সম্পর্কের_মায়াজাল পর্ব-০১

0
5407

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১

বধূ সেজে বসে আছি ছোট বোনের হবু স্বামীর সামনে।লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে এখন। চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছি না। বার বার মনে হচ্ছে সময়টা এইখানেই থেমে থাকুক। কাজী সাহেব বার বার তাড়া দিচ্ছেন কবুল বলার জন্য কিন্তু ছোট বোনের হবু স্বামীকে নিজের স্বামী ভাবতে নিলেই শরীল যেনো বার বার কেঁপে উঠছে…….

আমি শুভ্রতা। সাধারণ একটা জব করি। এখন আপনারা অবাক হচ্ছেন আমি কেনো ছোট বোনের হবু স্বামীকে বিয়ে করছি। বিষয়টা খুব লজ্জাজনক তাই না? হ্যাঁ আমারও খুব লজ্জা করছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে আমার কিন্তু পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে পারছি না। ছোট বোন সাধনা যা করেছে তার জন্য এমনিতেই সবার সামনে মুখ দেখাতে লজ্জাবোধ করছে আমার পরিবারের। সেই জন্য এখন তারা আমাকে তাদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে বলেছে। পরিবারের কথা ভেবে লাজ শরমের মাথা খেয়ে স্পন্দনের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি। স্পন্দন হলো আমার বোনের হবু স্বামী ওহহ সরি বর্তমানে আমার হবু স্বামী। স্পন্দনের অফিসেই কাজ করি আমি। জানি না কিভাবে যেনো স্পন্দন আর সাধনার পরিচয় হলো সেই পরিচয় থেকে আজ বিয়ে পর্যন্ত চলে এসেছে। আচ্ছা আপনারা এখন ভাবছেন বড় বোনের বিয়ের আগে কেনো ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে তাহলে বলবো ওদের দুজনের খুব তাড়া ছিলো সেই জন্য দুই পরিবার ওদের বিয়েতে রাজি হয়েছে তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করতে চাইছিলাম না। আমার সম্মতিও ছিলো ওদের বিয়েতে কিন্তু আজ হটাৎ করেই সাধনা কোথাও গায়েব হয়ে গিয়েছে। অনেক খুঁজাখুঁজি করার পরেও ওর কোনো খুঁজ না পাওয়াতে ওর হয়ে আমার বসতে হচ্ছে বিয়ের পিড়িতে……..

—” মা বলো আলহামদুলিল্লাহ বলো মা ?”

বুঝতে পারলাম এখন আমার হাতে কোনো উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে বলে ফেললাম ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘ হয়ে গেলাম স্পন্দনের স্ত্রী। স্পন্দন কি আমাকে নিয়ে বাজে চিন্তা করছে? আচ্ছা ওর মনে এখন কি চলছে? ও কি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবে? ছিঃ কি ভাবছি আমি কিছু মুহূর্ত আগেও যাকে আমি ছোট বোনের হবু স্বামী ভেবে এসেছি তাকে কিভাবে স্বামী হিসেবে মানবো? না পারবো না আমি। স্পন্দন কি পারবে বড় শালীকা হিসেবে যাকে সে ভেবে এসেছে তাকে স্ত্রী হিসেবে ভাবতে? এইসব ভাবতেও লজ্জা করছে এখন আমার। কিভাবে যাবো আমি ওর সামনে?

—” মা আমার, শশুর বাড়ির মন জয় করে চলবি। আমাদের সম্মানহানি যেনো হয় এমন কাজ কোনোদিন করবি না তোর বোনের মতো। আমি জানি তুই কোনোদিন চাইবি না আমরা অপমানিত হই। তুই যদি এমন কিছু করিস তাহলে লোকে বলবে আমরা আমাদের মেয়েদের ঠিক মত শিক্ষা দিতে পারিনি।”

আব্বু বার বার চোখের পানি মুছলেন আর আমাকে বলতে লাগলেন। আব্বুর কথা শেষ হলে আম্মু এসে বলা শুরু করলো…..

—” শুন মা তোর বোন যা করেছে তার জন্য শাস্তি ও পাবে তুই স্পন্দনকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়ে সুখে সংসার করবি। স্পন্দন ছেলেটা খুব ভালো রে মা।”

আম্মুর কথা শুনে চমকে উঠলাম। স্পন্দনকে স্বামী হিসেবে মানার কথা বলেছেন ওনি কিন্তু আদৌ কি সম্ভব স্পন্দনকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া?

