সম্মোহনী সেই মেয়েটি পর্ব-৪+৫

0
612

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

পরিবেশ মোহিত জ্যোৎস্নাতের আবেশে।প্রগাঢ় জ্যোৎস্না আলো ছড়িয়েছে পড়ন্ত সাঁঝের কয়েক প্রহর পূর্বে।এখন রাত ন’টা।কিছুতেই রান্না করতে মন চাইছে না অনিলার।আইলসার মতো শুয়ে আছে।রান্নায় তার মন নেই।সে জন্য ফুড পান্ডা থেকে খাবার অর্ডার করে দিলো।মন মস্তিষ্ক জুড়ে যদি একটা ঘটনাই ঘুরে তাহলে কি আর কিছু ভালো লাগে।অনিলা চাইছে কালকের বিষয় টা ভুলে যেতে কিন্তু বার বার একটাই বিষয় মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে।কিন্তু সে তো নিজের জায়গায় ঠিকই ছিলো।জুনইদ যদি ওতো হেয়ালি না করে বলে দিতো আগেই তাহলে তো আর তাকে সে চড় মারতো না।সে আর ভাবতে পারছে না।কিযে আছে কপালে।সে যায় হোক অনিলা ঠিক করলো সে আর একবার ই চেষ্টা করবে জুনইদ কে স্যরি বলার।এরপর আর চেষ্টাও করবে না।

তাই সে ফোন টা হাতে নিয়ে কল লাগালো।সে ঠিক করলো রিসিভ হতেই স্যরি বলবে সে।অনিলা ভাবলো বাব্বাহ আনব্লক ও করেছে। তার নাম্বার টা কাল ব্লক করা ছিলো তাহলে কি জুনইদ ও চাইছিলেন আমি উনাকে ফোন করি।একবার রিং হতেই ফোন টা রিসিভ হলো।

অনিলা হ্যালো বলার আগেই জুনইদ বলে,

কেন ফোন করেছেন মিস সুনামি।

অনিলা চোখ ঝাপটালো।রাশভারি গলায় বললো, হোয়াট মিস সুনামি কে?

কেন আপনি।আপনিই তো মিস সুনামি।ঝড়ের গতিতে মানুষকে চড় থাপ্পড় বসিয়ে দেন।এবার বলুন আমাকে ফোন করার কারণ টা কি।

আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারছেন না আমি কেন ফোন করেছি।

এক মিনিট,এক মিনিট মিস সুনামি, আপনি সত্যি সত্যিই আমার প্রেমে পরে যান নি তো।বার বার কল করছেন যে আমাকে।

অনিলা মনে মনে ভাবছে,এই লোকটা ইচ্ছে করে এমন করছে।যাতে আমি রেগে যায়। কিন্তু আমার তো এখন রাগা চলবে না।যে করেই হোক স্যরি টা আমাকে বলতেই হবে।

আমি কেন আপনার প্রেমে পরতে যাবো।দেখুন আমি আপনাকে স্যরি বলার জন্য ফোন দিয়েছি।

থাক আপনাকে আর বাহানা বানাতে হবে না।এই নিয়ে আপনি একশো দশ নম্বর মহিলা সবার একই ছুতো প্রেম করার।বাট আপনাকে নিয়ে ভাব্বার মতো টাইম আমার নেই।তাই প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করা বন্ধ করুন।

দেখুন স্যরি বলার জন্য ফোন করেছি আপনাকে ইম্প্রেস করার জন্য নয়।আমারও না টাইম নেই আপনাকে নিয়ে ভাব্বার।কাল কের জন্য স্যরি।আর হ্যাঁ আমি তো একটা থাপ্পড় দিয়েছি অন্য কেউ হলে আপনার বোকামীর জন্য লোক জড় করে দিতো দু চার ঘা।এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলেই ঘ্যাচাং করে ফোন টা কেটে দিলো অনিলা।এবার ক্ষমা করলেই বা কি না করলেই বা কি।সে তো নিজের মতো স্যরি ব’লেই দিয়েছে।মস্ত বড় বোঝা যেনো ঘাড় থেকে নেমে গেলো।ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো অনিলা।সেই সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।মনে হয় তার খাবার চলে এসেছে।


