সুখের পাখি পর্ব-০৩

0
847

#সুখের_পাখি


গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর। রোদের তীব্রতায় মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ফ্যানের বাতাস থেকেও আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুচ্ছে। ঘরের ভেতর শুয়ে থেকেও শান্তি নেই। তনু বিছানায় শুয়ে আশপাশ করছে। বাবা রে বাবা! শহরে এত গরম! গ্রামে তো এত গরম ছিল না। জানালা খুলে দিলেই ঠান্ডা বাতাস এসে ঘর শীতল করে দিত। বাড়িতে প্রত্যেক দিন দুপুরেই ঘুমিয়েছে তনু। কই তখন যদি এমন গরম লাগত তাহলে কি ঘুমাতে পারত? আজ শরীর জ্বলছে। শুয়ে শুয়ে তনু ভাবছে, জীবন কত বিচিত্র! একদিনে কতকিছু হয়ে গেল! সাত মাস ধরে সহ্য করছিল। কখনও প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না এমন না। সাহস ছিল ঠিকই। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলো যে ভীষণ সেকেলে। মূর্খই বলা চলে। সামান্য বিষয়কে গল্পগুজবের মাধ্যমে বটগাছের রূপ দিত। ছেলে গায়ে হাত না দিলে ওই মেয়ে চেঁচাত কেন? নিশ্চয় গায়ে হাত দিয়েছে। এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে? না, এই ছেলের সাথেই এই মেয়ের বিয়ে হতে হবে।
ভাবতেই তনুর গা জ্বলে গেল।

–‘জন্মের শিক্ষা দিয়ে এসেছি শালাকে। এবার যাস কোনো মেয়ের কাছে। হিজড়ার বাচ্চা। তোর মা’র শাড়ি চুড়ি পরে গ্রামে ঘুরে বেড়াস।’

তনু নিজের ওই কাজে মনে মনে তৃপ্তি পাচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে বলে এখন ওর মোটেও খারাপ লাগছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেল তনু। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। জানালা দিয়ে দেখল অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো। সন্ধ্যার পরে ফুপু আম্মা তনুর কাছে এলো। অনেকক্ষণ বসে ওর সাথে অনেক গল্প করল। তনুর ফুপু আম্মার একটা জিনিস ভালো লাগছে। হঠাৎ ওরা না বলে কেন এসেছে সে বিষয়ে একবারও জানতে চাইছে না।

–‘তুই চা খাস তনু?’

–‘হ্যাঁ।’

–‘আমি চা বসাতে যাচ্ছি। আয় তুই। ইহান আবার ফুলির হাতের চা খায় না। ফুলি সব পারলেও চা-টা একদমই ভালো বানাতে পারে না। বাজে হয়। ও চা করেছে শুনলেই ইহান চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তাই আগুনের কাছে গেলে কষ্ট হলেও চা-টা আমাকেই করতে হয়।’

ফুপু আম্মা চলে গেলে তনু ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ভাবল। ফুপু আম্মা বাচাল টাইপ মহিলা। তবে মনটা ভালো। যে মানুষগুলো বেশি কথা বলে ওদের মনে অত প্যাঁচ থাকে না।
বাবা, তনু, ফুপু আম্মা আর ফুলি মেয়েটা একসাথে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খেল। তনু জানতে পারল ফুপু আম্মার স্বামী দেশে থাকেন না। উনি গত ছয় মাস ধরে ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে আছেন। উনার যাওয়া আসা লেগেই থাকে। দুই মাস এখানে থাকলে তিন মাস ওখানে।
রাতের খাবার টেবিলেও ইহান এলো না। সাবিনা বিরক্তি গলায় ফুলিকে বলল,

–‘তোর ভাইজানকে ডেকে নিয়ে আয়।’

ফুলি খেতে খেতে জবাব দিল,

–‘ভাইজান আইব না আম্মাজান।’

সাবিনার বিরক্তি আরও বাড়ল। কপাল কুঁচকে বলল,

–‘সব কথায় জান, জান লাগাবি না তো ফুলি। আম্মাজান, আব্বাজান, ভাইজান। বিয়ের পর বরকে বরজান ডাকবি নাকি?’

ফুলির গাল লাল হলো। লজ্জা পাওয়া গলায় বলল,

–‘লজ্জার কথা কইবেন না তো আম্মাজান। আমার লজ্জা করে।’

তনুর মজাই লাগছিল। ফুলি মেয়েটার সাথে এখন পর্যন্ত তার কথা না হলেও তনু বুঝতে পারছে, ফুপু আম্মা এই ফুলির জন্যই এখনও মনের দিক থেকে সুস্থ আছেন। নইলে স্বামী খুব কম সময়ই দেশে থাকেন। এক ছেলের দেখা পাওয়ার দুষ্কর। বাড়িতে মানুষই বাঁচে ফুলি আর ফুপু আম্মা। এই বাচাল মেয়েই বাড়িটাকে ভূত বাড়ি হতে দেয়নি।

