সম্রাজ্ঞী পর্ব-১০+১১

0
110

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_10

সুলতানের কামরার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে শেহজাদি মাইরা। সে এটাই ভেবে পাচ্ছে না যে হুট করে সুলতান তাকে কেন ডেকেছে। কোনো বড় কারন আছে কি? সুলতান কী না কী বলবে সে কথা চিন্তা করে তার সাথের সেবিকাদের আগেই তাড়িয়ে দিয়েছে সে। দ্বারে কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তাকে দেখতেই দ্বারের বাইরে পাহাড়ারত সৈনিকগুলো একটু পিছিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর দ্বার খুলে দিলো মাহতাব। মাইরাকে দেখতে পেয়ে কেমন যেন কিঞ্চিত বিরক্ত হলো সে। কোনো কারন ছাড়াই কুচকে নিলো নিজের চোখ-মুখ। তার মুখভঙ্গির এমন নাজুক দশার কোনো কারন খুঁজে পেল না মাইরা। যথাসম্ভব তার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করছে সে। তখনই ভেতর থেকে সুলতান বললেন, “কে এসেছে মাহতাব?”

মাহতাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাইরা নিজেই বলে উঠলো, “আমাকে ডেকেছেন সুলতান?”

“ওহ মাইরা, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেতরে এসো।”

স্বস্তি পেল মাইরা। সৈনিক প্রধানের বিরক্তিকর দৃষ্টি আর সহ্য করতে পারছিল না সে। মাহতাবকে পাশ কাটিয়ে কামরায় ঢুকে পড়লো মাইরা। সিন্দুকের সামনে পেছন ফিরে আছেন সুলতান। সিন্দুকের ভেতরের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা করছে সে। পেছন থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারলো না মাইরা। সে খানিক এগিয়ে গিয়ে বলল, “হঠাৎ এমন জরুরী তলব?”

উত্তর দিলেন না সুলতান। সিন্দুকে তালা ঝুলিয়ে চাবিখানা লুকিয়ে ফেললেন নিজের পাগড়ির মাঝে। অতঃপর ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলেন মাইরার সামনে। দ্বারের দিকে নজর দিতেই দেখতে পেলেন মাহতাব সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে অদ্ভুতভাবে তার দৃষ্টিতে মিশে আছে একরাশ বিরক্তি। সেও কি তবে সুলতানা হিসেবে মাইরাকে চায় না? না-কি অন্য কোনো কারন রয়েছে এর মাঝে? এ নিয়ে আর ঘাটলো না সুলতান। মাইরার দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিলো। কথাগুলো না বললেই না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।”

“জরুরী কথা! আমার সাথে?” অবাক কন্ঠে শুধাল মাইরা।

“হ্যাঁ।”

এবার খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লো মাইরা। তার সাথে কী এমন জরুরী কথা সুলতানের? তবে যাই হোক, সেটা এই সৈনিক প্রধানের সামনে কেন বলতে হবে? আর এই লোকটাও একেবারে অসহ্য। সবসময় সুলতানের সাথে চিপকে থাকে একেবারে। এলিজা কী করে যে এটাকে সহ্য করতো কে জানে। সুলতান পারেও বটে! সারাক্ষণ শুধু কালেমার মতো করে জপতে থাকে এই আজমাইন মাহতাবের নাম। সৈনিক প্রধান ছাড়া এক পা আগাতে চান না তিনি। আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতে সে কটমট করে তাকালো মাহতাবের দিকে। যে কোনো মূল্যে সে সুলতানের কাছ থেকে সরাতে চায় এই লোকটাকে। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো, “আমাদের কথার মাঝখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি চাই না আমি।”

তার কথার মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হলো মাহতাব। তবুও তার প্রতিক্রিয়া পূর্বের মতোই শূন্যের কোঠায়। কে কী বলল বা কে কী ভাবলো তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। একমাত্র সুলতানের আদেশ পেলেই সে সরবে এখান থেকে। শেহজাদি কেন? স্বয়ং এলিজা সুলতান ফিরে এসে তাকে এই কামরা ত্যাগ করতে বললেও সে নড়তো না। সে সুলতানের হুকুম মানতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, অন্য কারো নয়। তবে চিরপরিচিতভাবেই সুলতান তাকে সরতে বলল না সেখান থেকে। বরং শক্ত কন্ঠে মাইরাকে বলল, “আমিও আমার জীবনে তৃতীয় পক্ষের আনাগোনা চাই না।”

ভ্রু কুচকাল মাইরা। কথাটা কি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সুলতান? তার আর এলিজার মাঝে আমাকে তৃতীয় পক্ষের তকমা দিলো? মৃত মানুষকে কেন সুলতান তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে? তার বোনের মৃত্যুর দুটো বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ তাকে কেন টেনে আনছে সুলতান? তার ভাবনার মাঝেই সুলতান বলে উঠলেন, “চলো, ঘুরে আসি আমার সাম্রাজ্য থেকে। মানে তোমার বোনের সাম্রাজ্য থেকে। আশা করি, ভালো লাগবে।”

আজ একের পর এক ঝটকা খাচ্ছে মাইরা। সুলতান তাকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আহ্বান করছেন! সে কি স্বপ্ন দেখছে! সুলতান শাহজাইন পুনরায় বললেন, “আসলে কথাগুলো এখানে বলাটা নিরাপদ হবে না। দেয়ালেরও কান আছে। তাছাড়া সাম্রাজ্য দর্শন করতেও বেরোনো হয় না অনেকদিন। তাই ভাবলাম একসাথে দুটো কাজ সেরে ফেলি।”

“ওহ, তাই বলুন। আমিতো ভাবলাম…………”

“কী ভাবলে?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল সুলতান।

“না, কিছু না।” কৌশলে কথাখানা এড়িয়ে গেল মাইরা।

উপলব্ধি করতে পারলো সুলতান। তবে সেদিকে ধ্যান দিলো না সে। নিজের মতো করে বলল, “তাহলে যাওয়া যাক। মাহতাব, সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছো তো?”

তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এলো মাহতাব। মাথা নুইয়ে বলল, “সবকিছু প্রস্তুত মহামান্য। আপনি হুকুম দিলে হাজির করতে পারি।”

ব্যবস্থা! কথাটা ঠিক হজম হলো না মাইরার। সুলতানের আবার নিজ সাম্রাজ্য দর্শনে কীসের ব্যবস্থার প্রয়োজন? সুলতানের আজব সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আজ পরিচিত হচ্ছে সে। কামরা থেকে বেরিয়ে গেল মাহতাব। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো সাথে একজন সেবককে নিয়ে। সেবকটির হাতে বেশ কয়েকটা বস্ত্র দেখা যাচ্ছে। সেগুলো খুবই সাধারণ। তবে এসব কম দামী পোশক এখানে কেন? এসব তো সাধারণের পোশাক। মহলে কেন এগুলো? সকলের আড়ালেই নাক সিটকালো মাইরা। কেন জানি এসব সাধারণ আর কম দামী জিনিস তার সহ্য হয় না। ছোট থেকে সে বড় হয়েছে বিশাল চাকচিক্যের মাঝে। এসবের সংস্পর্শে আসেনি কখনো তাই হয়তো এই বিরক্তি। তাকে অবাক করে দিয়ে সেবকের হাত থেকে একটা পোশাক তুলে নিলো সুলতান। কম দামী, সাধারণ একটা বোরখা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আজ আমরা ছদ্মবেশে যাব। সাধারণের মাঝে সাধারণ হয়েই যেতে চাই। এতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”

হতবাক নয়নে চাইল মাইরা। আমতা আমতা করে বলল, “নননা, আআমার আবার ককীসের সমস্যা? কোনো সমস্যা নেই। আমি এক্ষুনি প্রস্তুত হয়ে আসছি।”

বোরখাটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল মাইরা। তার মুখভঙ্গি খেয়াল করেছে মাহতাব। তাকে এভাবে নাস্তানাবুদ হতে দেখে মনে মনে বিশাল খুশি হলো সে। তার যাওয়ার পানে চেয়ে এবার খানিক উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। অতঃপর সুলতানের দিকে চেয়ে চুপ হয়ে গেল হুট করে। তার দিকে কপাল কুচকে চাইল সুলতান। উপলব্ধি করতে পারলো মাহতাবের হাসির কারন। সাধারণ একটা পাঞ্জাবি হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, “কম দামী পোশাক দেখে নাক সিটকানো সুলতানা কেমন হবে মাহতাব?”