এদিকে জুনইদ ভাবছে কি চীজ রে বাবা এই মেয়ে স্যরি বললো সেটাও যেনো ঝড়ের বেগে।স্ট্রেঞ্জ গার্ল।নিজের মতো স্যরি বলেই ফোন টা কেটে দিলো।সে একদম পার্ফেক্ট নাম দিয়েছে মিস সুনামি।আসলে নাম্বার টা আনব্লক করাই উচিত হয়নি তার।কিন্তু কেন যে আনব্লক করলো সে নিজেই জানে না।

তুমি কি ভেবেছো মিস সুনামি।তুমি ফোন করে আমাকে স্যরি বলবে আর আমি সব কিছু ভুলে যাবো।নো নেভার।ইউ স্ল্যাপড মি।এন্ড ইউ হ্যাভ টু প্যে ফোর দিস মিস সুনামি।দ্যান হাউ ক্যান আই লিভ ইউ।

জুনইদ রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে ঘরে চলে এলো।বিছানায় শুয়ে শুয়ে জুনইদ ভাবছ, “এতো কিছুর মধ্যেও যেনো অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে তার।দিন টা কেমন যেনো স্বপ্নের মতো কেটেছে।কিন্তু শুধু ওই মেয়েটির কথায় কেন মনে পরছে তার।হলো টা কি।

নারীদের উপর পুরুষের একটা প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয় কোনো কারণ ছাড়াই।পৃথিবীর পঞ্চাশ পার্সেন্ট পুরুষের বিপর্যয়ের কারণ নাকি নারী।কিন্তু তারপর ও কি আমরা পুরুষরা এই নারী ছাড়া থাকতে পারি।আর মিস সুনামি এমনই একটি সম্মোহনী মেয়ে যাকে না চাইতেও আমার মনে পরে যাচ্ছে।কালকের জুনইদ আর আজকের জুনইদের মধ্যে সত্যিই কি কোনো পরিবর্তন এসেছে।নাকি কাল কের দিন টা আজকের মতো ছিলো না।এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই জুনইদের চোখে ঘুম লেগে এলো।

সে নিজেকেই নিজে বলে, আব ওর নেহি জুনইদ।চল স্যো যাহ।গুড নাইট।


অনিলার খাবার চলে এলে সে খাবার খেয়ে শুয়ে আছে।সে চোখ বন্ধ করতেই জুনইদের রাগী চেহারাটা ভেসে উঠে।

আচ্ছা জুনইদ ছেলেটা কেমন। ভালো নাকি খারাপ।কাল তো ওর কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না। আমার পিঠের চেইন টা খোলা থাকার পরেও কোনো খারাপ মন্তব্য ও করে নি।আবার নিজের জ্যাকেট টাও খুলে দিয়েছিলো।সেদিক থেকে ভালোই বলা চলে।ধুর আমি এসব কেন ভাবছি।এবার আমার ঘুমানো উচিত।নইলে কাল ভার্সিটির জন্য বেরোতে লেট হয়ে যাবে।এসব ভাবতে ভাবতেই সেও ঘুমিয়ে গেলো।


পর দিন সকালে উঠতে দেরি হয়েছে অনিলার।সে প্রায় দৌড়ে ভার্সিটির গেটের কাছে যেতেই ধরাম করে কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেলো।

অনিলা মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে বলে,

উফফ বাবারে এই গেটের সামনে আবার ল্যাম্পপোস্ট টা কে তুলেছে রে।মনে হচ্ছে মাথার উপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেলো।

তাই তো বলি মিস সুনামি ছাড়া তো এভাবে সুনামির মতো ঝড়ের বেগে কেউ দৌড়াবে না।

পরিচিত কন্ঠ শুনে অনিলা চোখ তুলে তাকালো মানুষ টার দিকে।সে চোখ ছোট ছোট করে বলে,

জুনইদ আপনি,এই আপনি মিস সুনামি টা কাকে বলছেন শুনি।

কেন এইতো তুমিই মিস সুনামি।সুনামির মতো আমার উপর পড়ে আমার ভেতর টা বড্ডই বেসামাল করে দিয়েছো।তাই তো তুমি আমার কাছে মিস সুনামি।

এই আপনার সমস্যা টা কি।আপনি আবার আমাকে মিস সুনামি বলছেন।আশ্চর্য তো।এমন ভাবে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে তো ধাক্কা খাবেন ই।বাই দ্যা ওয়ে আপনি আজও ও আমার ভার্সিটিতে।কারণ টা কি বলুন তো।

জুনইদ প্রগাঢ় অভিলাষ গলায় বললো,

এটা শুধু তোমার একার ভার্সিটি নয় ওকে। তাছাড়া আমি নিশা কে ছাড়তে এসেছি।তোমার মুখ দর্শন করতে নয়।

অনিলা মুখ ভেংচি কেটে বলে, হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।আমি যতটা জানি আপনি নিশাকে এর আগে কখনোই ওঁকে ভার্সিটিতে ছাড়তে চান নি।নিশা বার বার বায়না করতো কিন্তু আপনি পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে ওঁকে রেখে যেতেন না।তা হঠাৎ এতো পরিবর্তন এর কারণ?