–‘ইহানটা আবার কী নতুন ঢঙ শুরু করেছে হ্যাঁ! প্রতি বেলা তাকে ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতে হবে! কেন টেবিলে এসে খেয়ে গেলে লজ্জা লাগে নাকি তার।’

–‘আপনে চিল্লাচিল্লি কইরেন না তো আম্মাজান। আমার খাওয়া শেষ হইলে আমি ভাইজানের খাওয়োন ঘরে দিয়া আসমু।’

–‘তোর এই অতি ভালোবাসার কারণেই আমার ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে। ওর কথার আগে সব কাজ করে দিবি না একদম।’

–‘ভাইজান রাইতে খাইতে চাইছিল না। আমি অনেক জোর করায় রাজি হইল। আপনে আর গানাবাজানা কইরা ভাইজানের মুড বিগড়াইয়া দিয়েন না।’

–‘বাবাহ! আমি তোর ভাইজানের মুড বিগড়ে দেই?’

–‘তা নয়তো কী? অত চিল্লায় কেউ?’

–‘ছেলেটা আমার পেট থেকে হয়েছে নাকি তোর? আজব কথাবার্তা! মা’র থেকে ফুলির দরদ বেশি দেখছি।’

ফুলি মুখ মুচড়ে উত্তর না দিয়ে খেতে লাগল। তনু খানিকটা অবাকই হলো। বাড়ির কাজের লোকের সাথে যে বাড়ির মালিকের এরকম সম্পর্ক হতে পারে তা তনুর ভাবনার বাইরে ছিল। এবাড়িতে ফুলির ভালোই রাজত্ব চলে দেখা যাচ্ছে।

–‘বাবা, আমরা কি এখানেই থাকব?’

তনুর প্রশ্নে জামাল সাহেব মৃদু হেসে তনুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলেন,

–‘কয়টা দিন তো থাকতেই হবে রে মা। কেন তোর কি এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে?’

তনু অতিদ্রুত মাথা নাড়ে। বাবার বাঁ হাত নিজের হাতে নেয়।

–‘আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না বাবা। ফুপু আম্মা ভীষণ ভালো মানুষ।’

–‘হ্যাঁ। সেই ভরসাতেই ওর কাছে এসেছি। ও না থাকলে কার কাছে যেতাম বল তো।’

–‘আমার জন্য এতসব সমস্যা দেখা দিল, তাই না বাবা?’

–‘দূর পাগল মেয়ে। তুই তো আমার সাহসী মেয়ে। তুই যা করেছিস একদম ঠিক কাজ করেছিস। অন্যায়ের প্রতিবাদ সবার করা উচিত।’

–‘কয়টা দিন নাহয় এখানে থাকব। তারপর আমরা কোথায় যাব বাবা?’

–‘দেখি। ব্যবস্থা একটা তো করতেই হবে।’

নতুন জায়গা বলেই হয়তো রাতে তনুর ঘুম হলো না। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকল। আজ আবার দিনে ঘুমিয়েছিল। সন্ধ্যায় চা খেয়েছে। এখন সারারাতই জাগতে হবে তাকে। নিজের ঘর ছাড়া তনুর সহজে ঘুম আসে না। রাত মনে হয় একটা কি দুইটা। তনু তখনও জেগে। তার চোখে আজ ঘুম ধরা দিচ্ছে না। হঠাৎ তনু কারো মিষ্টি একটা গলা শুনতে পেল। এই রাতের বেলায় গান গাইছে কে? সাথে গিটারের মুগ্ধ করা সুর। তনু উঠে বসে কান পেতে শুনতে থাকল। মাথার উপর থেকে আওয়াজ আসছে মনে হচ্ছে। কে গান গাইছে? কার গলা এতটা সুন্দর! একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চোখ বুজে তনু অচেনা মানুষটার গলায় গান শুনছে। শুনতে ভালোই লাগছে তার। গান শুনতে শুনতেই মনে হয় একসময় সে ঘুমিয়ে গেল। তনুর জানা হলো না মানুষটা কে ছিল। কে অত রাতে বাকি সবার ঘুম নষ্ট করছিল। না, নষ্ট করছিল বললে ঠিক হবে না। তার ঘুম এসেছে মানুষটার গান শুনে।

তনু ঘর থেকে বেরিয়েই কালকের সেই থ্রী কোয়ার্টার ছেলেটার সামনে পড়ে গেল। এই ছেলে এখনও খালি গায়েই আছে। তনু চলতি পথে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে চোখও বন্ধ করে নিল। মনে মনে বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে তনু। ছেলেটার জামাকাপড় নেই নাকি? সারা দিন রাত এরকম খালি গায়েই থাকে নাকি? মানুষকে বডি দেখায়! গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়! লজ্জাহীন ছেলে, বাড়িতে নতুন দু’জন মানুষ এসেছে। অচেনা মানুষদের সামনে এভাবে আসতে লজ্জা করে না! বাবা নাহয় ছেলে। সে তো একজন মেয়ে। তাকে তো অন্তত ছেলেটার লজ্জা পাওয়া উচিত। বেশ অনেকক্ষণ ধরে তনু চোখ বন্ধ করে আছে। ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে? নাকি চলে গেছে। পিটপিট করে একচোখ খুলে তনু৷ না এক চোখে ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। আরেক চোখও খুলে তনু। দু’টো চোখেই থ্রি কোয়ার্টারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে চলে গেছে।

–‘ফুপু আম্মা, আপনাদের বাড়িতে রাতে গান করছিল কে?’