সচকিত হয়ে তাকালো মাহতাব। কিঞ্চিত তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “সে সুলতানা হবার যোগ্য নয় মহামান্য।”

অতঃপর সব নীরব। কামরা জুরে বিরাজ করছে অসীম নিস্তব্ধতা। কারোর মুখে যেন কোনো বাক্য নেই বলার মতো। সুলতান রাজকীয় পোশাক বদলে সাধারণ পাঞ্জাবি পরিধান করলেন। রঙটা নীলচে, একেবারে হালকা নীল। মাথা থেকে বহু মূল্যবান পাগড়িটা খুলে রাখলেন পালঙ্কে। তার ঝাঁকড়া চুলগুলো বেরিয়ে এলো মুক্ত হয়ে। তবে বেশিক্ষণ চুলগুলো মুক্ত থাকতে পারলো না। দ্রুত টুপি পড়ে নিলেন সে। মাহতাব পরিধান করলো একটি স্বল্প মূল্যের ফতুয়া। সফেদ রঙের। কিন্তু তলোয়ার নিয়ে সে পড়লো বিপদে। সাধারণ সেজেছে সে। সাধারনের হাতে তলোয়ার থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তলোয়ার ছাড়া বাইরে যাওয়াটাও বিপজ্জনক। আত্মরক্ষার জন্য তলোয়ারটা ভীষণ প্রয়োজন। তাছাড়া প্রশ্ন যেখানে সুলতানের সুরক্ষা নিয়ে সেখানে সে একচুল ছাড় দিতেও রাজি নয়। চিন্তায় তার মাথা ছিড়ে যাবার উপক্রম। তাকে এভাবে চিন্তা করতে দেখে ঠোঁটদুটো প্রসারিত করলেন সুলতান। মাহতাবের কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “থাক না এটা। একটা দিন এটাকে ছাড়া কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তো যাচ্ছি সাধারণের বেশে কেউ তো চিনতেই পারবে না। তুমিও তলোয়ার ছেড়ে স্বস্তির শ্বাস নাও একটু সময়। আমি আছি, তুমি আছো। আমরা দু’জনই কি যথেষ্ট নয় শত্রুর জন্য?”

তার কথাতে সামান্য ভরসা পেল মাহতাব। তবে চিন্তা মুক্ত হতে পারলো না। বিপদ কি বলে-কয়ে আসে?
সর্বদিক বিবেচনা করে সে ছোট্ট একটা ছুড়ি গুঁজে নিলো ফতুয়ার নিচে। জুতোটাও বদলে ফেলল দু’জন। সাধারণ চটি পড়ে নিলো পায়ে। সব শেষে বিবর্ণ, সুতো উঠা, বহু পুরাতন পাগড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল নিজেদের মুখমণ্ডল। চোখের নিচ থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত ঢেকে গেছে পাগড়িতে। দৃশ্যমান কপালটাও পাগড়ি টেনে পেঁচিয়ে নিলো তারা। এখন শুধুমাত্র চোখ দুটোই দৃশ্যমান। এবার আর কে চিনবে তাদের?

কিছুক্ষণ পরেই সেই কামরার দিকে ফিরে এলো শেহজাদি মাইরা। বোরখা পরে হিজাব দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে সে। দ্বারে কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল নিয়মমাফিক। কিছুক্ষণ পর খট করে খুলে গেল দ্বারের কপাট। বেরিয়ে এলো সাধারণ দু’জন মানব। তাদের দেখে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তাকালো মাইরা। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তোমরা কারা? জানো এটা কার কামরা? সুলতানের কামরা এটা। কোন সাহসে তোমরা বিনা অনুমতিতে এই কামরায় প্রবেশ করেছো?”

“তুমিই আমাদের চিনতে পারছো না তাহলে বাইরের মানুষের চেনার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।”

কথাখানা শ্রবণগোচর হতেই হতবুদ্ধির ন্যায় চাইল মাইরা। সুলতান! আর এই বেশে! সাধারণ সাজবে বলে এতোটা সাধারণ যে তাকে চেনাই যাবে না! সুবিশাল মহলটা ছেড়ে বেরিয়ে এলো তারা। তবে আবারো তারা মাইরাকে চমকে দিয়ে ঘোড়শালের দিকে না গিয়ে সবকিছু অগ্রাহ্য করে হাঁটতে লাগলো প্রধান ফটকের দিকে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাইরা। এখন আবার হেঁটে হেঁটে যেতে হবে নাকি? সে অবাক স্বরে কিছু শুধাবে তার পূর্বেই ভেসে এলো আজমাইন মাহতাবের গম্ভীর কন্ঠস্বর।

“আমাদের হেঁটেই যেতে হবে শেহজাদি। দয়া করে আপনি হুটহাট এভাবে দাঁড়িয়ে পড়বেন না। তাহলে পিছিয়ে পড়বেন।”

অমনি ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো মাইরা। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সুলতান তাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে না-কি অত্যাচার করছে সুকৌশলে! তবে করার কিছু নেই। কথা যখন দিয়েছে তখন তাকে যেতেই হবে। আগে কখনো এভাবে হাঁটেনি সে। তাই একটু কষ্ট করতে হচ্ছে বটে! সামনে হাঁটছেন সুলতান। তার থেকে সামন্য পেছনে মাহতাব ও শেহজাদি মাইরা নিজেদের মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে প্রধান ফটক পার করে মহলের সীমানার বাইরে চলে গেল তারা। প্রধান দ্বারে দাঁড়ানো শেহজাদি তানহা ছলছল নয়নে চেয়ে থাকলো তাদের যাওয়ার পানে। কিছুক্ষণের মাঝেই দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল তারা। অমনি ঝুম বৃষ্টি নামল তার নয়ন জোড়ায়। তবে বেশিক্ষণ সেই পানির ফোয়ারা স্থায়ী হতে দিলো না সে। দ্রুত মুছে নিলো দু’হাতে। তখনই কোথা থেকে তোহফা এসে জাপটে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আর এক ফোঁটা পানিও নিজের চোখ থেকে বেরোতে দিলো না সে। ঝুঁকে পড়ে কোলে তুলে নিলো তোহফাকে। সামান্য পরিমাণ রাগও করলো না সে বরং তোহফার দিকে চেয়ে এটা-ওটা বলতে বলতে নিজের কামরার দিকে চলে গেল।

দূর থেকে এ সমস্ত কিছুই লক্ষ করছিল ফাইজা। সে এসে থেকেই খেয়াল করেছে শেহজাদি তানহা আর সবার মতো নয়। তার ব্যবহার, আচার-আচরন খুবই আজব! এই তাকে অতিরিক্ত ভালো মনে হয় তো আবার রাজ্যের খারাপ মনে হয়। তার আসল চরিত্রটা এখনো আন্দাজ করতে পারেনি ফাইজা। এই যে একটু আগেই সে রেগেমেগে চেয়ে ছিল ফটকের দিকে। আবার কেঁদেও ফেলল হুট করে। মুহুর্তের মাঝেই আবার তোহফাকে কোলে নিয়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল। রাগের কারনও উপলব্ধি করতে পারলো না সে, কান্নার কারনও উপলব্ধি করতে পারলো না। তবে শেষ মুহূর্তটুকুর কৃতিত্ব শেহজাদি তোহফার সেটা সে জানে। তার চরিত্র বুঝতে হলে আরো ভালো করে নজর রাখতে হবে তাকে। হতাশার শ্বাস ফেলল সে। বিরক্ত গলায় বলল, “কী যে চলছে এই মহলে কে জানে?”