জুনইদ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো, এখন আমি ডিসিশন চেঞ্জ করেছি।এখন আমি রোজ ই নিশা কে ভার্সিটি ছেড়ে আমার ভার্সিটিতে যাবো।তোমার কোনো সমস্যা নাকি।

আমার কি সমস্যা থাকবে।সরুন তো আমার লেট হয়ে গেছে।আজাইরা কাউ কাউ করার সময় আমার নাই।কথা শেষ করেই অনিলা এগোতে নিলে জুনইদ পিছু ডেকে উঠলো।

এই যে মিস সুনামি শুনুন।

অনিলা চোখ সরু করে কপট রাগ দেখিয়ে তেড়ে গেলো,

আপনি আবার আমাকে মিস সুনামি বলছেন।আপনাকে তো আমি,

কি করবে শুনি?একটু বেশিই কাছে চলে এলে মনে হয়।এতোটা কাছে আসছো কেন সবাই তো তাকিয়ে আছে দেখো।

অনিলা দমে যাওয়া গলায় বললো,দেখুন আমার একটা সুন্দর নাম আছে সেটাই ডাকবেন।দয়া করে এমন উদ্ভট মার্কা নামে আর ডাকবেন না।

আমি নাম ধরে ডাকতে পারবো না।তাহলে কি ডাকা যায় বলো তো।মিস তেলাপোকা ডাকি।
এটাও দারুন নাম কি বলো।এর থেকে সুন্দর নাম তোমার মুখ টা দেখলে আসে না।ঠিক তেলাপোকার মতো দেখতে।হাসতে হাসতে জুনইদ পারলে সেখানেই গড়াগড়ি খাবে।অনিলা কে জব্দ করতে বেশ মজা লাগছে তার।জুনইদ এবার একটু ঝুকে ব’লে,

তোমাকে না মুখ ভেংচি কাটলেও সম্মোহনী লাগে দেখতে।

অনিলা রাগে কটমট করে তাকালো হাত মুঠো করে হাত দুটো জুনইদের গলার দিকে এগিয়ে নিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলো।ইষৎ রক্তিমা লাল আভা ছড়ালে ওর চিবুক বেয়ে।

ইউ অ্যার জাষ্ট ইম্পসিবল!বলেই অনিলা সেখান থেকে চলে গেলো।

আর জুনইদ শব্দ করে হেসে দিলো।তাকিয়ে রইলো অনিলার যাওয়ার পানে।কাউকে ভেংচি কাটলেও যে এতোটা স্নিগ্ধ আর সম্মোহনী লাগে এটা তো জানা ছিলো না।মিস সুনামির আরও একটা ভালো নাম দেওয়াই যায়।যার প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্দর তাকে সম্মোহনী মেয়ে বলে আখ্যায়িত করাই যায়। না না এটা মিলছে না।শুধু সম্মোহনী নয়।সম্মোহনী সেই মেয়েটি।যাকে দেখলে ফুলেরাও লজ্জা পাবে।এই ভালো নাম টা সে শুধু স্পেশাল সময়েই ডাকবে না হয়।যদি কোনো দিন এমন দিন আসে তখন জানাবে না হয় এই সুন্দর নাম টা।আনমনে হেসে জুনইদ সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

এদিকে নিশা অপেক্ষা করছে অনিলার জন্য।সে বিরবির করে বলে,

এই মেয়েটা নিশ্চয়ই আজকেও লেট করে ঘুম থেকে উঠেছে।এটাই মেয়েটার বদ অভ্যাস।হইতো ঘুম থেকে উঠতেই পারে নি।নিশ্চিত কুম্ভকুর্ণের দূরসম্পর্কের বোন হয়।

অনিলা নিশাকে দেখেই বুঝতে পারছে আজকে নিশা ফায়ার হয়ে আছে।এদিকে যে ওরই ল্যাম্পপোস্ট ভাইয়ের জন্য দেরি হলো ঢুকতে সেটা তো দেখবে না।দোষ তো সব তার হবে।

অনিলা কে দেখে নিশা তো যেনো গিলে ফেলবে পারলে।ক্রধান্বিত গলায় বললো,

এত্তো দেরি করে কেউ আসে।নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠতে আজকেও লেট করছিস তাই না।

আরে আর বলিস না।কাল ঘুমিয়েছিই দেরিতে।তাই লেট হয়েছে।

তাহলে না আসলেই তো পারতিস।নিশা মুখ গোমড়া করে অন্য দিকে ফিরলো।

আরে নিশা রাগ করছিস কেন।আমি তো আরও আগেই এসেছিলাম।পথিমধ্যে তোর ল্যাম্পপোস্ট ভাই ই তো, এটুকু ব’লেই থামলো অনিলা।

নিশা অনিলার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো, ভাইয়া কে কোথায় পেলেই।নিশা আরও কিছু বলতে যাবে তখনই স্যার ক্লাসে আসলো।দুজনেই ক্লাসে মনোযোগ দিলো।

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

তখন দ্বিপ্রহর।রোদের উত্তাপ মোলায়েম। সোনালী,কমলাটে রোদ্দুরের ছটা গড়িয়ে পড়েছে ছোট রাস্তার উপর।সায়াহ্নের শেষপ্রান্তে এক চড়ুই পাখির দল কিচিরমিচির করে উড়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে।অনিলা বাজারে গিয়েছিল স্ট্রুয়ার্ট এর জন্য কিছু ফলমুল কিনতে।কোনো অটো বা রিকশা না পাওয়াই তাকে হেটে হেটেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।বেশ ক্লান্ত সে আজ।ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করেই বাজারে গিয়েছিল সে।আর ঘরেও কিচ্ছু নেই।চাল নেই ডাল নেই।আসলে সে তেমন রান্না ও জানে না।আলুভাজি,ডিম,ম্যাগি আর ভাত ফুটাতে পারে।এই টুকুই।আর মাঝে মাঝে মালাই চা বানিয়ে ফেলে শুধু চা টাকে একটু স্পেশাল করার জন্য। চা,কফি এসব ই করতে পারে আপাতত।তাই তেমন বাজার করার প্রয়োজন পরে না।কিন্তু আজকে মাংস কিনেছে।রোজ রোজ এক খাবার খেতে খেতে পিত্তি পরেছে মুখে।ইউটিউব ঘেটে নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করবে সে।অনলাইন ফুড এর প্রতিও অনীহা সৃষ্টি হয়েছে আজকাল।

ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক তাকালো অনিলা।আজকে যেনো রিকশা আর অটোরিকশা অন্যেষন নিয়েছে আসবে না বলে।ক্লান্তিতে কপালে আর ঠোঁটের উপর নিচে ঘামের বিন্দু জ্বলজ্বল করছে ওর।
বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েই পরলো এবার।শরীর টাও কেমন যেনো ম্যাজ ম্যাজ করছে।এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়।

হঠাৎ করেই একটা বাইক দমকা হাওয়ার সাথে অনেকটা গতিতে এসে থামলো অনিলার সামনে।কিছুটা ভড়কে গিয়ে দূরে ছিটকে গেলো সে।হাত থেকে বাজারের ব্যাগটাও পরে যায়।আকষ্মিক কান্ডে হকচকিয়ে যায় অনিলা।ক্ষোভে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আবার সেই বাইক ওয়ালা সামনে এসে হ্যালমেট খুলতেই অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো অনিলা।এই ব্যাক্তিটি বিগত কয়েকদিনে তাকে আসতে যেতে বেফাঁস বিরক্ত করেছে সমানে।একাধারে, নানা রকম ভাবে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলেছে।সেদিন ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুনইদ ইচ্ছে করেই ওঁর মুখে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিলো।অপমানে লজ্জায় সে দুদিন ভার্সিটিতে যায় নি।সব মেনে নিয়েছিলো সে।এরপর আর জুনইদ ওর সামনে আসেনি।এসবের জন্য নিশা অবশ্য অনেক বার ওর ভাইয়ের হয়ে ক্ষমা চেয়েছে বার বার।সে ভুলেও গেছিলো ব্যাপার টা।কিন্তু আজ যেনো এই ব্যাপার টা অতিরিক্ত মাত্রায় সহ্যসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে এই লোকটা।তাই সে ফুসে উঠলো,

মিস্টার ল্যাম্পপোস্ট আপনি?কোনো আক্কেল নাই আপনার তাই না।এভাবে কেউ বাইক চালাই নাকি।অসভ্য মাতালের মতো বাইক চালাচ্ছেন।লজ্জা করে না হ্যাঁহ।

বার কয়েক পলক ফেললো জুনইদ।সম্পূর্ণ কথার অর্থ বুঝতে পেরে অভিব্যক্তি মলিন হয়।নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকায় সে অনিলার দিকে।ভাব এমন যেনো কিছুই জানে না।সে কিছু বলবে তার আগেই অনিলা আবার ফুসে উঠলো,

এই কদিন এতো জ্বালিয়েও শান্তি হয়নি আপনার।আজকে একেবারেই বাইক চাপা দিয়ে মেরেই ফেলতে চাইছিলেন।একটা থাপ্পড় এর জন্য খুন করাটাই ঠিক মনে হলো আপনার তাই না।কি চান টা কি হ্যাঁ।

জুনইদ যেনো বিস্মিত হতবাক হয়ে গেলো। এসব কি বলছে অনিলা।সে তো কেবল অনিলাকে হেল্প কর‍তে চাইছিলো।হঠাৎ করেই বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছিলো তাই এভাবে ব্রেক কষতে হলো।দূর থেকে দেখেই সে বুঝতে পেরেছিলো এটা অনিলা।সন্ধ্যা হয়ে গেছে ভেবেই সাহায্য করতেই আসছিলো হঠাৎ করেই কি যে হলো বাইক টার।জুনইদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

আমি কোনো মার্ডারার নয় যে তোমাকে খুন করবো।না জেনে কাউকে একিউজ করা টা ঠিক নয়।আমি তো তোমাকে,,,

অনিলা জুনইদ কে থামিয়ে দিলো হাত উচিয়ে।তারপর ক্রধান্বিত কন্ঠে বললো,

আপনাকে আমার খুব ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে।সেদিন কিভাবে আমার মুখে সবার সামনে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিলেন সেটা আমি ভুলে যায় নি।ভার্সিটির সবাই হেসেছিলো আমাকে নিয়ে কত্তো।ঠিক কত্তো টা কষ্ট হয়েছিল জানেন আপনি।আমার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল জানা আছে আপনার। তাছাড়া এরপর তো সব কিছু মিটেই গেছিলো নাকি।সোধ বোধ হয়েই গেছিলো সব।আর তো কোনো ক্রোধ থাকার কথা না আপনার আমার উপর।

হ্যাঁ এতদিন পারিপার্শ্বিক ভাবে এটা সেটা করে জুনইদ অনিলাকে অতিরিক্ত মাত্রায় জ্বালিয়েছে।কিন্তু তারপর কাদা মাখিয়ে দেওয়ার পর সেই বিষয় টাই অনেক অনুতপ্ত হয়েছিল সে।অনেক বার অনিলার সামনে যেতে চেয়েছিলো ক্ষমা চাইতে।কিন্তু কোথাও গিয়ে সে আটকে যেতো।সামনেও যায় নি অনিলার।মেয়েটার তার প্রতি এমন নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে বলে,

আমি তোমাকেই হেল্প করতে আসছিলাম।এই রাস্তাটা আপাতত একদম ফাঁকা।কোনো রিকশা বা অটোরিকশা নেই। তুমি একা একটা মেয়ে এভাবে হেঁটে আসছিলে তাই ভাবলাম তোমাকে সাহায্য করি।কিন্তু তুমি তো,

অনেক সাহায্য করেছেন আপনি আমার।আপনি আমার সম্মুখে না এলে খুশি হতাম।এরপর আমি আর আপনার এই মুখ টা দেখতেও চাই না।

জুনইদ মলিন মুখ তাকালো অনিলার দিকে।দুজনের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো জুনইদ।