স্পন্দনের পরিবার বেশি দেরি করলো না। খুব তাড়াতাড়ি তারা শুভ্রতা ও স্পন্দনকে নিয়ে চলে আসলো। শুভ্রতা ও স্পন্দন ফুল সাজানো গাড়িতে বসে আছে। ড্রাইভার ড্রাইভ করছে। স্পন্দন যতটা সম্ভব শুভ্রতার কাছ থেকে দূরে বসেছে। শুভ্রতা বুঝতে পারছে স্পন্দন তার কাছে বসতে আন‌ইজি ফিল হচ্ছে। শুভ্রতা স্পন্দনের সংকুচ দুর করার জন্য বললো…..

—” স্যার, আমি পিছনের গাড়িতে গিয়ে বসছি। আপনি এত বিভ্রান্ত হবেন না।”

স্পন্দন কিছু বললো না। শুভ্রতা স্পন্দনের উত্তর না পেয়ে নিজেই ভেবে নিলো….

‘নিরবতা সম্মতির লক্ষণ’

—” মামা আপনি গাড়ি থামান আমি পিছনের গাড়িতে উঠবো।”

ড্রাইভার স্পন্দনের চোখের দিকে তাকালো। স্পন্দন চোখ বন্ধ করে আছে। শুভ্রতা যখন আবারো বললো ড্রাইভারকে গাড়ি থামানোর জন্য তখন স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো…..

—-” তামাশা কি এখনও বাকি আছে? যা তামাশা করার তোমার বোন আর তুমি করে ফেলেছো এখনো কি আরো তামাশা করতে চাও? তাহলে চলো তোমাকে সার্কাসে দিয়ে আসি। মানুষকে খুব হাসাতে পারবে।”

শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে একদম জানালার কিনারে বসে চুপ করে রইলো। চোখ বেয়ে নোনা জল পড়ছে। স্পন্দন একবারও শুভ্রতার দিকে তাকালো না। সে আনমনে ফোনে গেম খেলছে……

বাসর ঘরে বসানো হয়েছে শুভ্রতাকে। স্পন্দনের আত্মীয় স্বজন অনেকেই অনেক কথা বলেছে শুভ্রতাকে। শুভ্রতার শাশুড়ি মিসেস সাবিনা বেগম শুভ্রতার ভিতর কি চলছে তা বুঝতে পেরে বিয়ে বাড়িতে থাকা মেয়েদেরকে বলে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেছে।

চারপাশে ফুল আর লাইটিং করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। ফুল দিয়ে লেখা হয়েছে ‘স্বাগতম’ তার পাশে লাইটিং করা। জানালার পর্দাও খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। শুভ্রতার চোখ বার বার বাসর ঘরের সাজানো দেখছে।

—” ছিঃ আমি এইসব কি ভাবছি। এই ঘর তো আমার জন্য সাজানো হয় নাই। সাজানো হয়েছে সাধনার জন্য। বড় বোন হয়ে ছোট বোনের বাসর ঘর এইভাবে দেখা মোটেও ঠিক হচ্ছে না আমার। কি করবো আমি? কি করা উচিৎ এখন আমার? বার বার চোখ সরাতে গিয়েও কেনো পারছি না আমি? আচ্ছা আমি এখন লজ্জা পাচ্ছি না! কিন্তু কেনো? স্পন্দন এখন আমার স্বামী তাই বলে কি? কিন্তু ও তো আমার ছোট বোনের হবু স্বামী! ওর সাথে আমার সম্পর্ক তো ভিন্ন এখন। সম্পর্কের মায়াজালে কি হতে গিয়ে কি হলাম এখন আমি!”

শুভ্রতার খুব টায়ার্ড লাগছে। বিয়ের দখল তার উপরে অনেক বেশি গেছে। ছোট বোনের বিয়ে হবে বলে সব কাজ সে একাই সামলিয়ে এসেছে কিন্তু মাঝ পথে এসে সব তোলপাড় হয়ে গেলো। স্পন্দনের ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ছিটা দিলো। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো শুভ্রতা।

—” চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। সারা মুখ যেনো লালে লাল তার। ফর্সা মেয়েরা যদি কান্না করে তাহলে তাদের নাক,মুখ ও চোখ লাল হয়ে যায়। আমি তো এতটাও ফর্সা না তবুও চেহারার এমন করুন অবস্থা দেখে খারাপ লাগার থেকে খুব ভালোই লাগছে। নিজেকে এখন লাল সুন্দরী মনে হচ্ছে। ইসসসসসস ছিঃ কিসব বলছি আমি। সুন্দরী তাও আবার লাল সুন্দরী। শুভ্রতা তোর মাথা এখন ঠিক গেছে।”

নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই কথা বলছে শুভ্রতা। মাঝে মাঝে হাসছেও সে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানার দিকে তাকালো শুভ্রতা। স্পন্দন বসে আছে হাতে একটি পেপার।

—” আমাকে কি অফিস থেকে বের করে দিবেন? পারিবারিক বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার কোনো মানে আছে কি স্যার?”

