সিনিয়র লাভ বার্ড পর্ব-৭+৮

0
276

#সিনিয়র_লাভ_বার্ড(৭)
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

রাইসুরসহ বাকি ছেলে মেয়েদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রাহেলা বেগম! রাইসুরের জন্মদাত্রী মা। তিনি গোয়েন্দা অফিসের গেইটের সামনে চিৎকার করে বিলাপ করছেন। রাইসুর তার একমাত্র ছেলে, এতো আদরের ছেলের এমন অবস্থা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। দু’দিন আগে যে ছেলে মায়ের কাছ থেকে তার গহনা বিক্রি করে নেশাদ্রব্য পান করেছে, সেই ছেলের জন্য এক গরিব মায়ের এতো হাহাকার। এর নামই বুঝি মা! সন্তান হাজার অবহেলা অনাদর অত্যাচার করলেও বিপদের দিনে সবার আগে মায়েরাই এগিয়ে আসে। কোথায় গেলো আজ টাকা উড়ানো বন্ধুরা?

দারোয়ান না পেরে অফিসের ভিতরে খবর পাঠান, গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পি.সি সহ কিছু অফিসার অফিস থেকে বেরিয়ে গেইটের সামনে এসে দাড়ায়। রাহেলা বেগম দৌড়ে এসে তাদের সামনে হুড়মুড়িয়ে পড়েন। রাহেলা বেগমের হাত পি.সি’র পায়ে লাগার আগেই সে সরে যায়। তবুও থামলেন না রাহেলা, পি.সির দুইহাত টেনে ধরে বলতে লাগলেন-

‘ মা গো, তুমিও তো একটা মেয়ে, তুমিও কখনো কোনো সন্তানের মা হবে। আমার মানিকরে আমার বুকে ফিরাইয়া দেও মা! ওমা আমি তোমার পায়ে পড়ি মা!আমার রাইসুররে ক্ষমা করো মা। আমি কথা দিচ্ছি ওরে নিয়া অনেক দূরে চলে যামু। ওরে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দাও মা, আমার রাইসুর আগে এমন ছিলো না মা। খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে এমন হইছে। যে সন্তানের জন্য গর্বে একসময় আমার বুক ফুলে যেতো,আজ সে সন্তানের জন্য লোকে আমাকে থু থু দেয়। মা গো তোমার দুইটা পায়ে পড়ি, আমার রাইসুরকে ছাইড়া দেও মা।

জেসি!

পি.সির ডাকে জেসি সামনে এসে দাড়িয়ে বলে- জ্বি ম্যাম,

মহিলাকে উনার বাসায় পৌঁছে দাও, বলেই পি.সি গটগট করে অফিসের ভিতরে চলে গেলো।

সেইদিকে তাকিয়ে রাহেলা বেগম ক্ষুদ্ধ নিয়ে আক্রোশে বললেন- তুই কখনো সুখী হবিনা মেয়ে, তুই কখনো সুখী হবিনা! একটা মায়ের কোল থেকে তার সন্তান কে কেড়ে নিচ্ছিস, একজন মায়ের আর্তনাদ হাহাকার তোর হৃদয় নাড়াতে পারলোনা। তুই পাষাণী! তুই কখনো সুখী হবিনা। এটা একটা মায়ের অভিশাপ!

জেসি জোর করে রাহেলা বেগমকে গাড়িতে তুলে উনার টিন ও মাটির তৈরি বাড়িতে পৌছে দিলো। সাথে কিছু খাবারও দিয়ে এসেছে। অবশ্য এটা পি.সির অর্ডার ছিলো, ইশশ রাহেলা বেগম যদি একবার জানতে পারতেন ‘ সবার সামনে পাষাণী মেয়েটা গোপনে উনার দেখাশোনা করে যাচ্ছে’ তখন কি এমনই ভাবেই অভিশাপ দিতেন?

নামাজে বসে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই রাহেলা বেগমের। নামাজে বসে আল্লাহর কাছে একমাত্র বুকের মানিককে সহিসালামত ভাবে ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করছেন।

গোয়েন্দা অফিসের সামনে বড়োলোক মা বাবারাও ভীড় জমিয়েছিলেন, পুলিশ তাদের আটকিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। যা হবার যা দেখার সব আদালতে হবে আপাতত পি.সির কথায় সব হবে। সব মা বাবার আক্রোশ পি.সির উপরে, সবার একটাই কথা পি.সির মতো এমন নির্দয় মেয়ে মানুষ যেনো কারো ঘরে না জন্ম নেয়।

পি.সির অর্ডারে রাইসুর একটু সুস্থ হতেই তাকেসহ বাকি ছেলেমেয়েদের গোপন আস্তানায় নেয়া হয়েছে। এই জায়গার সম্পর্কে এই ক্যাসের দায়িত্বে থাকা সব অফিসাররা জানেন। সবাইকে চেয়ারের সাথে বেধে রাখা হয়েছে। সবার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছেন পি.সি, তার চারিদিকে বাকি অফিসার দাড়িয়ে আছেন।

পি.সি সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। তারপর বলে – সবাই ভালো আছেন?