বিশাল শাহ নদীর পাড় বেয়ে একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ইটের তৈরি রাস্তাটা নদীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই বানানো হয়েছে। রাস্তার দুই ধারে শুধুই বালু আর বালু। রাস্তার উপরেও খানিক বালু উঠে এসেছে। তবে হেঁটে চলতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না তাতে। রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটছেন সুলতান। দৃষ্টি তার সম্মুখেই সীমাবদ্ধ। টুপিটা মাঝে মাঝে টেনে নিচ্ছে সে। চুল বেরিয়ে এলে বোধহয় বিরাট পাপ হয়ে যাবে। যথারীতি বিরক্ত মুখে এগোচ্ছে শেহজাদি মাইরা। তবে মাহতাবের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, অত্যন্ত স্বাভাবিক। পাগড়ির বাঁধনের আড়ালেও তার মুখভঙ্গি উপলব্ধি করতে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। অনেক সময় ধরে তারা শুধু হেঁটেই চলেছে, হেঁটেই চলেছে। গরমের কারনে বোরখার ভেতরে ঘামে একেবারে ভিজে গেছে মাইরা। অতিরিক্ত গরমে হাঁসফাঁস করছে সে। অথচ সুলতান আর আজমাইন মাহতাবের কোনো হেলদোল নেই। যেন এই বেজায় গরম তাদের ছুঁতেই পারছে না। নদীর বুকে সামান্য বাতাস বইছে। বালু উড়ছে দিক্বিদিক। আরো কিছুদূর এগোতেই ফুরিয়ে এলো রাস্তা, নজরে এলো সুগঠিত একটি বাজার। বিপুল পরিমাণ বালুর উপরেই দন্ডায়মান এই বাজার। এই ভর-দুপুরে বাজারের ভীর খানিকটা কম কিন্তু দোকানগুলো এখনো খোলা। রং-বেরঙের ছাউনি টানানো প্রতিটা দোকানে। এবার কথা বলে উঠলেন সুলতান।

“আছো তো মাইরা? সামনে যেই বাজারটা দেখছো এটার নাম নূর বাজার। রামান সাম্রাজ্যের অনন্য সৌন্দর্য ধরে রাখতে এটার অবদান অনস্বীকার্য।”

বাজারের দিকে খুব একটা ধ্যান দিলো না মাইরা। এতো সাধারণ মানুষের মাঝে অস্বস্তি লাগছে তার। বালুর মাঝে হাঁটতে সামান্য বিরক্তও লাগছে। তবে দোকানপাটগুলো বেশ আগ্রহী নয়নে পর্যবেক্ষণ করছে সে। দোকানগুলো বেশ পরিপাটি, সুন্দর। প্রচন্ড গরমের মাঝেও দোকানিরা হাসি মুখে আপ্যায়ন করছে ক্রেতাদেরকে। দৃশ্যটা সুন্দর, অতিব সুন্দর। আচমকা মাহতাবের কাশির শব্দে ভাবনাচ্যুত হলো সে। সরু দৃষ্টিতে তাকালো মাহতাবের দিকে। সুলতানের সাথে একা ঘুরতে পারলে একটু শান্তি পেত সে। কিন্তু সুলতান তো একেবারে মাঝখানে খাঁড়া করে দিয়েছে এই সৈনিক প্রধানকে। দুটো কথা বলেও শান্তি নেই তার জন্য। সবসময় কেমন বিরক্ত চোখে দেখে তাকে। তার বুঝে আসে না- এই লোকটার আসলে সমস্যাটা কোথায় তাকে নিয়ে?

“সুলতান, আপনি কিছু বলবেন বলেছিলেন? ভুলে গেছেন বোধহয়?” বলল মাইরা।

“ভুলিনি মাইরা। আসলে অনেকদিন এভাবে বেরোনো হয় না তাই নিজ সাম্রাজ্য দর্শনে একটু বেশিই মশগুল ছিলাম।” হাঁটতে হাঁটতেই বললেন সুলতান।

এই জবাবের পর বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না মাইরা। তবে খানিক মনোক্ষুন্ন হলো সে। সাম্রাজ্য দেখতেই যখন আসবে তাহলে তাকে কেন এনেছে সাথে করে? এই বাজার দেখাতে? নাকি নদী দেখাতে? তার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে মাহতাব বলে উঠলো, “আপনি বাজারের মাঝে পানির কল লাগানোর কথা বলেছিলেন মহামান্য। আমি গিয়ে স্থানটা পর্যবেক্ষণ করে আসি। আপনারা ততক্ষণ কথা বলুন।”

“এখনো লাগানো হয়নি সেটা? অনেক আগেই লাগানো উচিত ছিলো মাহতাব।” অবাক স্বরে বললেন সুলতান।

মাথা নুইয়ে নিলো মাহতাব। নত স্বরে বলল, “তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। নানান ঝুটঝামেলার ভেতরে বিষয়টা আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।”

“ঠিক আছে। তুমি গিয়ে স্থানটা একবার দেখে এসো যে কোথায় কল লাগালে সকলের সুবিধা হবে।”

আশপাশ একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো মাহতাব। অতঃপর হনহন করে এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল ভীরের মাঝে। শান্তিতে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো মাইরা। এতোক্ষনে একটু স্বস্তি পাচ্ছে সে। হঠাৎ কী ভেবে সুলতানের উদ্দেশ্যে বলল, “আপনার এই সাম্রাজ্য অনেক বেশি সুন্দর আর স্নিগ্ধতা বহন করে। জীবনে এমন কিছু বোধহয় নেই যেটা আপনি চেয়েছেন অথচ পাননি। আপনার প্রাপ্তির খাতাটা আসলেই বেশ বড়।”

মৃদু হাসলেন সুলতান। অতঃপর হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলে ধরা গলায় বললেন, “আমার হারানোর অধ্যায়টা খুব বেশি বড় নয়। প্রাপ্তির অধ্যায়টা তার তুলনায় অনেক বড়। কিন্তু তাতেও কী লাভ হলো? তোমার বোন ঠিকই হারানোর অধ্যায়ের সবচেয়ে উচ্চ স্থানটা দখল করে নিলো। অথচ তাকেই আমি নিজের প্রাপ্তির অধ্যায়ে যত্ন করে রেখেছিলাম।”

আকস্মাৎ এলিজার কথা উঠতেই মুখটা মলিন হলো মাইরার। হয়তো বোনের মৃত্যু শোকে অথবা কোনো অপূর্ণতার আবছা অন্ধকারে! একে একে প্রতিটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছে তারা। কখনো পোশাকের দোকান তো আবার কখনো খাদ্য সামগ্রীর দোকান। একটা দোকানে ঢুকে হিজাব দেখছে সুলতান। দোকানি উপরের তাক থেকে কালো রঙের একটি সুন্দর নরম কাপড়ের হিজাব বের করে দিলো। পাথরের কারুকার্য করা হয়েছে হিজাবটার উপরে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হিজাবটা পর্যবেক্ষণ করছে সুলতান। অবাক হলো মাইরা। সুলতান হিজাব দিয়ে কী করবেন? তাও এতো সাধারণ হিজাব! দোকানি অন্যদিকে যেতেই হঠাৎ সুলতান বলে উঠলেন, “নিজের বোনের স্বামীর সঙ্গে বিবাহে তুমি সেচ্ছাই সম্মতি দিয়েছো? নাকি জোরপূর্বক রাজি করানো হয়েছে তোমাকে?”

আকস্মাৎ এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলো শেহজাদি মাইরা। অতঃপর নিচু স্বরে বলল, “আপনি ভুল ভাববেন না সুলতান। আমি শুধুমাত্র তোহফার কথা ভেবেই সম্মতি দিয়েছি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা আশা নেই আমার। আপনাকে নিয়ে সেরকম কোনো ভাবনাও নেই। এটা শুধুই দায়বদ্ধতা।”

দোকানিকে ডেকে হিজাবটা নিয়ে নিলো সুলতান। অর্থ পরিশোধ করে বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। বাজারের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “তাহলে তোমার নিজের কোনো আশা বা স্বপ্ন নেই এই বিবাহ নিয়ে। সেটাই বলছো তো?”

উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো মাইরা। সুলতান সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “আম্মা আমাকে জোরপূর্বক রাজি করিয়েছে। সে খবর কি জানো তুমি?”

“আমাকে এ ব্যপারে কিছুই জানানো হয়নি। জোরপূর্বক বিবাহ! এটা কখনো সম্ভব নয়। আপনার সম্মতি না থাকলে এই বিবাহ কখনোই হবে না। আমি আজই নিজের অসম্মতির কথা জানিয়ে দেবো সবাইকে।”

“না, তুমি এটা জানাবে না। এই বিবাহ হবে। ইদের আগেই হবে। বিবাহের জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও মানসিকভাবে।” গম্ভীর স্বরে বললেন সুলতান।

“কিন্তু সুলতান………..”

অসম্পূর্ণ থেকে গেল তার বাক্য। তাকে থামিয়ে সুলতান পুনরায় বলে উঠলেন, “তোহফার খালামণি তুমি। তোমার কি উচিত নয় তার খারাপ-ভালোর খবর রাখা? তোহফার জবান ফিরিয়ে আনতে আম্মার সাহায্য প্রয়োজন। আর সেটা সে তখনই করবেন যখন এই বিবাহটা হবে। আম্মার জিদ সম্পর্কে অবগত আমি। এই বিবাহ না হলে সে কিছুতেই সেই কবিরাজের ঠিকানা দেবেন না যে কি-না ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার কন্যার জবান। বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই জেনেও এ’কটা দিন বহুবার সকলের আড়ালে আম্মার দ্বারস্থ হয়েছি। অনুরোধ করেছি, পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। কিন্তু সে নিজ সিদ্ধান্তেই অনড় রয়েছেন। নিজ কন্যার জবান ফেরাতে আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে। তবে বিষয়টা তোমাকে জানানোর প্রয়োজন ছিল তাই আজ এখানে আসা।”

“আপনি অনুমতি দিলে আমি একবার কথা বলে দেখতে চাই আপনার আম্মার সঙ্গে?”

“আম্মার জিদ সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই তোমার। সে একবার যখন মনস্থির করে নিয়েছেন এই বিবাহ দেবেন তো সে যে কোনো মূল্যে সেটার জন্য চেষ্টা করে যাবেন। আম্মার পায়ে পর্যন্ত ধরেছি আমি। আর কী করতে চাও তুমি? তোমার কথা সে মানবে না সেটা আমি জানি।”

হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকলো মাইরা। কোনো মা এতো নিষ্ঠুর হতে পারে তার জানা ছিলো না। নিজের নাতনির কথাও ভাবলো না সে!

তখনই সেখানে ফিরে এলো মাহতাব। ক্লান্ত স্বরে বলল, “স্থান নির্ধারণ করে এসেছি মহামান্য। পানির কল আগামীকালই বসিয়ে দেওয়া হবে।”

“হুম।” ছোট্ট করে জবাব দিলেন সুলতান।

তার কন্ঠের এই সামান্য পরিবর্তনটাও লক্ষ করলো মাহতাব। তবে এর কারন আগে থেকেই অবগত সে। নিশ্চয়ই বিবাহ সম্পর্কিত আলাপ করছিলেন তারা। তাইতো কঠিন এই পুরুষের কন্ঠে সৃষ্টি হয়েছে অপারগতার খাদ। এ নিয়ে আর কোনো কথা বলে সুলতানের কষ্টকে দ্বিগুণ করতে চাই না মাহতাব। তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, “আপনাদের কথোপকথন শেষ হলে মহলে ফেরা যাক?”

উত্তর দিলেন না সুলতান। নীরবে হাঁটতে শুরু করলেন বাজারের উল্টো দিকে। মহলে ফিরতে হবে অতি দ্রুত। বেশিক্ষণ এই দহন বুকে চেপে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না সে। ছাই চাপা আগুনের ন্যায় ঠিকই বেরিয়ে আসবে তার কষ্ট। তবে জনসম্মুখে নিজের কষ্ট প্রদর্শিত করা একজন সুলতানের পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়। ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বাজার ত্যাগ করলো তারা।

বাজারের শেষ মাথায় এসে দাঁড়ালো জোভিয়া। হাতে ওষুধের থলে। বুবুকে বারবার বলেও দোকান খোলার জন্য রাজি করাতে পারেনি সে। বরং আজকের ঘটনার পর আরো বেঁকে বসেছে সে। ওষুধ কিনতেও লুকিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। আব্বাজানের ওষুধ শেষ। নিয়মিত ওষুধ না খেলে তাকে বাঁচানো কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এমনিতেই পায়ের গভীর ক্ষতটার কারনে সে ধুকে ধুকে মরছে। ক্ষতর কথা মনে পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। ক্ষতর কারনটা বুবুর জানা না থাকলেও তার সবটাই জানা। পাপের ফল সকলকেই ভোগ করতে হয়। সেটা একদিন আগে হোক বা পরে। কাতর হলো তার দৃষ্টি। ওষুধ কেনার জন্য গৃহে একটা কানাকড়িও নেই। দিন আনে দিন খায় অবস্থা তাদের। রমজান মাসে দোকান বন্ধ করে রাখলে চলবে কী করে? আজকের ঘটনার পর আরো বেশি ভীত হয়ে পড়েছে বুবু। কোনোমতে পালিয়ে এসেছে সে। কারন ওষুধটা খুবই প্রয়োজনীয়। একেবারে না হলেই না। হাতে অর্থ নেই তবুও এসেছে সে। পরিচিত দোকানির কাছে বলে-কয়ে বাকিতে ওষুধ নিয়েছে। তবে এভাবে আর বেশিদিন চলবে না। দ্রুতই দোকান খুলতে হবে। তার জন্য বুবুর অবাধ্য হতে হলেও হবে সে। হঠাৎ নজরে আসলো তিনজন মানব-মানবী। দুজন পুরুষ এবং একজন নারী। তাদের সকলেরই মুখ ঢেকে রাখা হিজাব ও পাগড়ি দিয়ে। ভ্রু কুচকাল সে। এই গরমে পাগড়ি দিয়ে মুখ বেঁধেছে! যতদূর পর্যন্ত তাদের দেখা গেল ততদূর পর্যন্ত অপলক চেয়ে রইল সে। হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ করছে সে। আচমকা সরু গলায় বলে উঠলো, “সুলতান শাহজাইন শাহ, সাধারণ পোশাকেও সুদর্শন আপনি ঠিক রাজকীয় পোশাকের ন্যায়।”

ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল তারা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল জোভিয়া। আনমনে বলে উঠলো, “শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে, সুলতান। তবে স্থানটা হবে ভিন্ন। পরিস্থিতি থাকবে আপনার অনুকূলে। জোভিয়ার সম্মুখে দাঁড়ানোর জন্য আপনি প্রস্তুত তো?”