–‘রাতে গান! অহ, বুঝেছি। কে আবার মা? আমার পাগল ছেলে, ইহান। সারাদিন ওই টুংটাং যন্ত্রটা নিয়ে পড়ে থাকে। রাতের পর রাত জেগে গান লিখে। নিজে গায়।’

–‘ওহ।’

–‘আর বলিস না মা। এই ছেলে পুরো পাগল। মাঝ পথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে ছেলে বলে তার দ্বারা নাকি ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সম্ভব না। সে গায়ক হবে। সেই থেকে শুরু হয়েছে ওর জ্বালা। গলা মাশাআল্লাহ ভালোই। তাই বলে পড়াশোনা ছেড়ে আদাজল খেয়ে গানের পেছনে পড়তে হবে? এই নিয়ে ওর বাবাও অনেক রাগারাগি করেছে। শেষ পর্যন্ত কোনোভাবেই ছেলেকে বুঝাতে না পেরে রাগ করে ছেলের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে কয়জন গান খেয়ে নামডাক কামাতে পারে? গায়কদের ভাত আছে দেশে? তার থেকে পড়াশোনাটাও অন্তত চালিয়ে যেত।’

তনু ভারী অবাক হলো। সত্যিই এই ছেলে পাগল। নইলে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে গায়ক হতে চায়!

–‘ইহান পড়াশোনায় ভালোই ছিল। এখনো আবার ধরলে পাস করে যাবে। গান ধরল তো মোটে পাঁচ মাসও হবে না। কত বুঝাচ্ছি ওকে। ওর এক কথা। সবাই যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে মা তাহলে বাকি পেশা গুলোয় মানুষের অভাব পড়বে না!’

তনু মাত্র দশম ক্লাসে পড়লেও সে একটা কথা খুব ভালো করে জানে যে, পড়াশোনা ছাড়া ভবিষ্যত অন্ধকার। জীবনে কিছু করতে হলে পড়াশোনা করতেই হবে। তনুকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবার জন্য, নিজের জন্য কিছু করতে হবে তাকে। তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ভীষণ জরুরি।

এবাড়িতে আসার পর থেকে তিনটা দিন কেটে গেল। অথচ ইহানের সাথে এখনও তনুর সামনাসামনি কথা হয়নি। হ্যাঁ দেখা হয়েছে ঠিকই। প্রতিবারই অপ্রস্তুত ভাবে। ছেলেটার মনে হয় জামাকাপড়ের ভীষণ অভাব। তাই সারাক্ষণ খালি গায়ে থাকে। অমন খালি গায়ের ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়!
ইহান নিচে আসে। মা’কে, ফুলিকে খুঁজে। কাউকেই পায় না। বাড়িতে নেই নাকি? কোথায় গেল সব একসাথে?
তনু ইহানকে দেখে পেছন থেকেই কেটে পড়ছিল। ইহান তার নাম ধরে ডেকে উঠলে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল। থ্রী কোয়ার্টার ওর নাম জানে!

–‘তনু, মা কোথায়?’

সাথে সাথে কোন কথা বলতে পারল না তনু। থ্রী কোয়ার্টার এতটা স্বাভাবিক ভাবে ওকে ডেকেছে যেন রোজ আলাপ হয়। ইহান ভাবল তনু হয়তো তার কথা শুনেনি। সে আবার বলল,

–‘মা কোথায় তনু, জানো?’

–‘ফুপু আম্মা ফুলি আপার সাথে বাজারে গেছে।’

–‘অহ।’

ইহান আর কথা বাড়ায় না। চিন্তিত মুখে ব্যস্ত পায়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তনু ফোঁস করে দম ফেলে।

–‘থ্রী কোয়ার্টার ভাই আমার নাম জানে। আমাকে চেনেও। তবুও এতদিন কথা বলেনি। অহংকার! কী অহংকারী ছেলে রে বাবা! এর সাথে কোনোদিন যদি আমার কথাবার্তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়, তাহলে একে জিজ্ঞেস করব, কী রে ভাই পরার কাপড় নেই তোর? এই মাশাআল্লাহ বডি দেখিয়ে বেড়ানোর মানে কী হ্যাঁ?’

তনু একা একাই হাসে। তার যত পাগলামি। তনু ভাবে, তার থেকেও পাগল তাহলে পৃথিবীতে আরও একজন আছে। ফুপু আম্মার ছেলে। ওই থ্রী কোয়ার্টার তো তার থেকেও পাগল। রাত একটার পরই তার পাগলামি শুরু হয়। গান গাওয়ার পাগলামি। তনুর অবশ্য ভালোই লাগে। পাগলের গান শুনতে শুনতে ঘুম এসে যায়।

চলবে🌸

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা