সম্পর্কের_মায়াজাল পর্ব-০২

0
5043

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২

ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয়ে গেলো। ভোরের দিকে শুভ্রতার চোখ লেগে এসেছিলো। হটাৎ কিছু অস্বস্তি বোধ করায় চোখ খুলে দেখলো স্পন্দন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। শুভ্রতার মুখে শ্বাস এসে পড়ছে স্পন্দনের। কিছুক্ষণের জন্য শুভ্রতা স্থির হয়ে রইলো। বার বার মনে হচ্ছে সে যেনো স্বপ্ন দেখছে…..

—” এইটা যেনো স্বপ্ন হয় । আমি চোখ খুলে তাকাতেই যেনো দেখি এইসব স্বপ্ন। স্যার এইভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না। স্যার কি সাধনাকে ভেবে আমায় জড়িয়ে ধরেছে? ছিঃ আল্লাহ দড়ি ফালাও আমি উঠে পড়ি। আমি তো ওনার দিকে তাকানোর সাহস পাবো না আর।”

ঘুমের ঘোরে স্পন্দন শুভ্রতাকে একদম বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রতার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শুভ্রতা স্পন্দকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ঘুমের মধ্যে স্পন্দন কিছু বুঝতে পারলো না যখন বুঝলো তখন সে ফ্লোরে পড়ে আছে।

স্পন্দন রাগী দৃষ্টিতে তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা বিছানার চাদর কামছে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আচমকা স্পন্দন শুভ্রতার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওয়াশরুমের ভিতর নিয়ে চলে গেলো।

—” স্যার সরি আমি। আমি বুঝতে পারিনি আপনি যে পরে যাবেন।”

—” চুপ একদম চুপ।”

স্পন্দনের ধমক খেয়ে শুভ্রতা চুপ করে রইলো। শুভ্রতাকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেই ঝর্না ছেড়ে দিলো স্পন্দন। স্পন্দন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ্রতা সরতে নিলেই স্পন্দন বললো….

—-” একদম সরবে না। আমাকে এই শীতে কম্বলের নিচ থেকে ফেলে দিয়ে কি ভাবছিলে তুমি আরামে ঘুমাবে তা তো হবে না ফুলটুশি।”

স্পন্দনের এমন ভাষা শুনে অবাক হওয়ার চরম পর্যায় চলে গেলো শুভ্রতা। শুভ্রতা ভাবতেই পারছে না স্পন্দন তাকে তুমি বলে সন্মেধন করছে আর কিসব নামে ডাকছে। এই শীতে যে সে ভিজছে সেই দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার।

—” স্যার আপনি কি রুলস ভুলে গেছেন?”

শীতে কাপছে শুভ্রতা। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন করলো স্পন্দনকে।

—” দোষ আপনার। আমাকে ওইভাবে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে স্মৃতি শক্তি দুর্বল করে দিয়েছেন। তাছাড়া এক দিক দিয়ে ভালোই হলো কেউ সন্দেহ করবে না। এইভাবে বেশি ভিজতে থাকলে পরে দেখা যাবে আমার মা আপনাকে সেবা করার জন্য বকতে থাকবে আমায়। আমি জামা কাপড় এনে দিচ্ছি ।চেঞ্জ করে চলে আসবেন।”

—” আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেলে দেইনি। আপনি আমাকে……!”

স্পন্দন দাঁড়িয়ে না থেকে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেলো। শুভ্রতার কথা আর শুনলো না। স্পন্দন দরজার ওপাশ থেকে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে ডেকে বললো…..