মিস সুনামি আমার কথাটা শুনো একবার।তুমি ভুল বুঝছো আমাকে।আমি ইচ্ছে করে–

জুনইদের কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিলা রাস্তায় পরে থাকা বাজারের ব্যাগ টা হাতে তুলে নিলো।নিচু হতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আপনা আপনি।কিছু একটা বিদঘুটে গন্ধ এলো।পেট্রোলের গন্ধ মনে হচ্ছে এটা।এদিক সেদিক তাকালো অনিলা।দেখলো জুনইদের বাইক থেকে পেট্রোল গড়িয়ে পরছে।আর নিচেই দগদগ করে জ্বলছে কিছু একটা।আবার শব্দ ও আসছে টিকটিক টাইপের।সেটা তে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না সে।একবার বাইক আরেকবার জুনইদের দিকে তাকিয়ে গটগট করে হাঁটা ধরলো।

জুনইদ ওর যাওয়ার পানে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো।বেশকিছু দূর যেতেই জোরে ব্রাস্ট হওয়ার একটা শব্দ কানে এলো।আকষ্মিক এমন শব্দে পিছনে ফিরলো অনিলা।দেখলো পিছনের দিকে জুনইদের বাইকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

জুনইদ ও বাইক রেখে অনিলার পিছনে পিছনে আসছিলো।যাতে ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারে।আর এরকম শব্দ পেয়ে সেও তাকালো পেছনে।এমন ঘটনাই সেও কেঁপে উঠলো।এক ঝটকায় ছিটকে দূরে চলে এলো সে।ভাগ্যিস দূরে ছিলো না হলে আজ কি হতো।এই আগুনেই শেষ হয়ে যেতো সে।কি ভয়াবহ অবস্থা এই মুহুর্তে হতো তার।হইতো লাশ টাও খুজে পেতো না তার পরিবার।

এদিকে অনিলা আগুন জ্বলছে দেখে ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে শুরু করলো।ঠোঁট, হাত পা কাঁপছে তার তিকতিক করে।শরীর অসাড়তায় মুড়িয়ে যাচ্ছে।ভয়াবহ ধোয়া উঠা আগুন দেখেই কাঁপতে কাঁপতে লুটিয়ে পরলো সেখানেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কিছু লোক জড়ো হলো সেখানে।পরিবেশ থমথমে কোলাহলযুক্ত সৃষ্টি হলো।কিছু লোকজন এগিয়ে এলো জুনইদের দিকে।এই সময় এই রাস্তায় লোকজন কম ই থাকে।কিন্তু শব্দ পেয়ে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে পরেছে সেখানে।

জুনইদ বেশ কিছুক্ষন পর নিজেকে ধাতস্থ হলো লোকজনেদ সরগোল পেয়ে।হঠাৎ বাইক ব্রাস্ট হওয়ার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না।তার ও শরীর কাঁপছে।বক্ষস্পন্দন দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে।এরকম কিছু হবে আন্দাজের ও বাইরে ছিলো সে।

আরে আরে কি হলো হঠাৎ।এই বাইক টাই আগুন লাগলো কিভাবে।তুমি ঠিক আছো তো বাবা।

একজন মাঝ বয়সি লোক জিজ্ঞেস করলো। জুনইদের দিকে তাকিয়ে।

জুনইদ উপর দিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষ জন দেরকে।তারপর শরীর ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

হ্যাঁ আংকেল ঠিক আছি।আপনারা যান আমি সামলে নিচ্ছি বাকিটা।কারোর কোনো ক্ষতি হয়নি দেখেই চলে গেলো তারাও।

হঠাৎ অনিলার কথা মাথায় আসতেই হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো জুনইদ।একটু দুরেই অনিলা জ্ঞানহীন অবস্থায় দুর্বল চিত্তে পরে আছে।জুনইদ দৌড়ে এলো অনিলার কাছে।এসেই হাটু মুড়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ওর গালে থাবড় দিলে।অশান্ত,অস্থির হয়ে উঠলো তার মন।অনিলার হাতে ব্যাগের ভেতর দেখতে পেলো একটা ওয়াটার বোটল।জুনইদ তারাতাড়ি করে সেটা নিয়ে অনিলার মুখ পানে পানি ছিটিয়ে দিলো।জ্ঞান ফিরছে না দেখে অস্থির হয়ে হাত ঘষতে লাগলো অনিলার।পায়ের কাছে গিয়ে পা ঘষতে লাগলো।আবার হাত ঘষতে ঘষতে সে আড়ষ্টভাবে মোলায়েম গলায় বলে,

