান্তনা দিলো। বুঝালো যে, স্পন্দন এখনও থাকে ভালোবাসতে পারে নাই। স্পন্দন তো সাধনাকে ভালোবাসা। এইসব ভাবতে গিয়েও লজ্জাবোধ করলো কেননা সম্পর্ক নিয়ে……..

—-” সাধনার সাথে আপনার পরিচয় কথায় হয়েছে?”

—” আপনি নাকি আমার আর আপনার পালিয়ে যাওয়া বোনের বিয়ে মেনে নিতে চাননি?”

স্পন্দন যে এমন একটি প্রশ্ন করবে শুভ্রতা ভাবতে পারেনি। সাধনার মুখে শুনেছে স্পন্দন তাকে ভালোবাসে কিন্তু স্পন্দনকে দেখে অন্য রকম লাগছে। তার কথা বলার ভঙ্গি, মন-মানসিকতা সব কিছুই বলে দিচ্ছে সে সাধনাকে মন থেকে কোনোদিন চাইনি। কষ্ট না পেয়ে শুভ্রতার ভালোই লাগছে। বার বার দোয়া করছে তার ভাবনা যেনো সত্যি হয়। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না হটাৎ তার মন এমন চেঞ্জ হওয়ার কারণ কি?

—-” আপনি সাধনাকে ভালোবাসেন না?”

—” আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি?”

—” আপনিও তো দেননি?”

—-” ভালোবাসা নামক শব্দটি উচ্চারণ করা যতটা সহজ কিন্তু ভালোবাসতে পারা অনেক কঠিন। ভালোবাসা হলো একটি দায়িত্ব, সারা জীবন পাশে থাকার কমিটমেন্ট, একজন আরেকজনকে বুঝতে পারা, দুইজনের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটির মানে দায়িত্ববোধ,কর্তব্য, হৃদয়ের গভীর থেকে আসা অনুভুতি, যার সুখের জন্য সব কিছু করা যায় কিন্তু আই লাভ ইউ কথার মানে তা নয়। আজকাল আমরা দেখতে পাই এক ফ্রেন্ডকে কথায় কথায় আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ বলছে কারণ স্বাভাবিক। কিন্তু ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ আর ‘আই লাভ ইউ ‘ পার্থক্য অনেক। আমার কথাগুলো শুনে আপনার কাছে ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে কিন্তু যখন থেকে আমি ভালোবাসা কি বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই ধারণা আমার এমন ছিলো। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ মানে আমি তোমার রূপ, বাইরের সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসেনি আমি ভালোবেসেছি শুধুই তোমাকে। তোমার মনকে। তোমার সবটুকু জুড়ে শুধুই আমি। ভালোবাসা বলে বা সময় বা দিন তারিখ দেখে আসে না। ভালোবাসা শুরু হয় হৃদয়ের বন্ধন থেকে। আমাদের এই ছোট হৃদয়ে ভালোবাসার জায়গা এক বিশাল আকাশ। ওই আকাশে সব কিছুই থাকে।”

শুভ্রতার কাছে স্পন্দনের কথাগুলো নতুন কিছুর আভাস দিচ্ছে। শীতের রাতের চাঁদের দিক মুখ করে তাকিয়ে আছে দুইজন। চাঁদের চারপাশ অর্থাৎ আকাশটা ঘন কালো কুয়াশায় ভরপুর। শুভ্রতা এখনও স্পন্দনের বুকের সাথে মিশে আছে। স্পন্দন তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

—” একটু দোলনায় বসবেন প্লিজ?”

শুভ্রতার কথা রেখে স্পন্দন দোলনায় বসলো। শুভ্রতা এইবার নিজ থেকে স্পন্দনের কাঁধে মাথা রাখলো।

—-” আপনাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছি তাই না?”

—” উহু। বরং খুব ভালো লাগছে। জানেন স্যার, আমি কোনোদিন শীতের রাতের চাঁদ এইভাবে দেখেনি। আজকেই দেখেছি। আপনি কি দেখেন প্রতিদিন?”

—” উহু। আজ দেখতে ইচ্ছা করলো খুব।”

—” কেনো? মন খারাপ?”

—-” আজ সন্ধ্যার জন্মদিন। কতবার ফোন দিয়েছি ধরলো না। এখন সম্ভবত ব্লক করে রেখেছে সব কিছু থেকে। এই প্রথম তাকে আমি উইশ করতে পারিনি। ”

—-” সন্ধ্যা কে?”