—” সাধনার জন্য আনা হয়েছিল দেখুন হয় কি-না আপনার? আপনার বোনের কাপড় যদি এখন আপনার না হয় তাহলে এখন আমার আবারো শপিং করতে হবে। দুই বোন মিলে আমার টাকা শেষ করার ধান্দা সব।”

শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে জামা কাপড় হাতে নিলো।

—” আমাদের দুই বোনকে পিছন থেকে সব সময় একই লাগে । ”

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শুভ্রতা দরজা লক করে শাওয়ার নিলো। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। ঠান্ডার জন্য সাথে স্পন্দনের এমন কাণ্ড দেখে শুভ্রতা ইনস্ট্যান্ট শাওয়ার ওয়াটার হিটারের কথা ভুলেই গেছে। সুন্দর ভাবে শাড়ি পরে বের হলো শুভ্রতা।

চুলের পানিতে শাড়িসহ অর্ধেক শরীল ভিজে গেছে শুভ্রতার। শীতে টকটক করে কাপছে ও। স্পন্দন একবার শুভ্রতার দিকে তাকালো।

—” আশি বছরের বুড়ির মত কাপছেন কেনো?”

—” শীতে কাপছি। কি ঠান্ডা পানি মনে হচ্ছে দশ দিন আগের পানি রেখে দিছেন।”

—” গরম পানির সুইচ দেন নি?”

স্পন্দনের কথায় মনে পড়লো তখন শুভ্রতার। জিব কেটে মাথা এদিক ওদিক হেলিয়ে না বললো।

—” আজব মানুষ আপনি। কোথায় কি আছেন দেখবেন না। থাক যা হয়েছে তো হয়েছে এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন।”

স্পন্দন কথা বলে পিছনে তাকিয়ে দেখলো শুভ্রতা অলরেডি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

—” শুনুন একটু পর রেডি হয়ে অফিস চলে যাবেন। আমার আজ যেতে দেরি হবে।”

—” দুইজন একসাথে গেলে ভালো হবে না?”

—” পাগল না-কি? অফিসের বস আর তার কর্মচারী একসাথে অফিস যাবে? মানুষ কি বলবে আমায়? যা বলেছেন তা এখানেই স্টপ ওকে!”

—” হুম।”

স্পন্দন তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। শুভ্রতা তখন স্পন্দনকে নকল করে বললো…..

—” অফিসের বস আর কর্মচারী একসাথে অফিসে ঢুকলে মনে হয় ওনার মহা ভারত নস্ট হয়ে যাবে। কেনো যখন কর্মচারীর বোনকে বিয়ে করতে চাইছিলো তখন কই ছিলো এত সম্মান আজব লোক একটা।”

শুভ্রতা স্পন্দনের সাথে পরিচয় হওয়া পর্যন্ত স্পন্দনের কথা-বার্তা,কাজ-কর্ম সব কিছু নিয়ে স্পন্দনের আড়ালে কথা শুনাতো।ভয়ে সামনে কিছু বলতে পারতো না।

।।

।।

।।

বাড়ি ভর্তি মেহমান। সবাই নতুন বউ দেখতে এসেছে। শুভ্রতাকে পার্লার থেকে লোক এনে সাজানো হয়েছে। শুভ্রতা পুতুলের মতো চুপ করে বসে রইলো। যে যা জিজ্ঞাসা করছে উত্তর দিতে লাগলো।

—” তোমার বোন কার সাথে পালিয়ে গেছে খবর কি জেনেছো?”

এইরকম নানান বিরক্তিকর কথা শুনে শুভ্রতার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। নতুন বউ বেশি কথা বললে মানুষজন খারাপ বৈ কি ভালো বলবে না।

—” আচ্ছা তোমাদের পরিবারের কোনো প্ল্যান না তো এইটা যে এক মেয়ের কথা বলে অন্য মেয়েকে পার করা। তোমার থেকে তোমার বোন নাকি অনেক সুন্দরী সেই জন্যই হয়তো এমন কাজ করেছেন ওনারা?”