মাথা তুলে থাকায় সকলে, রাইসুর এখনো মাথা নিচু করেই আছে। রাইসুরসহ তিনজন ছেলে ও তিনজন মেয়ে আছে মোট ছয়জন।

‘আপনাকে কি আলাদাভাবে বলতে হবে?

পি.সির প্রশ্নে মাথা তুলে রাইসুর, পি.সি আবারো প্রশ্ন করেন- সবাই ভালো আছেন?

কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই অনুশোচনা করছে মনে মনে, আজ যদি তারা নেশার পথে পা না বাড়াতো তবে কি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো তাদের?

যাই হোক আপনাদের কিছু প্রশ্ন করা হবে, তার ঠিক ঠিক উত্তর চাই। যদি সত্যি বলে দেন তো ভলো, আর না বললে কিভাবে কথা বের করতে হয় সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের বলতে হবেনা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই বুঝে আইনের লোকেরা কিভাবে কথা বের করে। তো আমার প্রথম প্রশ্ন- আপনাদের এখানে মোট ছয়জন আছেন, ছয়জনের মধ্যে কে প্রথম নেশা সেবন করেছেন?

ছয়জন একে অপরের দিকে তাকালো, সবার নজর মাথা নিচু করে রাখা ‘রাসেলের দিকে’ পি.সি তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন- আপনি নেশাদ্রব্য কোথায় পেয়েছিলেন? যদি কিনেও থাকেন তবে কোথা থেকে কিনেছেন?

রাসেল মাথা নিচু করেই বললো- কিনিনি, আমাকে দিয়েছে।

কে দিয়েছে?

শুকনো ঢুক গিলে রাসেল বলে- নাম জানিনা, সে মুখে কালো মুখোশ পড়ে আসতো। কখনো নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি।

চিনেন না জানেন না, কেউ আপনাকে কিছু দিলো আর আপনি অমনি সেটা সেবন করলেন?

নাহ, আসলে আমি টিভিতে ফেসবুকে, বিভিন্ন ভিডিওতে দেখেছি এসব। কেউ এসব চালান করতে ধরা পড়েছে, কেউ এসব খেতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সেই থেকে এটার প্রতি আমার কৌতূহল ছিলো, এটা খেতে ঠিক কেমন? ভার্সিটি শেষে আমি পিছনের মোড়ের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ওই মুখোশ পড়া লোকটি আমার সামনে কতোগুলো প্যাকেট ধরে বলে ‘ খাবি? আমিও হ্যা বলে দেই, আমার মনে হয়েছিলো একবার খেলেতো কিছু হবেনা। টেস্ট করে দেখিনা একবার ক্ষতি কি?

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পি.সি বলে – আর তাই আপনি সেটা সেবন করলেন?

হ্যা, আমিও ভেবেছিলাম একবার খেলে কিছু হবেনা, কিন্তু ওটা একবার খেয়ে আমার আরো খেতে ইচ্ছে করেছিলো, এভাবে আস্তে আস্তে একটু একটু করে খেতে খেতে আমার অভ্যাস হয়ে যায়। এটার প্রতি আমার নেশা হয়ে যায়। আমি ইনসুলিন এর মাধ্যমেও শরীরে ড্রাগস নিয়েছি, ড্রাগস, মদ, ইয়াবা, সব সেবন করেছি।

ক্ষুর হেসে নিয়াজ বলে – বাহ্, বাংলাদেশের বিখ্যাত নেশাখোর! কৌতুহল নিয়ে টেস্ট করতে গিয়ে একেবারে ডুবে গেলেন? সাথে বাকি বন্ধুদের ও ডুবালেন। তারপর কি বলুন,,