ওয়্যাক-আপ ইয়্যার।উঠো মিস সুনামি।মুখে আলতো করে আবারও থাবড় দিলো সে।

জুনইদ আবার অনিলার মুখে পানি ছেটালো।কিছুক্ষণ পর অনিলা চোখ মেললো।অনিলাকে চোখ খুলতে দেখে জুনইদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করলো,

আর ইউ ওকে মিস সুনামি।

অনিলা মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসলো।ঝিম ঝিম করছে মাথা টা।এরকম অগ্নুৎপাতের কথা মনে পরতেই ভয়ে অকপটে ঝাপটে ধরলো জুনইদ কে।বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে ফেললো নিজেকে জুনইদের বুকে।

জুনইদ কিছু টা বিব্রতবোধ করলো অনিলা এভাবে জড়িয়ে ধরায়।কিন্তু ওঁকে জড়িয়ে ধরেই অনিলা থরথর করে কাঁপছে দেখে কিছু বললো না।যাকে বলে ব্যাপকভাবে কাঁপছে মেয়েটা।জুনইদ বুঝতে পারছে অনিলা ভয় পেয়ে গেছে অনেক।এতোটাই ভয় পেয়েছে যে হিতাহিতজ্ঞান শুন্য হয়ে তাকে এভাবে জাপটে ধরেছে।কিছুক্ষন আগে যাকে নিজের খুনি ভাবছিলো তাকেই কিনা আঁকড়ে ধরেছে ভয় থেকে বাঁচতে।এভাবেই নিভৃতে কেটে গেলো কয়েক মুহুর্ত।কিছুক্ষণ পর একটু কাঁপুনি থামলো অনিলার।জুনইদ অনিলাকে শান্ত করার জন্য বলে,

অলরাইট।কিচ্ছু হয়নি মিস সুনামি।সব ঠিক আছে।এতো ভয় পাচ্ছো কেন।মিস সুনামির তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।ভয়ে একেবারে নিজের শত্রুকেই জড়িয়ে ধরলে।

নিজের অবস্থান বুঝতেই অনিলা কিছু টা হন্তদন্ত হয়ে সরে এলো।মাথা নত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

আ-আমার আ-আগুনে ফো-ফোবিয়া আছে।অতিরিক্ত আগুন দেখলেই আমি এভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়।আমি আগুন দেখে সহ্য করতে পারি না বুঝতেই পারছেন।আ’ম স্যরি।

জুনইদ অনুদ্ধত কন্ঠে বললো, হুম বুঝলাম।এবার চলো তোমাকে তোমার শত্রু বাড়ি পৌঁছে দেবে।

অনিলা নত মুখেই বলে,লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো।বলেই উঠে দাঁড়িয়ে পরলো অনিলা।বাজারের ব্যাগ টা নিয়ে হাটা ধরলো ক্লান্ত পায়ে।শরীরের শক্তি নেই কিন্তু জোর করেই হেটে যাচ্ছিলো সে।

জুনইদ ভাবছে এটা কেমন মেয়ে হ্যাঁহ।এরকম দুর্বল শরীরেও নিজের শরীরকে যেনো ঝড়ের বেগে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।এই জন্যই তো সে অনিলার নাম মিস সুনামি দিয়েছে।দেখো কিভাবে হেটে হেটে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।জুনইদ কিছুক্ষণ পরেই একটা রিকশা পেলো।রিকশা নিয়ে অনিলার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো।

অনিলা উঠতে না চাইলেও ওঁকে জোর করে উঠালো রিকশায়।অনিলা না পেরে বাধ্য হয়ে উঠে পরলো রিকশায়।প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে পৌঁছে গেলো ওরা।অনিলা দুর্বল শরীরেই নামলো রিকশা থেকে।ওর শরীর চলছে না আর।কিন্তু তাও হাঁটা লাগালো ফ্ল্যাট এ ঢুকার জন্য।

জুনইদ ভাড়া মিটিয়ে অনিলার দিকে তাকালো।এই মেয়েটা বড্ড জেদি আর এক গুয়ে।এরকম নচ্ছাড় মেয়ে সে জীবনে এক পিস ও দেখে নি।উপায়ন্তর না পেয়ে আচমকাই সে চট করে কোলে তুলে নিলো অনিলাকে।কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো আস্তে আস্তে।অনিলা নির্বাক নিরর্থক ভাবে বোকা বোকা চাহনিতে চেয়ে রইলো শ্যাম পুরুষটির মুখ পানে।

#চলবে