চলবে……..

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_11

“প্রথম যেদিন সে কপাল কুচকে চোখ রাঙালো- আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে কী সৌন্দর্য!
যেদিন সে অভিমানে মুখ ফেরালো- আমি শূন্য হয়েছিলাম, হৃদয়ের অনর্গল দহনে পুড়ে ছাই হয়েছিলাম।
নতুন নতুন বেগম হয়েই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুদ্রমুর্তি ধারন করলো- আমি স্তব্ধ হয়েছিলাম।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলেন সুলতান। চোখে-মুখে তার অন্য রকম এক আত্মতৃপ্তি পরিলক্ষিত হলো। বিশুদ্ধ কোনো ঝলক ফুটে উঠলো মুখশ্রীতে। মহলের কাছাকাছি আসতেই পাগড়ির বাঁধন খুলে দিয়েছে সে। তার চোখের ঘন পাপড়িগুলো বারংবার পলক ফেলার সাথে সাথে নিজেদের সৌন্দর্যতার বর্ণনা দিচ্ছে। বেগমের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতেই কষ্ট কমে যেন শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকল। আচমকা শক্ত হলো তার মুখভঙ্গি। মুহুর্তেই কেটে গেল তার শান্ত মনোভাব। উত্তেজিত স্বরে বললেন, “এই বিবাহ হবে না মাইরা। তুমি তোমার অসম্মতির কথা জানিয়ে দাও মহলে। এলিজার স্থানে অন্য কাউকে বসানো! এ কাজ আমার সাধ্যের বাইরে!”

আকস্মাৎ এমন কথাতে ভ্রু কুচকে চাইল মাইরা। খানিক পূর্বেই যখন সে এই কথাটা বলেছিল তখন এই সুলতানই সেটা নাকচ করেছিল! নিজ কন্যাকে সবল করে তুলতে নিজের আবেগ মাটি চাপা দিয়েছিল! এক মুহুর্তের মাঝে হলোটা কী? সে চিন্তিত স্বরে শুধাল, “হঠাৎ কী হয়েছে সুলতান? আপনাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে?”

“শান্তি পাচ্ছি না আমি। শ্বাস নিতেও অপরাধবোধ করছি আমি। চোখের পলক ফেলতেই ভেসে উঠছে এলিজার ক্রন্দনরত চেহারা। সেই চেহারা আমি উপেক্ষা করি কী করে?” ছটফট করছে সুলতান। অজানা যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করছে সে।

এতোক্ষন তাদের কথোপকথনের মাঝে পিনপন নীরবতা অবলম্বন করছিলো মাহতাব। কিন্তু আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সুলতানের সম্মুখে। আহত গলায় শুধাল, “এভাবে ভেঙে পড়বেন না মহামান্য। শেহজাদি তোহফার জবান ফেরানো অত্যন্ত জরুরী। এই সাম্রাজ্যের তাকে প্রয়োজন। তার জবান ফেরানোর সমস্ত চেষ্টাই তো করে ফেলেছি আমরা। আর কোনো চিকিৎসা বাকি নেই আমাদের নিকট। এটাই এখন একমাত্র ভরসা তার জবান ফেরানোর। আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে হেরে যাবেন না।”

চকিতে তাকালেন সুলতান। করুন গলায় বললেন, “আমি আবারো আম্মার দ্বারস্থ হব। আম্মা এতো নিষ্ঠুর কেন হলো মাহতাব? তার কি হৃদয় পোড়ে না নিজ পুত্রের এই অজস্র অশ্রুজলে? জবানহীন তোহফার অসীম মায়াও কি তার পাথর মন গলাতে পারে না?”

হতাশার শ্বাস ফেলল মাহতাব। ক্ষীণ স্বরে বলল, “তার দ্বারস্থ আর কতবার হবেন মহামান্য? আমি সবকিছুই জানি। তাই বৃথায় লুকানোর চেষ্টা করবেন না দয়া করে। বড় সুলতানা এই বিবাহ ব্যতীত আর কোনো উপায়েই মানবেন না। তাছাড়া গুপ্তভাবে খবর পেয়েছি- সে প্রতিজ্ঞা করেছে মহলে বেগম আনার জন্য। তার প্রতিজ্ঞা কতটা কঠোর হয় সে কথা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়?”

কুল হারানো নৌকার ন্যায় দিশেহারা হলো সুলতান। প্রতিজ্ঞা করেছে তার আম্মা! কেন? কী প্রয়োজন বেগমের? সে কিছুতেই সায় দেবে না আম্মার এই অন্যায্য কর্মকাণ্ডে। যতবার তার দ্বিতীয় বিবাহের কথা মনে পড়ে ততবারই যেন তরতর করে রাগ উঠে যায় সপ্তম আসমানে। একদিকে কন্যার জবান অন্যদিকে তার ভালোবাসা। আর সহ্য করতে পারলো না সে। সব ফেলে হনহন করে চলে গেল মহলের ভেতর। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব ও মাইরা। হুট করে কী থেকে কী ঘটলো বুঝে উঠতে খানিক সময় লাগলো তাদের। ততক্ষণে চোখের আড়াল হয়ে গেছেন সুলতান। হয়তো খিল এঁটেছে নিজ কামরায় গিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহতাব। হতাশ স্বরে বলল, “আপনি নিজ কামরায় যান শেহজাদি। আমি সুলতানের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাবো। একটা সঠিক সমাধান খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে। এভাবে তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্তে গেলে তা শেহজাদি তোহফার জন্য ভালো হবে না।”

পূর্ণ দৃষ্টিতে মাহতাবের দিকে লক্ষ করলো মাইরা। নাহ! এবার আর লোকটার দৃষ্টিতে বিরক্তি নেই বরং সেখানে ঠাঁই পেয়েছে চিন্তার পাহাড়। সে কী তোহফার জন্য চিন্তিত নাকি সুলতানের জন্য? সৈনিক প্রধানের নিকট সে যে কঠিন রকম অপছন্দনীয় ব্যক্তি তা সে আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। তবে এখন বোধহয় সৈনিকের প্রধানের আর কোনো আপত্তি নেই তাকে সুলতানা হিসেবে দেখতে। এ ছাড়া যে আর কোনো উপায়ও নেই। তোহফার জবান ফেরানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজেও চিন্তিত এই বিষয়ে। হঠাৎ তার নজর কাড়লো অদূরে দাঁড়ানো শেহজাদি তানহা। তোহফাকে কোলে নিয়ে বাগনানের পাশটাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি অবশ্য তাদের দিকেই আবদ্ধ। ভ্রূযুগল কুঞ্চিত করলো মাইরা। সে যেন কঠিন এক প্রেম কাহিনীর আভাস পাচ্ছে। সেদিন খাবার টেবিল থেকেই সে লক্ষ করছে তানহাকে। সৈনিক প্রধানকে দেখলেই যেন তার দৃষ্টি রং বদল করে। এট কি ভালোবাসা নাকি অন্য কোনো যোগসূত্র?

আসল কাহিনী পরিক্ষা করতে সে কিছুটা সরে এলো মাহতাবের নিকট। বর্তমানে অতি সামান্যই দূরত্ব রয়েছে তাদের মাঝে। তানহার স্বাভাবিক মুখভঙ্গি নিমেষেই শক্ত হতে শুরু করলো। দৃষ্টিতে যেন অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে তার। যা বোঝার বুঝে নিলো মাইরা। হঠাৎ এভাবে কাছে আসাতে সচকিত হয়ে তাকালো মাহতাব। মাইরার দৃষ্টিতে লক্ষ করে বুঝতে পারলো আসল কারন। রাগান্বিত হয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে তানহা। হুট করে মাহতাবকে একা ফেলে ছুটে মহলে ঢূকে পড়লো মাইরা। হুটহাট এসব কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে রইল মাহতাব। তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো তানহা। তাকে শক্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। ঢোক গিলল মাহতাব। করতে কী চাচ্ছে শেহজাদি?

তাকে আরো অবাক করে দিয়ে তানহা বলে উঠলো, “তোহফাকে একটু কোলে নিন। সে আপনার কাছে যাবার জন্য অনেকক্ষণ ধরে মুখ ফুলিয়ে আছে।”

বাক্য সম্পূর্ণ করার প্রায় সাথে সাথেই আলতো হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো তোহফা। তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে তুলে নিলো মাহতাব। তোহফা তার ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে টেনেটুনে খুলে ফেলল তার পাগড়ি। মৃদু হাসলো মাহতাব। সন্তুষ্ট নজরে তাকালো শেহজাদি তানহার দিকে। জবান না থাকা স্বত্বেও এই নারীটি কীভাবে যেন বুঝে যায় বাচ্চাটার না বলা সমস্ত কথা। কী সুন্দরভাবেই না খেয়াল রাখে তার চাওয়াগুলোর। তোহফা হাসিমুখে একবার তার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার ফুফির দিকে তাকাচ্ছে। কখনো কখনো আস্তে করে টেনে ধরছে তার দাড়িগুলো। বাঁধা দিলো না মাহতাব। বরং শান্ত স্বরে তানহাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমাদের মহলে যাওয়া উচিত শেহজাদি। সুলতানের এ সময় প্রয়োজন পড়তে পারে আমাকে।”

আকস্মাৎ কী হলো জানা নেই কিন্তু তার দিকে কটমট করে তাকালো তানহা। ছোঁ মেরে তোহফাকে নিয়ে নিলো তার কোল থেকে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তো যান। কে নিষেধ করেছে আপনাকে? আপনার অতিরিক্ত ভক্তি পেয়ে বোধহয় ভাই নিজেও বিরক্ত হয়ে পড়ে।”

চোখ গোল গোল করে তাকালো মাহতাব। সুলতান তার জন্য বিরক্ত হয়! কই তাকে তো কখনো কিছু বলেনি! নিজের মনকেই ধমকে উঠলো সে। ধুর! বিরক্ত হলে তবে না বলবে কিছু। শেহজাদি তানহা এমনিতেও দেখতে পারে না তাকে। তাই এসব ফাউ কথা বলছে। নিশ্চয়ই সুলতানের সাথে তার দ্বন্দ্ব বাঁধানোর ফন্দি এটেছে। আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই সে মহলে ঢুকে পড়লো আচমকা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থাকলো তানহা। সে জানে এই লোক এখন গিয়েই ভাইয়ের কামরায় হাজির হবে। সুলতান ছাড়া তার জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাই যেন শূন্য! তোহফা শুধু ড্যাবড্যাব করে দেখে গেল তাদের কর্মকাণ্ড। কথা বলতে পারলে হয়তো আধো আধো স্বরে কিছু বলতো। তবে সেই সুযোগ তো উপরওয়ালা তাকে দেয়নি!

গম্ভীর হয়ে বসে আছেন ওয়াসিফা সুলতান। তার বহু মূল্যবান শাড়ির আঁচলটা নিচে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অথচ তার সেদিকে কোনো হুঁশ-খেয়াল নেই। অতিরিক্ত রাগে গজগজ করছে সে। চোখে দৃশ্যমান হচ্ছে রাগের লেলিহান। কিছুক্ষণ পূর্বে মাইরা এসেছিল তার নিকট। সে ভেবেছিলো জরুরি কোনো কথা হবে হয়তো। কিন্তু মাইরা তাকে সরাসরি বলে বসলো এই বিবাহ সে করতে পারবে না। সুলতানের অসম্মতিতে এই বিবাহ সম্ভব নয়। তার উপর যেচে তাকে উপদেশ দিয়েছে তোহফার চিকিৎসা করার জন্য সাহায্য করতে, দাদিজান হবার দায়িত্ব পালন করতে। এসব নানান কথাতে সে ভীষণ অপমানিত বোধ করেছে। রেগেছেনও সীমা ছাড়া। এতোগুলো কথা বলার সাহস মেয়েটা পায় কোথায়? তার পুত্র নিজেই এই সুযোগ করে দিয়েছে তাই মাইরা এগুলো বলার হিম্মত করতে পেরেছে। কিন্তু সে এতো সহজে ছাড়বেন না। এর একটা বিহিত অবশ্যই করতে হবে। তাই সুলতানকে ডেকে পাঠিয়েছে সে। আজ একটা না একটা হ্যাস্তন্যাস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। দ্বারে কড়া নাড়ার শব্দে ভাবনাচ্যুত হলো সে। গম্ভীর স্বরে বলল, “ভেতরে এসো।”

দ্বার ঠেলে ভেতরে আসলেন সুলতান। মুখটা মলিন, কোনো উজ্জ্বলতা নেই। তার উপস্থিতিতেও কোনো ভাবান্তর ঘটলো না ওয়াসিফা সুলতানের মাঝে। মায়ের মৌনতার কারন ধরতে পারলো না সুলতান। জিজ্ঞাসু স্বরে শুধাল, “আমায় ডেকেছেন?”

এবার শক্তভাবে তার দিকে দৃষ্টিপাত করলো ওয়াসিফা সুলতান। সুলতানের কাতর মুখভঙ্গি তার কঠোরতা কমাতে পারলো না। সে পূর্বের ন্যায় গম্ভীর স্বরে বলল, “বসো।”

তার কথা বলার এই কঠিন ভঙ্গিমা লক্ষ করলো সুলতান। তবে অবাক হলো না কিঞ্চিত পরিমাণও। সে আগেই বুঝতে পেরেছে আম্মা আজ আরোও কঠোর হবে তার প্রতি। নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাবে হয়তোবা! সে নিজেকে আগে থেকেই তৈরি করে নিচ্ছে আম্মার কঠোরতাকে বরণ করে নিতে। কটু বাক্য শুনতে তার আপত্তি নেই শুধু বিবাহের প্রসঙ্গ না উঠলেই হয়। চুপচাপ সে পালঙ্কে গিয়ে বসে পড়লো। ওয়াসিফা সুলতান থমথমে কন্ঠে বললেন, “আমি তোমাকে দশ মাস পেটে ধরেছি। সেই দশটা মাস কেমন কষ্ট সহ্য করতে হয় একজন মাকে তা কি জানো? নাড়ি ছিড়ে তোমায় জন্ম দিতে কেমন যন্ত্রণা হয়েছিল সেটা বোঝো তুমি? একজন সুলতানা হবার পরেও তোমার কষ্ট কমাতে কত রাত জেগে কাটিয়েছি তার হিসেব দিতে পারবে? তোমার সামান্য অসুখে নিজের অস্তিত্ব ভুলেছি। তোমাকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তোমার উদাসীন পিতা কোন দায়িত্বটা পালন করেছে তোমার প্রতি? তোমাকে বুকে করে তার সাম্রাজ্যও আমাকে সামলাতে হয়েছে এই একা হাতে। এতো এতো সংগ্রামের পরে যেদিন তুমি সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসলে, বিশ্বাস করো সেদিন বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটা আমি ছিলাম। নিজের খুশির সীমানা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি।”