– ওই মুখোশ পড়া আগন্তুক আমাকে বলতো তোমার বন্ধুদের ও এগুলো টেস্ট করিও দেখবে ওরাও তোমার মতো মজা পাবে। আমিও ওদের জোর করে এগুলো প্রথম খাওয়াই। কিন্তু রাইসুর খেতে চাইতো না, ওকে আমরা জোর করে খাওতাম। আস্তে আস্তে রাইসুরেরও অভ্যাস হয়ে যায়। যখন আমরা সবাই এসব সেবন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, তখনই ওই আগন্তুক আমাদের নেশাদ্রব্য গুলো দেওয়া কমিয়ে দেয়। বলে টাকা দিতে হবে নাহলে ওগুলো আমাদের দেওয়া হবে না। আমাদের মধ্যে সবারই কমবেশি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, তাই আমাদের টাকা দিয়ে কিনে খেতে তেমন সমস্যা হতো না। তবে রাইসুর মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় ও খেতে পারতো না, পরিবারে রাইসুর ও ওর মা ছাড়া কেউ ছিলো না। রাইসুর বিভিন্নভাবে ওর মায়ের থেকে টাকা নিয়ে আমার সাহায্যে নেশাদ্রব্য কিনতো, তা আমরা সবাই একসাথে আনন্দ করে সেবন করতাম।

হাতে তালি দিয়ে পি.সি বলে – বাহ্! আগামীর ভবিষ্যত আপনারা। আপনাদের দেখেই তো আগামী প্রজন্ম শিখবে।
রাইসুরের দিকে তাকিয়ে বলে – লজ্জা হওয়া উচিত, নিজের মাকে অত্যাচার করে টাকা নিয়ে এসব নেশাদ্রব্য সেবন করেন।

আজ এই পর্যন্তই থাক, কাল আবারো আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এখনো অনকে কিছু জানা বাকি। নিয়াজ ওদের গাড়িতে তুলো আগের জায়গায় পাঠিয়ে দাও। বলেই বের হয়ে গেলো পি.সি।

.
পি.সির মুখ কেউ দেখতে পায়নি মাক্স পড়ে থাকার কারণে। তবে তার শরীরের গঠন ও চুল দেখে সবাই বুঝে গেছে পি.সি একজন মেয়ে। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ধুম পেলেছে, এতো সাহসী অফিসার তাও মেয়ে সত্যি প্রসংশা পাওয়ার যোগ্য।

চলবে, ইনশাআল্লাহ,,

#সিনিয়র_লাভ_বার্ড(৮)
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

মাক্স পরিহিত পি.সি’সহ তার টিমের প্রতিটি অফিসারকে টিভিতে দেখাচ্ছে, ফেসবুক, ইন্স্ট্রাগ্রাম সব ইন্টারনেট সংযোগ এপ্সে দেখানো হচ্ছে। রাইসুরদের’কেও দেখানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ জায়গা থেকে দেখতে পাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে- এরকম ছেলেমেয়েদের মরে যাওয়া উচিত, আবার কেউ কেউ বলছে- অল্পবয়স ভুল করে ফেলেছে, একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। কেউ কেউ বলছে- মা বাবা শিক্ষা দিতে পারেনি, হয়তো মা বাবাও এমন, তাই সন্তানরাও এমন হয়েছে।

এই সমাজ এতো নিষ্ঠুর, কেউ একটা ভুল করলে এমন এমন কথা বলবে যা শুনে বিপরীত পাশের মানুষটির বেচে থাকার ইচ্ছে মরে যায়। আর কেউ যদি ভালো কাজ করে সেটা নিয়েও সমালোচনা করতে বাদ রাখেনা, খুজে খুজে খুঁত বের করবেই। এরই নাম সমাজ! অথচ এই সমাজটা আমরা মানুষরাই তৈরি করেছি। এইযে মানুষে মানুষে এতো ভেদাভেদ সেটাও কিন্তু আমরা মানুষরাই সৃষ্টি করেছি। অথচ এক সৃষ্টিকর্তাই কিন্তু সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, উনার কাছে আমরা সবাই সমান। শুধু আমরা মানুষরাই ভেদাভেদ, হিংসা, অহংকার, বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা, মারামারি, রক্তারক্তি, খুনাখুনি, এসব করি। যা মিলে একটি সমাজ তৈরি হয়, এই সমাজের মধ্যেই আমরা মানুষরাই এসব করে বেড়াই। দিন শেষে দুষ হয় ওই সন্তানদের মা বাবাদের, কিন্তু কেউ ভাবে না এসব কিন্তু সবার আগে সমাজের মানুষরাই সৃষ্টি করেছিলো! এক প্রজন্ম থেকেই আরেক প্রজন্ম শিখে। ভুল মানুষ মাত্রই হয়, কেউ দুধে ধোয়া তুলসি পাতা না, যারা মনে করে সে কখনো ভুল করে না সে কখনো মানুষ হতে পারেনা।

“সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি!”