—-” আমার বোন। বিয়েতে রাজি ছিল না তাই রাগ করে চলে গিয়েছে।”

—” আজ আমার জন্যই আপনারা ভাইবোন আলাদা । আমি আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছি।”

—” দোষ আপনার না। দোষ আমার। আমি সকলের সামনে থাপ্পড় মেরেছি ওকে সেই জন্যই রাগ আমার প্রতি ওর। ও খুব জেদী মেয়ে। সবার সামনে চড় মারাতে অপমানজনক ভেবেছে। চিন্তা করবেন না ও আসলে ঠিক হয়ে যাবে। আমার বোন খুব সহজ সরল। যার সাথে কথা বলে, বিশ্বাস করে তার জন্য সব কিছুই পারে ও। মাঝে মাঝে অনেকেই তার ভালো মানুষের সুযোগটা নিয়েছে। তাছাড়া আমার বোন প্রতিবন্ধী।”

স্পন্দনের শেষ কথাটা বলার সময় গলা,ঠোঁট কেপে উঠেছিল। চোখের কোনা গুলো পানিতে চিকচিক করছে। দেখে মনে হচ্ছে চোখের পাতা ফেললেই গড়িয়ে পানি পড়বে।

এই প্রথম শুভ্রতার খুব কষ্ট হচ্ছে। স্পন্দনকে দেখে যেমন মনে হয় সে তেমন না। সবার সাথে রাগী রাগী ভাব, সারাদিন সময় ও টাকার হিসাব, কঠোর মনের মানুষ তার ভিতরেও কষ্ট আছে কেউ বুঝতে পারে না। সবাই যাকে খুব ভয় পায় আজ সেই লোকটাই কান্না করছে।

—” চলুন যাওয়া যাক। একটু পরেই আযান দিবে। নামাজ পড়ে বোনের জন্য দোয়া করবেন । চলেন।”

স্পন্দনকে মসজিদে পাঠিয়ে সেও রুমে নামাজ পড়লো। মনটা খুব ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে তার। আজকের সকালটা একটু অন্যরকম ভাবে শুরু হলো। শীতের সময় তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সকালের শীত যেনো আরো তিনগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আজ তো শুভ্রতার কোনো ভাবেই ইচ্ছা করছে না অফিস যেতে……

—-” মালিকের বউ হয়ে দিনদিন অলস হয়ে যাচ্ছি। এইটা ঠিক না শুভু ভুলে যাস না মাত্র এক বছর তুই মালিকের বউ এখন আবার এক বছরের কম আছে। এখন চাকরির বাজার যে দর তাতে বর ডিভোর্স দিলে আরেকটি বর পাবি কিন্তু চাকরি হারালে চাকরি পাবি না।”

শুভ্রতার লাস্ট কথাটা শুনে ফেললো স্পন্দন। ভ্রু জোড়া কুচকে মাথা,মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকে আর বলে …..

—-” নতুন বিয়ের প্ল্যান করছেন নাকি?”

শুভ্রতা দুষ্টুমি করে বললো…..

—” হুম আপনি তো এক বছর পর ডিভোর্স দিয়ে দিবেন তাহলে আমি একা কি করবো তাই প্রেম করার জন্য মানুষ খুঁজছি।”

স্পন্দন শুভ্রতার কথা শুনে ধীরে ধীরে শুভ্রতার কাছে এসে কোমর জড়িয়ে শুভ্রতার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো……

—-” আমাকে দাওয়াত দিতে ভুলবেন না। আমি আবার অনেকদিন ধরে বিয়ে খেতে পারি না।”

স্পন্দনের এমন উত্তরের আশায় ছিলো না শুভ্রতা। এই শীতে সে আরো জমে যাচ্ছে। বরফের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। শুভ্রতার এমন মুখ দেখে স্পন্দন শুভ্রতার নাক চেপে ধরলো…..

—-” আহ্। অসভ্য ছেলে।”

—” আজকের মিটিং ক্যান্সেল করে দিচ্ছি। যে বৃষ্টি পড়ছে তাতে ঘুমানোটা বেটার হবে। ”

স্পন্দন শুয়ে আছে। শুভ্রতার শশুর শাশুড়ি সকালে সন্ধ্যা যেখানে আছে সেখানে চলে গিয়েছে। সন্ধ্যার জন্মদিন তারা থাকবে না তা-কি হতে পারে। বৃষ্টিও তাদের আটকাতে পারেনি। স্পন্দন একবার ভেবেছিলো যাবে কিন্তু শুভ্রতাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সবার সামনে কি করবে কে জানে সন্ধ্যা? শুভ্রতা একা থাকবে বলে মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনকে বারণ করেছেন যেতে।

শুভ্রতা আজ কালো কালারের জামা পরেছে। কিন্তু সমস্যা করছে জামার হুক লাগানো। পিছনের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে আটকাতে পারছে না। এক পায়ে দাঁড়িয়ে হাত নিচু করতে গিয়ে স্পন্দনের উপরে পরে যায় ও…….

—” হাতি পরলো গায়ের উপরে। আল্লাহ?”

চলবে…..

বানান ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।