হঠাৎ করে এই বাক্যগুলো নাড়িয়ে তুলল সুলতানকে। মাতার নিঃস্বার্থ অবদান সবসময়ই সন্তানকে সঠিক দিশা খুঁজে দেয়। হ্যাঁ, তার আব্বার কারনে আম্মাকে সারাটা জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে। সন্তানদের সামলে আবার সাম্রাজ্য সামলাতে হয়েছে। তার পিতা নামমাত্র সুলতান ছিলেন। তার নিকট তো যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো কিছুই প্রাধান্য রাখে না। নিজের স্ত্রী-সন্তানকে কখনো দু’দন্ড সময় পর্যন্ত সে দেয়নি। সে নত স্বরে বলল, “আপনার অবদান কখনোই ভুলার নয় আম্মা। আপনি নিঃসেন্দহে আমায় গড়ে তোলার প্রধান কারিগর। আপনার ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে আনন্দিত রেখেছে।”

“তাহলে আজ কেন তুমি অন্য দিশায় পা বাড়াচ্ছো? তোমার নিকট কি তোমার আম্মার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে? যার দরুন তুমি নিজের মৃত স্ত্রী ব্যতীত চারপাশে আর কাউকে লক্ষ করছো না। কেন শাহজাইন? আমি কি তোমার ভালো চাইতে পারি না? নাকি সে অধিকারও খুইয়ে বসেছি আমি?”

চমকাল সুলতান। আবেগঘন কন্ঠে বলল, “এভাবে বলবেন না আম্মা। আপনার প্রয়োজন আমার জীবন থেকে কখনোই ফুরাবে না। আপনাকে ছাড়া আমি যে শূন্য। আমি যেমন স্ত্রীকে ভালোবেসেছি তারও বহু পূর্বে আমি আমার আম্মাজানকে ভালোবেসেছি।”

আচমকা তেতে উঠলেন ওয়াসিফা সুলতান। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তাহলে কেন আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছ তুমি? মাইরাকেও নিজের দলে এমনভাবে টেনে নিয়েছো যে সে এসে আমাকে অপমান করে গেল। এবার খুশি হয়েছো তো তুমি?”

“মাইরা অপমান করেছে আপনাকে!” চরম বিস্ময় নিয়ে বলল সুলতান।

“তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। শুধুমাত্র আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই বিবাহ তোমাকে করতেই হবে। মাইরাকে মানানোর দায়িত্বটাও এখন তোমার। মাইরা নয় তো অন্য কেউ আসবে এই মহলের বেগম হয়ে কিন্তু আসবেই। বিবাহ হবেই, সেটা মাইরা হোক বা অন্য কোনো সাম্রাজ্যের শেহজাদি। শোনো শাহজাইন, আবারো বলছি। তুমি যদি এভাবেই বিবাহ না করার জন্য ছলচাতুরি করতে থাকো তাহলে কোনোদিনই নিজ কন্যার কন্ঠ শুনতে পারবে না। আমাকে এর চেয়ে অধিক নির্দয় হতে বাধ্য করো না। এই সাম্রাজ্যের সুলতানা আমি। তোমার বা তোমার পিতার মতো আবেগি অথবা উদাসীন নই। সাম্রাজ্যের জন্য উত্তরাধিকার চায় মানে চায়। সম্রাজ্ঞীর আসন এভাবে ফাঁকা থাকতে দেবো না আমি। তোমার পর সিংহাসনে বসবার মতো কাকে রেখে যাবে তুমি? কোথায় পরবর্তী সুলতান? তোমার জবানহীন কন্যা! সে সাম্রাজ্য সামলাবে? সে তো কথাই বলতে পারে না, সাম্রাজ্য সামলাবে কীভাবে? আমার কসম! তুমি যদি এই বিবাহ না করো তাহলে সারাজীবনের জন্য নিজের আম্মাকে হারাবে।”

আর বসে থাকা হলো না সুলতানের। উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন মায়ের দিকে। তার পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আহত চোখে তাকালো মায়ের মুখের দিকে। তার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে ধরা গলায় বলল, “আমায় এমন কঠিন পরিক্ষায় ফেলবেন না আম্মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে আমার হাতে অদৃশ্য হাতকড়া পড়িয়ে দিলে যে আমি নিশ্ব হয়ে যাবো। তোহফার মুখের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখবেন এই জটিলতা আপনি ভুলে যাবেন। আপনিই বলুন, তোহফা যখন কথা বলতে পারবে তখন সে তো আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে কেন তার আম্মাজানের স্থানে অন্য কাউকে বসিয়েছি। সেদিন কীভাবে উত্তর দেবো আমি?”

তার করুন মিনতিতেও কিঞ্চিত পরিমাণও দমলো না ওয়াসিফা সুলতান। বরং পূর্বের কঠোরতা বজায় রেখে বলে উঠলেন, “আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। তুমি যাই বলো না কেন আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। এখন তুমি যেতে পারো।”

হতাশার শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান। শেষবার আহত দৃষ্টিতে আম্মাকে একবার দেখে নিয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে। তার জীবন ঠিক কোন দিশায় গিয়ে আটকাতে চাইছে জানা নেই।

প্রথম রোজা সকলের কেটেছে বেশ সানন্দেই। আল্লাহর রহমতের বর্ষণে কারোর বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। তার সাথে রমজানের স্নিগ্ধ হাওয়ায় জুড়িয়েছে মন-প্রাণ। গরম পড়েছে, তবে তা অতি সামান্য। সারাটা দিন যেন আলাদা এক প্রশান্তিতে কেটে গেল। একটা মাস অন্তত বন্দি থাকবে শয়তান। সে কলুষিত করতে পারবে না কারোর হৃদয়। তবুও যে অন্যায়-অনাচার খুব বেশি কমবে তা কিন্তু নয়। সারা বছর শয়তানের ধোঁকায় পড়তে পড়তে মানুষ কখন যে নিজের সচ্ছ হৃদয় হারিয়ে বসে তা টেরও পায় না। তাইতো রমজান মাসে শয়তান বন্দি থাকার পরেও কমে না তাদের পাপকার্য। ইফতার শেষ করে নামাজ পড়ে সকলের এখন বিশ্রামের সময়। চাঁদের অনন্য রূপে মুগ্ধ প্রকৃতি। ঝলমলে উজ্জ্বল তারকাবিন্দু ঝিকিমিকি করছে আসমান জুরে। জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো জোভিয়া। কপাট খুলে মেলে দিতেই বাইরে থেকে প্রবল বাতাস হামলে পড়লো তার শরীরে। এলোমেলো হলো তার হিজাব। ধীরে-সুস্থে হিজাবটা খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলো জোভিয়া। জানালা ধরে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। তবে রাতের কালো আকাশকে বোধহয় দেখছে না সে। দেখছে তো সফেদ চন্দ্ররূপসীকে। থেকে থেকে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে উঠছে তবে সেটা খুবই ক্ষীণ শব্দে। সে কথা আর অন্য কারোর শ্রবণগোচর হবার জো নেই। পেছনে কখন জারনাব এসে দাঁড়িয়েছে জানা নেই। সে ভ্রু কুচকে পর্যবেক্ষণ করছে বোনের সমস্ত কর্মকাণ্ড। সকাল থেকেই তার উদ্ভট কান্ডে রীতিমতো মাথা ঘুরছে জারনাবের। প্রথমত জিদানের গলায় হুট করে ছুড়ি চেপে ধরলো। কী সাহস! আর সে কী অগ্নি দৃষ্টি তার! চোখদুটো যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড! শুধু চেপে ধরেই ছাড়েনি, আঁচড়ও কেটেছে ঐ ধারাল ছুড়ি দিয়ে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে জারনাবের। ছুড়িটা কীভাবে জোভিয়ার কাছে আসলো তাও তার অজানা। আগে কখনো ছুড়িটা এ বাড়িতে দেখেনি সে। বোনের সেই তেজস্বী রূপ কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। আরেকটু হলে তো জিদানের প্রাণ-ই নিয়ে নিতো সে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই মুহুর্তে তার বিচক্ষণ ভাবাবেগ, তীক্ষ্ম চাহনি, জিদানকে দেওয়া সেই হুমকি, অস্ত্র ধরার কৌশল- সবকিছুই যেন নতুন কোনো জোভিয়াকে আবিষ্কার করে। চিন্তায় চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে তার।