মিসেস সাবিনা বেগম বসলেন সবার সাথে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললেন,

—” জানেন আমি কোনোদিন সুন্দরী মেয়ে, বৌমা হিসেবে চাইনি। আমি চেয়েছি ভালো,নম্র,ভদ্র, লক্ষী একটা মেয়ে । মহান আল্লাহ তায়ালা আমার সেই ইচ্ছাটা রেখেছেন। আচ্ছা ভাবী আপনার বৌমা নাকি আপনার ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকে? এত সুন্দরী বৌমা পেয়েছেন কিন্তু দেখুন কপাল খারাপ থাকায় একসাথে থাকতে পাচ্ছেন না।”

মিসেস সাবিনা বেগম হেঁসে হেঁসে কথা বললেন ওনার কথায় অপমানজনক বিষয় বুঝতে পেরে ওই মহিলাটি চুপ করে থাকেন। শুভ্রতা ওর শাশুরির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে চোখ ভর্তি পানি ফেলে।

—-” এই তুই কান্না করছিস কেনো? দেখ এই কান্নার জন্য মেকআপ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পরে ভুতের মত লাগবে।”

শাশুড়ি মায়ের কথায় হাসলো শুভ্রতা। শুভ্রতাকে মিসেস সাবিনা বেগম অফিসে যেতে দেয়নি। সেই জন্যই মায়ের সাথে ঝগড়া করে না খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় স্পন্দন। স্পন্দনের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক মোটেও ভালো না। খুব কম কথা বলে সে। মায়ের সাথে সম্পর্কটা ভালো তার। সবচেয়ে ভালো ও আদরের সম্পর্ক হলো সন্ধ্যার সাথে স্পন্দনের । সন্ধ্যা স্পন্দনের একমাত্র বোন। কিন্তু সন্ধ্যা শুভ্রতার সাথে স্পন্দনের বিয়ে মানতে রাজি হইনি। তাই বাবা মায়ের সাথে রাগ করে মামার বাসায় চলে গিয়েছে।

দুপুরের খাবার খেয়ে শুভ্রতা স্পন্দনের বাড়িটা দেখতে লাগলো। স্পন্দনের বাড়িটা সাদা আর সোনালী কালারের একদম আনকমন। ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখছে সে। দুই ঘণ্টা ধরে হাঁটছে কিন্তু তবুও শেষ করতে পারছে না।

—-” আজ এই বাড়িটা আমার বোনের বাড়ি থাকতো। আমি হয়তো মাঝে মাঝে এসে কয়েকদিন থেকে বা কিছুক্ষন থেকে চলে যেতাম। কিন্তু আজ এই বাড়িটা কি-না আমার শশুর বাড়ি। সম্পর্কের মায়াজালে কে কখন কিভাবে আটকে যায় বুঝা মুশকিল। যা কোনোদিন ভাবা তো দূরে থাক কল্পনা পর্যন্ত করতে সাহস পাইনি তা যে কিভাবে আমার ভাগ্য হবে কেউ কি বলতে পারতো?”

—-” বাড়ি দেখা শেষ হলো তোমার?”

পুরুষ কণ্ঠ শুনে শুভ্রতা আশে পাশে তাকিয়ে পিছনে ঘুরলো । শশুর মশাইকে দেখে তাড়াহুড়া করে মাথায় আঁচল টেনে দিয়ে সালাম দিলো…..

—-” আসসালামু আলাইকুম আংকেল।”

—” ওলাইকুম আসসালাম। তুমি এইখানে?”

কঠোর সুরে বললো। শুভ্রতা মাথা নিচু করে বললো….

—-” একা থাকতে ভালো লাগছিলো না তার জন্য বাড়িটা ঘুরেঘুরে দেখছিলাম।”

—” দেখবেই তো এইরকম বাড়ি তো সাত জন্মে দেখনি। কপাল ভালো থাকায় আমার ছেলের বউ হয়ে এসেছো। ”

—” সরি বাবা।”

—” আংকেল এই ঠিক আছে। আমি আবার যার তার মুখে বাবা ডাকতে পছন্দ করি না।”

—” সরি আংকেল।”

—” যাও গিয়ে কাজ কর্ম করো। এইভাবে বসে থাকলে শরীল অচল হয়ে পড়বে।”

শুভ্রতা লজ্জা ও কষ্ট পেয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলো। শুভ্রতা কিছু দূর যেতেই মিস্টার আজম গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ফোন কানে নিয়ে বললেন…..

—” খুশি হয়েছিস মা?”

ফোনের ওপাশ থেকে খুশি হয়ে সন্ধ্যা তার বাবাকে বললো…..

—” হুম ডেড খুব খুব খুশি হয়েছি। শুনো তুমি তোমার প্রমিজ রেখেছো আমারও তো রাখতে হবে তাই না? কিছুদিন মামার বাড়ির রসের হাঁড়ি খেয়ে আসি পরে বাসায় যাবো উম্মাহ ডেড। আর শুনো ওই মেয়েকে যত পারো কষ্ট দিও ওকে।”

—” হুম।”

ফোন রেখে মিস্টার আজম চোখ মুছে চশমা চোখে দিলো…..

—” কতটা স্বার্থপর আমি। নিজের মেয়ের খুশি দেখার জন্য নিজের পুত্র বধূকে কষ্ট দিলাম। মেয়েটা খুব কাঁদছিলো আমার কথা শুনে কিন্তু কি করবো সন্ধ্যার খুশির জন্য ওকে কষ্ট দিতে হচ্ছে।”

।।

।।

।।

—” ওনি আমায় এইভাবে বলতে পারলেন? ওনি নিজ থেকেই তো আমাকে ওনার পুত্রবধূ বানানোর কথা বলেছেন তাহলে এইভাবে কেনো কথা বললেন?এমন কঠোর গলায় আমার সাথে কথা বললেন কেনো ওনি?কিছু কি ভুল করেছি আমি?”

শুভ্রতা কাঁদছে মিস্টার আজমের কথাগুলো বড্ড কষ্ট দিয়েছে তাকে।

ফোন আসলো শুভ্রতার….

—” আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

স্পন্দন ফোন দিয়েছে…..

—” ওলাইকুম আসসালাম। শুনুন, আপনাকে তো আমি বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিবো না তাই বাসায় আমি অনেকগুলো ফাইল রেখে এসেছি । টাকার গরমিল আছে আরো নানান সমস্যা ওইগুলো দেখেন। আমি বাসায় আসতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি তার আগেই সব ঠিক করে রাখবেন। ”

—-” স্যার ফাইল কতগুলো? তিন ঘণ্টায় কি সম্ভব হবে?”

—” এক কথা বার বার বলতে ইচ্ছা করে না আমার। শুনুন, ওয়াল কেবিনেটে রাখা আছে ফাইল তাড়াতাড়ি দেখা শুরু করুন।”

স্পন্দন ফোন কেটে দিলো। শুভ্রতা কয়েকটা গালি দিলো মনে মনে।

—” কমার্সের পোলাপান গুলা কিপ্টা,হিসাবী হয় আগে শুধু শুনে এসেছি এখন নিজ চোখে দেখছি। আমি কমার্স নিয়ে পড়লেও এত হিসাবী ছিলাম না কিন্তু স্যারের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব হিসাব আর হিসাব। একদিক দিয়ে ভালোই হলো, সময়টা এখন ভালো চলে যাবে।”

যেই বাবা সেই কাজ। ওয়াল কেবিনেট খুলে শুভ্রতা যেই ফাইলগুলো গুলো হাতে নিলো তখন তখনি ওর হাতে কিছু একটা টাচ্ করায় ওর শরীল খুব বড় সরো ঝাঁকি খেলো। ফাইল গুলো রেখে ওই জিনিসটা বের করার পর মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো….

—-” ওয়াক ছিঃএএএএএ।”

চলবে……

বানান ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।