—” এইটা ডিভোর্স পেপার। আজ থেকে এক বছর পর আপনাকে আমি ডিভোর্স দিবো। আর হ্যাঁ আমি বাচ্চা না যে অফিস আর ফ্যামিলি একত্রে টানবো তাছাড়া আপনি আমার ফ্যামিলির কোনো মেম্বার না। আপনাকে ফ্যামিলির মেম্বার আমি কোনোদিনও মানতে পারবো না। আপনাকে বিয়ে করার কারণ জাস্ট আপনার ছোট বোন সাধনার জন্য। সাধনাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি আমি।”

স্পন্দন কথাগুলো শান্তভাবেই বললো। শুভ্রতা স্পন্দনের এই শান্ত কথার মানে বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। এই মানুষটার সাথে তার পরিচয় দেড় বছর হতে চলেছে। এই মানুষটা যে কতটা কঠোর খুব ভালোভাবেই জানে শুভ্রতা।

—” দিন পেপার এক্ষুনি সই করে দিচ্ছি।”

হাত বাড়িয়ে পেপারটা হাতে নিতে চাইলো শুভ্রতা। স্পন্দন শুভ্রতার হাত ঝাঁকি মেরে সরিয়ে দিলো। রাগান্বিত স্বরে বললো…..

—” আমি আপনাকে বলেছি এক্ষুনি সই করার জন্য? আমি কিন্তু এতটা অ্যাডভান্স পছন্দ করি না।”

—” কি করতে হবে এখন? ”

—” পেপারটা খুব সযত্নে রেখে দিন। এক বছর পর এই পেপারে সই করে আপনি এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন। সেদিন যেনো আপনাকে মনে করিয়ে না দিতে হয়।”

—” তাহলে এক বছর পর এই পেপারটা আনলে হতো না?”

—” না। কেননা, এই পেপার যখনি আপনার সামনে আসবে তখনই আপনার এই চুক্তির কথা মনে হবে। এখন যদি এই পেপার আমি না আনতাম তাহলে তো আপনি আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার ফলাতেন এমনও তো হতে পারে আপনি ডিভোর্সের কথা ভুলে যেতে পারেন। তাই আগে ভাগেই সব ঠিক করে রেখেছি।”

—” হুম ভালো করেছেন।”

—” আর শুনুন, আমরা সবার সামনে একে অন্যকে তুমি করে সম্মেধন করবো। যখন কেউ থাকবে না তখন আপনি করেই বলবো। আমি চাই না এই এক বছরে আমার পরিবার কোনো কারণে কষ্ট পাক। এমনিতে সাধনা যা করেছে তার জন্য আমি আমার পরিবারের সামনে মুখ দেখাতে পারছি না।”

—” আপনার সব শর্তই আমি মেনে চলবো।”

—” আগামীকাল অফিস আছে শুয়ে পড়ুন।”

শুভ্রতা আমতা আমতা করে স্পন্দনকে জিজ্ঞাসা করলো….

—-” ইয়ে মানে কোথায় ঘুমাবো আমি?”

—” আমার বুকে এসে ঘুমান। যত্তসব আদিক্ষেতা।খাট অনেক বড় আছে যদি ঘুমাতে চান ঘুমিয়ে পড়ুন। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি ওকে।”

শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা করলো। অর্থাৎ সে বুঝতে পেরেছে।

স্পন্দন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু শুভ্রতার চোখে ঘুম নেই। সাধনার চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না তার।কোথায় আছে মেয়েটা? কোনো বিপদে পড়েছে না-কি? কেনো সে বিয়ের আগে পালিয়ে গেলো? সে-তো ভালোবাসে স্পন্দনকে! তাহলে?

ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয়ে গেলো। ভোরের দিকে শুভ্রতার চোখ লেগে এসেছিলো। হটাৎ কিছু অস্বস্তি বোধ করায় চোখ খুলে দেখলো……

চলবে…….
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।