এই কবিতাটা সবাই আওরিয়েছে, কয়জনই বা মান রেখেছে?

রাহেলা বেগম জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। হয়তো টাকা ততোটা ছিলো না তবে সেখানে দুঃখ ছিলো না, কষ্টরা ছুঁতে পারতো না। সকালে উঠে মা চুলে দুই বেনী করে দিতেন, বেনী দুলিয়ে দুলিয়ে স্কুলের পোশাক পড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতেন। শহরের বড়ো বাবুরা গ্রামে আসতেন বিভিন্ন কাজে, তাদের মধ্যে থেকেই একজনের চোখ পড়েছিলো তার উপর। রাকিব হাওলাদার! শহরের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। স্কুলের পোশাক পরিহিত রাহেলাকে দেখে মনে প্রথম প্রেমের ফুল ফুটে তার। তখন রাহেলার বয়স ছিলো তেরো বছর, ধনী ব্যবসায়ী রাকিবের বয়স তখন ছাব্বিশ ছুঁইছুঁই। রাহেলার থেকে বয়সে প্রায় চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন রাকিব হাওলাদার। কিন্তু প্রেম কি আর বয়স মানে? রাকিব প্রথম রাহেলার বিষয়ে খুঁজ খবর নিলেন, রাহেলার সাথে তার প্রতিদিন দেখা হতো। আস্তে আস্তে ভাব জমাতে থাকেন রাহেলা নামক কিশোরীর সাথে। কিশোরী রাহেলাও রাকিব নামক পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। এভাবে কয়েকমাস চলতে চলতে রাকিব ভাবলেন- আর কতো দিন এভাবে থাকবো?

যেই ভাবা সেই কাজ, চলে গেলেন শহরে। নিজের বাবা মা সবাইকে রাহেলার কথা বললেন। কিন্তু! রাকিবের বড়োলোক বাবা রাজি হলেন না, কোথায় তিনি তার ছেলেকে বড়োলোক পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়ে দিবেন ভেবে রেখেছেন, আর এখানে তার ছেলে গ্রামের মধ্যবিত্ত চাষার মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলছে। মানলেন না রামিম হাওলাদার, বাবার কথার অবাধ্য হয়ে রাকিব গ্রামে চলে আসেন, কিছু বন্ধুদের নিয়ে রাহেলার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এদিকে এতোদিন রাকিবকে না দেখতে পেয়ে ভিতরে ভিতরে চটপট করেছিলেন রাহেলা। রাকিবকে নিজের বাড়িতে দেখে ছুটে এসে সবকিছু ভুলে সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে লজ্জায় আবার ছেড়েও দিয়েছিলেন। রাহেলার বাবার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো, শেষে কোনোকিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যান রাকিবের প্রস্তাবে। রাহেলা কিছু সময় পেরিয়েই হয়ে যান মিসেস রাকিব হাওলাদার!

রাকিব রাহেলাকে নিয়ে শহরে চলে যান, কিন্তু তার পরিবার রাহেলাকে মেনে নেয়নি। রামিম হাওলাদার কিছু একটা ভেবে রাহেলাকে ও রাকিবকে বাড়িতে ঠাই দিয়েছিলেন। সুখের সাগরে বাসা রাকিব ভেবেছিলেন কয়েকদিন গেলে তার বাবাসহ পরিবারের সবাই এমনি এমনি সব মেনে নিবেন। সেভাবেই চলছিলো তাদের দিনকাল। কয়েকমাস পরে গর্ভবতী হলেন রাহেলা, তাতে যেনো খুশির সীমা ছিলো না রাকিবের।