হঠাৎ লক্ষ করলো জোভিয়া কটমট করে তাকাচ্ছে চাঁদের দিকে। অধর বিকৃত করে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলছে যা তার কর্ণ গহ্বরে পৌঁছাচ্ছে না। ভাবভঙ্গিতে অনুমান করা যাচ্ছে যে সে চাঁদের উপরেও রাগারাগি করছে। হতবুদ্ধির ন্যায় চাইল জারনাব। চাঁদের উপরেও কেউ রাগারাগি করে!

আচমকা চাঁদের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে সে অকপটে বন্ধ করে দিলো জানালার কপাট। শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করায় জোরালো শব্দ হলো। ভাবখানা এমন যেন কারোর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে সে। বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকলো জারনাব। বোনের মতিগতি কিছুই ভালো ঠেকছে না তার। হুট করে কী হলো?

পেছনে ফিরে আকস্মাৎ জারনাবকে দেখে হকচকিয়ে উঠলো জোভিয়া। তবে তার চিরচেনা স্বভাব মতোই রাগ দমাতে অক্ষম হলো সে। গটগট করে হেঁটে গিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। রাগে দু’ভ্রুর মাঝে ভাজ পড়েছে কয়েকটা। যা সে চাইলেও এখন স্বাভাবিক করতে পারছে না। তাই কৌশলে মাথা নিচু করে নিলো সে। আর একবারও তাকালো না বুবুর দিকে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। এতো প্রচেষ্টার পরেও সে জারনাবের থেকে লুকাতে পারলো না নিজের রাগ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জারনাব। চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠিক তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। আগ্রহী স্বরে শুধাল, “কী হয়েছে জোভিয়া? এমন অস্বাভাবিক আচরন করছো কেন?”

লালচে চোখে মাথা তুলে তার দিকে তাকালো জোভিয়া। সাথে সাথেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে।কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো উত্তর দিলো না। জারনাব কিঞ্চিত উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “আরেহ! চুপ করে আছো কেন? আজ হয়েছে টা কী তোমার?”

তবুও নিশ্চুপ জোভিয়া। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো জারনাবের। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কথা বলছো না কেন? সকাল থেকে তোমার এসব সহ্য করছি। কার রাগ চাঁদের উপর দেখাচ্ছিলে তুমি?”

“পুরুষ মানুষ খুব খারাপ হয় বুবু।”

আকস্মাৎ এমন উত্তরে আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না জারনাব বরং কৌতুহল আরো বাড়লো তার। পুরুষ মানুষ খারাপ হয় মানে? তার সরল মস্তিষ্কে খেলল না বিষয়টা। সে পুনরায় শুধাল, “কী বলতে চাইছো খোলসা করে বলো? কোন পুরুষ মানুষ? কার কথা বলছো তুমি?”

আচমকা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো জোভিয়া। চোখ-মুখ কুচকে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “কার কথা আবার? রামান সাম্রাজ্যের সুলতান, এক নম্বরের খা’রাপ আর নোং’রা একটা লোক!”

মাত্রাতিরিক্ত রাগে হিসহিসিয়ে উঠলো সে। চমকাল জারনাব। সুলতান! আর খারাপ! মাথা কি খারাপ হয়ে গেল জোভিয়ার? সুলতানের মতোন এমন সভ্য আর অমায়িক একটা মানুষকে খা’রাপ বলছে! কী সাংঘাতিক! অতিরিক্ত রাগের ফলে কি তার মস্তিষ্কে গন্ডগোল দেখা দিলো? সে হতবাক স্বরে শুধাল, “এসব কী বলছো তুমি জোভিয়া? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? সুলতানের মতোন ভালো মানুষ বর্তমানে খুব কমই আছে। আর তাকে কি-না তুমি খারা’প বলছো? তাও আবার শুধু খা’রাপ না, সাথে নোং’রাও যুক্ত করেছো!”

এবার আর ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা হলো না জোভিয়ার। বিছানার পাশে থাকা পানির পাত্রটা সশব্দে ছুড়ে ফেলল নিচে। কিঞ্চিত উচ্চস্বরে বলল, “ভালো মানুষ? অমায়িক মানুষ, তাই না? কোন ভালো মানুষ নিজের স্ত্রীর ছোট বোনকে বিবাহ করে আমাকে বলো? আবার ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে স্ত্রীর বোন সমেত ছদ্মবেশে বাজারে চলে আসে ঘুরতে! যত্তসব!”

“বিবাহ! কার বিবাহ! কই, আমরা তো এমন কিছুই শুনিনি? তুমি কোথা থেকে শুনলে এসব ভুলভাল কথা? সুলতান বিবাহ করলে আমরা অবশ্যই জানতাম।” জোরালো কন্ঠে বলল জারনাব।

তেতে উঠলো জোভিয়া। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “বিবাহ হলে তারপর তো জানবে, না কি? শীঘ্রই খুশির খবরটা পেয়ে যাবে। হয়তো সেটা ইদের আগেই।”

বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকলো জারনাব। হুট করে এমন সংবাদে মুখের কথা হারিয়ে গেছে তার। সুলতানদের একাধিক বিবাহের রেওয়াজ আজ নতুন নয়। তবে সে তো শুনেছিল সুলতান শাহজাইন তার স্ত্রীর প্রেমে উন্মাদ। স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই সাম্রাজ্যের প্রতিটি কোনায়। সেও বিবাহ করছে! তাও আবার নিজের স্ত্রীর ছোট বোনকে! কিন্তু এসব জোভিয়া জানলো কীভাবে? এসব মহলের ভেতরের খবর! বাইরে তো এখনো সুলতানের বিবাহ সম্পর্কিত কোনো ঘোষণা করা হয়নি। সে আরো কিছু শুধাবে তার পূর্বেই জোভিয়া নিজ থেকে বলে উঠলো, “ন’ষ্ট, খা’রাপ একটা মানুষকে সুলতানের আসনে বসিয়ে রেখেছে! আবার তার সে কী গুণগান! সুলতান এই, সুলতান সেই- অসহ্য একেবারে! পুরুষ মানুষ আর কিছু পারুক বা না-পারুক, স্লোগান একটা মুখস্থ তাদের: ইসলামে চারটা বিবাহ জায়েজ আছে। অথচ আর কোনো হাদিসের খবরাখবর নেই। কীট কতগুলো! আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে একাধিক বিবাহ করা সমস্ত পুরুষের মাথা তরবারির এক কোপে ধর থেকে আলাদা করে দিতাম!”

চলবে………