অল্প বয়সী রাহেলা তখন ততোটা বুঝতেন না, রাহেলার যখন পাঁচ মাস তখন রামিম হাওলাদার কি একটা জরুরি কাজে রাকিবকে দেশের বাহিরে পাঠান। রাকিব বাবার কথা ফেলতে না পেরে রাহেলাকে আশ্বাস দিয়ে যান ‘ তিনি খুব শীগ্রই ফিরে আসবেন’ কিন্তু রাকিব আর ফিরে আসলেন না। প্রসব যন্ত্রণায় হসপিটালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে একবার প্রাণ প্রিয় স্বামীর মুখ দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। জন্ম দেন ফুটফুটে দুই জমজ সন্তান। দুই ছেলের জননী হোন তিনি। রামিম হাওলাদার তখনই যেনো নিজের হিংস্রতা প্রকাশের সুযোগ পেলেন, দুই ছেলেকে রেখে রাহেলাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন। অল্প বয়সী রাহেলা তখন হতোভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন শুধু। বয়স অল্প হলেও মা তো! পারেন নি সন্তানকে ত্যাগ করতে, রাতের আঁধারে এক সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে চলে আসেন। কিন্তু তার আরেক সন্তান? তার কথা তিনি জানেন না, কেমন আছে কোথায় আছে কিছু জানেন না। রাকিব হাওলাদার কি ফিরে এসেছিলেন? সেটাও জানেন না তিনি। রাইসুরকে নিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন, মানুষের বাসায় কাজ করে বড় করতে থাকেন রাইসুরকে। পড়াশোনা শিখাতে থাকেন আদরের ছেলেকে, রাইসুরও মা ভক্ত ছিলো। রাইসুরের সুনাম ছিলো সবার মুখে মুখে। কিন্তু মা ভক্ত রাইসুর খারাপ বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করলো। যে রাইসুর মায়ের হাতে ছাড়া ভাত খেতো না, যে রাইসুর মায়ের কোলে মাথা না দিয়ে ঘুমাতো না, সেই রাইসুর নেশাদ্রব্য পান করে রাতের আঁধারে ঘরে ফিরে মাকে গালাগাল করতো টাকার জন্য, যখন টাকার অভাবে নেশাদ্রব্য কিনতে পারতো না তখন বাসায় এসে মাকে মারধর করতো। হতো ভাগি রাহেলা নির্বাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতেন, প্রতিবাদ করতেন না। তিনি শুধু বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন।

রাহেলার জীবনটা সহজ ছিলোনা, যখন রাইসুরকে নিয়ে হাওলাদার বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলেন নির্জন মাঝ রাস্তায় নরপশুদের কবলে পড়তে হয়েছিলো তাকে। সেদিন ভাগ্যের জোরে বেচে গিয়েছিলেন, দুধের শিশু রাইসুরকে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় এসে পরেছিলেন বুঝতেও পারেন নি। রাতের আঁধারেই মানুষের বাসার দরজায় দাড়িয়ে আশ্রয় চেয়েছিলেন, প্রচন্ড ঠান্ডায় রাইসুরের খিঁচুনি শুরু হয়ে গেছিলো। অবশেষে এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় পান, সেই বৃদ্ধা ভিক্ষা করে নিজের দিন চালাতেন। তিনিই রাহেলাকে মানুষের বাড়িতে কাজ খুজে দেন। যে রাইসুরকে এতো কষ্ট করে মানুষ করলেন সেই রাইসুর নেশাদ্রব্য কিনার জন্য টাকা চাইতো, মায়ের কাছে না পেয়ে কতো অত্যাচার করতো।

চোখের পানি মুছলেন রাহেলা বেগম, সবার চোখে পানি। পি.সি নিজের চোখের কোণের পানি সবার আড়ালে মুছে নিলেন। রাহেলা বেগম পি.সির পায়ের কাছে বসে বলতে লাগলেন- মা গো, আমার মানিকরে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দাও, আমি তোমাকে হয়তো তখন অনেক মন্দ কথা বলেছিলাম, তুমি কিছু মনে করোনা মা। আমি সারাজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকমু মা, তবুও আমার রাইসুররে আমার বুকে ফিরাইয়া দাও।

রাহেলা বেগমের দুই হাত ধরে টেনে তুললো পি.সি, চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো- আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যারা এই সমাজের ছেলে মেয়েদের নেশাদ্রব্য দিয়ে নেশাগ্রস্ত করছে, মাদকাসক্ত করছে তাদের খুজে বের করবো। কারো রেহাই নেই, কেউ পার পাবেনা। আমি ‘পূরবি শেখ’ আপনাকে কথা দিলাম!

পূরবি নিজের মুখের মাক্স খুলে দিলো,রাহেলা বেগম চুমু আঁকেন পূরবির কপালে। পূরবি রাহেলা বেগমের দোয়া নিয়ে আবারো মাক্স পরে বেরিয়ে গেলো। সাথে তার টিমের সব অফিসার।

রাহেলা বেগম চোখের পানি মুছলেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে আবারো বসে পড়লেন সিজদায়।

চলবে, ইনশাআল্লাহ,,